ফ্ল্যাশব্যাকে থিয়েটার পাঁচালি :
সাবিত্রীর সঙ্গে দেখা
প্রতি,
বাঙলির চিঠি আসা দিনগুলো এখন আর ফ্ল্যাশব্যাকেও
আসে না। তাই একটি দুপুরবেলার কথা শোনাই। আমার ফ্ল্যাশব্যাকে এরকমই অনেক দুপুর রয়েছে।
যেখানে অনেকেই উঁকি দিয়েছেন। এদিনও এরকমই এক দুপুরবেলা। কলকাতা খুব গরমে ঝিমিয়ে নিচ্ছে
হাতটানা রিকশায়। হোমিওপ্যাথি-দোকানের ফুটপাথ ঘেঁষে তার বাহনটি। হেঁকে তাকেই ঠেলে নিয়ে
চলা শিয়ালদা থেকে হাতিবাগান পাড়া। বসতেই ছ্যাঁকা আর ইয়া লম্বা চালকের কথা, জ্যায়েঙ্গে
বাবু … খালি পা। রিকশা টেনে চলল টুঙ্গটুঙ্গ বাজিয়ে। এমনসময় আগে তো এই পাড়ায় আসিনি।
এটা অসময় বলা যায়। দুপুরে খোলা থাকে বলেই ধারণা
ছিল না। বাবার সঙ্গে গলির মধ্যে ঢুকতেই সাজসাজ রব। এদিকে ওদিকে করে হলগুলো। সারকারিনা,
বিশ্বরূপা … আর। বাবা টিকিট কাটতে এসেছেন এই দুপুরে। তখন ভিড় কম থাকে। বাঙালির রবিবার
তখন কথায় কথায় বলে, রোববার সাবিত্রী চ্যাটার্জির শো। অভিনয় দেখতে হল ভরে যায় আগে থেকেই। হাউসফুল শো।
এমনিতে হলগুলোর টিকিটঘরের তেমন মাহাত্ম্য নেই। আজকের দিনের তুলনায় তো ম্যাড়ম্যাড়ে বটেই।
সাজসজ্জা বলতে থিয়েটারের পোস্টারগুলো। আর টিকিটের দাম লেখা কাগজ সাঁটা। শত সহস্র অজস্র
আঠার দাগ। এর আগে বাবা ঘুরে গেছেন, টিকিট না পেয়ে। তাই এবারে সপ্তাহের শুরুতেই ভরদুপুরে
আগমন। বাবা টিকিট কাটতে ব্যস্ত ইত্যাদি কথাবার্তা চলছে।
এসব থেকে চোখে সরিয়ে সামনের আইসক্রিমওলার কাছে যেতে বেশিক্ষণ লাগে না। এক-একটা বরফকাঠিই জিয়নকাঠি। জিভ সবুজ আইসক্রিম ঠোঁটে রাঙিয়ে ফেলে কনুই পর্যন্ত। গলে যাওয়ার সঙ্গে লড়তে গিয়ে যত তাড়াতাড়ি মুখে পুরলাম। ব্যস, গলায় আটকে গেল… বরফ বলে কথা। ভাল দুজন কাকু ধরে নিয়ে বসালেন ওদের অফিসঘরে। সব্বাই ঝুঁকে পড়েছে। একটা বাচ্চার জন্যে ডাক্তার খুঁজতেও চলে গেছেন কেউ। ইত্যাদির মধ্যে তিনিও উঁকি দিলেন। বললেন, দেখি, কী হয়েছে। এখানে এত্ত ভিড় কেন। ওনাকে দেখামাত্রই সব্বাই বলতে লাগল একসঙ্গে, দিদি, এই হল কাণ্ড। রে রে করে উঠলেন, ইস। বাচ্চাটাকে ভেতরে নিয়ে আসুন তো। সাজঘরে। হ্যাঁ, সাজঘরে ইয়া বড় ফ্যান ঘমঘম করে ঘুরছে। সব দেখে ব্যোমকে গেছি। বাবাকে, চুপ করিয়ে দিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, একটু দেখবেন তো। বাবা বললেন, না মানে, টিকিট শেষ শুনেই এক ছুটে এসেছি। থিয়েটার বলে কথা, আপনার অভিনয় মানে। এবারেও টিকিট না পেলে ওর মা খুব রাগারাগি করতেন। অরন্ধন চলত। হাতের কাছেই তো ছিল। একটু মানে কথা বলছি। এরইমধ্যে কখন যে এত বড় আইসক্রিমটা মুখে পুরেছে। উফ, বাচ্চাদের সামলানো… তিনি বললেন, থিয়েটার মাসের পর মাস চলবে। পরেও দেখতে পাবেন। কিন্তু বাচ্চাটা তো লাল হয়ে গেছে চোখমুখ। আপনারা সত্যি।
বাবা বেবাক অপরাধী চুপ থেকে গেছিলেন।
সেদিন তিনি উত্তর দিতে পারেননি যে, সত্যি হল সাবিত্রী। বড় চোখ বাঙ্গাল মেয়ের কথা। আর
অসাধারণ কৌতুকের সংলাপ বলা সাবিত্রী। তাঁকে দেখতেই তো আসা। আমার মনে পড়ছিল, পয়লা বৈশাখের
ভোরে মায়ের সঙ্গে ঘুমঘুম চোখে গেছিলাম দক্ষিণেশ্বরে। সেখানে লাল পাড় শাড়িতে উনি প্রণাম
করছিলেন। মা দেখে ফিসফিস করে বলেছিলেন, সত্যি অভিনেত্রী বটে। প্রণাম করাতেও একটা স্টাইল
আছে। আসলে, অভিনয় ওঁর শরীরের ব্যাকরণে মিশে গেছে, নাচের মুদ্রা যেমন শিল্পীর সঙ্গে
মিশে যায় তেমনই। সবাই এত কথা বলছে। একজন কাকু
বললেন, দিদি, আপনার রুমালটা ইয়ে মানে গেল তো! উনি বললেন, আরে, বাচ্চার থেকে রুমালের
দাম বেশি নাকি। কাকু বললেন, হাজার হোক, আপনার
দামি রুমাল আর আরও দামি সুগন্ধি। উনি বললেন, কে বলেছে … দামি বলে ইউজ করি। ওটায় অন্য
গন্ধ আছে যে। ওটা আমার দেশের বাড়ির ফুলের গন্ধ। কাছে থাকলে মনে হয় যেন …।
বাবা চুপ করেই ছিলেন। এবারে বললেন, হ্যাঁ,
দেশ। আমাদের দেশ নেই এখন, উদ্বাস্তু আমরা। ভিটেমাটি ছেড়ে এই কলকাতায় বাসাবাড়িতে …।
কোথায় মাঠ পুকুর মাছ আম কাঁঠালের গন্ধ। বেলফুলের গাছ কিছু আমার জ্যাঠামশাই পরপর লাগিয়েছিলেন।
শখ করে। একদিন বাবার কোলে চেপে সব ছেড়ে পালিয়ে আসছিলাম। ভয় করছিল। গাছতলায়। অচেনা স্টেশনে।
কত ধাক্কায় যে এসে বাবা ঠেকেছিলেন …। বাবা, বললেন তাঁর বাবার কথা। মানে আমার ঠাকুরদা।
এবারে উনিও যোগ দিলেন বাবার কথার মধ্যে। বললেন, আমরাও তো। সব ফেলে পালিয়ে এলাম। মানে
আসতে হল। কতটুকু বয়স বলুন তো। কিছুই তো বুঝি না। কেন পালাচ্ছি, কোথায় যাচ্ছি। হারিয়ে
যেতে যেতে এসে ঠেকেছি। ভয়ে, আতঙ্কে সেই বাচ্চা বয়সে ভীতি এমন হয়েছিল যে, পরেও ঘুমের
মধ্যে জানান দিত। দুঃস্বপ্ন যাকে বলে। কে জানত যে …। আচ্ছা আপানদের দেশ কোথায় ছিল।
বাবা জানাতে থাকে প্রাণের কথাগুলো, ব্রাহ্মণবেরিয়া। আমার জ্যাঠামশাই চালাতেন টোল। ওটাই
পেশা বলতে পারেন। এপারে এসে তিনি আর কাজ পাননি। শুয়ে বসে অন্ধকার স্যাঁতস্যাঁতে ঘরে
চলে গেলেন। যাওয়ার সময় আকাশটুকুও দেখতে পেলেন না। আর আমআর বাবা নেই এখন। আমি এখন বাবার
রেখে যাওয়া ছাপাখানা চালাই। তিনি হাসলেন, বললেন তারপর, কি আশ্চর্য বলুন তো। আমরা ওপারের।
দেখা হল, এপারের এই থিয়েটার হলে। তাও রিহার্সাল করতে এসেছি বলে। নাহলে, এই দাদাবোনের
সম্পর্ক হয়ত ওপারে থাকলে আরও …। বাবার চোখ ভেজা কিনা দেখতে পাইনি, কিন্তু মন যে ভেজা
সেটা বুঝতে পেরেছিলাম ঐ বয়সেই। আর কি কি হত দুজনের কেউই তা বলতে পারেননি। তবে, বিশ্ববিদ্যালয়ে
পড়ার সুবাদে দেশভাগের বই নিয়ে বিস্তর নাড়াচাড়া করতে হয়। তখন বুঝেছি, এই দুঃখ এপার ওপারে
একই। এপারে এসে কি হয়েছে, তা নিয়ে বিস্তর লেখালেখি, গবেষণা। কিন্তু একেকজন মানুষের
ছিন্নমূল ব্যথার গবেষণামূলক ফলপ্রাপ্তি ঘটে না যে।
এপারের থিয়েটারের কথা বললে, উদ্বাস্তু
সংসারের মেয়েদের যে আর্থিক দায় নিতে হয়েছিল, তার হলমার্ক ছবির তো মেঘে ঢাকা তারা। ঋত্বিক
ঘটক সব ছবিতেই প্রায় এই অনুষঙ্গ রেখেছেন। আসলে, ওঁরা ছিলেন গণনাট্য সংঘের শিল্পী ও
আন্দোলনকারী যুবাদল। যাঁদের পারাপার ছিল, আসা যাওয়া ছিল। ঢাকা চট্টগ্রাম রংপুর কলকাতা
–সবটাই ছিল একই আন্দোলনের সুতোয় বাঁধা। যেমন, রংপুরের ছাত্রী রেবা রায় চৌধুরীর সদস্য
হওয়া। তারপর তাঁর বাবার মেয়েকে বাড়ি ফিরিয়ে আনতে পুলিসি সাহায্য নেওয়া। তারপর তাঁর
সাহস করে দাদার সঙ্গে আইপিটিএর –কাজে বোম্বাই চলে যাওয়া। তখনও বাংলায় আইপিটিএ-র শাখা
খোলেনি। খুলেছিল আরও পরে। রেবা হলেন ভাগ না হওয়া বাংলার মেয়ে, নেত্রী এবং গণনাট্য সংঘ-এর
সদস্য। এবং গ্রুপ থিয়েটারের সক্রিয় কর্মী। নাটকে, অভিনয়ে, সাংগঠনিক কাজে এভাবেই ভাগ
না হওয়া বাংলা থেকে অনেক যুবাদল যোগ দিয়েছিল। কিন্তু, সাবিত্রী-দের অবস্থা আরও অন্যরকম।
উদ্বাস্তু জীবন তাঁকে এবং তাঁর মতন অনেককেই শিল্পী করেছিল, অভিনয়ের সঙ্গে যুক্ত করেছিল। সুপ্রিয়া চৌধুরী, বিশ্বরূপা, চৌরঙ্গী। এবং সমর মুখারজির
নির্দেশনায় কোন কোন থিয়েটারে কাজ করেন। সমর মুখারজির একটা দল ছিল কালচারাল সেমিনার,
থিয়েটারের। সেটা পরে প্রফেশনাল থিয়েটারের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যায়। পরে, কেতকী দত্ত-এর
অভিনয় 'বারবধূ' নাটকে সাড়া ফেলেছিল। তারপর, তো ইতিহাস। সেই চরিত্রেই পরে দেখা যায় ছন্দা
চট্টোপাধ্যায়কেও। এসব নিয়ে কথা বলতে বলতে আজও নসটালজিয়া। এসব জানালেন দীর্ঘদিনের নাট্যকর্মী
নির্দেশক সঞ্জীব রায়। কত ইতিহাস যে রয়েছে। আমি বলি, গীতা দে।
এবং গীতা দে থিয়েটারে সিনেমায়, তাঁকে কে না চেনে। উনি বক্স আর্টিস্ট। ওঁদের
লড়াই তো চলেছে জীবনের শেষদিন পর্যন্ত। সেইসূত্রেই অভিনয়ের এক বিশেষ শাখায় উদ্বাস্তু
শিল্পীদের ভিড় রয়েছে খণ্ডিত পশ্চিমবঙ্গের থিয়েটারের ইতিহাসে।
উদ্বাস্তু অভিনেত্রীদের অনেকেই এসেছিলেন
মঞ্চে কিছু টিকে ছিলেন। কিন্তু, সরে গেলে এই অভিনেয়-স্রোতে নামও মুছে যায়। যাঁদের নাম
হয়েছে, তাঁদের পাওয়া যায় পরের থিয়েটারের ইতিহাসে। যাঁদের যোগাযোগ কাজ করতে করতে হারিয়ে
গেছে, মানুষ তাঁদের ভুলে গেছে। আবার, প্রচারের বাইরে বলেও তাঁরা তেমন আলো পাননি। কোথা
থেকে কোথায় এসে পড়া। আবার নাগরিক জীবনের ভিড়ে এক সন্ধ্যাবেলায় শো দেখতে দেখতে মনে পড়ছিল।
দুপুরবেলার কথাগুলো। গলার ব্যথা, কেমন জিজ্ঞেস করলে হেসে বলতেই পারতাম, নেই। সেদিন
বলতেই পারিনি কিছু। কারণ, ওঁদের নিজস্ব ব্যথা মনে হচ্ছিল আমার চেয়েও বেশি। এখনও বলতে
বলতে ভেতরে ফুলে উঠি, কারণ অত কাছে ওনাকে দেখছিলাম যে। সেদিন আরেকটু পরেই ভুলে গেছিলাম
কেন কাঁদছিলাম। চারদিকে গরমেও ফুরফুরে। ওদিকে, ঠাণ্ডা বরফের মধ্যে রুমাল মুড়ে আমার
মুখচোখে বুলিয়ে দিচ্ছেন। রুমালে কি সুন্দর গন্ধ। শো-য়ের দিন বাবাকে বলতে চাইছিলাম,
যাব বাবা। গিয়ে বলব ওঁনাকে কি সুন্দর লাগছে। সাজগোজ ছাড়া দেখেছিলাম। তাতেও তিনি সুন্দর।
চোখ এত ভাষাময় হতে পারে? পারে নিশ্চয়। আর তিনি কি কিংব্দন্তি? নইলে এত ভিড় কেন? তখনকার
কলকাতায় এরকম এক শিল্পী কণ্ঠে ভাসছে সন্ধ্যে। সাড়ে ছটা থেকে শুরু। আর তারপর মঞ্চের
মাপা আলোর প্রক্ষেপণে তিনি অনন্যা এক অভিনেত্রী। সাদা ডুরে শাড়ি লাল পাড়। সংলাপ বলছেন
যেন, হল ভাসছে। হল কাঁদছে। আর কিছুতেই বুঝি না কিভাবে এত মানুষ হাততালি দেয়। আর মুগ্ধ
হয়ে যা শোনেন, সেকি সংলাপ শুধু ! চিরব্রতী অভিনেত্রী লগ্নের এই নক্ষত্র সাবিত্রী চট্টোপাধ্যায়।
উদ্বাস্তু ইতিহাস বয়ে চলা থিয়েটার, হাতিবাগান পাড়ার ইতিহাস লেখা থাকবে। আর থাকবে এই
কালো ভোমরার চোখ মেয়েটির দাপট, হ্যাঁ, বাংলা থিয়েটারের একে মনে রাখা ছাড়া উপায় নেই
যে!
_ ইতি
একুশ শতকের ফ্ল্যাশব্যাক সত্ত্বাধিকারী
নাটক নিয়ে প্রচুর তথ্য ও তত্ত্বনির্ভর আলোচনা, ভারী প্রবন্ধ, সূক্ষ্ম বিশ্লেষণ পড়েছি। কিন্তু মৌ চক্রবর্তী এই লেখাটিতে চলতি পদ্ধতি ছেড়ে এক নতুন গদ্যের সন্ধান দিলেন। এই লেখাটি নতুন ট্রেণ্ড সৃষ্টি করল সন্দেহ নেই।
উত্তরমুছুনপ্রাণিত হলেম ...✍️
মুছুনঅত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এক যাত্রাপথের খতিয়ান।আরো চাই এমন লেখা।
উত্তরমুছুনসেই দিন গুলো আবার ফেরত চলে এলো I কি অসাধারণ লেখনী I ফিরে গিয়েছিলাম 70,80 দশকে I খুব ভালো বর্ননা I এক কথায় বলছি তুমি নিয়ে গেছো সেই দিনগুলিতে I
উত্তরমুছুন