কালিমাটি অনলাইন

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

রবিবার, ১ জুলাই, ২০১৮

তুষ্টি ভট্টাচার্য




দেশ, আমার দেশ




দেশ, আমার দেশ, উচ্চারণ করতেই কোথা থেকে যেন আবেগ এসে ঘিরে ধরে। আমি যেখানে থাকি, নির্দিষ্ট করে বলতে গেলে, যে বাড়ির যে ঘরে থাকি, প্রাথমিক ভাবে সেটাই আমার দেশ। আবার যেখানে রুজির টানে যাই, সেটাও আমার দেশ। যেখানে গেলে মনের খোরাক পাই, সেটাও আমার দেশ। আসলে নিজেকে ঘিরে রাখা ছোট্ট গণ্ডি আর সেই গন্ডিকে ঘিরে থাকা আমার চারপাশ, পুরোটাই আমার দেশ। অথচ যে ভৌগলিক সীমারেখায় আমি থাকি, সেটাই আমার প্রকৃত দেশ। মাঝেমাঝে ভাবলে অবাক হই, কী বিরাট মাপের আয়তন জুড়ে ছড়িয়ে আছে আমাদের দেশের সীমারেখা! আর এই দেশের ভূখন্ডের কত না বৈচিত্র! কত বিচিত্র জাতি, উপজাতি, কত ভাষা, কত বর্ণময় সংস্কৃতির ধারক ও বাহক আমার দেশ। প্রাকৃতিক বিভিন্নতার সমাহার যেমন রয়েছে, তেমনি প্রাকৃতিক গঠন অনুযায়ী বিভিন্ন আদলের মানুষও রয়েছে এই দেশে। সাদা বরফে ঢাকা কোন বরফের চূড়ায় দাঁড়ানো একজন মানুষ, বা মরুভূমির শুষ্ক বালিতে হেঁটে যাওয়া উটের পিঠে বসা কোন মানুষ, সমুদ্রের তীরে মাছ ধরতে যাওয়া ট্রলারের কোন মানুষ, অথবা নদীর তীরে এক সবুজ ক্ষেতে চাষ করতে যাওয়া কোন মানুষ, এরা সবাই কিন্তু ভারতবাসী হতে পারে। এরা হয়ত ভিন্ন ভাষায় কথা বলে, ভিন্ন স্বাদের খাবার খায়, ভিন্ন ধর্মে জন্মগ্রহন করেছে। তবুও এদের সবার দেশ কিন্তু ভারত।

যেখানে এত ভিন্নতার সহবাস, সেখানে মতবিরোধ থাকবে না, তা কি হয়? মতবিরোধ, মতান্তর, মনান্তর থেকে আসে রাগ, হিংসে। আসে বিভাজন। তবে মতবিরোধ খুব স্বাভাবিক ঘটনা। পাশাপাশি থাকলে মতবিরোধ হয়েই থাকে। মনান্তরও হয়। দুই বন্ধু তুমুল ঝগড়া করল, দুদিন কথা বন্ধ, তারপর আবার যেই কে সেই ভাব! বন্ধু হলেই যে প্রতিটি ব্যাপারে সহমত হবে, এমন তো না। আমার ব্যক্তিগত জীবনেও এমন হয়েছে। আমার বন্ধুদের সাথে আমার বনে না। দিনরাত কথা কাটাকাটি। তাই বলে কি আমরা শত্রু হয়ে যাব একে অপরের? আমরা কি ঘেন্নায় মুখ ফিরিয়ে নেব? আসলে একটা সীমারেখা থাকে। যে রেখাকে অতিক্রম করলে আর আমরা বন্ধু থাকি না। এই অদৃশ্য সীমারেখার কথা একেক সময়ে মানুষ ভুলে যায়। আর তখন তারা আক্রমণ করে ফেলে একে অপরকে। হিংসায় অন্ধ হয়ে এতদিনের বন্ধুকে গলা টিপে মারতেও তার হাত কাঁপে না। এই সীমারেখা টপকানোর কয়েকটি ধাপ আছে, কয়েকটি অযৌক্তিক কারণ আছে। স্বাভাবিক যুক্তিবুদ্ধিতে যে কারণগুলো হাস্যকর বলে মনে হয়, হিংসার বশে মানুষের তখন সেসব বিচার করার হুঁশ থাকে না। ‘মান’এর ‘হুঁশ’ গেলে সে কী আর তখন মানুষ থাকে!

এত বড় দেশে এত ভাষা, কজন আর কজনের ভাষা বুঝি? আরও কিছু ভাষাভাষী মানুষ স্বীকৃতির জন্য আন্দোলন চালাচ্ছে। সবাই চায় তাদের ভাষাতেই সকলে কথা বলুক, সরকারী স্বীকৃতি পাক। এই বিভেদের জন্যই গড়ে উঠল রাষ্ট্রভাষা। বৃটিশ ইংরেজিকে হটিয়ে হিন্দি রাষ্ট্রভাষার খেতাব পেল। আমাদের মানে বাঙালিদের কিছু সুবিধে হল কি? তামিলভাষীদের কিছু সুবিধে হল? যা কিছু সুবিধে, সব পেল হিন্দিবলয়। মাঝখান থেকে সরকারী কর্মচারীদের হিন্দি শিখতে বাধ্য করা হল। দক্ষিণভারতে হিন্দি প্রায় নিষিদ্ধ, তাহলে হিন্দিকে কেন মানবে ওরা? এভাবেই ভাষাকে ঘিরে ক্রমশ ক্ষোভ বাড়তে থাকে। শুধু হিন্দি মানতে হবে বলে না, অনেক আদিবাসীরাই রীতিমত লড়াই করে তাদের নিজস্ব ভাষার অধিকার অর্জন করে নিয়েছে বা এখনও লড়ছে। এই ক্ষোভ চেপে থাকতে থাকতেই তা হিংসায় পরিবর্তিত হচ্ছে। হিংসা ছড়াচ্ছে ভূখন্ড নিয়েও। একটা রাজ্য ভেঙে টুকরো টুকরো হচ্ছে, জেলা ভাঙছে, দেশের সীমারেখা নিয়ে যুদ্ধের পরিস্থিতি তৈরি হচ্ছে। আজ কথায় কথায় সীমান্তে গুলিবর্ষণ, বোমাবাজি চলছেই। দেশ, আমার দেশ, উচ্চারণ করতেই এখন যেন শুধু হিংসার ছবি, কূটকাচালির ছবি চোখে আসে। আর রয়েছেন মহান রাজিনীতিবীদরা! এরাই নিজেদের স্বার্থে সাধারণ মানুষের মনে হিংসার বীজ পুঁতে দিচ্ছেন। আমআদমীকে খেলার পুতুল বানিয়ে নিজেরা আখের গোছাচ্ছে। এখন মাঝেমাঝে ভাবলে অবাক লাগে, এই রকম স্বাধীনতা পাওয়ার জন্য কী আমাদের বীর শহিদরা ইংরেজদের বিরুদ্ধে এত সংগ্রাম করেছিলেন!


বলতে কত যে ভালো লাগে- আমাদের দেশ ধর্ম নিরপেক্ষ। আহা দেখ সবাই, আমরা কোন ইসলামিক কানট্রি নই, আমরা কোন খ্রিশ্চিয়ান কান্ট্রি নই, আমরা হিন্দু কানট্রি নই, আমরা সেকুলার! এই দেখ, আমরা হিন্দু মুসলিম ভাই ভাই, আল্লাহ গড বুদ্ধ মহাদেব গুরুসাঁই- আমরা সবাইকে মাথায় রাখি। ‘ভুলি ভেদাভেদ জ্ঞান’, আমরা সহিষ্ণু ভারতবাসী। কিন্তু সত্যিই কী তাই? ধর্মের নিরিখে ভেদাভেদ ছিল না, নাকি এখন নতুন করে শুরু হয়েছে? এই প্রশ্নের উত্তর এককথায় দেওয়া অসম্ভব। আগেও যেমন ভাই-ভাই সম্পর্ক ছিল, এখনও আছে। আবার আগেও যেমন ছুতমার্গ ছিল, এখনও আছে। বরং আগে যেমন হিন্দুদের কাছে মুসলমানের হাতে জল খেলে ধর্ম যাওয়ার ভয় ছিল, এখন আমরা দিব্যি মুসলমান হোটেলে গিয়ে পেট ভরে খাওয়াদাওয়া করে তৃপ্তির ঢেকুর তুলি। অবশ্যই মানুষ এখন অনেক উদার হয়েছে। তবু যখন শুনি, গোবলয়ের কোন হিন্দু প্রধান নিরামিষাশী গ্রামে একজন মুসলমানকে স্রেফ গরু খেয়েছে বলে সন্দেহের বশে পিটিয়ে মারা হচ্ছে, তখন অবাক লাগে বই কী! আবার যখন এই বাংলার এক মুসলিম প্রধান গ্রামে হিন্দুদের দুর্গা পুজো করতে দেওয়া হয় না, সেটাও অবাক করে। এইরকম পরিস্থিতিতেই খবরে শুনি, আরও এক গ্রামের কথা। যেখানে একই গাছের তলায়, একই দেওয়ালে পাশাপাশি শান্তিতে সহাবস্থান করছে মন্দির আর মসজিদ। দুই ধর্মের গ্রামবাসী একসাথে মাজারে সিন্নী চড়ায়, আবার পুজোর সময়ে একসাথে পুজো করে। এসব দেখেশুনে আমি খুব দ্বিধায় পড়ি। কে ঠিক, কে ভুল এই দ্বন্দ্বে না গিয়ে ভাবি, যার যার ইচ্ছে মত আচরণ পালন করলে খুব কি অসুবিধে হবে অন্যের? যদি অবশ্যই সেই ইচ্ছে অন্যের অসুবিধের কারণ না হয়ে থাকে। ধর্ম তো প্রতিটি মানুষের বুকে থাকে, আলাদা আলাদা ধর্মীয় আচরণ পালনের মধ্যে দিয়েই তৈরি হয়ে যায় মানুষের ধর্মীয় পরিচয়। অথচ এই পরিচয় জন্মের সাথে বহন করে আনে না সে। তার পিতামাতার ধর্ম পরিচয়েই তার পরিচিতি হয়, এক্ষেত্রে পছন্দের কোন সুযোগ থাকে না। যেহেতু ধর্মীয় আচরণ পছন্দের কোন সুযোগ নেই, অন্যের ধর্মীয় আচরণ অপছন্দ করার অধিকারও থাকে না আমাদের। কেউ যদি গরু খায় খাক, আমার পছন্দ না হলে নাই বা খাবো! শূয়র, গরু, মুরগী, খাসী, শাকসব্জী, যার যা খুশি খাক। এখানে হিংসার কোন জায়গা নেই, থাকতে পারে না। আর এই সহজ, সরল সত্যটাকে অস্বীকার করতে গিয়ে আমাদের যত অসহিষ্ণুতা। নিজেদের মধ্যে হানাহানি বেড়েই চলেছে।
দেশ, আমার দেশ, তুমি শান্তিতে আছ? তোমার সীমানা দখলের জন্য রোজ রোজ এত যে মানুষের লাশ পড়ে, তুমি দেখে যাবে চুপচাপ? নাকি নির্লিপ্তির আড়ালে তুমিও কাঁদো? তোমার মাটিতে আমাদের যত রক্ত মিশে যায়, ততই তোমার কান্না বাড়ে। আর এই কান্না বোঝার জন্য যে অকৃতজ্ঞ সন্তানদের কাঁধে ভর করে তুমি দাঁড়িয়ে আছ, তারা আসলে নির্বোধ, কুলাঙ্গার সন্তান তোমার। ওরা তোমার কান্না বোঝে না, ওরা নিজেদের স্বার্থ বোঝে। আর এই আপনা বুঝে যাওয়া মানুষগুলো যখন স্বাধীনতা দিবসে তোমার গলায় মালা দিয়ে জাতীয়তাবাদের গান গায়, অহিংসার কথা বলে, আমার খুব হাসি পায় এই প্রহসনে। এই লোক দেখানোর পালা এখন সমাজের প্রতিটি স্তরে, প্রতিটি অনুভূতিতেও বোধহয়। আবেগ বড়ই মূল্যহীন আজ। ছোট থেকে সুকুর মিঞার সঙ্গে গলা জড়িয়ে বড় হওয়া নারাণ পাল, আজ সন্দেহের চোখে দেখে একে অপরকে। ভুলে যায়, ছেলেবেলার মার্বেল, পুকুরের সাঁতার। মনে থাকে শুধু নমাজের আজান আর পুজোর মন্ত্রের তফাতটুকু। একসাথে দুর্গাঠাকুর দেখতে যাওয়া বা একসাথে ঈদের সেমুই খাওয়ার ঘটনা আনন্দটুকু আজ বুঝি বড় ফিকে হয়ে গেছে ওদের কাছে। হে ঈশ্বর, হে দেশ, আজ বড় শান্তির প্রয়োজন আমাদের। হিংসা নয়, দ্বেষ নয়, আমাদের প্রধান বিচার্য হোক আমাদের দেশ।


4 কমেন্টস্:

  1. চমৎকার লিখেছ। সব বিষয়েই তুমি দারুণ তুলে আনো।

    উত্তরমুছুন
  2. দোকানদারি করেও কতো সময় পাস রে ? দোকানে বসেই পড়ালেখা করিস মনে হয় । এবার একটা গদ্যের সংকলন বের কর ।
    জেঠুদাদু

    উত্তরমুছুন
    উত্তরগুলি
    1. তোমাকেই দায়িত্ব দিলাম সংকলন প্রকাশ করার।

      মুছুন