কালিমাটি অনলাইন / ১১৭ / একাদশ বর্ষ : সপ্তম সংখ্যা
চিন্তা প্রকাশনী থেকে সম্প্রতি
মলয় রায়চৌধুরীর একটি উপন্যাস প্রকাশিত হয়েছে আমার সম্পাদনায়, শিরোনাম ‘চাইবাসা আবিষ্কার’।
চাইবাসাকে আবিষ্কার করার জন্য অবশ্য চাইবাসায় যেতে হয়নি, কেননা তিনি আবিষ্কার করতে
চেয়েছেন, চাইবাসায় সংঘটিত সাহিত্যের একটি কালখন্ডের ইতিহাস। আমার এমন কোনো আবিষ্কারের
প্রয়াস আদৌ নেই, তবে আমি কোথাও প্রয়োজনে বা অপ্রয়োজনে বেড়াতে গেলে সেখানকার একটা মোটামুটি
পরিচিতি অনুসন্ধান করি। সেইসব স্থানের ভৌগলিক, সামাজিক, ঐতিহাসিক, সাংস্কৃতিক পরিচিতি।
এই যেমন দিন কয়েক আগে আমরা বন্ধুরা গেছিলাম পুরুলিয়া জেলায় একটি মনোরম জায়গায়। বড়ন্তি।
জায়গাটির এমনিতে কোনো ভৌগলিক বা ঐতিহাসিক অথবা সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য বা গুরুত্ব নেই, তবে
প্রাকৃতিক রূপ ও সৌন্দর্যে অসাধারণ। যেদিকেই চোখ মেলি, সেদিকেই প্রকৃতি যেন অদ্ভুত সুন্দরভাবে সেজে
বসে আছে। দেখে মুগ্ধ হতে হয়। মন জুড়িয়ে যায়। এমন একটা জায়গায় দু’দিন অতিবাহিত করে আমার
মনে হয়েছে, সব সৃষ্টিশীল মানুষের এখানে আসাটা একান্ত জরুরি। যিনি কবিতা-গল্প লেখেন,
যিনি অঙ্কনশিল্পী, আলোকচিত্রশিল্পী, সঙ্গীতশিল্পী, অভিনয়শিল্পী – সবাই এখানে এসে প্রকৃতির
অনবদ্য রূপ ও সৌন্দর্য দেখে অভিভূত হতে বাধ্য। এবং শুধুমাত্র কবি-সাহিত্যিক-শিল্পী
নয়, যিনি সাহিত্যবোদ্ধা, শিল্পবোদ্ধা, সংস্কৃতিবোদ্ধা – সবাই এক অনস্বাদিত ভালোলাগায়
আচ্ছন্ন হয়ে পড়বেন। আমি জানি না, আমার এই মাত্র দু’দিনের এই পুরুলিয়া জেলার অন্তর্গত
বড়ন্তি গ্রাম, পাহাড় ও লেকের সান্নিধ্যে এসে কী আবিষ্কার করেছি, কিন্তু মনের আনন্দ
যে খুঁজে পেয়েছি, তা বলাই বাহুল্য। আসলে আমরা যারা কোনো সৃষ্টিমূলক কাজের সঙ্গে জড়িয়ে
থাকি এবং নতুন কোনো সৃষ্টির প্রয়াস করি, তাদের প্রতিদিনের ঘেরাটোপ থেকে মাঝে মাঝেই
বেরিয়ে আসাটা একান্ত প্রয়োজন। আর সেই প্রয়োজনের কথা মনে রেখেই স্বয়ং প্রকৃতি যেন আনন্দের
ভাঁড়ার গচ্ছিত রেখেছে তার প্রতিটি কোণে, প্রতিটি খাঁজে।
এই বড়ন্তি থেকেই আমরা দেখতে গেছিলাম
পুরুলিয়ায় অবস্থিত জয়চন্ডী পাহাড়। যদিও জয়চন্ডী একটি পাহাড়ের নাম, কিন্তু মূলত চারটি
পাহাড়ের সমষ্টিকে জয়চন্ডী পাহাড় নামে অভিহিত করা হয়। এই চারটি পাহাড়ের আলাদা আলাদা
নাম আছে – যোগীঢাল, রামসীতা, সিজানো ও জয়চন্ডী। জয়চন্ডী পাহাড়ের চূড়ায় আছে জয়চন্ডী
মায়ের মন্দির। এই মন্দিরে পৌঁছতে গেলে পাঁচশোর বেশি সিঁড়ি ভাঙতে হয়। অনেকেই সিঁড়ি ভেঙে
জয়চন্ডী মায়ের মন্দির দর্শন করে আসেন। এই পাহাড়ের চূড়ায় পৌঁছে অথবা পাহাড়ের পাদদেশ
থেকেই চারিদিকে ছড়ানো প্রাকৃতিক রূপ ও সৌন্দর্য
দেখে মন আনন্দে ভরে ওঠে। তাছাড়ে এই পাহাড়ে স্পর্শ লেগে আছে বিশ্ববরেণ্য চলচ্চিত্র পরিচালক
সত্যজিৎ রায়ের। তাঁর পরিচালিত চলচ্চিত্র ‘হীরক রাজার দেশে’র শ্যুটিং হয়েছিল জয়চন্ডী
পাহাড়ে। পাহাড়ের পাদদেশে সত্যজিৎ রায়ের নামে একটি মুক্তমঞ্চ আছে, সেই মঞ্চ তিনিই উদ্বোধন
করেছিলেন। শুনলাম, প্রতি বছর ২৮শে ডিসেম্বর থেকে ১লা জানুয়ারী পর্যন্ত জয়চন্ডী পাহাড়ে
পর্যটন উৎসব ও মেলা উদযাপিত হয়। আগ্রহী পর্যটকদের আগমনে তখন রীতিমতো সরগরম থাকে সারাটা
পাহাড়।
এবারের নিতান্ত সংক্ষিপ্ত ভ্রমণ
সূচিতে আরও ছিল পুরুলিয়ার গড় পঞ্চকোটও। একটি
অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ঐতিহাসিক স্থান। বি ডি
ও অফিস, নিতুরিয়া ব্লক, পোস্ট রামকানালির সৌজন্যে প্রচারিত বিজ্ঞপ্তি পড়ে জানতে পারলাম,
পঞ্চকোট রাজবংশের রাজপুরোহিত ও সভাপন্ডিত রাখালচন্দ্র চক্রবর্তী 'পঞ্চকোট ইতিহাস' গ্রন্থে
লিখেছেন, মহারাজা বিক্রমাদিত্যের উত্তরপুরুষ উজ্জয়নী নগরীর ধার রাজ্যের মহারাজা জগদ্দেও
সিংহের পুত্র দামোদর শেখর সিংদেও (জন্ম ঝালদায় ৮০ খৃষ্টাব্দে) যে 'শেখর রাজবংশে'র প্রতিষ্ঠা
করেছিলেন, সেই রাজবংশের ৩১তম রাজা কীর্তিনাথ শেখর (রাজ্যাভিষেক ৯২৬ খৃষ্টাব্দ) এর পর
কোনো এক সময়ে তাঁর রাজধানী পাড়া থেকে পঞ্চকোট পাহাড়ের দক্ষিণ পাদদেশে স্থানান্তরিত
করেন। এখানে প্রায় তিরিশজন রাজা দীর্ঘ আটশ বছর ধরে বংশ পরম্পরায় রাজত্ব করেন। ১৭৫০
খৃষ্টাব্দে মহারাজা শত্রুঘ্ন শেখরের আকস্মিক মৃত্যুর পরে সিংহাসন নিয়ে একাধিক রক্তক্ষয়ী
সংঘর্ষের ফলে রাজধানী প্রথমে মহারাজনগর, পরে ১৭৬২-৬৩ সালে রামবনী মৌজায়, ১৭৯৩ সালের
পরে কেশরগড় এবং অবশেষে ১৮৩২ সালে কাশীপুরে
স্থানান্তরিত করা হয়। এবং পঞ্চকোট তারপর থেকে পরিত্যক্ত অবস্থায় পড়ে থাকে। ১২ বর্গমাইল
এলাকা জুড়ে পঞ্চকোট গড় (রাজধানী) সুরক্ষিত
ছিল সেইসময়। উত্তরে পঞ্চকোট (শিখর) পাহাড়, অন্য তিনদিকে পরিখা ও মাটির প্রাচীর। প্রাচীরগুলোতে
ছিল প্রবেশ তোরণদ্বার মোট পাঁচটি। চারটি তোরণদ্বার এখন আর নেই, একটি তোরণদ্বার 'দুয়ার
বাঁধ' এখনো টিকে আছে।
পঞ্চকোট দর্শনে এসে আমাদের মন তার
চারপাশের নৈসর্গিক সৌন্দর্য ও পাহাড়ের প্রশান্তিতে অভিভূত হয়ে পড়েছিল। পশ্চিমবঙ্গের
হেরিটেজ কমিশন পঞ্চকোটকে হেরিটেজ সাইট ঘোষণা করে তার সংস্কার এবং সংরক্ষণের দায়িত্ব
গ্রহণ করেছে। পুরো এলাকাটিকে জোন অফ সাইলেন্স বা নৈ:শব্দের এলাকা হিসেবে ঘোষণা করেছে।
আর তাই এই এলাকায় মাইক, ডিজে এবং মোবাইলে জোরে গান বাজানোয় নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছে।
প্রসঙ্গত জানাই, মাইকেল মধুসূদন দত্ত ১৮৭২ সালে কাশীপুরে এসেছিলেন এবং পঞ্চকোট এস্টেটের
ম্যানেজার হিসেবে প্রায় দু’মাস কাজ করেছিলেন। এই পরিপ্রেক্ষিতে তিনি পঞ্চকোট নিয়ে তিনটি
কবিতা রচনা করেছিলেন।
এছাড়া আমাদের ভ্রমণ সূচিতে ছিল বিহারীনাথ পাহাড় ও মন্দির। বিহারীনাথ পাহাড়ের
পাদদেশেই বিহারীনাথ মন্দির। এই এলাকা অবশ্য পুরুলিয়া জেলার মধ্যে নয়, বরং বাঁকুড়া জেলার
অন্তর্ভুক্ত। আমাদের এই পাহাড় ও মন্দির দর্শনে যেতে কিছুটা দেরি হয়ে গেছিল, প্রায় সন্ধ্যের
মুখে পৌঁছেছিলাম। আর তাই বিহারীনাথ পাহাড়ের ছবি আলাদাভাবে তোলা সম্ভব হয়নি। প্রসঙ্গত
জানাই, বিহারীনাথ পাহাড় বাঁকুড়া জেলার সবথেকে উঁচু পাহাড়, উচ্চতা মোটামুটি ৪৫১ মিটার।
আর এই পাহাড়ের পার্শ্ববর্তী অঞ্চল ঘন অরণ্য পরিবেষ্টিত। বিহারীনাথ পাহাড়কে পশ্চিমবঙ্গের
আরাকু ভ্যালি বলা হয়। বিহারীনাথ শিবের আরও এক নাম, আর সেই নামেই পাহাড়ের নামকরণ করা
হয়েছে। জনশ্রুতি আছে, বিহারীনাথের শিবলিঙ্গটি এখানকার রাজা স্বপ্নাদেশে পেয়েছিলেন।
প্রতি বছর শিবরাত্রিতে এই উপলক্ষে মন্দির চত্বরে মেলা আয়োজিত হয়। শিবভক্ত মানুষের সমাগমে
তখন বিহারীনাথ মন্দির এবং বিহারীনাথ পাহাড়ের পাদদেশ মুখরিত হয়ে ওঠে।
সবাইকে জানাই আমাদের শারদ শুভেচ্ছা
শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা।
আমাদের
সঙ্গে যোগাযোগের ই-মেল ঠিকানা :
kajalsen1952@gmail.com
/ kalimationline100@gmail.com
দূরভাষ
যোগাযোগ : 9835544675
অথবা
সরাসরি ডাকযোগে যোগাযোগ : Kajal Sen, Flat 301, Phase 2, Parvati Condominium, 50
Pramathanagar Main Road, Pramathanagar, Jamshedpur 831002, Jharkhand, India.
দুর্দান্ত লিখেছেন সম্পাদক। মনেহল ঘুরে এলাম। জয় হোক জয় হোক এমন ভ্রমণের...✍️
উত্তরমুছুনসজীব অভিজ্ঞতা সজীব বৃত্তান্ত সজীব সম্পাদকীয়.....
উত্তরমুছুনঝুমা চট্টোপাধ্যায়