কালিমাটি অনলাইন

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

বুধবার, ২৬ ফেব্রুয়ারী, ২০২০

দেবব্রত চক্রবর্তী




বইমেলা দুই শূন্য দুই শূন্য






ঠিক মা দুর্গার মতনই৷ থাকেন না বেশীদিন, কিন্তু প্রতিবারই আসেন৷ আসার আড়ম্বরটাই দেখবার৷ রাজবদুন্নতধ্বনিঃ৷ আবালবৃদ্ধবনিতা তাঁর জন্যে সেই পুজোর পর থেকেই কেমন উসখুস করতে থাকে, কবে আসবেন, কবে আসবেন৷ আসবার আগে খুব হাঁকডাক৷ আর এলেন যদি বা, তা সে বলতে গেলে নিমেষেই হুশশশ৷ অন্তরে অতৃপ্তি থেকে যায়, শেষ হলেও মনে হয় শেষ হল না৷

বইমেলা দেখছি সেই ১৯৭৬ থেকেই৷ ভারি ছিমছাম ঘরোয়া ছিল সেই বইমেলাটা, মানে প্রথম বারকারটা৷ পরের বারকার মেলায় জোড়ে প্রথম যাই৷ বেশ কিছুদিন ঘরোয়াই ছিল৷ তার পর থেকেই গলা ঝাড়া দিতে লাগল৷ ক্রমশ দৈত্য৷ আর ওই সময়টা থেকে শুরু ক’রে বইও যেন আমার অক্ষরজীবনকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরতে লাগল৷ নিষ্কৃতি পেলাম না তার হাত থেকে৷ মেলার আকর্ষণও তাই থেকে গেল ভীষণ, আজীবন কাল৷

তা বই বই ক’রে সে মেলারও বয়স এখন মেলা৷ আর মাত্তর কটা বছর, দেখতে দেখতে অর্দ্ধশতবর্ষও দিব্যি পার হয়ে যাবে৷ দেখে যেতে পারব ব’লেই তো মনে হয়৷

কিন্তু এখনও সেই পুরনো বইমেলাগুলিকেই যেন বড় আপন মনে হয়৷ কি জানি সেই ভাল ছিল কিনা৷ স্মৃতি তো সব কিছুকেই কেমন সরল ক’রে দেখায়!

হালকা ভীড়, পুরনো লেখকদের আড্ডা, সইশিকারীর দল, এজন্য আগে থেকে কোনও ঘোষণা ছিল না৷ কেউ এলেই হঠাৎ সবাই মিলে জমিয়ে বসে পড়তাম আড্ডায়৷ এমনিভাবেই কতই দেখেছি সুনীলদা, শক্তিদা, সন্তোষ ঘোষ, নরেন মিত্র, নীরেন চক্রবর্তী, সুবোধ ঘোষ প্রমুখ লেখকদের৷ শিল্পীরাও থাকতেন৷ থাকতেন কেষ্টবিষ্টুরা, খুব সাধারণ ‘প্রোফাইল’-এ৷

মেলাটা জমজমাট হয়েছে, ভীড়ে টইটুম্বুর, তার কৌলিন্যও বেড়েছে – এসব পরিবর্তন খুব স্বাভাবিক৷ সমবেত কন্ঠের প্রতিনিধিত্বের একটা জায়গাও হয়েছে বটে৷ খুচরো কারিগরি, ছোট শিল্পীদের কর্মকুশলতার সম্ভার, সবেরই পসরা নিয়ে ব’সে পড়ছেন ব্যক্তিবিশেষেরা৷ চাষী যেমন নিজের উৎপন্ন ফসল নিয়ে হাটে চলে আসেন, তেমনি কবি সাহিত্যিক, শিল্পীরাও তাঁদের পসরা নিয়ে সরাসরি চলে আসতে পারছেন – ব’সে হোক, দাঁড়িয়ে হোক নিজেদের সম্বৎসরের উৎপাদন সরাসরি পাঠকের হাতে তুলে দিচ্ছেন, লিটল ম্যাগাজিনের বিরাট হাট চলছে রমরমিয়ে, যদিও বিক্রিবাটা কেমন, তা নিয়ে ঘাড় চুলকুনি যাচ্ছে না৷

তবু একটা একঘেয়েমি তো আছেই৷ মেলা নিয়ে ভাবনা চিন্তার কোনও পরিবর্তন নেই৷ যেন শুধু বিক্রি হলেই হল৷ প্রতি বছর সেই একই৷ পাশাপাশি দু চারটে অন্যজাতীয় ‘প্রমোশন’ যে নেই, তা নয়৷ যেমন বক্তৃতার ব্যবস্থা, যাতে বই  সম্পর্কে সচেতনতা বাড়ে, যাতে লেখাপড়ার বিষয় টিশয় নিয়ে আলোচনা হয়, জ্ঞানের সাত সতেরো, বহুমুখী দিকগুলি যাতে একটা প্রসার লাভ করে, কিন্তু সে যেন সব নাম কা ওয়াস্তে, বড়ো দায়সারা গোছের৷ শাঁস নেই৷  তার ছাপ সমাজে পড়ে ব’লে বিশেষ মনে হয় না৷ বরং ভীড় হলে তার নিয়ন্ত্রণ কীভাবে করতে  হবে, কত বড় সব রাজনীতির লোককে শামিল করা যাবে, কত ভারি ওজনের ‘সেলিব্রিটি’কে এনে হাতুড়ি মারবার কাজটা করানো যেতে পারে, তাই নিয়েই  ঢোল শোহরত বেশী৷ কত নতুন নতুন বিষয়ে যে মনোনিবেশ করা যেতে পারত, তার কোনও কিনারা হয় না৷ যেমন বইয়ের প্রুফ দেখায়, বই বাঁধাই নিয়ে আলোচনায়, বইয়ের অলঙ্করণ সম্পর্কে, ছাপার কাগজ নিয়ে, গ্রন্থস্বত্ব বিষয়ে, লেখকের গ্রন্থস্বত্বের মূল্য চোকানোর নিরিখে, সারা দেশে বই বিপণন সম্পর্কে, সর্বোপরি বই সম্পাদনা নিয়ে, এমন কি অনুবাদের অপ্রতুলতা নিয়েও – হা হতোস্মি, বলতে গেলেই নানা রকমের  নেতিবাচকতা, মোট কথা বইমেলার ওপর যে শিক্ষিতমনস্কতার ছাপ থাকতে পারত, তার ছিঁটেফোঁটাও পাওয়া যায় না৷ গোটা ব্যাপারটার মধ্যেই একটা ওপর চালাকি, গয়ংগচ্ছ ভাব, রাজনীতির মানুষদের কাছে হাত কচলানোর প্রক্রিয়া, রূপোলি ইশারা, ক্ষমতাপ্রদর্শন, এবং আনুষঙ্গিক ধান্দা – কর্তাব্যক্তিদের এই সব নিয়েই ব্যস্ত থাকতে হয় বেশী৷

নামী হোন, অনামী হোন, কবি সাহিত্যিক, শিল্পী, সকলেই তো সভ্যতার শীর্ষ প্রবক্তার মত, আমি তো তাঁদের ঈশ্বরের প্রতিভূই মনে করি। কিন্তু প্রকাশক সম্প্রদায়ের হাতে তাঁদের কি হেনস্থা!  অবশ্য নামী দামীদের মেলায় কিছু পুরষ্কার দেবার ব্যবস্থা আছে৷ এবং কিছু পেটোয়া লোকেদেরও৷ কিন্তু তাঁদের গ্রন্থের বিক্রি থেকে যে অর্থ আসে, তার স্বত্বমূল্য ঠিক ঠিক তাঁদের হাতে তুলে দেওয়ার কোনও ভাবনা চিন্তা সমবেতভাবে প্রকাশকেরা করেন কি? এই বিষয়ে কোনও আলোচনা সভা হয়? হলে অন্তত তার একটা বার্তা থাকে সমাজে৷ আগের কালের বেশ কিছু লেখক লিখে কিছু আয় করতে পারতেন৷ আমি নিজেই তো মনে আছে বাহাত্তর সালে চিত্রাঙ্গদা পত্রিকায় লিখে দুবারে পাঁচ পাঁচ দশ টাকা আয় করেছিলুম৷ এখন তো দেখি একটি মাত্র প্রকাশক ছাড়া কলকাতায় বা পশ্চিমবঙ্গে কেউ ডেকে পয়সা দেন না৷ আমার বেশীর ভাগ বইয়ের প্রকাশক একজন - তিনি যে দেন না এমন নয়, কিন্তু চাইতে হয় এবং হেঁটে হেঁটে জুতোর সুখতলা শুকিয়ে যায়৷ আমি আর কি লেখক! - অমর মিত্র- যাঁর বইয়ের বেশ ভাল কাটতি আছে ব’লে সবাই জানেন - আমাকে বলেছিলেন, এক বিখ্যাত প্রকাশক তাঁর বইগুলি প্রথম সংস্করণের মুদ্রণে চাপিয়ে দিয়ে হাজার হাজার কপি বিক্রি করছিলেন, এবং সেই এক হাজার কপি ধ’রেই তিনি শেয়ালের ছানা দেখানোর মত অমরবাবুর প্রাপ্য মিটিয়েছেন৷ একদিন দোকানে গিয়ে চেঁচামেচি করাতে তখন তাঁরা তাঁদের আধ-বোঁজা চোখ খুলে দ্বিতীয় সংস্করণের সূচনা করলেন পরের বার থেকে৷ এই লেখকের অনুবাদ ‘টিন ড্রাম’ প্রভূত বিক্রি হয়েছে, হাজার  কপি তো ছেড়ে দিন, আরও কত, সে কে জানে? বাংলাদেশে দুর্দান্ত বিক্রি হয়েছে সে বই৷ প্রকাশক একটা অগ্রিম দিয়ে সেই যে পিঠটান দিলেন, তারপর এখন আর চিঠি দিলেও তার উত্তর দেন না৷ আর এখন তো চুক্তি অনুযায়ী বিক্রীর অনুমোদন শেষ হয়ে গেছে, তবু তিনি তা অবৈধভাবে ছাপিয়ে বিক্রী করছেন৷

শুধু আমি কেন, পুরনো অনেক লেখকই আমার কাছে অনেক সময় আক্ষেপ করেছেন৷ কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের মত মানুষ আমাকে একদিন বলেছিলেন, প্রকাশক কীভাবে তাঁকে ঠকায়, যাঁদের বইয়ের কাটতি বেশী তাঁদেরকেও – কেউ  ওদের হাতে ছাড় পায় না জানো? কাগজের কোম্পানি, বই বাঁধাইয়ের শ্রমিক, এমন কি যে মুটেরা বইগুলি এক জায়গা থেকে অন্যত্র নিয়ে যায়, প্রত্যেকে তাদের প্রাপ্য পায় কিন্তু লেখকের সঙ্গে প্রকাশকের সম্পর্কটা কিরকম যেন – অর্থাৎ আমিই বা কোথায় আর তুমিই বা কোথায় – মাঝখানে বিশাল অনন্ত কে তাহাকে উত্তীর্ণ হইবে?

তা এই রাবীন্দ্রিক ব্যাপারটি নিয়ে প্রকাশকেরা সমবেতভাবে এগিয়ে আসতে পারতেন, আলোচনার সভা বসত বেশ, লেখকদের প্রাপ্যটুকু মেটানো নিয়ে তাঁরা কি ভাবছেন তার আদান প্রদান হতে পারত দিব্যি, কিন্তু কা কস্য পরিদেবনা! সে সভা বসবার কথা কোথাও কস্মিন কালেও উচ্চারিত হয় না৷

ফ্রাংকফুর্ট বইমেলাটা বেশ কয়েকবার অবশ্য দেখেছি৷ দেখলে যেটা মনে হয় সেটা হল শিক্ষা আর সদিচ্ছা৷ হ্যাঁ টাকা পয়সার স্রোত বেশ ভালই আছে কিন্তু বড় কথা হল ওই দৈত্যাকার মেলাটির গোটা পরিচালন ব্যবস্থার মধ্য থেকে একটা শিক্ষিত মনের সুবাস বেরিয়ে আসছে৷ ফ্রাংকফুর্ট বইমেলাতে কিন্তু বই বিক্রি হয় না৷ মেলার আয়তন কয়েকটা গ্রামের যৌথ পরিসরে, এক প্যাভেলিয়ন থেকে অন্য প্যাভেলিয়নে যাবার জন্য নিয়মিত বাস, প্যাভেলিয়নে উঠতে এসক্যালেটর, ট্র্যাভেলেটর (চলমান রাস্তা), লিফট, অসম্ভব সুন্দর টয়লেট ব্যবস্থা৷ ক্যান্টিন৷ মানুষের চলাচল খুব সুশৃঙ্খল, গত বছর ১০৪টি দেশ অংশগ্রহণ করেছিল, ৭৪৫০-টি বিপণি বসেছিল, আর মানুষ এসেছিলেন মোট ৩ লক্ষ ২ হাজার ২৬৭ জন৷ সংখ্যা হিসাবে দর্শক কি খুব বেশী? আমাদের এখানে এবারে কিন্তু কুল্যে প্রায় ১৮ লাখ৷ ১৮ টি দেশ অংশগ্রহণ করেছিল, বিপণি ছশোর মত প্রায়৷ এর ওপরে লিটল ম্যাগাজিনের হাট৷ পনেরো কোটি টাকার বই বিক্রি হয়েছে৷ মিলন মেলাটা চালু হলে কেমন হবে সেটাই দেখবার৷ তবে যেটুকু আছে সেখানে অব্যবস্থাও যে খুব আছে তা নয়, এইজন্যেই বলছি কারণ এখানে জননিয়ন্ত্রণের জন্য পুলিশমানুষ ওদেশের অনুপাতে নিতান্তই কম এবং সেদিক থেকে আমাদের জনসংখ্যা বাঁধনহারা৷

সবচেয়ে যে অভাবটা বিশেষ ক’রে চোখে পড়ে তা হল পশ্চিমবঙ্গের বাংলা সাহিত্যে পুস্তক সম্পাদনা-র কোনও কাহিনী নেই৷ এই কাজে ও-বাংলাও যেখানে, এ-বাংলাও প্রায় সেইখানেই৷ সম্পাদনা মানে কিন্তু প্রুফ রিডিং নয়৷ সাহিত্যের একটি ফসল ক্রেতার হাতে তুলে দেবার আগে তাকে বেশ ভাল ক’রে ঘষা মাজা করা, তার বিষয়ের স্বচ্ছতা, গভীরতা অটুট রাখবার ব্যবস্থা করা, পুনরুক্তি বর্জন করা, অস্পষ্টতা পরিহার করা, পাদটীকা থাকলে তাকে দ্বিতীয় বার খুঁটিয়ে দেখা, না থাকলে প্রয়োজনবশে লেখককে তাগাদা দেওয়া, ভাষা লক্ষ্যমুখ কিনা দেখা, লেখকের শৈলী সংরক্ষণ, আর এইসবের জন্যে যে মানুষটির অচঞ্চল সাধনা বইয়ের সাফল্যের পিছনে কাজ করবে, তাঁর নিয়োগের ব্যবস্থাপনা করা৷ ‘সম্পাদনা’ বা ‘এডিটিং’ বইটিকে যে কতখানি উচ্চতায় পৌঁছে  দিতে পারে, তা আমি ইউরোপে ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকেই জানি৷ যেহেতু আমরা বাঙালী, তাই বাংলা লেখাটা এমন কি ব্যাপার, এই কথা ভেবে তার গুরুত্ব কম রাখবার কোনও মানে নেই৷ বাংলা ভাষার সাহিত্য মানে চাট্টিখানি কথা নয়৷ গল্প উপন্যাস ও কবিতার দিক থেকে বাংলা পৃথিবীর শ্রেষ্ঠতম ভাষামাধ্যমের মধ্যে একটি তো বটেই৷ কবিতার কথা এলে আমি তো বলব যেন আরও বেশী৷ এপার এবং ওপারের বাঙালীর কবিতার যে মান তা তো পৃথিবীর অনেক ভাষার সাহিত্যকেই ম্লান করে দেবে!

এইখানে যে কথাটা অপ্রতিরোধ্যের মত এসে হাজির হয় তা হল আমাদের সাহিত্যে অনুবাদের  অপ্রতুলতা৷ এত ভাল মানের কবিতা, গল্প, উপন্যাস – অথচ তার জন্য কোনও বারোয়ারী অঙ্গন নেই, যা থাকলে অন্যান্য ভাষাভাষীরাও তার স্বাদ নিতে পারতেন৷  বাংলাদেশ এই দিক দিয়ে অনেক অগ্রসর, কারণ তাঁরা অন্তত ইংরেজী (বা কিছু ক্ষেত্রে অন্যতর ভাষা থেকে) থেকে প্রভূত বাংলা অনুবাদ ইতিমধ্যেই সেরে ফেলেছেন৷ কিন্তু ইংরেজীতে বাংলা সাহিত্যের অনুবাদ ওখানেও যেমন নেই, এখানেও প্রায় তথৈবচ৷ শুধু যে ইংরেজীর কথা বলব তা নয়, ভারতের অন্যান্য বহু ভাষা থেকে অনুবাদ ও বহু ভাষায় বাংলা সাহিত্যের অনুবাদ এখনও অসূর্যম্পশ্যা হয়ে দাঁড়িয়ে আছে৷ বইমেলার ভাবনা এইখানেই মস্ত বড় একটা বাঁক নিতে পারত৷ বইমেলার কর্তাব্যক্তিরা এইরকম সচেতনতা সৃষ্টির কারক হতে পারতেন৷ কিন্তু সে আশা দূরাশা মাত্র৷

অনুবাদ মানেই একটা ক’রে দিলাম হয়ে গেল তা নয়৷ তার প্রক্রিয়া বহুশাখ৷ অনুবাদ প্রতিটি শব্দ ও লাইনানুগ এবং তা অসীম নিষ্ঠা, শিক্ষা ও প্রতিভার উপর নির্ভর করে৷

আমি ফ্রাংকফুর্ট বা লাইপৎসিগ বা অন্যান্য বিদেশী বইমেলার সঙ্গে তুলনা করছি না৷ অনুবাদকর্মের পরিমাণ তো সেখানে সাগরতুল্য৷ বলছি অনুবাদের প্রকাশন  ব্যবস্থা প্রাণিত করবার জন্য যে ‘বুস্টিং’-রূপী কার্য দরকার হয়, এই বইমেলায়  তার ধারে কাছে কিছু নেই৷ ফ্রাংকফুর্ট বইমেলায় অনুবাদকদের রীতিমত নিজস্ব একটা সুবিশাল হল আছে, গতবার ৩০ জন বিভিন্ন ভাষার অনুবাদককে ওঁরা এনেছিলেন৷ কিভাবে অনুবাদক অনুবাদ করেন, প্রতি মুহূর্তে সেই কাজ দেখানোর প্রক্রিয়া চলছে সরাসরি৷ অর্থাৎ অনুবাদক অনুবাদ করছেন ‘জীবন্তভাবে’  (‘লাইভ’) এবং সেটা সকলে বড় পর্দায় দেখতে পাচ্ছেন৷ অনুবাদের স্বত্ব বিক্রি  হচ্ছে প্রতিদিন৷ অনুবাদের কর্মশালা বসছে৷ অনুবাদ পরিষৎগুলি এখানে এসে অনুবাদ প্রসঙ্গে তাঁদের বক্তব্য জানাচ্ছেন, বিভিন্ন জলপানি দেবার প্রকল্পের কথা আসছে, স্বত্ব কেনাবেচা হচ্ছে - এই কেনাবেচাটা অবশ্য সঠিক বিপণিগুলিতে৷ আমাদের দেশে তো স্বত্ব নিয়ে এত ঝামেলা নেই৷ মেরে ছাপিয়ে দিলেই হল, আর অনুবাদককে বঞ্চিত করা সে আর কি এমন ব্যাপার? তেমন হলে অনুবাদক হিসাবে তার নামটা না ছাপানো হতে পারে৷ কথায় কথায় মামলা করবার ক্ষমতা অনুবাদকের কই? মূল বইয়ের প্রকাশকই বা এসব খবর পাবেন কি ক’রে যে তিনি মামলা করবেন?

এইজন্যে বলছি কারণ অনুবাদ কর্ম সম্প্রসারিত হলে দেশই উপকৃত হয়৷ বিদেশের সঙ্গে যোগাযোগ সুদৃঢ় হয়৷ ফুটবল আর ক্রিকেট ‘পাবলিক’ খুব খায়  ব’লে সেটাই কিন্তু মানুষে মানুষে সমন্বয় সাধনের প্রকৃত জায়গা নয়৷ সাহিত্য শিল্প মানুষের মন ও সংস্কৃতির খুব গভীরে প্রবেশ করে৷ তবে সব দেশের মানুষই ক্রমশ শিক্ষিত হয়ে উঠছেন ব’লে তাঁদের সঙ্গে যোগোযোগের বাণী কিন্তু সাহিত্যের এই অনুবাদের মাধ্যমেই সার্থকভাবে রূপায়িত হয়৷

বইমেলা অনুবাদ সচেতনতার অনুঘটক হতে পারত৷ হয়নি৷ এ দেশ ভারি আজব জায়গা৷ এখানে একটা অনুবাদ কোনও দ্বিতীয় ভাষার মাধ্যম থেকে হলেও সরকারী পুরস্কার পায়৷

অন্ধের কিবা দিন কিবা রাত্রি!

যা বলতে চাইলাম, তার মধ্যে আরও একটা কথা বোধ হয় যোগ করা দরকার৷ এখানে কিছু খাবারের স্টল থাকে, ভীড় উপছে পড়ে সেখানে৷ বইয়ের স্টলেও ভীড় আছে৷ কিন্তু খাবারের স্টলের সামনে গিয়ে লোকে তবু হাত উপুড় ক’রে খায়, বইয়ের দোকানে গিয়ে হাত উপুড় করে না৷

হয়তো শীতের দিনে চিড়িয়াখানায় না গিয়ে লোকে বইমেলাতেই এসেছিল!

তাই আমার কথার একটা ছোট নির্যাস হয়তো খুব বেদনা নিয়েই বেরিয়ে আসছে যে, বইমেলার প্রভাব আমাদের সমাজের গভীরে খুব পড়েনি৷

এবারকার বইমেলায় যাওয়ার সময় সেই বেদনাভার নিয়েই যাওয়া৷ তার সঙ্গে দেশে নতুন নাগরিকত্ব আইন চালু করবার হুঙ্কারে মানুষের মন খুবই অবসাদগ্রস্ত ছিল৷ প্রতিবাদ করতে গিয়ে কিছু মানুষের উপর পুলিশী অত্যাচারও হল৷ তিক্ততায় ভরে গেল মন৷ এটা নতুন অভিজ্ঞতা, এমনটি আগে কখনও হয়নি৷ বইমেলার প্রভাব সমাজের ওপর কি হতে পারত তার কথাই ভেবেছিলাম৷ এবার দেখলাম গোটা সমাজের বেদনাহত মনের প্রভাব বইমেলার ওপর কিভাবে এসে পড়ছে৷ সমাজ সংসার ছারখার ক’রে দেবার তালিবানী শাসন যদি এ বছর এপ্রিল থেকে শুরু হয়, তাহলে পরের বারকার বইমেলাটা হবে তো?






0 কমেন্টস্:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন