কালিমাটি অনলাইন

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

রবিবার, ১ জুলাই, ২০১৮

রঞ্জনা ব্যানার্জী




ইচ্ছেডানা


পিসিমাদিদাকে দেখতে গিয়েছিলাম আমরা। একপাশ হয়ে শুয়ে থাকা ঐ মাংসপিন্ডটি যে পিসিমাদিদা আমার মানতে কষ্ট হচ্ছিলো।

কী সুন্দর দেখতে ছিলেন পিসিমাদিদা! ধবধবে সাদা খোলের চিকণ পাড়ের শাড়ি পরতেন গা থেকে অগুরুর মিষ্টি গন্ধ বেরুতো। সে প্রায় ত্রিশ বছর আগেকার কথা। আমার সাত বছর বয়েসে দেখা সেই মুখের কোনো প্রামাণ্য চিহ্নই নেই এই মুখে!  আমি দ্বিধা নিয়ে মায়ের দিকে তাকাই; মা ততক্ষণে চৌকির ধার ঘেঁষে বসে পড়েছেন।   
সেদিন প্রায় দু’ঘন্টা ছিলাম ওখানে। মা কানের কাছে মুখ টেনে বেশ ক’বার  ফিসফিস করে বলেছিলেন, ‘পিসিমা আমি রানু’তিনি চোখ মেলেন নি। রাতে ট্রেন ছাড়তেই প্রদীপ বাবু’র ফোন;  পিসিমাদিদা নেই আর। আমার কাঁধে মাথা রেখে মা হু হু কাঁদছিলেন। আর আমি ট্রেনের দুলুনির তালে শুনছিলাম সেই সুর, ‘আমার পরাণে প্রেমের বিন্দু ...’     
 
গত মাসে প্রদীপ রায় ফোন দিয়েছিলেন। মা যদি পারেন তবে যেন একবার আসেন চাটগাঁয়। পিসিমাদিদা মৃত্যুশয্যায়। মা’কে খুব দেখতে চাইছেন। প্রদীপবাবু ওঁর জ্ঞাতি ভাইপো। আমার ঘোর যায় না। পিসিমাদিদা বেঁচে আছেন?

চাটগাঁয় আমাদের কেউ নেই আরদাদু দিদা নেই। নেই বাড়িটাও।

নিবারণ কাকার মৃত্যুর খবরটা বাবা ভাত মাখতে মাখতে খুব স্বাভাবিক ভাবে দিয়েছিলেন। আমরা তখন রাতের খাওয়া সারছি। জোছনা রাতে অসাবধানে পা হড়কে পুকুরে পড়ে গিয়েছিলেন কাকা। সাঁতার জানতেন না। আমার কানে সেদিনও অবিরাম বেজেছিল, ‘আমার পরাণে প্রেমের বিন্দু তুমি শুধু তুমি’! 
 
নিবারণ কাকার বাবা দাদুর বাড়ির দেখভাল করতেনবছরে একবার পুজোর সময় আমরা সবাই যেতাম বাড়িতে। আনন্দের হাট বসতো তখন। জোছনা ঢালা ফকফকা উঠোনে গানের আসর হতো। নিবারণ কাকা মায়ের পছন্দের ‘বর্ণে গন্ধে’ গাইতেন।
কাকা চোখে দেখতে পেতেন না। জন্মান্ধ নয়। কী এক স্নায়ুর অসুখে দৃষ্টি হারিয়েছিলেন  তিনি। কিন্তু অসম্ভব সুন্দর ছবি আঁকতেনবলতেন, ‘মনের আলোয় দেখতে পাই’  
পুজোর ক’দিন দাদুর কাছারিতেই সবার জন্যে পাত পড়তো। নিবারণ কাকা সেদিন  খেতে যাননি। আমাকে মা খাইয়ে দিয়েছিলেন আগেভাগে। আমি কাকার ঘরে ঢুকে দেখি টেবিলে ঝুঁকে আঁকছেন কিছু। ওমা প্রজাপতি! মাথা তুলে বলেছিলেন, ‘ইচ্ছেদের ডানা দিচ্ছি’আমি অবাক। ইচ্ছেদের ডানা থাকে! হঠাৎ আমারও অদ্ভুত ইচ্ছেটা জাগল,  ‘আমার ছবি এঁকে দেবে?’  কাকা আমার মুখে আলতো হাত বোলালেন, ‘এই মুখ আমি এক টানেই আঁকতে পারি’আমার আর তর সইছিল না। আঁকা শেষ হতেই আমি অবাক। ‘এ তো মা!’  

নিবারণ কাকা ফ্যাকাশে হয়ে গিয়েছিলেন। আমি ছবি নিয়ে এক ছুট্টে কাছারিতে। সবাই খাচ্ছেপিসিমাদিদা তদারকি করছেন দাঁড়িয়ে আমি বাবাকেই নালিশটা দিলাম, ‘আমাকে আঁকতে গিয়ে মা’কে এঁকেছে নিবারণ কাকা’! হঠাৎ সব থমকে গেল। বাবা উঠে গেলেন খাওয়া ছেড়ে। আমি বোকার মত দেখলাম ছবিটা ডানা ভেঙে পিসিমাদিদার পায়ের কাছে মুখ থুবড়ে পড়লো। পিসিমাদিদা ওকে কুড়িয়ে নিলেন মমতায়।
সেদিন রাতেই বাবা আমাদের নিয়ে ট্রেনে চেপেছিলেন।  

আমরা আর কখনো চাটগাঁয় আসিনি।  

0 কমেন্টস্:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন