কালিমাটি অনলাইন

দ্বাদশ বর্ষ / চতুর্থ সংখ্যা / ১২৪

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

দ্বাদশ বর্ষ / চতুর্থ সংখ্যা / ১২৪

সোমবার, ১৪ অক্টোবর, ২০২৪

সুকান্ত পাল

 

সমকালীন ছোটগল্প




কলমীশাক


 (১) 

সামনে ভাতের থালায় বেশ পরিপাটি করেই স্ত্রী অদিতি সাজিয়ে দিয়েছে  শোভনের প্রিয় রসুন ফোড়ন দিয়ে কলমীশাক, মুগ ডালের বাটি, রুই মাছের ঝোল যার উপর মাছের মাথাটা উঁচু হয়ে উঠে রয়েছে বাটির প্রাচীর ডিঙিয়ে এবং টমেটোর গাঢ় লালচে চাটনি। খাবার টেবিলে বসে কলমীশাকের দিকে তাকিয়েই শোভন কেমন যেন আনমনা হয়ে যায়।

সকালে ঘুম থেকে উঠে হাঁটতে যাওয়ার অভ্যাস শোভনের অনেকদিনের। হাঁটতে যাওয়ার সময় সে সবসময় একটা কাপড়ের ব্যাগ ভাঁজ করে তার পাঞ্জাবির পকেটে নিয়ে বেরোয়। ফেরার পথে টুকিটাকি সবজি বা মাছ কিনে একেবারে ফিরে আসে। আজ রবিবার অফিস যাওয়ার তাড়া ছিল না। তাই জাতীয় সড়কে হাঁটতে গিয়েছিল। বেশ কিছু দূর গিয়ে সে যখন ফিরে আসছে তখন জাতীয় সড়কের ধার বরাবর ধামার বিল যা বহুদূর বিস্তৃত তার পাশে আসতেই দেখে বেশ কয়েকজন ভদ্রলোক যারা তার মতোই প্রাতঃভ্রমণে রোজ বেরিয়ে পড়েন তাদের একটি জটলা। এদের মধ্যে অনেকেই চাকরির জীবন থেকে  অবসর নিয়েছেন, কেউ বা অবসরের প্রায় দোরগোড়ায়।

ঐ জটলার মধ্য থেকে একটি ছোট মেয়ের শান্ত গলা শোনা যাচ্ছিল। শোভন কৌতুহলী হয়ে এগিয়ে গিয়ে দেখে একটি খুব জোর আট থেকে দশ বছরের কালো অথচ ভীষণ সুশ্রী, একহারা চেহারার ডাগর ডাগর দুটি চোখের ভাসানো দৃষ্টি মেলে একটি মেয়ে একগাদা কলমীশাকের আঁটি মাটিতে একটা কলাপাতার উপর রেখে বিক্রি করছে।

শোভন ভালো করে লক্ষ্য করল মেয়েটি তার নিজের মেয়ে তিতলির বয়সীই হবে। এখন শরৎ কালের মাঝামাঝি। তাদের এই গ্রামের দিকে এখন সকালে ঘাসের উপর যেমন শিশিরের আস্তরণ পড়ে তেমনি বেশ শিরশিরে একটা ঠান্ডাও আছে। এই সময় ভোরের দিকে একটা পাতলা চাদর হলে ভালো হয়।

তিতলি এবং অদিতি এখন হয়তো সেরকমই একটা চাদর জড়িয়ে মা মেয়েতে ঘুমে বিভোর হয়ে আছে। এখনো সূর্য ওঠেনি। কিন্তু উঠতেও বেশি দেরি নেই। অথচ এই ভোররাতে এইটুকু মেয়েটি ঐ বিলের জলে নেমে জলের উপর লতিয়ে ছড়িয়ে থাকা নধর শরীরের লাল লতার কলমীশাক তুলে বিক্রি করছে দুটো পয়সার জন্য! এতেই বোঝা যায় ঐ মেয়েটির বাবা মায়ের সংসারে কি নিদারুণ দারিদ্র্য লেপ্টে আছে।

শোভন আরো কাছে যেতেই দেখল মেয়েটি হাঁটুর উপর পর্যন্ত ঝ্যালঝেলে জামাটা ভিজে লেপটে রয়েছে ওর শরীরে। একটু বোধহয় শীতে কাঁপছে ওর কচি হাতগুলো। চুলও ভেজা। ওর চোখের দিকে তাকালে মনে হয় শিশিরে ভেজা দুটি চোখে এক গভীর তৃপ্তিবোধ ছড়িয়ে আছে। এই তৃপ্তিবোধ কিসের জন্য? সংসারের দারিদ্র্য মোচনের জন্য? নাকি খদ্দেরদের তাদের পছন্দের শাক হাতে তুলে দিতে পারার আনন্দ থেকে এই তৃপ্তিবোধের জন্ম?

হঠাৎই শোভনের কানের কাছে কর্কশ কন্ঠে একজন ভদ্রলোক বললেন,

--- এই মেয়ে ঠিক করে বল কত করে আঁটি নিবি?

এই প্রশ্নের জবাবে খুব শান্ত ও মিহি গলায় মেয়েটি বলল,

-- বললাম তো বাবু পাঁচটাকা আঁটি।

-- সে তো শুনেছি। এখন বল্ কত করে নিবি? তুই তো আর কিনে আনিসনি। বিনে পয়সায় ঐ জলা থেকে ইচ্ছামতো আপন-জালা শাকগুলো কেটে এনেছিস। এক পয়সা খরচ না করে বেশ তো কামাচ্ছিস!

এই কথা বলতে বলতে ভদ্রলোক কলমীশাকের আঁটি বাছতে বাছতে তিনটি আঁটি হাতে নিয়ে বললেন,

-- এই তিন আঁটি নিচ্ছি দশ টাকা দেব বলে দিলাম কিন্তু।

মেয়েটি এই কথার প্রত্যুত্তরে কিছুই বলতে পারে না শুধু হাঁ করে অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে ভদ্রলোকের  দিকে এবং যন্ত্রের মতো হাত বাড়িয়ে ভদ্রলোকের দেওয়া দশটাকার একটা কয়েন নিয়েও নিল।

শোভন ব্যাপারটা লক্ষ্য করল এবং এও লক্ষ্য করল যে অন্যান্যরা এবার প্রস্তুতি নিচ্ছে ঐ দশটাকা দরে তিনটে করে আঁটি বাচ্চা মেয়েটির সরলতার সুযোগ নিয়ে লুটপাট করার।

হঠাৎই শোভনের চোখ পড়ল মেয়েটির ডান পায়ের হাঁটুর উপর। সে চিৎকার করে উঠে বলল,

--- এই তোর হাঁটুতে রক্ত কেন?

শোভনের চিৎকারে ভদ্রলোকদের লুটপাটের প্রস্তুতি ধাক্কা খেল। শোভনের কথায় মেয়েটি খুব শান্ত গলায় বলল,

--- ও কিছু না বাবু, বিলের জলে আর কচুরিপানায় জোঁক আছে, সেই ধরেছে। আরো  তিনটে ছিল পড়ে গেছে। এটারও রক্ত খাওয়া শেষ হলে পটাশ করে নিজেই পড়ে যাবে।

মেয়েটির এমন নির্লিপ্ত উত্তরে শোভন কিছুক্ষণের জন্য থম মেরে রইল, তারপর বলল,

-- হ্যাঁ, তোকে যে বড়ো বড়ো জোঁকেরা ছেঁকে ধরেছে তা তো দেখতেই পাচ্ছি। এখন বিক্রি বন্ধ কর। একটু দাঁড়া,  আমি তোর ঐ জোঁকের বারোটা বাজাচ্ছি।

বলেই শোভন রাস্তার পাশেই ভেরেন্ডা গাছ থেকে একটা পাতা ছিঁড়ে সেই পাতাটা ভাঁজ করে ধরে মেয়েটির হাঁটুর উপরে কামড়ে বসে থাকা জোঁকটাকে এক ঝটকায় তুলে ছুঁড়ে ফেলে দিল। তারপর তার পকেট থেকে রুমাল বের করে যখন উপর থেকে নিচের দিকে নেমে আসা রক্তের ধারা মুছিয়ে দিতে যাবে তখন মেয়েটি একটু ভয় পেল না লজ্জা, নাকি সংকোচে সরে দাঁড়ালো বোঝা গেল না। শোভনও ছাড়ার পাত্র নয়। সে মেয়েটির ঘাড় ধরে দাঁড় করিয়ে রক্তটা মুছে দিয়ে বলল,

-- তোর এখানে যতগুলো শাকের আঁটি আছে আমিই নেব। শোভনের আচরণ ও কথা শুনে মেয়েটির দুই চোখের কোণায় নোনা জলের উপর প্রথম সূর্যের কিরণ পড়ে চিকচিক করে উঠেছিল কিনা তা আর মনে নেই।

শোভনের কীর্তি কলাপে উপস্থিত ভদ্রলোকেরা কিঞ্চিত ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গিয়েছিল। শোভন গুনে গুনে দেখল মোট কুড়ি আঁটি শাক আছে। পকেট থেকে তার কাপড়ের ব্যাগ, গ্রাম বাংলায় যাকে বলা হয় ঝোলা, সেই ঝোলার ভিতর সব শাকের আঁটি ভরে নিল। গুনে গুনে ঠিক একশো টাকা মেয়েটির হাতে গুঁজে দিয়ে বলল,

-- যা, এবার তাড়াতাড়ি বাড়ি যা। বাড়ি গিয়ে যেখানে যেখানে জোঁক কামড়েছে সেখানে সেখানে কলগেটের পেস্ট লাগিয়ে দিবি, দেখবি সব ঠিক হয়ে যাবে।

শোভনের কথায় মেয়েটি কেমন করে যেন শব্দহীন হাসি হাসল। সেই হাসিতে যেন এই পৃথিবীর যাবৎ খেটে খাওয়া প্রান্তিক মানুষের শ্লেষ ছিটকে পড়ে। এই ধরনের হাসিকে ভীষণ ভয় পায় শোভন। এমন

হাসির সামনে দাঁড়ালে যেন মনে হয় একটা বড়ো আয়নার সামনে সম্পূর্ণ উলঙ্গ হয়ে সে দাঁড়িয়ে আছে। সেই আয়নার প্রতিবিম্বের মধ্যে কে যেন বেরিয়ে এসে তাকে বারবার মুখ ভেংচিয়ে যায়। যা খুবই অসহ্য অথচ তাকে এড়ানো যায় না।


(২)

-- কী হলো বাবা, তুমি কী ভাবছ? ভাত খাচ্ছ না কেন?

খাবার টেবিলে ঠিক তার উল্টো দিকের চেয়ারে খেতে বসেছে তার মেয়ে তিতলি। ভাতে হাত না দিয়ে এইভাবে চুপচাপ বসে থাকা এবং শোভনের দৃষ্টিতে এক ধরনের উদাসীনতা দেখে তিতলি প্রশ্ন করল।  পাশের ঘরেই নিজের খাবারটা থালায় বেড়ে নিয়ে খাবার টেবিলে আসতে আসতে অদিতি তিতলির কথাগুলো শুনতে পেয়ে তার বুক কেঁপে উঠল। এতোগুলো শাকের আঁটি কিনে আনার জন্য সে সকালে শোভনকে অনেক কথা শুনিয়েছিল।

-- তোমার কি মাথা খারাপ হয়ে গেছে? এতো শাক দিয়ে কী হবে শুনি? তুমি কি আমাদের তৃণভোজী গোরু ভেবে নিয়েছ?

অদিতির কথা শুনে শোভন হতচকিত হয়ে যায়। কোনো কথার উত্তর না দিয়ে সে এক শূন্য দৃষ্টিতে অদিতির দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে। তার ঐরকম ভ্যাবাচ্যাকা খাওয়া মুখের অবস্থা দেখে অদিতির আক্রমণ করার ইচ্ছাটা যেন আরো বেড়ে যায়। সে বলে,

-- তোমার যদি টাকা বেশি হয়ে থাকে তবে তা শাকপাতা দিয়ে চাল দেখাচ্ছ কেন, দু’কিলো খাসির মাংস কিনে আনলে না হয় এইসব বড়োলোকি চাল মেনে নিতাম।

অদিতির এই কথারও কোনো উত্তর শোভন দিতে তো পারলই না উল্টে সে ভাবতে লাগলো এ কোন অদিতি!

বেশ কিছুক্ষণ থম মেরে থেকে শোভন বেশ শান্ত ও গভীর স্বরে বলল,

-- না, আমি বড়োলোক নই আর আমার কোনো বড়োলোকি চালও নেই। আর ঐরকমভাবে আমি ভাবতেও পারি না। ঐরকমভাবে ভাবাটা আমার কাছে অশ্লীলতা ছাড়া আর কিছুই নয়। তবে...

-- তবে কী?

কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে শোভন বলল,

-- এতোদিন পর একটা বিষয় আবিষ্কার করলাম।

-- কী?

-- বুঝলাম এতোদিনেও তুমি আমার চিন্তা ভাবনাকে স্পর্শ করতে পারোনি। একটি বাচ্চা মেয়ের অর্জিত শ্রম লুট হয়ে যাচ্ছিল। সেই লুটপাট থেকে মেয়েটাকে রক্ষা করার জন্য আমার সীমিত সাধ্যের মধ্যে যতটুকু পেরেছি তা করেছি। কত টাকাই তো আমরা প্রয়োজন ছাড়াও খরচ করি! এটাও সেরকমই একটা ধরে নাও। যদি দু এক আঁটি রাখতে চাও তো রেখে দিয়ে বাদবাকি আমাদের কাজের মাসি পুঁটির মা’কে দিয়ে দিও। ওর বাড়িতে অনেকগুলো পরিবার আছে, সবাই ভাগ করে নিলে কোনো অসুবিধা হবে না।

শোভনের কথা শুনে অদিতি বুঝতে পারে নিশ্চয়ই কোনো কারণ আছে। তার হঠাৎ করে এইভাবে শোভনকে আক্রমণ করাটা ঠিক হয়নি। পরে সে সব কথাই শোভনের কাছ থেকে শুনেছিল। শুনে মনে মনে ভীষণ ভাবে লজ্জিত হয়েছিল অদিতি। তাই খাবার টেবিলে আসতে আসতে তিতলির কথা শুনে তার বুকটা কেঁপে উঠেছিল। খাবার টেবিলের কাছে এসে সে দেখল শোভন এক শূন্য দৃষ্টিতে তার খাবার থালার দিকে তাকিয়ে আছে। সেই দৃষ্টিতে কিসের ছায়া খেলে যাচ্ছে তা অদিতি বুঝতে পারে না।

শোভনের খালি মনে হচ্ছে ঐ রান্না করা কলমীশাকের মধ্যে হাজার লক্ষ জোঁকেরা পেঁচিয়ে রয়েছে। রুই মাছের মুড়োর মরা নিস্পৃহ চোখ দুটোর মধ্যে সে যেন সেই মেয়েটির নিস্পৃহ অথচ নিঃসহায় দৃষ্টিকেই দেখতে পাচ্ছে। টমেটোর গাঢ় লাল রঙের চাটনির সাথে সেই মেয়েটির হাঁটুর উপর থেকে গড়িয়ে পড়া জোঁকের কামড়ে ক্ষত থেকে রক্তই যেন তার সামনে সাজিয়ে দেওয়া হয়েছে।

ভীষণ বমি পাচ্ছে শোভনের। পেটে তীব্র এক মোচড় অনুভব করল সে। বুক গলা বেয়ে বমি উঠে আসছে। 'ওয়াক' আওয়াজ করে সে বেসিনের দিকে উঠে যায়।

 

 

 


1 কমেন্টস্:

  1. খালি হৃদয় স্পর্শ করল গল্পটা, এইটুকু বলে ছেড়ে দিলে কিছুই বলা হয় না। গল্পটা হৃদয় থেকেও বেশি আপীল করে মগজকে – আমাদের মধ্যবিত্ত কিংবা উচ্চ-মধ্যবিত্তের মগজকে। গল্পের মধ্যে জবরদস্তি কোন চমক তৈরি করার প্রবণতা নেই, অথচ খুব খুউব নিষ্ঠুর অথচ সাদামাটা সত্যিটা আছে। আছে এমন ঘটনা যা আমরা প্রতিদিনই কোন না কোন ভাবে দেখতে পাই। দেখতে পাই, অথচ মুখ ফিরিয়ে নিই। মুখ ফিরিয়ে নিই আর এই ভেবে নিজেদের সান্তনা দি যে আমাদের করার কিছুই নেই, আমাদের সামর্থ্য সীমিত। সত্যি কথা বলতে কি বাস্তবকে মেনে নেবার সাহস আমাদের নেই। লেখক সুকান্ত পালকে ধন্যবাদ। তিনি সমাজের একটা নোংরা অথচ স্পষ্ট-দৃশ্যমান দিককে তুলে ধরেছেন, যে দিকে লক্ষ লক্ষ জোঁক অক্ষমের রক্তপান করতে ছাড়ছে না।

    নমস্কারান্তে,
    অমিতাভ চৌধুরী

    উত্তরমুছুন