এমিল নেলিগান বা অপরাহ্ণ
আমার বেড়ে ওঠা গোপালগঞ্জের গোয়ালবাথানে, একটা খ্রিস্টান মিশনারী আশ্রমে। মিশনারী স্কুলে ফাইভে পড়ার সময় ফাদার গিলবার্ট একদিন আমাকে ডেকে সব কিছু বলেন। রেজিস্ট্রার খাতা অনুযায়ী আমার জন্ম তারিখ ২৯শে
ফেব্রয়ারী। ফাদার জানান যে, জনৈক জেলেনী আমাকে এক ঝড়ের রাতে এই আশ্রমে
রেখে যান। আমার ব্যাপ্টিজম হয় এক ছোট্ট অনুষ্ঠানের মাধ্যমে।
আমার বাবার নাম লেখা হয় শেখ মুজিবর রহমান। জাতির পিতা
বঙ্গবন্ধু যখন ঘোষণা দিলেন : আজ থেকে বাংলাদেশে সব অনাথ শিশুর পিতার নাম যেন তাঁর নামে রাখা হয়, ফাদার গিলবার্ট সেই ঘোষণা স্মরণ করে আমাকে বঙ্গবন্ধুর পুত্র বানিয়ে অসীম মমতার কাজটা করলেন।
আশ্রমের নিয়ম কানুন খুব কড়া। দ্য সেভেনথ ডে এডভেন্টিস্ট (The seventh-day Adventist) বিশ্বাসী খ্রিস্টান সম্প্রদায় আমরা। শনিবার সকালে চার্চে গিয়ে চোখ বুজে প্রার্থনা করি।
And the dragon was wroth with the woman, and went to
make war with the remnant of her
seed, which keep the commandments of God, and have the testimony of Jesus
Christ.
কানাডার মন্ট্রিয়ল শহরের এক দম্পতি একবার গোপালগঞ্জ
বেড়াতে গিয়ে আমাদের আশ্রমে আসলেন। সারাদিন আমাদের সাথে কাটালেন, গল্প করলেন, ছবি
তুললেন। সন্ধ্যায় যাবার সময় আমি নাকি ভদ্র মহিলার হাত শক্ত করে ধরে রেখেছিলাম, কিছুতেই
যেতে দিচ্ছি্লাম না।
ফরাসী ভাষী দম্পতি আবেগাপ্লুত হয়ে পড়লেন। কানাডা ফিরে
গিয়ে আমাকে দত্তক নেবার আবেদন করলেন। আমি এই দম্পতির সাথে মন্ট্রিয়ল চলে এলাম। এই দম্পতির আরও দুটো
ছেলেমেয়ে ছিল। সমস্যা দেখা দিল আমাকে নিয়ে। কোনো ভাবেই
আমার কথা ফুটছিল না, সারাদিন নাকি বোবার মতো আমার নতুন
মায়ের হাত ধরে থাকি, কথা নেই।
শিশু বিশেষজ্ঞ’র
কাছে আমাকে নিয়ে যাওয়া হলো, থেরাপিস্টের কাছে নিয়ে যাওয়া
হলো। সব ঠিক আছে, তবু আমি কথা বলি না, ভাষা শিখছি না। আমার পালক বাবা মায়ের মন খুব খারাপ।
যখন আমার বয়স আট বছর, হঠাৎ আমি কথা বলতে শুরু করি। সাধারণত: ছোটরা কথা
বলে একটা দুটো আধো শব্দ বলে বলে। আমি আচমকা পুরো বাক্য বলা শুরু করলাম এক সাথে।
মা বাবা আমার নাম রাখেন এমিল নেলিগান। ক্যুইবেকের এক বিখ্যাত কবির নামে নাম। আমাদের শহরে তুষার পড়ে কার্ণিশে কার্ণিশে। আমি মাথা ঝুঁকিয়ে কবিতা লিখতে শুরু করি।
The former chapel is closed, and I repressed in
discrete steps slabs sounding regrets from a
perfumed era...
পড়াশোনায় কখনো ভালো ছিলাম না আমি, তবু কলেজ শেষ করি
কোনো রকমে। শরতের খুব সুন্দর এক সকালে এক সড়ক দুর্ঘটনায় আমার বাবা ও মা দুজনেই
মারা যান। আমার সিজোফ্রেনিয়া রোগ ধরা পড়ে। জানালার কাচে, বাজারের বিলে, আমার গার্লফ্রেন্ডের খোলা পিঠে আমি বেশুমার কবিতা লিখি।
শরীর খুব খারাপ হলে আমাকে ডগলাস মানসিক হাসপাতালে আবার
ভর্তি করে দেওয়া হয়।
আমি আবার বাংলাদেশ চলে আসি। গোপালগঞ্জে এসে আমার জন্মদাত্রী মাকে খুঁজতে
শুরু করি। প্রথম আলোতে আমাকে নিয়ে একটা সচিত্র প্রতিবেদন ছাপা হলে আমার জন্মদাত্রী মাকে পেয়ে যাই অলৌকিক ইস্টিমারে সে এক আশ্চর্য
জলটুঙ্গী!
পরশু থেকে আমি মাধবপুর চা বাগানে। আমার মা এখানকার চা বাগানের শ্রমিক। একটা প্রায় অন্ধকার
খুপড়িতে থাকেন। সন্ধ্যা হলে মদ খান আর বিড়বিড় করতে করতে কী যেন বলেন। আমি অনেক
কিছুই বুঝি না। টের পাই, আমার সিজোফ্রেনিক অ্যাটাকের লক্ষণ।
ঘুম লোপ পেতে শুরু করে, আমি কলকল করে ফরাসী ভাষায় কবিতা পড়তে শুরু করি মাধবপুরের চাঁদপানা
সবুজ বনভূমিতে। হ্যালুসিনেশন শুরু হবার আগেই এপিভাল, ক্লোজারিল
খেতে শুরু করি।
জলটুঙ্গীর মতো চাঁদ নেমে আসে আমার হাতের নাগালে। তাকিয়ে দেখতে পাই, কী অমল কাকাতুয়া সুন্দর জ্যোৎস্নার ঢল! ঢালু
পাহাড়ের ঢালের পাশে চা পাতার শীর্ষে চকচকে
আধুলির মতো আলো! চোখ ভিজে যায়। আমার কুলি-মা আমাকে খুঁজতে বেরিয়ে পড়েন। আমি শুনতে পাই তাঁর নেশা ভরা উৎকন্ঠিত ডাক। সুর করে ডাকছেন—
: হেই এমিল! হেই নিলিগান... কুনঠি
গেছিস? সাপে কামড়াবেক... অই শুনছিস... এ কীসের শব্দ? বল
দিনি...
আমি চা গাছের ডাল ধরে কাঁদতে থাকি একাকী। বিড়বিড় করে
বলতে থাকি—
: মা, ও মা! আমি এমিল না! আমি তোমার
অপরাহ্ণ...
গল্পটা আগেও পড়েছি । তখনো মনটা আন্দোলিত করেছিল ঠিক যেমন করে এবারো করলো । কিছু গল্প থাকে যা কখনো পুরোনো হয় না । প্রতিবার কিছু অতৃপ্ত সুধা রেখে যায়, নতুন করে অশ্রু ফোটায় ! এখানেই একজন সাহিত্যিকের সার্থকতা । পাঠককে টেনে নিয়ে যেতে পারে তার নিজের ভূবনে । মিশিয়ে দিতে পারে আপন সুধায় । অ্ভিনন্দন এক রাশ এবং আগামী সকল দিনের শুভকামনা রেখে গেলাম এই অসাধারণ গল্পটার রেশের সাথে ।
উত্তরমুছুন