কালিমাটি অনলাইন

দ্বাদশ বর্ষ / চতুর্থ সংখ্যা / ১২৪

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

দ্বাদশ বর্ষ / চতুর্থ সংখ্যা / ১২৪

সোমবার, ১৪ জুন, ২০২১

রঞ্জনা ব্যানার্জী

 

কালিমাটির ঝুরোগল্প ৯৭


অকথা

সেজপিসি অকথা-কুকথা নিয়ে একটা গল্প বলেছিলেন ঘুমাবার আগে।  এরপরেই মস্ত পাশবালিশটা দুজনের মাঝখানে পেতেছিলেন। রিপার নয় চলছে, তবুও ছড়িয়ে শোওয়ার স্বভাব। গায়ে হাত-পা লাগলে পিসির ঘুম চটে যায় তাই এই ব্যবস্থা। রিপা তখনো গল্পে ঘুরছে। পিসি বললেন, ‘দেখো শব্দ হইল ব্রহ্ম। কথার ওজন মাইন্যা কথা কইতে হয়। যে সব কথা না বললেও চলে সেইগুলানরে কয় অ-কথা। অ-কথা যখন কু-কথা হয় তখনই সর্বনাশ। কু-কথার ফলা তীক্ষ্ণ, জীবন সংহারী। অ-কথা না কইলেই কুকথা মনে আসবো না’। এরপরে হাই তুলে বলেছিলেন, ‘এবার ঘুমাও। আমার চক্ষু ভাইঙ্গা ঘুম আসতেসে’। এবং  দেয়ালের দিকে মুখ ঘুরিয়ে পাশ ফিরেছিলেন। 

উল্টোদিকের পড়ার টেবিলের পাশে, জানালার পর্দা খানিক ফাঁক করা। সেই ফোকর দিয়ে রাস্তার আলো টেবিলের কোণ ধরে অন্ধকারে ঝুলছিল। সেই দিকে তাকিয়ে গল্পটার আগাপাশতলা ভাবতে ভাবতে রিপাও ঘুমিয়ে পড়েছিল। 

পিসি রোজ স্নান সেরে রিপাকে জাগান। আজ জাগান নি। রিপা চোখ মেলে দেখল, পর্দার সেই ফাঁক গলে মেঝেতে রোদ থইথই করছে। নিত্যদিনের মতো পাশবালিশ পেরিয়ে ওর পা পিসির গায়ে ঠেকেছে প্রায়। পিসির পিঠের দিকে তাকিয়ে কেন যেন ওর মনে হয়েছিল, পিসি আর কোনোদিনই জাগবেন না। পিসির পিঠে ও আলতো করে হাত ছুঁয়ে ডেকেছিল, ‘সেজপিসি’! সাড়া মেলে নি। আর তখনই ওর দু চোখ ভরে ঘুম নেমেছিল। মনে হয়েছিল আসলে এইসব ঘটছে না, ও স্বপ্ন দেখছে। পিসি বলেন, 'ছড়াইয়া শুবা না। ছোট কইরা শুইলে ভালো স্বপ্ন আসে’। রিপা ছড়িয়ে শুয়েছে বলেই হয়তো বাজে স্বপ্ন দেখছে। ঘুম ভাঙলেই সব ঠিক হয়ে যাবে। ফ্রিজের মাছের মতো পিসির ঠান্ডা শরীরটা জড়িয়ে ও ফের ঘুমের ভেতর তলিয়ে গিয়েছিল।

গতবছর পিসির হৃৎপিণ্ডে ব্লক ধরা পড়েছিল। অপারেশনের পরে পিসিকে যেদিন কেবিনে আনা হলো সেইদিন রিপাকে নিয়ে গিয়েছিল বাবা। হাসপাতালের বিল মিটিয়ে গম্ভীর মুখে পিসির হাতে রিসিটটা  দিতেই পিসি মজা করে বলেছিল, ‘বাহ্‌ আমার হৃদয়ের দাম কম না তো!’ বাবা গম্ভীর হয়েছিল, হাসেনি।

পিসি বাড়ি ফেরার পরেও মা, কাকী, কাকা, বাবা সবার মুখ থমথমে ছিল বেশ কদিন। পিসি যেদিন বিলের টাকাটা বাবাকে মিটিয়ে  দিলেন সবকিছু আবার স্বাভাবিক হয়ে গিয়েছিল। কেবল পিসি বিষণ্ণ গলায় রিপাকে বলেছিল, ‘সব মায়াতে আঠা নাই’।

রিপা কতক্ষণ ওভাবে সেজপিসিকে জড়িয়ে ঘুমিয়েছিল, জানে না। কেউ একজন  পিসির ঠান্ডা শরীর থেকে ওকে টেনে আলগা করেছিল।

বারান্দায় কৃষ্ণনাম গাইছে কীর্তনিয়ার দল। সেজপিসিকে চন্দন, ফুলের মালা দিয়ে সাজানো হয়েছে। ঘরভর্তি মানুষ। মা-কাকি সেজপিসির সুখ্যাতি করে চোখ মুছছে ঘনঘন। সেইদিকে তাকিয়ে রিপার মনে হলো, অকথায় শাঁস নাই, সবই খোসা। ঠিক তখনই সেজপিসির মুখের দিকে নজর গেল ওর। স্পষ্ট দেখল সেজপিসি যেন  চোখ টিপে বললেন, ‘ঠিক ধরছ। এইগুলান খোসাই মাটিতে পড়ার আগেই ফুস্‌ কইরা মিলাইতেসে, মায়ার আঠা নাই এক কণাও’…

 

 

 

 

 

 

 

 

 


1 কমেন্টস্:

  1. এমন কথায় কথায় শোলক আওড়ানো পিসিগুলো কোথায় হারিয়ে গেল

    গল্প বলার সুমিত সূক্ষ্ম শৈলী খুব ভালো লাগল

    উত্তরমুছুন