কালিমাটি অনলাইন

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

বুধবার, ২৬ ফেব্রুয়ারী, ২০২০

পিয়ালী বসু




Uncut বইমেলা





কথায় আছে, বাঙালির বারো মাসে তেরো পার্বণ। আর এর সঙ্গে বইমেলা যোগ করলে হয় চোদ্দো পার্বণ। 

বইয়ের সঙ্গে চিরকালই বাঙালির নাড়ির যোগ। কলকাতার প্রথম বইমেলাও অনুষ্ঠিত হয়েছিল ১০২ বছর আগে। কলেজ স্ট্রিট চত্বর ঘিরে বসেছিল সেইসব বইয়ের প্রদর্শনী। 

তখন স্বদেশী যুগ। বিদেশী পণ্য বয়কট করার পর স্বদেশী উৎপাদন ব্যবস্থা গড়ে উঠছে দেশের নানা প্রান্তে, আর তার সঙ্গেই উদ্যোগ চলছে স্বদেশী শিক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তোলার। 

সেই উদ্দেশ্যেই প্রথম তৈরি হয় ‘বঙ্গীয় জাতীয় শিক্ষা পরিষৎ’। সেই পরিষদের উদ্যোগেই ১৯১৮ সালের এপ্রিল মাসে কলেজ স্ট্রিট চত্বরে শুরু হয় ‘জাতীয় শিক্ষা সপ্তাহ’। সেই অনুষ্ঠানের অঙ্গ হিসাবে ছিল দুটি প্রদর্শনী। একটি শিল্প প্রদর্শনী, অন্যটি গ্রন্থ প্রদর্শনী।

‘প্রদর্শনী’ নামে শুরু হলেও, তাতে যোগ দিয়েছিলেন দেশের নানা স্বদেশি  প্রকাশক। তাদের মধ্যে যেমন ছিল বেনারসের ‘মতিলাল বেনারসীদাস পাবলিশার’, তেমনই কলকাতার ‘বসুমতী প্রকাশন’ও হাজির ছিল সেখানে। বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ আনন্দদেব মুখার্জীর মতে, ‘বইমেলা’ নামে না হলেও সেটিই কলকাতার প্রথম বইমেলা। সম্ভবত ভারতেরও প্রথম।

বইয়ের এই প্রদর্শনীর সঙ্গে যুক্ত ছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, লালা লাজপত রাই, গুরুদাস বন্দোপাধ্যায়, বিপিনচন্দ্র পাল, সতীশ মুখার্জি, নীলরতন সরকার, চিত্তরঞ্জন দাশ, অরবিন্দ ঘোষের মতো জাতীয় নেতৃবৃন্দরাও। জাতির বৌদ্ধিক উন্নতির জন্য গ্রন্থকারদের এগিয়ে আসার আহ্বান জানান শ্রী অরবিন্দ ঘোষ। প্রদর্শনীর উদ্দ্যোক্তাদের প্রতি আশীর্বাদবাণী পৌঁছে দিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথও।

এ বছর কলকাতা বইমেলার বয়স হলো চুয়াল্লিশ বছর। ১৯৭৬-এর ৩ মার্চ মাত্র  ৫৪টি স্টল নিয়ে বিড়লা তারামণ্ডলের উল্টোদিকে ছোট মাঠটিতে যে বইমেলা শুরু হয়েছিলো, তার এই ৪৪ বছরের যাত্রাটা কেমন? তথ্য বলবে ক্রমশ ফুলতে থাকাই সেই যাত্রার চরিত্র। তার খতিয়ানের জন্য একটি তালিকাই যথেষ্ট। সে মেলার প্রধান পণ্য যতই আন্তর্জাতিক বলা হোক না কেন, বাংলা বই। আর সে বইয়ের অবস্থাটা কী?

যে জাতির বই সংখ্যা যত বেশি তার মেধাগত সমৃদ্ধিও তত বেশি, এটিই প্রমাণিত সত্য। শিক্ষিত-অর্ধশিক্ষিত এমনকি অক্ষরজ্ঞানহীন এমন কোনো মানুষ নেই, যার সঙ্গে বইয়ের আত্মার নিবিড় সম্পর্ক নেই। যারা বই থেকে নিজেদের মন-মানসিকতা-গঠন এবং আত্মার খাদ্য-খোরাক খুঁজে নেয় - তাদের কাছে বই যেমন মেধা বিকাশ এবং মানসিক পরিতৃপ্তির আশ্রয়স্থল; তেমনি অক্ষরজ্ঞানহীন মানুষও বইয়ের বুকে গাঁথা পৃষ্ঠার অক্ষর বা ছবিতে হাত বুলিয়ে পরাণের গহীন থেকে উঠে আসা দীর্ঘশ্বাস গোপন করার চেষ্টা না করে নিজের অক্ষমতায়  আবারও দীর্ঘশ্বাস ফেলে। যুগ যুগ ধরে পৃথিবী জুড়ে বিচিত্র সব বইমেলার আয়োজন হয়ে আসছে। 

বারো মাসে তেরো পার্বণে আর একটি নতুন পার্বণ এ বছর যুক্ত হলো, বই-পার্বণ। বইমেলা নামে বই নিয়ে একটি বিস্তর বাড়াবাড়ি প্রতি বছর সরকারি আনুকূল্যে ঘটে থাকে। সেটিঙ মোটামুটি বাঙালির গা-সওয়া হয়ে গিয়েছে। কিন্তু সদ্য গোলদিঘিতে আতসবাজি-সহকারে যে উৎসবটির সমাপন হল সেটিকে, এককথায় বলা যায় এক ধরনের সুভাষণ মাত্র।

আসলে, কোনও পার্বণ একটি সামাজিক বাস্তব হয়ে উঠলে তার জন্মবৃত্তান্তের উৎস নিয়ে বিস্তৃত হওয়া যায়, সমাজবিজ্ঞানীরা জ্ঞানগর্ভ প্রবন্ধ লিখে নানা ধরনের বিশ্লেষণ পেশ করতে পারেন। কেউ কেউ বাঁকা চোখে পার্বণটির মুণ্ডপাতও করতে পারেন। তবে ইতিমধ্যে সেই পার্বণ এর-ওর-তার নাগালের  বাইরে চলে গিয়েছে। কীভাবে বাঙালি বইমেলা এখন থেকে বিবর্তিত হবে, কারও পক্ষেই আর তা স্পষ্ট প্রত্যয়ে বলা সহজ নয়। বইমেলার ভবিষ্যৎ ইতিহাস এখন থেকে বাঙালির সামগ্রিক সামাজিক প্রক্রিয়া-বিক্রিয়ার সঙ্গে অবিচ্ছিন্ন হতে বাধ্য, বাঙালি সমাজ যে-রকম চাইবে বইমেলাও সে-রকম আদল নেবে।

বাঙালি বুদ্ধিজীবী গর্ব করে দাবি করতে পারেন, এই পার্বণটির উৎসে কোনও   ধর্মীয় নামগন্ধ নেই। বাঙালি মানসের একটি বিশেষ ঝোঁক বুদ্ধির চর্চা। বাঙালিদের ধারণা, যার কোনও দোসর পৃথিবীর অন্য কোথাও মিলবে না। সেই বুদ্ধির চর্চাই নাকি বইমেলাকে লালন করেছে, পালন করেছে। 

একটু লক্ষ্য করলেই দেখতে পাবেন, বইমেলার সাম্রাজ্য যত বিস্তৃততর হচ্ছে বই পড়ার অভ্যেস ততই, আশঙ্কা হয়, অন্তর্হিত হচ্ছে। প্রকাশক-পুস্তকবিক্রেতারা এই মরসুমে প্রচুর ব্যবসা করেন, কিন্তু সম্ভবত মেলা উপলক্ষ করে আরও যাঁরা পসরা সাজিয়ে মেলাপ্রাঙ্গণেই জড়ো হন তাঁদের বিক্রিবাটার পরিমাণ ঢের বেশি। প্রধানত কোন ধরনের বই বিকিকিনি হয়, তা-ও তো আমাদের জানা। বড়লোকেরা কোনও কালেই বই কেনেন না। মেলার বর্বর ভিড়ে জুটে গিয়ে কেনার তো প্রশ্নই নেই। অন্য দিকে, গরিব নিম্নবিত্তের তো বই কেনার সংগতি নেই। উঠতি মধ্যবিত্তের জীবনবোধে বিপ্লব এসেছে। তাঁরা এমন ধরনের বই খোঁজেন যার সারবত্তা অনুধাবন করে কাজে লাগালে বই পড়ার প্রয়োজনই চিরতরে শেষ হবে। সম্ভ্রান্ততর বইমেলায় ইতিমধ্যেই তো বৈদ্যুতিনগ্রন্থের উপস্থিতি একটু-আধটু টের পাওয়া যাচ্ছে।

বাড়ছে, রাজ্য জুড়ে সাক্ষরতার হার পর্যাপ্ত ঊর্ধ্বগতি পাচ্ছে না। মেলাগুলি বিনোদন শিল্পে পরিণত। গরিবগুর্র্বোদের যেহেতু বিনোদনে অধিকার নেই, সাক্ষরতার বাইরেই তাঁদের অধিকাংশ থেকে যাচ্ছেন। ভারী ভারী বইমেলায় ভর-সন্ধ্যায় ঠাসা ভিড়ের সামনে মঞ্চে উপবিষ্ট পণ্ডিতজনেরা এন্তার ভারী ভারী বিষয়ে আলোক বিতরণ করেন। কিন্তু কোথাও সাক্ষরতার সঙ্গে গ্রন্থপাঠের পারস্পরিক সম্পর্ক নিয়ে সামান্যতম আলোচনাও কানে আসে না। প্রতি বছর গোটা রাজ্যে অন্তত হাজারখানেক নানা পরিমাপের নানা ঘরানার পুস্তকমেলা অনুষ্ঠিত হয়, কলকাতায়, মফঃসল শহরে, গঞ্জে, বন্দরে, বনেবাদাড়ে। যদি  প্রতিটি মেলার সঙ্গে নিরক্ষরতা দূরীকরণের একটি সংক্ষিপ্ত কর্মসূচি গ্রহণ করা যেত, আখেরে বই বেচনেওয়ালাদের লাভ বই ক্ষতি হত না। একটু গুছিয়ে ছক কেটে এগোলে বিভিন্ন অনুষ্ঠান-কর্তাদের সহযোগিতায় উৎসবের দিনগুলি জুড়ে মেলাপ্রাঙ্গণের ঈষৎ নিভৃত কোনও কোণে এ-রকম সাক্ষরতার পাঠশালার ব্যবস্থা করা নিশ্চয়ই সম্ভব। কয়েক লক্ষ নিরক্ষর নারী-পুরুষ-বৃদ্ধ-বৃদ্ধা-বালক-বালিকাদের ওই ক’দিন বইমেলার আশ্রয়ে নিয়ে এসে মজবুত অক্ষর-পরিচয় করিয়ে দেওয়ার প্রবর্তন ঘটলে হুজুগ আর নিছক হুজুগ থাকত না। একটু সামাজিক দায়িত্ব পরিপূরণের স্পর্শ লাগত তাতে। 

উদ্যোক্তারা সম্ভবত প্রস্তাবটি হেসে উড়িয়ে দেবেন। এমনিতেই মেলার ওই ক’টা দিন নাওয়া খাওয়া নেই, হাজার বায়নাক্কা সামলাতে হয়। পুলিশের-প্রশাসনের আইনকলা পুঙ্খানুপুঙ্খ মেনে চলা, ক্ষমতার উচ্চমার্গে বিহাররত সমাজ-বিরোধীদের নানা মর্জি ও বায়না মেটানো, আরও কত কী। এর মধ্যে গরিব-হাবড়াদের পাকড়ে এনে ক খ গ শেখানো এবং এটাকে তাঁদের কর্মসূচির মধ্যে ঢোকানো সম্ভবপর নয়। প্রযোজকরা না হয় মুখ ফিরিয়ে রইলেন, প্রশাসনের তরফ থেকেও কি কোনও উদ্যোগ নেওয়া যায় না? রাজ্যের সর্বত্র অধিকাংশ বইমেলা সরকারি খাস-জমি দখল করে অনুষ্ঠিত হয়। তার জন্য সরকার থেকে একটি মামুলি সম্মতিপত্র প্রয়োজন। সম্মতি দেওয়ার শর্ত হিসেবে প্রশাসনের তরফ থেকে কিছু কিছু বাধ্যতামূলক নির্দেশনামা স্বচ্ছন্দে যুক্ত করা যেতে পারে। সাক্ষরতা কর্মসূচি গ্রহণ সেই তালিকার শীর্ষে ঢুকিয়ে দিতে কীসের অসুবিধা? সরকারকে একটু বাড়তি সক্রিয় হতে হবে মাত্র। শর্তটি যথাযথ পালিত হচ্ছে কি না তা নির্ণয় করে পরের বছর মেলার অনুমতি বাতিল করে দেওয়ার সতর্কবাণী ঘোষণাও এমন কিছু কঠিন নয়। অন্য কিছু মহৎ উদ্দেশ্য সাধিত হোক না হোক, প্রশাসনিক চাপ থাকলে মেলার উদ্যোক্তারা অন্তত লেখাপড়ার এবং বইয়ের উপযোগিতা নিয়ে নিজেরা শিক্ষিত হতে পারবেন। 

এই মুহূর্তে বইমেলার সঙ্গে পড়াশোনার বড়ই অসদ্ভাব। যদি-মূর্খ-থাকতে-চান বইমেলায়-যাও গোছের নিন্দাবাদ যদি খানিকটা বন্ধও হয়, তাহলে, স্বয়ং রবীন্দ্রনাথের ভাষায়, "এ জগতে ক্ষতি কার?" 













0 কমেন্টস্:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন