বিদর্ভ’র স্বেচ্ছানির্বাসিত
কবি সুকুমার চৌধুরী
(১)
প্রিয় সুকুমার, তোমার সাথে তো বেশ অনেকবার দেখা হয়েছে, কথা হয়েছে, তোমার লেখা বই বা সম্পাদিত ‘খনন’ পত্রিকাগুলো পড়েছি; কিন্তু আফশোস এসে রয়ে গেলো তোমাকে যতটা চেনা বা বোঝা উচিত ছিল, সত্যি বলছি তোমাকে ততটা চিনে বা বুঝে উঠতে পারিনি! এটা আমার বা আমাদের সীমাবদ্ধতা!
আমি বেশ কয়েকবার নাগপুরে গেছি, চাকুরী সংক্রান্ত কাজ বা পারিবারিক প্রয়োজনে। তুমিও ভিলাই এসেছো বেশ কয়েকবার। সেই তো এলে ২০১৮র অক্টোবরে – ভিলাই বঙ্গীয় সাহিত্য সংস্থার বিশেষ অনুষ্ঠানে। নাগপুর থেকে ট্রেনে সকালের দিকে দুর্গ স্টেশনে নামলে, সারারাত প্রায় জাগা, তেমন ঘুমটুম হয়নি। স্টেশন থেকে তোমাকে নিয়ে এলাম আমার বাড়িতে। চানটান করে একটু ফ্রেস হলে। জলখাবার, তারপরে সামান্য আড্ডা। ফোন এসেছে অনুষ্ঠান শুরু হবে – বিবেকানন্দ ভবনে যেতে হবে। ভিলাই বঙ্গীয় সাহিত্য সংস্থার সেই অনুষ্ঠানে সারাটা দিন আমাদের সাথে কাটালে। সমস্ত দিনের অনুষ্ঠানে একটা পর্বের অধ্যক্ষতা করলে, জামশেদপু্রের ‘কালিমাটি’ সম্পাদক কাজল সেনও এসেছিলো। অনুষ্ঠান শেষ হলো, সেদিনে তোমার ভিলাই থাকাটাকে আর দীর্ঘায়িত করা গেলো না। রাতের ট্রেনেই আবার নাগপুর রওনা দিলে। যাবার আগে বলেছিলাম – দেখা হবে; কিন্তু সেদিন কি জানতাম, এটাই শেষ দেখা!
আমাদের পরিচয় তো কম দিনের নয়। আটের দশকের মাঝামাঝি বা শেষ দিকের কথা। নাগপুরে গিয়ে দেখা করলাম। আড্ডা হলো। তখন নাগপুরে তোমরা ‘খনন’ পত্রিকাকে ঘিরে একটা ছোটখাটো দল তৈরী করে ফেলেছো। নবদ্বীপের সুব্রত পাল ছিল, আরো অনেকেই ছিলো। এরপরেও ভিলাই থেকে নাগপুরে অনেকবার গেছি। জয়ন্ত ভট্টাচার্যদা, ডাক্তার কৌশিক চট্টোপাধ্যায় - তোমাদের কফিহাউজ ছিলো, রাস্তায় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে আড্ডা ছিলো! ভিলাই থেকে গেলে তোমাদের দিনগুলোকে কলকাতা কলকাতা মনে হতো। ‘খনন’কে ঘিরে এই আয়োজন, তার পেছনে তোমার ছিল বিশাল অবদান। খুব আন্তরিক ছিল সেসব দিন।
১৯৮৮-এ নাগপুর গেছি। তখন তুমি হাতে তুলে দিলে তোমার কাব্যগ্রন্থ ‘মানুষ হে’। কথাবার্তায় দারুণ মিষ্টভাষী। তুমি নিজেও নিকো কম্পানীর অফিসে ধোপদুরস্ত, প্রতিষ্ঠিত। কিন্তু বাইরে থেকে বোঝা যেত না – তোমার অতীতটাও মাটির সাথে গভীর ভাবে জড়ানো! ‘মানুষ হে’ বইটা পড়তে পড়তে চমকে উঠেছিলাম – অতীতের তোমার ঘর-ঘৃহস্থালী, দৈনন্দিন দারিদ্র, অপমানবোধ – এসব তো আমাদের অনেকেরই অতীত জীবনের কথা, আমি নিজেও তো এরকম একটা জীবন পিছনে ফেলে এসেছি!
১৯৮৯এ হাওড়ার কবিবন্ধু প্রশান্ত ভট্টাচার্যের উদ্যোগে আমাদের চোদ্দজন, জুনিয়র সিনিয়র, কবিদের নিয়ে প্রকাশিত হলো একটা কবিতা প্রচেষ্টা – ‘সময়ের পদাবলী’ কাব্যগ্রন্থ। সবার জন্যে বরাদ্দ এক ফর্মার কবিতা, এখানেও তোমাকে পেলাম। তোমার পর্বের নাম – ‘মায়ের বাপের বাড়ি’ – তোমার উনিশটা কবিতা, যা পেরিয়ে এসেছে তোমার শৈশব-কৈশোর, পুরুলিয়ার জল হাওয়ার গন্ধ মাখিয়ে!
আবার নাগপুরে গেলাম – ১৯৮৯তে। আড্ডা হলো; তুমি উপহার দিলে ‘মাংস ও মনীষা’ – তোমার কবিতা বই। তবুও বললাম না – তখনো তোমাকে ততোটা বুঝতে পারিনি। জানতাম না, বেশ কষ্ট আর দারিদ্রের মধ্যেই তোমার শৈশব-কৈশোরকাল কেটেছে!
ভিলাই থেকে নাগপুর, মোটামুটি ঘন্টা ছয়েকের জার্ণি। সেবার আমার মেয়ের কমপিটিটিভ পরীক্ষার সেন্টার নাগপুরে, তখনো সদলবলে তোমার সাথে আড্ডা। ফোনে কথাবার্তা হলেই আমার মেয়ে অনন্যার কথা জিজ্ঞেস করতে, কত না আত্মীয়তায় মাখা সে সম্পর্ক!
সুকুমার, আমাদের প্রতি তোমার কি কোনো গোপন অভিমান ছিলো? না কি তোমার স্বভাবটাই এমন চাপা? আমাকে, তোমার কাছের বন্ধুবান্ধবদেরও জানতে দাওনি, তুমি মারাত্মক অসুখে আক্রান্ত!
১৫ই আগষ্ট ২০২০, ইন্টারনেটে ‘দূরের খেয়া’র পক্ষ থেকে কবিতা উৎসব করছে বাপী চক্রবর্তী। তুমি কবিতা পড়তে পড়তে বললে – সবাইকে খুশী করবার বিপুল দায়িত্ব নিয়ে জন্মাইনি আমি এ পৃথিবীতে! সেদিন কবিতা পাঠরত তোমাকে আবার দেখলাম কম্পিউটর স্ক্রিনে, তোমার সাথে এর আগে দেখা হয়েছিলো ২০১৮র ভিলাইতে। মাত্র দুবছরের ব্যবধানে এ কী চেহারা হয়েছে তোমার? কোথায় তোমার সেই ফ্রেঞ্চকাট দাড়ি? তুমি বিছানায় বসে কবিতা পড়লে, সমস্ত শরীরটা একটা লাল কম্বলে মোড়া, মাথা জুড়ে একটাও চুল নেই! কবিতা পাঠের সময়ে তুমি জানালে, হাসপাতালে ছিলে; সেদিনই বাড়ি ফিরে কবিতা পড়ছো, তোমার আগামী কাব্যগ্রন্থের পান্ডুলিপি থেকে। তোমার কবিতাগুলো শুনলাম, ভালো লাগলো। কিন্তু সবার মনে প্রশ্নটা ঝুলেই রইলো, আমাদের পরিচিত সেই ফ্রেঞ্চকাট দাড়ি, স্মার্ট, সুপুরুষ সুকুমার কোথায় গেল? আমাকে দিল্লী বোম্বে থেকে কেউ কেউ ফোন করলো - সুকুমারদার কেন এমন চেহারা হয়েছে? আমিও পরদিন তোমাকে নাগপুরে ফোন করলাম। তুমি বললে, তেমন কিছু না। গাড়ি ধোয়ার সময়ে জলের বালতি ওঠাতে গিয়ে মেরুদন্ডে স্লিপ ডিস্ক জাতীয় কিছু সমস্যার কথা। তোমার যে ক্যান্সার হয়েছে, তা কি তখনো তুমি জানতে না? তুমি কি কেমো থেরাপি নিচ্ছিলে না? না কি সব জেনেও আমাদের কাছ থেকে সব কিছু লুকিয়ে রেখেছিলে? তোমার বন্ধুরা কষ্ট পাবে বলে! না কি তোমার শারীরিক রোগের যুদ্ধটুকু পরিবারের সহায়তায় তুমি নিজে নিজেই করে নিতে চেয়েছিলে? আসলে তুমি তো নানা কষ্টের মধ্য দিয়ে বড়ো হয়েছো, দেহের এসব রোগ যন্ত্রণার কষ্ট তোমার কাছে কিছুই না! এই ঘটনাটার পাঁচমাস পরেই তোমাকে দুনিয়া ছেড়ে চলে যেতে হলো – সেদিনটা ১৯শে জানুয়ারী ২০২১! অবিশ্বাস্য অকল্পনীয় ব্যাপার! খবরটা প্রথমে সোসাল মিডিয়াতে দেখলাম, আমাদেরই বন্ধু সুব্রত পালকে ফোন করলাম – ও জানালো খবরটা সত্যি, সুকুমার চৌধুরী আর নেই?
(২)
সুকুমার চৌধুরীর জন্ম ১৪ই জানুয়ারী ১৯৬২, পশ্চিমবঙ্গের পুরুলিয়া জেলাস্থ ঝালদা অঞ্চলের বলরামপুর গ্রামে। তার শৈশবও কেটেছে পাহাড়, নদী আর জঙ্গল ঘেরা ঝালদায়। অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে তাকে চলে আসতে হয়েছে বিদর্ভ অঞ্চলে নাগপুরে। এখানে এসে সে চেষ্টা করতে থাকে কী করে একটা বাংলা ম্যাগাজিন বের করা যায়। বহির্বঙ্গে বসে ব্যাপারটা সহজ সাধ্য ছিল না। ঘটনাচক্রে সঙ্গী হিসেবে সুকুমার পেয়ে যায় সুব্রত পালকে। এই দুজনের সম্পাদনায় ১৯৮৬তে প্রথম প্রকাশিত হয় ‘খনন’ পত্রিকাটি। এটা ছিল ওই অঞ্চলের প্রথম বাংলা লিটিল ম্যাগাজিন।
এই ‘খনন’ পত্রিকাকে ঘিরে নাগপুরে বাংলা সাহিত্য ও সংস্কৃতির পালে একটা নতুন উদ্দীপনার হাওয়া লাগে। সুকুমারের সাথে আরো অনেকেই ধীরে ধীরে সক্রিয় ভূমিকায় যোগ দেন। নাগপুরে চাকুরীর সূত্রে অনেকেই এসেছে, আবার নাগপুর ছেড়ে অনেকেই চলে গেছে। যেমন সুব্রত পাল ১৯৯০এ নবদ্বীপে ফিরে গেলে ‘খনন’এর সম্পাদনার সমগ্র দায়িত্ব সুকুমার চৌধুরীকেই নিতে হয়েছে। ২০১৯ পর্যন্ত এই পত্রিকাটি সুকুমার নিয়মিত বের করে গেছে, বছরে একটা বা দুটো করে সংখ্যা। করোনার কারণে ২০২০তে কোনো সংখ্যা বের করা যায়নি। আমৃত্যু সুকুমার চৌধুরীর সম্পাদনায় ‘খনন’ পত্রিকাটি বেরিয়ে এসেছে। আরো একটা উল্লেখযোগ্য বিষয়, নিয়মিতভাবে খননের যে আড্ডা বুলেটিন বের হতো, তার সম্পাদনা ঘুরিয়ে ফিরিয়ে অনেককেই নিতে হয়েছে। মূল বাংলায় প্রকাশিত ‘খনন’ পত্রিকায় থাকতো ইংরেজী সাপ্লিমেন্ট, যার জন্যে কিছু অবাঙালী বন্ধুবান্ধবও তারা সহযোগী হিসেবে পেয়ে গেছিলো। সঙ্গত কারণেই ‘খনন’ পত্রিকাটার পরিচিতি পশ্চিমবঙ্গ, ভারতের অন্যান্য প্রদেশ, বাংলাদেশ ও বিভিন্ন লিটিল ম্যাগাজিনের দরবারে পৌঁছে গেছিলো। আর এসবই সম্ভব হয়েছিল সুকুমারের পরিশ্রম, দক্ষ পরিচালনা ও বাংলার প্রতি তার একনিষ্ঠ ভালোবাসার কারণে। প্রসঙ্গত উল্লেখ করা যেতে পারে, ২০০৫ সালে জলপাইগুড়ি বইমেলায় ‘খনন’ পত্রিকাটা ভারতবর্ষের শ্রেষ্ঠ লিটিল ম্যাগাজিন হিসেবে ‘মুন্সি প্রেমচাঁদ পুরস্কার’ পাবার গৌরব অর্জন করে। কয়েক বছর আগেই সন্দীপ দত্তের কলিকাতা লিটিল ম্যাগাজিন লাইব্রেরী ও গবেষণা কেন্দ্র কর্তৃক ‘খনন’ বছরের শ্রেষ্ঠ লিটল ম্যাগাজিন হিসেবে পুরস্কৃত হয়।
সুকুমার চাকরী করতো নিকো কোম্পানীতে। এই চাকরীর সাথে সাথে সে অবিচ্ছিন্নভাবে চালিয়ে গেছে নিজস্ব সাহিত্য চর্চা ও লেখালেখি। ‘খনন’ পত্রিকার প্রকাশ আর নিজেদের ধারাবাহিক আড্ডা তো ছিলই। সুকুমার মূলত কবি, কাব্যগ্রন্থের তালিকা যথেষ্ট লম্বা। কবিতার সাথে সাথে কিছু গল্প ও গদ্যও লিখেছে। গল্প লেখার জন্যে ১৯৯৮তে সে পেয়েছিল ‘মায়ামেঘ’ পুরস্কার। তার বেশ কিছু কবিতা অন্যান্য ভাষায় অনূদিত হয়েছে। ইংরেজীতে অনূদিত কবিতা নিয়ে প্রকাশিত হয়েছে একটা বই – ‘Bohemian Songs’, সেটা ১৯৯৯এর কথা।
সুকুমার চৌধুরী আরো বেশ কিছু সম্মান ও পুরস্কারে ভূষিত হয়েছে। যেমন ১৯৯৭এ শ্রেষ্ঠ কবিতার জন্যে পেয়েছে ‘এখন কবিতা’ পুরস্কার, ২০০০ সালে শ্রেষ্ঠ সম্পাদনার জন্যে ‘মহাদিগন্ত পুরস্কার’। ২০০৫ সালে ‘সদ্ভাবনা পুরস্কার’, ২০১১ সালে বিশিষ্ট কবি ও সম্পাদক হিসেবে পে্যেছে ‘কল্যাণী হালদার মেমোরিয়াল অ্যাওয়ার্ড’।
সুকুমার খুব ভালো একজন শিল্পী। ‘খনন’-এর প্রথম সংখ্যার প্রচ্ছদ করেছিল সুকুমার নিজেই। এদিক ওদিকে ছড়িয়ে আচ্ছে তার বিভিন্ন শিল্প প্রচেষ্টা!
সুকুমারের প্রকাশিত বইগুলোর মধ্যে আছে - মানুষ হে (১৯৮৬), মাংস ও মনীষা (১৯৮৭), মায়ের বাপের বাড়ি (১৯৮৯/২০০৬), আমাদের পর্যটন (১৯৯৬), ছন্নমতির কুহু (১৯৯৭), লাল লীল হইলদা তিন দিকে ঝাইলদা (১৯৯৮), ফণিমনসার উলু (২০০০), লিবিডোর হাড়মালা (২০০০), পদ্য প্রতিবেশী (২০০১), গদ্য প্রতিবেশী (২০০২), রজনীর নীল (২০০৪), আমার কাটিয়ে ওঠা (২০০৪), আমার সনেট (২০১২), আমার লাগে না (২০১৩), পাউচ সভ্যতা (২০১৪), কবিতা পাঠ (দীপাবলী – ১৪২৪) ইত্যাদি।
অনেকেই বলে সুকুমার চূড়ান্ত বোহেমিয়ান। আমার মনে হয়, ওর অন্তরটা চূড়ান্ত ব্যবস্থিত ও সুস্থির। তা নইলে একটা প্রাইভেট অফিসের চাকুরী করে নিজের সুদীর্ঘ সাহিত্যকর্ম চালিয়ে যাওয়া, একটা সুন্দর পত্রিকা সম্পাদনা একজনের পক্ষে কী করে সম্ভব? নাগপুরের ওয়াড়ি লাভা রোডের কাছে নিজের বাড়ি। তার বাড়ির সামনের রাস্তাটার নাম ওদিককার পোষ্টম্যানেরা জানে – ‘খনন সরনি’ – নামটা সুকুমারেই দেয়া। কিন্তু মৃত্যু বড়ো তাড়াতাড়ি ছিনিয়ে নিয়ে গেলো আমাদের বিদর্ভ পুরুষ সুকুমারকে। মৃত্যুকালে রেখে গেলো একটা শোকতপ্ত পরিবার - নিজের স্ত্রী, এক পুত্র আর একমাত্র কন্যা।
(৩)
সুকুমারের প্রথম কবিতার বই ‘মানুষ হে’, বইটা কতকাল আগে পড়েছি। বই-এর কিছু কিছু কবিতা আমার ছবির মতো মনে আছে। চোখ বুঝলেই দেখতে পাই কবিতায় লেখা দরিদ্র পরিবারের ছবি, তাদের জীবনযাপন! সুকুমারের পুরুলিয়ার প্রথম জীবনকে বুঝতে গেলে এই কবিতাগুলো অবশ্যই পড়া দরকার। ‘মানুষ হে’ কবিতার ভূমিকার পাতায় লেখা আছে –
‘অই
আমার উপবাসক্লিষ্ট মা মলিন বসন
তুলসীতলার
নীচে নতজানু সন্তর্পণে প্রদীপ জ্বালান
কল্যাণ
কামনা করেন আমাদের ... ’
কিশোর
কবির জীবনযাপনে কি এক নিদারুণ যুদ্ধ ছিল, তা সে লিখে রাখে ‘প্রতিদিন’ কবিতায় –
‘চোরের
মতো লুকিয়ে লুকিয়ে আমি
নিয়ে
আসতাম জিআরের ভাঙ্গা গম, খুদকুড়ো, বাজরার দানা...
...খালি
পকেটে হাত ঢুকিয়ে
আমার
ভীষণ লজ্জা করতো
ধিকিধিকি
আগুনের মতো বেড়ে উঠতো অপমানবোধ’
কিংবা তার ‘ধান’ কবিতা। যেখানে এক ধনী বন্ধুর সামনে কিশোর সুকুমারের জীবনযাপনের লজ্জা উঠে আসে, পুরো কবিতাটাই তুলে দিচ্ছি -
‘আর
একেকদিন হুট কোরে সুজয় এসে পড়তো
সে
ছিল এক জোতদারের ব্যাটা, সহজ সুন্দর আর বোকা সোকা
ভারী
বন্ধু ছিল আমার, আর আমাদের এই অসম বন্ধুত্বে
যাতে
চির না ধরে, তার জন্যে আমার মা
গিরিধারীর
দোকান থেকে ধার করে আনতেন বিস্কুট আর চানাচুর
আমার
দিদি ছেঁড়াখোঁড়া শাড়ি দিয়ে ঢেকে ফেলতো ঠোঙ্গার পাহাড়
আর
ভাইবোনদের লুব্দ্ধ দৃষ্টির সামনে বিস্কুট চিবুতে চিবুতে
সে
এক সময় বলে উঠতো:
ও
গুলো কী ঢেকে রেখেছিস রে? ধান নাকি?’
দেশের
রাজনৈতিক পরিবেশ সুকুমারের মনে ছাপ ফেলে! জানুয়ারী ১৯৮০তে লেখা তার কিছু কথা উঠে আসে
‘দিনলিপি’ কবিতায় –
‘ভোটের
আগুন ক্রমে নিভে আসে, দিকে দিকে ইন্দিরার জয়গান
ক্রমশঃ ভাবিয়ে তোলে শীতার্ত মানুষদের...’
কেউ কেউ বলতে পারে সংবাদ বা দিনলিপির বর্ণনা কাব্য নয়। তাদের এই সব শঙ্কাকে উড়িয়ে দিয়ে ‘মানুষ হে’ বইতে সুকুমার আমাদেরকে উপহার দেয় অসাধারণ সব কাব্যিক লাইন –
‘দীর্ঘসূত্রী
বিষাদের শেষ লগ্নে শুয়েছিল সুখ’ [ সুখ]
অথবা
‘যেন
সমুদ্র পাথার অই নীল চোখে ভেসে গ্যাছে আমার মনীষা’ [রুমা] ।
‘মাংস ও মনীষা’ সুকুমারের দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থ, তখন তার ভেতরে প্রথম যৌবনের কুহক আচ্ছন্নতা। তাই তার এই বই-এর বেশ কিছু কবিতায় খেলে বেড়ায় কামনা, প্রেম, যৌনভাবনা। কবি বুঝে নিতে চায় শরীর আর সম্মোহন। যেমন –
‘তার
মাংসল প্রতিভাখানি খেলে ভালো উধাও শাড়িতে’ [উত্তরণ]
অথবা
তার ‘শিল্পজ নীলা’ কবিতার কয়েকটি লাইন-
‘কামান্ধ
মাছির মতো সে চাইলো
চেটেপুটে
খেয়ে নিতে আলোর শরীর...
শ্বেতবর্ণ
যোনি ফেঁড়ে ফেঁড়ে প্রলয় ঝড়ের মতো ছুঁড়ে দেয় মায়াবী রোদ্দুর অহো
চেয়ে
দ্যাখো তেতোচোখ শিল্পজ নীলার ঐ নীল বিচ্ছুরণ
যোনিজ
আলোর ঐ বিস্ফোট অসুখে নীল মাছি মুহূর্তেই হয়ে গেল মুগ্ধ ময়ূরী’।
সুকুমার ‘ফেরাতে পারি না (একটি ভোর ও কৃষ্ণাকে)’ কবিতায় লেখে –
‘আমি
জানি
তুমি
তো স্বৈরিণী নও, বেশ্যা নও, খেলুড়ে রমণী নও দূর পৃথিবীর
তুমি
তোমাদের রুটি, লালপানি, বিলাসব্যাসন
অথচ
অনিবার্যতার কাছে তুমি হেরে যাও ক্রমাগত হেরে যেতে থাকো
আমি
তোমাকে ফেরাতে পারি না’
এবার আসি তার তার অন্য একটি কবিতাতে –
‘৭ই
জানুয়ারী, ১৯৮৫
ভিলাই-এ
এবারে স্বাতী নেই। শুধু
সোনালী
রোদ্দুর মাখা ঝুল বারান্দায় স্মৃতিহিম আলো।
গোলাপের
ডালে কেন ফেলে গেছ মাংস গন্ধ
কালো
ব্রেসিয়ার’ [উলঙ্গ ডায়েরী থেকে]।
কবি প্রেমের জন্যে উন্মাদ। সমুদ্রের মতো কোনো রমণীর উদ্দেশ্যে তার তীব্র উচ্চারণ প্রেমজ হাহাকারের মতোই তীব্র –
‘আমাকেও
নষ্ট করো এইবার, নাও
অসংকোচে
বলি ফের প্রকৃত যুবতী তুমি
একবার
দ্বিচারিণী হও,
শরীরের
সমগ্র জিহ্বায় তোলো স্বর, আমাকে আমূল
নাও,
নষ্ট করো, খাও
আর
অসংকোচে বলি আজ সাগর বালিকা তুমি
ওগো
ডুবজল, সন্ন্যাসে যাওয়ার আগে
শেষবার
তৃপ্ত হতে চাই [সমুদ্ররমণী]
সুকুমারের এক এক করে অনেকগুলো কবিতার বই বেরিয়েছে। ১৯৯৬এ প্রকাশিত ‘আমাদের পর্যটন’ কবিতার বইটি ও আমাকে উপহার দিয়েছিলো। এই বইটি পড়েছি। এখন আবার নতুন করে পড়ছি। সুকুমারকে যতটা পড়ছি ততই আচ্ছন্ন হয়ে পড়ছি! এই বই-এর কয়েকটা কবিতা পাঠকদের দরবারে তুলে দিতে চাই।
‘অন্ধকার
সিঁড়িতে থমকে রইলো অভিমান
আর
আমি ঘৃণার শেকল টেনে
লোভ
ও পাপের যত লঘুসিঁড়ি মাড়িয়ে মাড়িয়ে
নেমে
এলাম ঠান্ডা হিম শ্মশান ভূমিতে
যেখানে
চুল্লিচিতায় পোড়ে দাউ দাউ আমার পৌরুষ
আর
উঠে আসে পরিত্রাণ হোমধোঁয়
কান্না
ও কোরাস’ [ঈশ্বর হে]
অথবা
‘পাপড়ি খোলার মতো থরোথরো খুলছিল তার লজ্জা
মুহূর্ত
কি শুধুই অলীক তাকে মূল্য দিতে
পদ্মকোরকের
মতো খুলে গেলো দ্বিধাগ্রন্থি ব্রেসিয়ার আমূল সংস্কার! [সাবমেরিন]
অথবা
‘আমি বললাম শুদ্ধতার দিকে হেঁটে যাক
আমাদের
ছদ্মজীবন’ [ জীবন]
কিংবা
‘ওষ্ঠে বারুদগন্ধ চুলে রাত্রিজট
নিমন্ত্রণের
মতো উড়ছে আঁচল’ [পাপকল্প]
মাভূমি ঝালদাকে নিয়ে পুরুলিয়ার আঞ্চলিক ভাষায় লেখা সুকুমারের ‘লাল লীল হইলদা তিন দিকে ঝাইলদা’ প্রকাশিত হয় ১৯৯৮ সালে, প্রকাশ কর্মকার এই বইটির অলঙ্করণ করেছিলেন। বইটা সে সময় বেশ সাড়া জাগিয়েছে।
সুকুমারের লেখালেখি সময়ের সাথে সাথে তাল মিলিয়ে হাঁটে। ২০১৪তে প্রকাশিত ওর কাব্যগ্রন্থ ‘পাউচ সভ্যতা’। তাতে ও লিখছে-
‘পাউচ
সভ্যতা নিয়ে কোনদিন লেখা হবে স্যাশে কবিতা
খুব
দেরী নেই
রচনাবলীর
দিন শেষ হয়ে এলো’। [পাউচ সভ্যতা]
সত্যি তো আমাদের জীবন ভরে উঠেছে মাইক্রো চিপসে, শ্যাম্পু-টুথপেষ্ট-আচার কুরকুরে নীল কন্ডোমের যাবতীয় পাউচে! বিশাল বা ব্যাপকভাবে মানবীয় কিছু ভাববার দিন কি ধীরে ধীরে শেষ হয়ে আসছে?
‘চক্রান্ত’ কবিতায় দেখি কবির কি নিদারুণ পর্যবেক্ষণ –
‘চক্রান্তের
গন্ধ ভেসে আসে। নিষিদ্ধ
মাংসের
ঘ্রাণ, সুরা ও সিম্ফনি।
চক্রান্তের
গন্ধ ভেসে আসে। উষার
প্রতীক্ষা
করি। খুব দ্রোহহীন। কেন না
আমি
জানি
মধ্য
রাত্রের সমস্ত চিয়ার্স
সূর্যালোকে
ম্লান হয়ে যায়’।
কবিতা নিয়ে এই আলোচনা বা উল্লেখপর্ব শেষ করবার আগে আসি সুকুমারের ১৪২৮ দীপাবলীতে প্রকাশিত ‘কবিতাপাঠ’ গ্রন্থ থেকে দুটো লাইন তুলে দিতে চাই
‘একদিন আমারও আধার কার্ড আসে ক্যুরিয়ারে।
আর
আমিও হারিয়ে যাই আম জনতার মাঝে।’ [আধার কার্ড]
সামাজিক অবস্থার কারণে মানুষ কী করে তার নিজের বিশেষত্ব হারিয়ে ফেলে, মানুষ কীভাবে একটা মাত্র সংখ্যা দিয়ে নির্দিষ্ট হয়, একথা এখানে কবি খুব সুন্দর ভাবে সবাইকে বুঝিয়ে দেয়। এজন্যেই বলছি, বহির্বঙ্গে বসবাসকারী সুকুমার চৌধুরী সময়ের সাথে জুড়ে থাকা ভারতবর্ষের একজন বিশিষ্ট বাংলা ভাষাভাষী কবি প্রতিভা।
(৪)
সাধারণতঃ কবিকে আমরা খুঁজে নিই কবিতায়। তার লেখায়। আবার কাছের মানুষ হিসেবে যখন একটা আত্মীয়তা বোধ জাগে, তখন কবিকে আমরা খুঁজে নিতে চাই তার ব্যক্তিগত জীবনে। অংশুমালী আয়োজিত একটা ফেসবুক অনুষ্ঠানে কবি স্বপন রায়কে একটা সাক্ষাৎকার দিচ্ছিলো সুকুমার চৌধুরী, তারিখটা ২৩ সেপ্টেম্বর ২০২০। সেদিন কালো গোঁফ শার্ট প্যান্ট টুপি চশমাতে সুকুমারকে দেখতে মোটেই অসুস্থ লাগছিলো না; একমাস আগে আগস্ট ২০২০তে আমরা ওকে খুব অসুস্থ দেখেছিলাম। সেই সাক্ষাৎকারে সে খোলাখুলি সবাইকে জানিয়েছিল, বাংলার এক প্রত্যন্ত গ্রামীণ পরিবেশে তার বড় হওয়া, সে জানিয়েছে গ্রামে থাকতে লোকে তাকে ‘বোকাচোদা সুকু’ নয়তো ‘সুকা’ নামেই ডাকতো। পারিপার্শিক নানান অবস্থা, রাজনৈতিক দলাদলি, মফস্বলের কবি হিসেবে তাচ্ছিল্য প্রাপ্তি এসব কারণে সে মাত্র ১৮ বছর বয়সে গ্রাম ছেড়ে স্বেচ্ছায় নাগপুরে চলে আসে। সেখানেই বাকী পড়াশোনা, চাকরী, নিজের জীবনকে অন্যভাবে ঢেলে সাজানো। সেই থেকেই সুকুমারের স্থায়ী ঠিকানা নাগপুর। ১৯৮৬ সালে প্রথম শুরু হয় ‘খনন’ পত্রিকার প্রকাশ! সুকুমার চেয়েছিলো বাঙ্গালী, মারাঠী তথা অন্য অবাঙ্গালী ভাষীদের এক মেলবন্ধন! অংশুমালীর সেই অনুষ্ঠানটিতে আমি শ্রোতা হিসেবে উপস্থিত ছিলাম। সুকুমার তাতে ইঙ্গিতে জানিয়েছিলো তার শারীরিক অসুস্থতার কথা, সেদিনের প্রোগ্রামে ছিলো তার প্রাণোচ্ছ্বল উপস্থিতি, আমরা কেউই বুঝতে পারিনি, আগামী চারমাস বাদে সে আর ইহলোকে থাকবে না!
সুকুমার চৌধুরীর ছেলে রাহুল মৃত্যুর পর তার বাবাকে নিয়ে কিছু স্মৃতিচারণ করেছে ‘দূরের খেয়া’ পত্রিকার ২০২১-গ্রীষ্ম সংখ্যায়। তার থেকে কিছুটা জানতে পারি সুকুমারের মানসিকতা, তার শেষ দিনগুলোর বৃত্তান্ত! এখানে রাহুল চৌধুরীর দেয়া সামান্য কিছু বৃত্তান্ত তুলে দেয়া প্রাসঙ্গিক মনে করছি –
(ক) ‘আমার বাবা একই সাথে অসতর্ক ও যত্নবান ছিলেন। তিনি যে বিষয়গুলি গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করেছিলেন সেগুলি সম্পর্কে যত্নশীল ছিলেন। বাকী পৃথিবী তার কাছে কিছু যায় আসে না। তিনি সামাজিক চাপ বা বিষয়গুলি কীভাবে হওয়া উচিত সে সম্পর্কে কখনও ভাবেননি। তিনি খুব উদার ব্যক্তি ছিলেন।’
(খ) সুকুমারের শৈশবের দিনগুলোর কথা বলতে গিয়ে রাহুল মনে করিয়ে দিলো ‘আদালতের মামলায় জড়িয়ে থাকা ক্ষুধার্ত ভাইবোন ও করুণ পরিস্থিতিতে ভরা ঘরটি নিয়ে তার শৈশব কতটা ভয়াবহ ছিল তা স্পষ্টই প্রমাণিত হয়েছিল, যার অনেকটাই তার লেখায় পাওয়া যায়।’
(গ) মৃত্যু পরবর্তী সময়টির কথা স্মরণ করে, পরিবারের বাকী তিনজনের (সে নিজে, বোন আর মা) প্রসঙ্গ তুলে রাহুল তার বাবার সম্পর্কে লিখেছে - ‘তিনি আমাদের তিনজনকে কাঁদতে দেখে কাঁদছেন? তিনি যে জিনিষগুলি চেয়েছিলেন তা শেষ না করার জন্য অনুতাপ করছেন? তিনি দুইশত বই লিখতে চেয়েছিলেন, তিনি আমার বোনকে বিয়ে দিতে চেয়েছিলেন। তিনি অবসর নেওয়ার পরে বিশ্বভ্রমণ করতে চেয়েছিলেন। কে জানতো, এই ইচ্ছাগুলি ঘটবে না।’
(ঘ) ‘তিনি ছিলেন সর্বাধিক বাস্তববাদী, স্ট্রিট স্মার্ট, সুপ্রতিষ্ঠিত কবি, তার সহকর্মীদের মধ্যে শ্রদ্ধাশীল। তিনি প্রয়োজনে স্বজনদের অর্থ দিতেন। তিনি যত্নশীল ছিলেন।
তিনি ছিলেন সর্বশ্রেষ্ঠ বাবা। কখনও আমাদের কিছু করতে বাধা দেননি। তিনি আমাদের যা খুশি তা অনুসন্ধান করতে দিতেন। তিনি একজন সত্য শিল্পীর জীবনযাপন করেছিলেন। উক্তিটি প্রমাণ করার জন্যে তার কবিতা এবং স্কেচ সহ বইতে পূর্ণ একটি কক্ষ আছে।’
(ঙ) কেমোথেরাপি, স্লিপ ডিস্ক এসব অন্যান্য অসুস্থতার সাথে সুকুমার কোভিডে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি ছিল। হাসপাতালের ভেতরে অন্তিম দশায় বাবাকে দেখতে যাবার কথা বলতে গিয়ে রাহুল লিখেছে – ‘রাতে যখন ডাক্তার আমাদের হাসপাতালে আসতে বললেন, তখন আমি নিশ্চিত হয়েছিলাম যে বাবা বাসায় ফিরে আসবে না। আমার মনে আছে আমি গার্ডের সাথে লড়াই করেছিলাম এবং আইসিইউতে থাকা আমার বাবা সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করতে নিষিদ্ধ কোভিড ওয়ার্ডে প্রবেশ করেছিলাম।
তবে আমি এখনও আমার জীবনের সবচেয়ে ভয়ঙ্কর জিনিষটি দেখতে সেখানে গিয়েছিলাম। আমার বাবা একটি অস্বস্তিকর অবস্থানে শুয়েছিলেন। তার মুখটি সরাসরি ছাদের দিকে তাকিয়ে ছিল এবং তার হাত এবং পা তার বিছানা জুড়ে ছড়িয়ে পড়েছিল এবং আমি তার পেটের দিকে তাকালাম যা আর চলছিল না।
আমি
আমার মেজাজ হারিয়ে কাঁদতে লাগলাম। আমি রাত ৮টায় ফোনে তার সাথে কথা বললাম এবং এখন সে
চিরতরে চলে গেছে। ...’
তার পরিচিত পরিবৃত্তে ছিল বঙ্গ ও বিভিন্ন অঞ্চলের প্রচুর লেখক কবি শিল্পী ও সাহিত্যিক। কাকে ছেড়ে কার নাম বলবো। রবীন্দ্র গুহ, গৌতম দাশগুপ্ত, পুরুলিয়ার কবি বিপ্লব গঙ্গোপাধ্যায়, ভিলাই-এর শিবব্রত দেওয়ানজী (প্রয়াত), আন্দামানের অনাদিরঞ্জন বিশ্বাস, সন্দীপ দত্ত, সমীরণ ঘোষ, অলক বিশ্বাস এমনি অসংখ্য মানুষজন আর পত্রপত্রিকার গোষ্ঠী, না লিখে এ তালিকা শেষ করা যাবে না। মৃত্যুর পর এককালের বন্ধু ও প্রথম দিককার ‘খনন’ পত্রিকার যুগ্ম সম্পাদক সুব্রত পাল সুকুমার চৌধুরী সম্পর্কে লিখেছে – ‘ওর মৃত্যুর পর নাগপুরে বাঙালি সংস্কৃতির সেই জায়গাটা হারিয়ে গেল বলেই মনে হয়। যারা থাকলেন বা পরবর্তী কালেও যারা ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকবেন (খোদ পশ্চিমবঙ্গেই যেখানে বাঙালির অনীহা ও হিন্দি ভাষা সংস্কৃতির চাপে এখন ক্রমশ এসব চাপা পড়ার মুখে) তাদের কারও পক্ষে আর সকলকে গুছিয়ে গ্রন্থিবাঁধা সম্ভব হবে কিনা বলা মুশকিল। অবশ্য কালীবাড়ি থাকবে, দুর্গাপূজোও থাকবে একরকম। তবে সেখানে বাঙালিত্ব থাকবে কিনা সেটা আলাদা প্রশ্ন।’
প্রথমেই বলেছিলাম সুকুমারকে যতটা চেনা বা বোঝার দরকার ছিল, আমার মনে হয়েছে, ওকে আমরা অনেকেই ততটা চিনে বা বুঝে উঠতে পারিনি! তাই আমাদের বন্ধু সুকুমার চৌধুরীকে আরো বেশী করে আবিষ্কার ও অধ্যয়ন করার প্রয়োজন আছে। আপাতত আমার এই লেখাটার সমাপ্তি টানছি ওরই লেখা একটা এপিটাফ দিয়ে -
‘পৃথিবীর
ওপর শুইয়ে দিও আমার ঘুমন্ত মৃতদেহ
আর
আমার আদিগন্ত ঠান্ডা শরীরের ওপর
একসময়ে
ভালোবাসার মতো ঝরে পড়বে বৃষ্টি
যা
আমি তোমাদের কাছে চেয়েছিলাম হে মানুষ হে মানুষী’ [এপিটাফ]
চোখের জলে সব আবছা হয়ে এলো বন্ধু 😢
উত্তরমুছুনকি লিখবো ? সব আবছা মিতা দাস ভিলাই
উত্তরমুছুনবহুদিন বাদে এরকম একটি লেখা পড়ে চমকে উঠেছি। এই লেখার মধ্যে দিয়ে সুকুমারের লেখার উজ্জ্বলতা চোখে পড়ার মতো। যা রীতিমতো ঈর্ষণীয়। আশির দশকের এই কবির জীবনযাপন ও কবিতা যাপন, খনন পত্রিকার সম্পাদনাও মনে দাগ রেখে গেল। ধন্যবাদ, এই অনবদ্য আলাপচারিতার মাধ্যমে আরও একবার কবি সুকুমারকে তুলে ধরার জন্য।
উত্তরমুছুন-সুমিত্রা দত্ত চৌধুরী