কালিমাটি অনলাইন

দ্বাদশ বর্ষ / চতুর্থ সংখ্যা / ১২৪

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

দ্বাদশ বর্ষ / চতুর্থ সংখ্যা / ১২৪

সোমবার, ১৪ অক্টোবর, ২০২৪

দীপক সেনগুপ্ত

 

সমকালীন ছোটগল্প




কুইলা কাকুর কাকেরা

একদিন কুইলাকাকু আমাকে হাতছানি দিয়ে ডেকে বলেছিলেন।

- এই আনন্দ এদিকে আয়।

আমার নাম আনন্দ নয়, কিন্তু কুইলাকাকু আমাকে আমার আসল নাম ধরে কখনো ডাকেন না। এক একদিন এক এক নামে ডাকেন। এজন্য অবশ্যি ওনাকে দোষ দেওয়া যায় না। আমরাও তো ওনাকে ওনার আসল নাম ধরে কখনো ডাকি না। ওনার নাম আশুতোষ অথচ আমরা ডাকি কুইলাকাকু বলে। অথচ ওনার ভাই পরিতোষ কাকুকে আমরা পরিকাকু বলি।

হাতছানি দেখে আর ভুল নামে ডাক শুনেও আমি ভয়ে ভয়ে কাকুর কাছে এগিয়ে গেছিলাম।উনি একটা কানের দুল আমার হাতে দিয়ে বলেছিলেন,

- এটা কার দুল খোঁজ নিতে পারবি?

- এটা আপনি কোথায় পেলেন?

- সুকুমার দিয়েছে।

- তো সুকুমারকেই জিজ্ঞেস করুন না, কার দুল এটা?

- আরে কী আশ্চর্য! সুকুমার কী করে বলবে? ও তো কাক। কাক কি কথা বলে? কা কা ছাড়া ওরা কি আর কোনো ভাষা জানে?

- সুকুমার মানে কাক?

- হ্যাঁ। নামটা আমিই দিয়েছি। একটা নাম না দিলে চিনবো কী করে?

একটু ভেবে নিয়ে বলেছিলেন,

- নাম ছাড়া কি কাউকে ডাকা যায়?

- তা ঠিক। আচ্ছা দেখছি খোঁজ নিয়ে।

এটুকু বলে দুলটা হাতে নিয়ে চলে এসেছিলাম আমি। কিন্তু মনে মনে বুঝেছিলাম, এ আমার কম্মো নয়। বিশাল টাটানগর রেল কলোনির হাজার হাজার লোকেদের মধ্যে খোঁজ করে দুলের মালকিন কে বের করা আমার পক্ষে অসম্ভব। আমি তাই গীতার স্মরণাপন্ন হয়েছিলাম।

কতদিন আগের কথা। কিন্তু এখনও সব পরিষ্কার মনে আছে। আমাদের তৎকালীন টাটানগর রেল কলোনিতে বেশ কয়েকজন পাগল মানুষ ছিলেন। যদিও আমার মা বলতেন সব মানুষই একটু আধটু পাগল। গীতা তো কথায় কথায় আমাকেই পাগল বলে। তবে কারো ক্ষেত্রে এই পাগলামিটা লাগামছাড়া হয়ে গেলে তখন তাকে সবাই পাগল বলে। কুইলাকাকু তাই ছিল। তার পাগলামি লাগাম ছাড়া হয়ে গেছিল। কিন্তু সেদিন আমি আর গীতা এটা জেনে অবাক হয়ে গেছিলাম যে কুইলাকাকু কাক চেনে। তাদের সঙ্গে ওনার ভাব ভালোবাসা আছে। তাদের নাম ধরে ডাকেন। এবং তার সেই পরিচিত কাকেদের মধ্যে একজন, সুকুমার কাক কুইলা কাকুকে একটা কানের দুল এনে দিয়েছে। কিন্তু কেন?

শুনেছি দুল আংটি চামচ চুরি করে ছাতারে পাখিরা। টাটানগর রেল কলোনিতে তাদের আনাগোনা খুব একটা নেই। কিন্তু ছাতারের মতো ঐ সব চুরি করার অভ্যেস তো কাকেদের হয় না। আমরা আরো জানতাম, কাকেদের মানুষের সাথে এরকম ভাবপটাব করার অভ্যেসও হয় না। তারা  মানুষের কাছে পিঠে থাকে শুধু  নিজেদের খাবার দাবার পাওয়ার লোভে। খাবার দাবারের ব্যাপারটা অবশ্যি এখানেও আছে। পাগলদেরও খিদে পায়। তাদেরও বেঁচে থাকতে খাবার খেতে হয়।

কুইলাকাকু ভোর থেকেই ঘরের বাইরে থাকেন। বাড়ির পেছনের  মাঠে বসে থাকেন দিনভর। কখনো নিষ্ফলা আমগাছটার নিচে কখনো বা রোদ-টোদ উপেক্ষা করে একেবারে খোলা আকাশের নিচে।

মা বলতেন, পাগলদের গরম লাগে না। ঠান্ডাও লাগে না।পাগলদের আরো কতো কিছুই লাগেনা। কিন্তু যেটা লাগে সেটা খুব গভীর ভাবে লাগে।

কুইলা কাকুর ভাই পরিতোষ। সেই ভাইয়ের বউ নন্দাকাকি। সময়ে সময়ে এসে কুইলা কাকুকে খাবার দিয়ে যায় নন্দাকাকি। একটা বড়ো সাইজের এলমুনিয়ামের থালায় কখনো মুড়ি চানাচুর তো কখনো ভাত ডাল তরকারি। তবে কুইলাকাকু কখনো একা একা খেতেন না। খাবার এসে গেলেই তার বন্ধু কাকেরাও তার কাছে এসে যেত। কুইলাকাকু তাদের সাথে ভাগাভাগি করে খাবার খেতেন। বোধহয় পাঁচজন ছিল তারা।

সুকুমার, আনোয়ার, বিজন, বৈকুণ্ঠ আর গান্ধারী। কাকুই নাম বলে বলে আমাদের চিনিয়ে দিয়েছিলেন। যদিও আমরা নাম জেনেছিলাম কিন্তু চিনিনি তাদের কাউকেই।

কাকেদের আর সবাই কাকুর পাশে পাশে ঘুরে ঘুরে খাবার খেলেও, গান্ধারীকাক খেতো কাকুর কোলে বসে। বাকিদের জন্য কাকু খাবার মাটিতে ছিটিয়ে দিতেন। শুধু গান্ধারীকে কাকু নিজের হাতে খাইয়ে দিতেন। গান্ধারী লক্ষ্মীমেয়ে হয়ে কাকুর কোলে বসে খাবার খেয়ে নিত। এসবই আমি খুব মন দিয়ে দেখে দেখে জেনেছিলাম। জিজ্ঞেসও করেছিলাম কাকুকে,

- তুমি ওকে কোলে বসিয়ে খাইয়ে দাও কেন?

- ওমা! খাওয়াবো না? ও তো গান্ধারী। চোখে কম দেখে। মাটিতে ছড়ানো খাবার ও ঠিকমতো দেখে ঠুকরে তুলে খেতে পারে না যে! বাকিরা সব খাবার লুটেপুটে নেয়। তাই।

- চোখে কম দেখে? কী হয়েছে ওর চোখে?

- কী জানি? হয়তো ছানি পড়েছে।

- কাকেদের চোখে ছানি পড়ে?

- মানুষের পড়লে কাকেদের পড়বে না কেন?

তারপর গান্ধারীকে আদর করতে করতে কাকু বলেছিলেন,

- কিন্তু এতো কম বয়সে চোখে ছানি পড়লো কেন? সেটাই ভাবনার কথা। এদের মধ্যে তো গান্ধারীই বয়সে সবচেয়ে ছোটো।

- তুমি কী করে কাকেদের বয়স জানলে? ওরা কি বলেছে?

- বলতে হবে কেন? এই যে তুই বয়সের তুলনায় এতো ঢ্যাঙা, তুই কি আমাকে তোর বয়স বলেছিস? তবে জানলাম কী করে?

সোমনাথ সব শুনে খুব হেসেছিল। তবে আমাদের এও বলেছিলো,

- এটা মোটেও হাসির কথা না। রীতিমত কালচার করার বিষয়।

পরিমল স্যারের কাছে টিউশনি পড়ে সোমনাথের খুব উন্নতি হয়েছে। নানা রকম ইংরেজি শব্দ মিশিয়ে কথা বলে। সেই ইংরেজি শব্দের মানে আমাদের বুঝিয়ে দেয়। যেমন তখন বুঝিয়ে ছিল, কালচার করা মানে ভালো করে বোঝার চেষ্টা করা।

কানের দুলটা আমি প্রথমে গীতাকেই দিয়েছিলাম খোঁজ করতে। ও মেয়ে। দুলটাও মেয়েদের। তাই মনে হয়েছিলো। পারলে ওই পারবে। কিন্তু পারেনি। ও শুধু খবর এনেছিল,

- তিনআনা সোনার দুল। ডিজাইনটা পুরনো। এখন কেউ আর এরকম ঝুমকো ঝোলানো দুল পড়ে না।

- আরে ও সব ছাড়। দুলটা কার সেটা জানতে পেরেছিস?

- না। জানা অতো সহজ নাকি? খড়ের গাদায় ছুঁচ খোঁজা।

এবার আমি হেসে ফেলেছিলাম।

- তার মানে, রেল কলোনির মেয়েরা খড়, আর দুলটা একটা ছুঁচ! হা হা হা।

গীতাও আমার সঙ্গে হেসেছিল। তারপর দুলটা আমার কানের সঙ্গে ধরে বলেছিলো,

- শুধু মেয়েরা কেন, ছেলেরাও পড়লে পারে! এইতো দুল পড়ে কী সুন্দর লাগছে তোকে! আয়না আনবো? দেখবি?

- ভাগ।

মোটকথা দুলের ভাগ্য এরকম দোদুল্যমান হয়েই থাকলো কিছুদিন।

তারপর হঠাৎ একদিন ঝড়ের মতো এসে সোমনাথ আমাকে বলেছিলো,

- এই দীপে। দুলটা দে তো? মনে হচ্ছে পেয়ে গেছি।

- কী পেয়েছিস?

- কার দুল সেটা জানতে পেরেছি।

- কার?

- আরে আগে দুলটা তো দে। মিলিয়ে নিয়ে কনফার্ম হয়ে নি। তারপর বোলবো।

- ওটা তো গীতার কাছে আছে।

- এক্ষুনি নিয়ে আয়।

 আমি গীতাদের বাড়ি ছুট লাগালাম। যেতে যেতে শুনলাম কুইলা কাকু সুর করে চেঁচাচ্ছে,

- কু মানে কুইলা। আই এম কুইলা। ভেরি ব্যাড কুইলা।

হ্যাঁ। আশুতোষ কাকুদের টাইটেল ছিল কুইলা। তবে সেটা এরকম চেঁচামেচি করে জানানোর কি আছে? মা তো বলে, কুইলারা ছোটজাত হয়। পাগল আর কাকে বলে!

সোমনাথের ডিটেকশনটা সঠিক ছিল। দুলটা ছিল পারুল পিসির। পারুলপিসি টাটানগর রেল কলোনির আর একজন পাগল। মহিলা পাগল। জানা গেছিল পারুল পিসিরই ওরকম একটা ঝুমকো দুল হারিয়ে গেছে। কিন্তু হারালো কি করে সেটাই একটা গভীর রহস্য। কারণ ওগুলো তো পারুল পিসিকে পড়তে দেওয়া হতো না। যদিও ওগুলো একসময় তৈরি করা হয়েছিল পারুল পিসির বিয়ের গয়না হিসেবেই। তা পিসি যখন পাগল হয়ে গেল তখন আর কী করা! সেসব গয়নাগুলোকে আলমারিতে তুলে রাখা হয়েছিল। এখন প্রশ্ন, আলমারির মধ্যে থেকে এই দুলটা জোড়া ভেঙ্গে বাইরে বের হলো কী করে? আশু পাগলের সুকুমার কাক সেটা পেলোই বা কী করে?

সোমনাথ মাথা নেড়ে বলেছিলো,

- সারটেইনলি এটা পারুল পিসির‌‌‌ই কাজ। বলে না, ছাগলে কী না খায় - পাগলে কী না করে। কিন্তু কিভাবে পারুল পিসি এটা করলো? সুকুমারকে দুলটা দিলোই বা কি করে? সেসব রহস্য উদ্ধার হয়নি। তবে খবরটা ছড়িয়ে গেছিল গোটা পাড়াময়। এরকমটা তখন হতো। মোবাইলের যুগ নয়। তবু ঘটনা নিমেষে ভাইরাল হয়ে যেতো।

সোমনাথ পারুল পিসির মায়ের হাতে দুলটা ফিরিয়ে দিয়েছিল। অবশ্যই মিলিয়ে নিয়ে কনফার্ম হবার পর।

উনি সোমনাথ কেআশীর্বাদ করেছিলেন দুচোখ ভরা জল নিয়ে। সেটা মোটেই আনন্দাশ্রু ছিল না। মেয়ের দুর্দশা নতুন করে কাঁদিয়ে দিয়েছিলো তাঁকে।

তার পরদিন আমি আর গীতা ছাদে পাশাপাশি শুয়ে আছি। শুনলাম বারান্দায় বসে গীতার মায়ের সাথে আমার মায়ের কথা চলছে।

- ও দিদি। ভগবানের কী অবিচার দেখ! ভগবান তো দয়ার সাগর। যেখানে জাতে মেলে না সেখানে মনের  মিল করালেন কেন? কুইলাদের সাথে চক্রবর্তীদের কি কোনোদিন সম্পর্ক সম্ভব? মাঝখান থেকে দুটো ছেলে মেয়ে পাগল হয়ে গেল!

মায়েদের কথা শুনে আমি আর গীতা দারুন অবাক হয়ে গেছিলাম। আবার দুয়ে দুয়ে চার করতেও পেরেছিলাম। ওহো! তাহলে এটাই কারণ! কুইলাকাকু নিজের জাত বোঝাতেই ওরকম কুইলা কুইলা করে চেঁচায়। ওটা আফসোসের চিৎকার। ক্ষোভের চিৎকার। আর সেই জন্যেই কুইলাকাকু মানুষ ছেড়ে কাকেদের সাথে ভাব ভালোবাসা করে।

সোমনাথকে বলেছিলাম সেটা। ও শুনে বলেছিলো,

- বার্ডস আর বেটার দ্যান হিউম্যান। পারটিকুলারলী কাক। ওদের কোনো জাত নেই। দেখতেও ওরা সবাই এক। কোনোরকম ভেদাভেদ নেই।

পরে কিন্তু পারুলপিসি সেরে গেছিলো। বিয়েও হয়েছিল তার। সুখের সংসার হয়েছিলো। জীবন কেটেছিল সুখে শান্তিতে। সে কাহিনী লিখেছি আগে।

কুইলাকাকুর জীবনে কিন্তু আর কোনো পরিবর্তন আসেনি। তিনি তাঁর কাক বন্ধুদের নিয়েই আজীবন সংসার করে গেছেন। তবে সুখে শান্তিতে কি না, তা জানি না।


0 কমেন্টস্:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন