কালিমাটি অনলাইন

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

বুধবার, ২৬ ফেব্রুয়ারী, ২০২০

পাপড়ি গুহ নিয়োগী




আবেগের আর এক নাম ‘কলকাতা বইমেলা’ 





শিক্ষাই জাতির মেরুদন্ড। সুশিক্ষিত জাতিই পারে  একটি  দেশকে উন্নতির শিখরে পৌঁছে দিতে কিন্তু এই শিক্ষা এমনি এমনি আসে না। তারজন্য প্রয়োজন একটি সুদীর্ঘ ইতিহাস এবং তার নিয়মিত অধ্যয়ন। এই অধ্যয়নের জন্য বই একটি অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম। বইমেলা বাঙালির প্রাণের মেলা।

মেলার আক্ষরিক অর্থ মিলন। মেলায় একে অন্যের সঙ্গে ভাব বিনিময় হয়  কিন্তু পৃথিবীতে যত মেলা হতে পারে তার মাঝে সবচেয়ে ভালো লাগার মেলা হচ্ছে   বইমেলা আর সেটা যদি কলকাতা বইমেলার মতো আন্তর্জাতিক বইমেলা হয়, আনন্দের বহর বারে দ্বিগুণ।

১৯৭২ সালে নতুন দিল্লিতে আয়োজিত বিশ্ব বইমেলা ছিল কলকাতা বইমেলার আদি অণুপ্রেরণা। ১৯৭৪ সালে ন্যাশানাল বুক ট্রাস্ট (এনবিটি) কলকাতার অ্যাকাডেমি অফ ফাইন আর্টসে একটি জাতীয় বইমেলার আয়োজন করে এই বইমেলায় বাংলা বই বিক্রির সাফল্যে কলকাতার পাঠক সম্পর্কে এন বি টির ধারণা পরিবর্তিত হয়। এরপরই ১৯৭৫ সালে কলকাতার চোদ্দোটি প্রকাশক ও পুস্তক বিক্রেতা সংস্থাকে নিয়ে বিমল ধরের উদ্যোগে গঠিত হয় পাবলিশার্স অ্যান্ড বুক সেলার্স গিল্ড  এই সংস্থা প্রতিষ্ঠার মূল উদ্দেশ্য ছিল কলকাতায় বার্ষিক বইমেলার আয়োজন। বিমল ধরের সঙ্গে ছিলেন এম. সি. সরকার অ্যান্ড সন্স সংস্থার সুপ্রিয় সরকার, দাশগুপ্ত অ্যান্ড কোম্পানির প্রবীর দাশগুপ্ত, সাংবাদিক অতীন রায়, জিজ্ঞাসা প্রকাশনের প্রতিষ্ঠাতা শ্রীশকুমার কুণ্ডা ও সুশীল মুখোপাধ্যায় প্রমুখ বিশিষ্ট ব্যক্তিগণ প্রথমে এই সংস্থার নাম  ছিল ‘পাবলিশার্স গিল্ড’ কিন্তু গিল্ড সংবিধান তৈরি হওয়ার পর সংস্থার নাম বদলে রাখা হয় ‘পাবলিশার্স অ্যান্ড বুকসেলার্স গিল্ড’ সুশীল মুখোপাধ্যায় গিল্ডের প্রতিষ্ঠাতা-সভাপতি নির্বাচিত হন। ১৯৭৫ সালেই কলকাতা তথ্যকেন্দ্রে গিল্ড ‘ওয়ার্ল্ড অফ পেপার ব্যাকস’ নামে একটি বইসংক্রান্ত প্রদর্শনীর আয়োজন করে। এরপরই শুরু হয় কলকাতা বইমেলার চিন্তাভাবনা। সর্বভারতীয় প্রকাশক ও পুস্তক বিক্রেতাদের কথা মাথায় রেখে কলকাতা বইমেলার পোশাকি নামকরণ হয় ‘কলিকাতা পুস্তকমেলা’ বা ইংরেজিতে ‘ক্যালকাটা বুক ফেয়ার’ ১৯৭৬ সালে প্রথম কলকাতা বইমেলার আয়োজন করা হয়। ১৯৭৬ সালে প্রবর্তিত এই বইমেলা ১৯৮৪ সালে আন্তর্জাতিক বইমেলার স্বীকৃতি অর্জন করে। ১৯৭৬ সালের ৫ মার্চ প্রথম কলিকাতা পুস্তকমেলা আয়োজিত হ মেলা চলেছিল ১৪ মার্চ অবধি। সেন্ট পলস ক্যাথিড্রাল বিড়লা তারামণ্ডলের উলটো দিকের মাঠে  (বর্তমানে মোহরকুঞ্জ  উদ্যানে) এই মেলা আয়োজিত হয়েছিল।

কলকাতা আন্তর্জাতিক বইমেলা ২০২০ এবারে ৪৪তম বর্ষে পা রাখল। সল্টলেকের সেন্ট্রাল পার্ক মেলা গ্রাউন্ডে এই মেলা শুরু হ  জানুয়ারি এবং চলে ৯ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত। খোলা ছিল বেলা ১২টা থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত। এবারের  মেলার থিম কান্ট্রি রাশিয়া। মেলা উদ্বোধন করেন  মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। প্রতি বছরের মত এবছর বইমেলাকে কেন্দ্র করে কড়া নিরাপত্তা ব্যবস্থা করা হয়েছে। একইসঙ্গে পরিচ্ছন্নতাকেও বিশেষ করে সামনের সারিতেই রাখা হয়েছে। মেলা প্রাঙ্গণে রাস্তার দু’পাশে প্রচুর জলের পাউচের ব্যাবস্থা করা  হয়েছে। অতিরিক্ত বাস ট্রেন চলেছে ছিল উন্নত মানের শৌচালয় ব্যবস্থা। মেলায়  ছিল উৎসবমুখর পরিবেশ কেউ অসুস্থ হলে ছিল প্রাথমিক চিকিৎসার ব্যবস্থা। তবে এত কিছুর পরও চোখে পড়েনি কোনও ওষুধের দোকান। মেলায় আগত  প্রচুর মহিলাদের জন্য ছিল না কোনও স্যানিটারী ন্যাপকিনের ব্যবস্থা।

বাংলা সাহিত্যের আঁতুড়ঘর লিটল ম্যাগাজিন লিটল ম্যাগাজিনকে কেন্দ্র করে নানা সময় গড়ে উঠেছে সাহিত্য আন্দোলন। এবারের লিটল ম্যাগাজিন  প্যাভিলিয়ন  করা হয়েছে কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের নামে। প্রতি বছরই লিটল ম্যাগাজিনের জন্য আলাদা জায়গা বরাদ্দ থাকে। প্রায় ২০০টি লিটিল ম্যাগাজিন নিয়ে এবারের  লিটিল ম্যাগাজিন প্যাভিলিয়ন তৈরি হয়েছে। লিটিল ম্যাগাজিন
প্যাভিলিয়ন আক্ষরিক অর্থেই হয়ে ওঠে এক মিলন ক্ষেত্র।  বিচিত্র  সব 
মানুষজন বিচিত্র পরিবেশ শেষ নেই বৈচিত্র্যের

তবে স্মৃতি এক গভীর সঞ্চয় ছোটবেলার কথা মনে পড়ে যায়। মামা অরুণেশ  ঘোষের হাত ধরে ১৯৮৪/৮৫ নাগাদ প্রথম কলকাতা বইমেলায় যাওয়া। বইয়ের প্রতি ভালবাসা আসলে ছোটবেলা থেকেই  তৈরী হয় শিশুদের বইমুখী করে তোলার পেছনে সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা থাকে বাবা মায়ের। এখনকার শিশুরা বেশীরভাগ সময় ব্যস্ত থাকছে মোবাইলে গেম খেলতে বা কার্টুন দেখতে। এতে তাদের প্রধানত দুই ধরনের ক্ষতি হয়। প্রথমত দৃষ্টিশক্তি কমে যায়। দ্বিতীয়ত এক জায়গায় দীর্ঘক্ষণ বসে থাকার ফলে শরীরের ওজন বেড়ে যায়, ক্ষিদে কমে যায়, মস্তিকের বিকাশের হারও কমে। এরচেয়ে বই পড়ার অভ্যাস অনেক ভাল। শরীরের ক্ষতির পরিমাণ কমে। মস্তিস্কের সুষম বিকাশ ঘটে। বই আদতেই এক নস্টালজিয়া। এখন যতই ই-বুক বা ব্লগ থাকুক না কেন, পাতা উল্টে বই-এর গন্ধ নিতে নিতে বই পড়ার একটা আলাদা মজা  আছে। অলস সময়ে বুকের ওপর বই রেখে ঘুমানোও একটা সুখানুভূতি। আমাদের ছোটবেলায় বইমেলা ছিল বই কেনার একমাত্র জায়গা। স্কুল থেকেও বইমেলায় নিয়ে যেত। খুব বেশি বই কেনার উপায় ছিল না, তাই আমরা বইয়ের  স্টলের সামনে দাঁড়িয়ে অনেক বই পড়ে ফেলতাম। বইমেলায় থাকত বহু দেশি-বিদেশী বইয়ের স্টল নতুন বইয়ের গন্ধ। আর নতুন বই কিনে লেখকের কাজ থেকে অটোগ্রাফ একটি বাড়তি পাওনা।

ইন্টারনেটের এই যুগে, স্মার্টফোন নির্ভর প্রজন্মের কাছ থেকে ক্রমাগত হারিয়ে যেতে বসেছে বই-এর প্রয়োজনীয়তা। বিভিন্ন সোস্যাল নেটওয়র্কিং সাইটের  জনপ্রিয়তা একটা চ্যালেঞ্জ এনে দিয়েছে বই-এর সামনে। ক্রমশই জনপ্রিয়তা বাড়ছে বিভিন্ন ব্লগগুলোর। ই-বুক পড়ার প্রবণতাও বাড়ছে দিন দিন তাই এই  আধুনিক প্রজন্মকে বইমুখী করে তুলতে বইমেলার প্রয়োজনীয়তা অপরিসীম।


0 কমেন্টস্:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন