কালিমাটি অনলাইন

দ্বাদশ বর্ষ / চতুর্থ সংখ্যা / ১২৪

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

দ্বাদশ বর্ষ / চতুর্থ সংখ্যা / ১২৪

সোমবার, ১৪ অক্টোবর, ২০২৪

তপজা মিত্র

 

‘টেক্কা’, ‘বহুরূপী’, ‘শাস্ত্রী’র ত্র্যহস্পর্শ  কি বাঁচাতে পারবে বাংলা ছবিকে?


 Welfare economicsএর জন্ম হয়েছিল বস্তুনিষ্ঠ রাষ্টব্যবস্থার ত্রূটি মেরামত করার জন্য। welfare cinema সেই ভিত্তিভূমির সন্তান। নব্য সিনেমার আন্দোলন যেখানে ভিত্তোরিয়ো দি সিকার ‘বাইসাইকেল থিভসে’র উড়ান নিশ্চিত করেছিল, যেখানে সিনেমা নিজস্ব ঘেরাটোপ থেকে, ঘূর্ণায়মান আবর্ত থেকে বের হওয়ার প্রাণপণ চেষ্টা করে সেখানে ভাষা সম্পূর্ণ স্বকীয়তা অর্জন করে। সেই আপন বাংলাভাষায় বাস্তবতার প্রক্ষিতে জন্ম নেয় রুচিকর মুহূর্ত। সিনেমা হয়ে ওঠে রুচিশিল্প। এখনকার ক্রমবর্ধমান বাস্তবতার ক্যানভাসে অনেক ছবির ভিড়। এমন ভিড় আগেও ছিল, এখনও আছে। এই ভিড়ের মধ্যে প্রকূত সিনেমার মেরুদণ্ড কোনটি, সেটা দেখার দরকার।

‘টেক্কা’য় মাছের বাজারে দরদাম করা পুলিশ, রিয়েল এস্টেট কোম্পানির অমানবিক ম্যানেজার, ইগোসর্বস্ব দুর্নীতিবাজ রাজনীতির কারবারী - কে নেই! কিন্ত মোটা দাগের। একটি জনবহুল রাস্তা। অপহরণকারী বাচ্চা এক মেয়েকে নিয়ে ছুটছে, পিছনে জনতা। কোনও পুলিশ নেই। এই দৃশ্য আমাদের সমাজের চরম বাস্তব। এমন ঘটনা যখন ঘটে তখন সবসময় কি নগরপালদের দেখতে পাওয়া যায়? সিনেমার সারবত্তা সমাজের বহুধাবিস্তৃত চিত্রায়নের বাইরে নয়। কিন্ত টেক্কার মেজাজ কিছু অগভীর সংলাপের দৃশ্যায়ন। যদিও গান সময়োপযোগী। অভিনয়ে স্বাভাবিকতার মাত্রাকে স্পর্শ করেছেন আরিয়ান, সৃজা, সুজন, লোকনাথ, স্বস্তিকা। সৃজিত মুখোপাধ্যায়ের ছবিতে চমক থাকে। কিন্ত ক্যামেরার নিজস্ব নির্মাণ শৈলী থাকে না। বিশ্ব সিনেমার মানচিত্রে এমন ধরনের ছবির স্থান কোথায়! রুক্মিণী মৈত্রের অভিনয়, তাঁর পর্দাচিত 'আবির্ভাব' অবশ্যই নজরকাড়া, কিন্ত ধ্রুপদী কি? কৌশিক সেন, কমলেশ্বর, পরাণ স্তর বিন্যাসে এসেছেন আবার চলে গিয়েছেন। দাগ কাটলেন কি? পুজোর মরসুমে থ্রিলার বানানোর প্রচেষ্টায় একমাত্র উল্লেখযোগ্য ফসল দেব।  অসম্ভব পরিণত। উদাত্ত। পরিমিত। সবাইকে ছাপিয়ে তাসের দেশে তিনি ‘টেক্কা’ দিয়েছেন। আসলে সৃজিত নিজস্ব একটা ঘরানা তৈরি করেছেন। সেই ঘরানার আধিপত্যে পূর্বসুরীদের প্রভাব খুব একটা নেই। জলসাঘরের মায়াময় আলো আছে। শাস্ত্রীয় সংগীতের আভিজাত্য নেই।



২০১৭ সালের ওয়েব সিরিজ মানি হেইস্ট-এর বঙ্গীয় সংস্করণের প্রচেষ্টায় নন্দিতা-শিবপ্রসাদ সফল জুটি পরিচালক। নব্বই দশক। একের পর এক চটকল বন্ধ। ইউনিয়নের দাপট আর ক্রমবর্ধমান শ্রমিক অসন্তোষ জন্ম দিল ঘটনাচক্রে চটকল কর্মী থেকে ব্যাঙ্ক ডাকাতে পরিণত হওয়া বিক্রম প্রামাণিকের। মিথ্যা খুনের মামলায় ফেঁসে যায় সে। বাড়ির লোকও মিথ্যা সাক্ষ্য দেয়। জেলে তাকে বেধড়ক মার মারে পুলিশ অফিসার সুমন্ত ঘোষাল। জেদ চাপে, শোধ তুলতে হবে। এই ছবির মাধ্যমে বহুরূপীর মতো ধুঁকতে থাকা এক শিল্পের পুনর্জাগরণের ইংগিত দেওয়া হয়েছে। লোকশিল্পের মুখোশের আড়ালে যান্ত্রিক সভ্যতার কষ্ট ধরা পড়েছে। কৌশানী, শিবপ্রসাদ, আবীর, ঋতাভরী চার স্তম্ভের বুনিয়াদ neo realismএর টানটান চিত্রনাট্যে সংযত ও ঋদ্ধ।



‘শাস্ত্রী’ ছবির মেরুদণ্ডে মিঠুন চক্রবর্তীর মাপা অভিনয়ের সঙ্গে সোহমের মতো নব্য যুবকের উদাত্ত উচ্চারণ মিশে যায়। বিজ্ঞান ও জ্যোতিষের যুযুধান দ্বন্দ্বে যুক্তিবাদ জিতে যায়। আসলে ভণ্ডামি কোনভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। তা সে বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে হোক বা জ্যোতিষের ক্ষেত্রে। ভুলে গেলে চলবে না যে আমরা আলো ধরতে ভালবাসি।

পরশুরামের বিরিঞ্চিবাবা অবলম্বনে সত্যজিৎ রায় মহাপুরুষ ছবিটি নির্মাণ করেন। পথিকৃৎ বসু সত্যজিৎ রায় নন। তাঁর কাছ থেকে মহাপুরুষের আলোকিত উচ্চারণ আশা করা অন্যায়। তিনি সেটা পারবেন না। কিন্ত যেটা পারতেন সেটা করলেন কী? Dissolve বলে film এর একটি ভাষা আছে। আছে pan shot, tilt up, tilt down, long shot, mid long. সেগুলোর মাননীয় অনুশাসন তো প্রয়োগ করা যেত । তা না করে দারুণ বিষয় থাকা সত্ত্বেও কোনও টানটান চিত্রনাট্য কেন তৈরি হল না সেটা পরিচালক হয়ত বলতে পারবেন। অথচ মিঠুন ছিলেন। দাদাসাহেব ফালকে পাওয়া গৌরাঙ্গর পরিমল সান্যাল থেকে পরিমল শাস্ত্রীর কাল পরিক্রমায় তাঁর অভিনয় তো সম্পদতুল্য। সেই গুপ্তধনে হাত না দিয়ে পথিকৃৎ বাণিজ্য করতে চাইলেন, কিন্ত সেটাও হল না। সোহম astrophysicist কিন্ত নেশা ভণ্ড জ্যোতিষীদের মুখোশ খোলা। বিরিঞ্চিবাবায় ধোঁয়ার আড়ালে ছিল সত্যের নির্যাস এখানে সংলাপের পিঠে সংলাপ বসিয়ে নিজস্ব অবস্থান স্পষ্ট করতে চেয়েছেন পরিচালক। মিঠুন ও দেবশ্রী জাতীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত দুই অভিনেতার যুগলবন্দিতে জমাটি তবলা লহড়া শোনা গেল না। কত অলংকরণ, বাক্যবিন্যাস, শব্দ তীর যে সঞ্চিত যোদ্ধার তূণে, সময়ে ব্যবহৃত হল না। অন্ধবিশ্বাস ও কুসংস্কারের ঘেরাটোপে ছবি হারাল কক্ষপথ। তবুও এই সময়ের আবর্তে, ভাসমান জটিল প্রবাহে সিনেমা নামক বৃহত্তম শাস্ত্রে এটি শিরদাঁড়া স্বরূপ কারণ বর্তমান সময়ের সমস্যার কথা সরবে প্রকাশ করেছে, ভয় পায়নি।




1 কমেন্টস্:

  1. 'টেক্কা' ছবির পোস্টার বর্তমানে যে ছবিটি চলছে এবং যেটি নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে, সেই 'টেক্কা'-র পোস্টার নয়, ওই নামে হওয়া অন্য কোন ছবির।

    উত্তরমুছুন