কালিমাটি অনলাইন

দ্বাদশ বর্ষ / চতুর্থ সংখ্যা / ১২৪

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

দ্বাদশ বর্ষ / চতুর্থ সংখ্যা / ১২৪

শনিবার, ১২ সেপ্টেম্বর, ২০২০

শতাব্দী দাশ

 

সমকালীন ছোটগল্প


গেরস্তালি

কোকিলটা ভোররাতে ঘুম ভাঙিয়ে দিল। কোকিল বসন্ত বিকেলে গায় না শুধু। অযাচিত গায় রাত-বিরেতেও। ঘুম ভাঙিয়ে দেয়। স্বামী মহাশয়ের নিদ্রা এখনও গাঢ়। শুক্র-শনিবার তিনি গভীর রাতে শুতে আসেন। সাধের সপ্তাহান্ত। তিনি বাড়ি থাকলে, বস্তুত ভালোই লাগে তুলির। যেন এখুনি পেলব কিছু ঘটবে, যেন একটা মুহূর্ত তৈরি হবে। যদিও পাশের ঘরে ল্যাপটপ কোলে খুটখুট, তবু তো পারফিউমের ঘ্রাণ পাওয়া যায়, এত কাছে। তিনি সুগন্ধি ভালোবাসেন। জিরে-হলুদ বা আঁশটে গন্ধের চেয়ে আলাদা এ'সব দিন।

ঘুম ভেঙে তুলি আবিষ্কার করল, স্বামীর ভারি হাতখানি কোমর জড়িয়ে রেখেছে তার। সন্তর্পণে হাত সরিয়ে উঠে আসতে হল। পা টিপে টিপে তুলি বারান্দায়  দাঁড়াল। কাণা-ভাঙা চাঁদ আকাশে লটকে আছে। চারটে বাজলে দুটো বাড়ি  পেরিয়ে যে মন্দির, সেখানে প্রার্থনা শুরু হবে। ভোরের প্রার্থনা মনকে পবিত্র করে।  অথবা ভোরের প্রার্থনা আর পবিত্রতার সম্পর্কের কথা আজীবন শুনে এসেছে বলে, অমনই মনে হয় তুলি চৌধুরির। কোকিলটা এখনও এমন অসহায় ডাকছে, যেন থামলে সাজা দেওয়া হবে৷ দু’পায়ের ফাঁকে চিটচিটে অস্বস্তি টের পায় তুলি। মনের ভুল? নাকি কাল রাতে হয়েছিল কিছু? আজকাল চাবি বা স্বামীর পার্সের অবস্থান ভুলে যায়। তবু মৈথুন ভুলে যাওয়া কঠিন।

অতএব তুলি বাথরুমে যায়। ভ্রম নয়। হাত বোলালে যোনির চারপাশে বীর্য টের পাওয়া যায় এখনও। গত রাতে স্বামী টিভি দেখছিলেন। তুলি এপাশ-ওপাশ করে ঘুমিয়ে পড়েছিল। তুলির ইচ্ছে করছিল। স্বামী ইচ্ছা করেননি। তিনি দেখছিলেন একটি গম্ভীর ছবি৷ ছটফট করতে করতে ঘুমিয়ে পড়ার সময় তুলি জানত, দরকার পড়লে তিনি জাগিয়ে দেবেন। বা ঠ্যালাঠেলিতে তুলি জেগে যাবে ঠিক। চেষ্টা করবে আনন্দ পেতে। মন্দ নয় এ নিষ্ক্রিয়তা। সক্রিয়তাই বরং পরিশ্রমসাধ্য মনে হয় দীর্ঘ অনভ্যাসে। নিষ্ক্রিয়তাই কাঙ্ক্ষিত অংশগ্রহণ।

নিষ্ক্রিয়তাই যদি অংশগ্রহণ হয়, তবে খারাপ লাগছে কেন? টেলিফোন শাওয়ার ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে যোনি ধুতে ধুতে তুলি চৌধুরি ভাবছিল, খারাপ লাগা কি আদৌ উচিত? যোনিতে জলের তীক্ষ্ম সূচীমুখ প্রবেশ করলে তুলির ঘুমের ঘোর কেটে যায়। শিরশির করে। গতরাতে এর চেয়েও নিঃসাড়ে এসেছিলেন তিনি। কথা হয়নি। শীৎকার হয়নি। মানুষটি মন্দ নন। হয়ত তুলিকে জাগাতে চাননি  সারাদিনের পরিশ্রমের পর।  তবে খারাপ লাগছে কেন? স্বামী অনুমতি নিয়ে প্রবিষ্ট হবেন, এমন হয় নাকি? কাল কি একবার কথা বলবে তুলি? কথা বলা, যৌন সক্রিয়তার মতোই, একরকম সক্রিয়তা। সক্রিয়তা কি কাম্য?

“হে স্বামী, আপনি কি স্বীয় বিজয়কেতনে নিবারক ধারণ করবেন? গেল বার  ট্যাক্সির সিট ভিজে গেছিল রক্তে। আগের রাতে ওষুধ। পরদিন অ্যাবর্শন। মাঝের সময়টুকু বড় রক্ত। অপারেশনের দিন আপনি সঙ্গে ছিলেন না। ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র কাজে কি আপনাকে মানায়? অতএব হে স্বামী, যদি অনুগ্রহ করে

মন্দিরে ঘণ্টাধ্বনি হল। নিম্নাঙ্গকে স্নান করিয়ে তুলি চৌধুরী বিছানায় ফেরে।  চারটের মন্ত্রোচ্চারণ হল। তবু গা ঘিনঘিন করছে আজ। জানলার বাইরে মরা জ্যোৎস্নার বীর্য ছড়িয়ে আছে।

 *****

শ্রী চৌধুরী রবিবার বেলা করে ওঠেন। কাগজের ভাঁজ আর আড়মোড়া ভাঙেন, একযোগে। তুলি চৌধুরী ততক্ষণে মেয়ের সামনে দুধ এগিয়ে দিয়েছে৷  ছেলের মুখে ঠুসে দিচ্ছে টোস্ট। এরপর মেয়ে যাবে নাচের ক্লাসে। এই বয়সের মেয়েদের নাচের ক্লাস করা ভালো, শ্রী চৌধুরির মতে। শরীরে লালিত্য আসে। হাঁটা-চলা-চাউনি, সবই গ্রেসফুল হয়।

মেয়ের মায়েরও নাচের শখ ছিল। হাতের মুদ্রা, চোখের পলকের নেমে আসা,  আলগোছে দাঁড়ানো - সবেতেই ছিল কোমলতা ও আভিজাত্য। চোখ আটকে যেত। তুলি নামটিও নরম, শৈল্পিক। নাচ ছাড়ার পর তুলি পৃথুলা হয়েছে। শ্রী চৌধুরি অ্যাডজাস্ট করে নিয়েছেন অনুগ্রহ করে। যখন অভ্যস্ত হাতে অনাবৃত করেন প্রাক্তন নর্তকীর শরীর, ঈষৎ মেদ তখন তিনি মেনে নেন। বউ-এর দেহপট কবেই বা তরুণী ইন্টার্নদের মতো হয়?

মধ্যবয়সের দাম্পত্যে শৈথিল্য আসে, প্রাক্তন নর্তকীর শরীরের মতো। যৌনতায় অনুঘটক লাগে। হুইস্কি কিংবা নীলছবি। হুইস্কির গন্ধে আবার তুলির বমি পায়। উইকেন্ডে হোয়াটস্যাপ গ্রুপে আসে নীলছবি। তার অপেক্ষায় বসে থাকার সময় কোনো গম্ভীর ছবি চালিয়ে কালক্ষেপ করতে হয়। যৌনতা নিয়ে কোনো আলোচনা তুলির সঙ্গে হয়নি কখনও। কার্য হয়েছে একমুখী। তেমনই দস্তুর। সেভাবেই এসেছে পাপান। তুতুনও এসেছে। আরও একবার, অনবধানে যে  এসেছিল, শ্রী চৌধুরীর তৎপরতায় সে বিদায় নিয়েছে। ইয়ার এন্ডিং-এর ব্যস্ত সময়ে সেসব ঘটে না গেলে, হাসপাতালে হয়ত সঙ্গে যাওয়া যেত।

সে ঘটনার পরেই কি তুলি বিছানায় অসাড় হয়ে গেল? মাঝে মাঝে নিজেকে ধর্ষক মনে হয়। নীরব আত্মসমর্পণে অপরাধবোধ হয়। শিশ্ন কুঁকড়ে যায়। জ্যোৎস্নারাত জানে, কালও কুণ্ঠা হয়েছিল। ঘুমন্ত শরীরে আরোহণ করতে কুণ্ঠা হয়। সচরাচর তুলি জেগে যায়। ঈষৎ উশখুশ করে। কখনও গোঙায় বেসুরে।

কিন্তু কাল তুলি জাগল না।  নতুন ওষুধের প্রভাব কি? ডিপ্রেশনের ওষুধ খায়।  স্খলনের পর কাল বারান্দায় এসে দাঁড়িয়েছিলেন শ্রী চৌধুরী। যে বারান্দায় ঘণ্টা তিনেক পর তুলি এসে দাঁড়াবে ঘুম ভেঙে। কিছু ক্ষমাপ্রত্যাশা ও দুঃখপ্রকাশ রেখে গেছিলেন। কিছু অজুহাতও রেখেছিলেন পাশে। সারা সপ্তাহের কর্পোরেট চাপ।  তুলিও বাচ্চাদের নিয়ে জেরবার থাকে। সপ্তাহান্তে শুধু রুটিন যৌনতা... যদি উত্তেজনা বোধ করেন, যদি তাড়া থাকে বা তাড়না, যদি মদের ঘোরে উচাটন হন, যদি ফোরপ্লে করতে ইচ্ছে না করে, যদি শুধু যোনিটুকু দরকার হয়, তাহলে কী করবেন?  তুলি তো জেগে থাকলেও জড়বৎ। তাহলে?

ইদানিং বোঝা যায়, ও খুশি নয়। হীনম্মন্যতা হয়। রাতের বারান্দা ছাড়া সেকথা কাউকে বলার নয়।  তুলি কি আনন্দের ভান করে? জাগ্রত তুলির চেয়ে ঘুমন্ত তুলিকে অহমের পক্ষে নিরাপদ মনে হয়।

তুলি কিন্তু স্বাভাবিক সকাল থেকে। যথাবিহিত রীতিপূর্বক প্রথম কাপ গ্রিন টি এগিয়ে দিল। শ্রী চৌধুরীও সহজ হতে চান। তুলিকে খুশি করতে কী করা যায়? ভ্যাকেশনে একটা ট্যুর?

-সামারের ট্যুরটা প্ল্যান করে নাও।

তুলি অবাক হয়। সংসারে ব্যবস্থাপক ও আজ্ঞাকারীর ভূমিকা বাঁধাধরা বলেই সে জানে।

-আমি? তুমিই করো।

জোর করে ট্যুর অপারেটরকে ফোন লাগিয়ে তুলির হাতে ধরিয়ে দেন শ্রী চৌধুরী।

-হ্যালো, আমি মিসেস চৌধুরী। আমার স্বামী, শ্রী চৌধুরী, ইন্টেলের, চিনতে পারলেন? হ্যাঁ হ্যাঁ, স্বামী, চৌধুরী…

‘স্বামী চৌধুরী’ শুনে হাসি পায়। সস্নেহে  স্ত্রীর জড়তা ও অপ্রতিভতা দেখেন শ্রী  চৌধুরী। নিজের নাম অদ্যাক্ষর হয়ে গেছে, বাকিটা চাপা পড়েছে কোম্পানির তলায়।

‘স্বামী চৌধুরী’ নামটি মন্দ নয়। শ্রী চৌধুরি, এই ডুপ্লেক্স, ওই বারান্দা, এই  সন্ততিযুগল ও ওই নারীশরীরটির মালিক, প্রভুসূচক পরিচয়ে প্রত্যয় ফিরে পান।

*****

তিয়াষ চৌধুরীর ভালো লাগে না পাশের ঘরের ধুপধাপ। অন্বেষা বলে, মা-বাবার  খেলাধুলো। দু’পক্ষই খেলতে রাজি থাকে কি? মাকে সুখী লাগে না। এমনিতে, ভাই বাবা-মার সঙ্গে শোয়। শনিবার এলেই মা বলে, ‘ভাই আজ দিদিভাই-এর সঙ্গে শোবে, কেমন?’ মাকে যুগপৎ নির্লজ্জ ও অসহায় শোনায় সে সময়।

আজ উইকেন্ড নয়। অথচ অদ্ভুত সব কাণ্ড ঘটছে। সকালে বাবা বেরিয়ে যাওয়ার পর, স্কুল কামাই করতে বলল মা।

-একটা জায়গায় যাবি আমার সঙ্গে, পাপান?

বালিকার আকুতি মায়ের চোখে।

ড্রাইভার যথাসময়ে এল। মামাবাড়িতে ভাইকে ড্রপ করে মা গাড়ি ঘোরালো গড়িয়াহাটের দিকে।

-হাসপাতালে একটা ছোট অপারেশন হবে। আজ থাকতে হবে মনে হয়। মামাবাড়ি চলে যাবি ভাইয়ের কাছে?

তিয়াষ মাথা নাড়ে।

ফর্ম-ফিলাপে তিয়াষ ‘টিউবাল লাইগেশন’ পড়তে পারে। গুগলের কল্যাণে মানে উদ্ধার করা কঠিন নয়।

-বাবা জানে? বাবা এলো না? জেনেবুঝে একা ছেড়ে দিল তোমায়?

-বাবার অনেক কাজ। তাছাড়া

-কী?

-এসব কাজে বাবা আসে না। বোধহয় লজ্জা পায়।

পুরুষ নিশ্চিন্তে প্রবিষ্ট হতে চান। তাই নারী এসেছেন একাকী। নিশ্চিন্ত যৌনতার ভূমি হয়ে উঠতে রক্তাক্ত হবেন নিজে। পেট গুলিয়ে ওঠে। কাকে ঘেন্না করা উচিত হবে? হাসপাতালের গন্ধকে? জনককে? নিজের অস্তিত্বকে?  মা ফোন রেখে চলে গেছে ভিতরে।  নিঃশব্দ মুঠোফোন কেঁপে ওঠে। মায়ের শাঁখা-বাঁধানো, পলা-বাঁধানো, নোয়া - এখনও ধরা তিয়াষের হাতে। এমনভাবে ঘৃণায় তাদের আলগোছে ধরে আছে, যেন অসাবধান হলে তার হাতেও এঁটে যাবে তারা। বাবার ফোন ধরে না তিয়াষ। মোবাইল কেঁপে কেঁপে নেতিয়ে পড়ে।

*****

-দেশপ্রিয় পার্কে বসবি একটু?

ফেরার পথে মা বেমক্কা বলে ওঠে। মায়ের ছোটবেলার পাড়া। পরদিন হাসপাতালে মাকে নিতে এসেছিল তিয়াষ। এবার গাড়ি আবার মামাবাড়ির পথ নিয়েছে। ভাইকে তুলতে হবে।

গাড়িটা ওদের নামিয়ে চলে গেল। এখান থেকে মামাবাড়ি হাঁটাপথ। রাধাচূড়া গাছের নিচে, রোয়াকে বসা গেল।

-জানিস পাপান, আমি একা হাসপাতাল যেতে ভয় পাই৷ মা হাত ধরে থাকত ছোটবেলায়, ইঞ্জেকশন দিতে এলে। গেল বার, অ্যাবর্শনের সময়, খুব ভয় পেয়েছিলাম।

-মা, তোমার এসব ভালো লাগে?

-কীসব?

-এইসব হ্যাজার্ডস... ওষুধ নিতে না কেন তুমি?

-সহ্য হয় না।

-বাবাও তো পারত ব্যবস্থা নিতে…

-ও ওরকমই।

-তোমার ভালো লাগে?

মা কথা ঘোরায়।

-নাচের ক্লাসের ছেলেটাকে আমি দেখেছি। ভারি নরম দেখতে।

-কীভাবে দেখলে?

-দক্ষিণী থেকে তোরা হাত ধরে ফিরছিলি।

-বাবা ওকে পছন্দ করবে না। ও বাবার টাইপ নয়। বাবা বলে আমি নাচ শিখলে  গ্রেসফুল হব। তাহলে অরণ্য নাচ শিখলে তা গ্রেসফুল কেন নয়?

-আমার তো পছন্দ।

-থ্যাঙ্কিউ। কিন্তু কথা এড়িয়ে গেলে। তোমার ভালো লাগে?

-কী জানি! আমারও তো ইচ্ছে করে। নানারকম ইচ্ছে। তবে একান্ত আমার ইচ্ছে। কাউকে বলিনি।

তিয়াষ শোনে।

-তোরা চুমু খেয়েছিস? আমি চুমু খাইনি অনেকদিন। শেষ কবে যে…

মায়ের অতৃপ্তি কোকিলের আর্তনাদ হয়ে যায়। তিয়াষের কাঁধে মায়ের মাথা। তিয়াষ আঁজলা ভরে মাতৃ-অশ্রু ধারণ করে৷

তিয়াষ পাপান চৌধুরী, সেদিন গোধূলিতে, বীর্যের মধ্যস্থতা ছাড়াই মা হয়ে ওঠে।

 


15 কমেন্টস্:

  1. সব তুলির তিয়াষ থাকে যেন। আর তিয়াষ রা যেন জীবনের সব আঙ্গিকেই সক্রিয় থেকে নিজের চাওয়া পাওয়া বুঝে নিতে পারে। ❤️

    উত্তরমুছুন
  2. অদ্ভুত ঘোর ধরানো লেখা।

    উত্তরমুছুন
  3. যুগোপযোগী... বাস্তবকে তুলে ধরেছেন অপূর্ব ভাষায়...

    উত্তরমুছুন
  4. বড্ড ভালো। ন্যাকামি বর্জিত, বলিষ্ঠ এবং স্পষ্ট। ভালো লাগল বহুদিন পরে একটি ঠিকঠাক গল্প পড়ে।

    উত্তরমুছুন
  5. বড্ড ভালো। ন্যাকামি বর্জিত, বলিষ্ঠ এবং স্পষ্ট। ভালো লাগল বহুদিন পরে একটি ঠিকঠাক গল্প পড়ে।

    উত্তরমুছুন
  6. তিয়াশ পাপান চৌধুরীর মুঠো শক্ত হল। তুলিদের হাত পেলব কোমল

    উত্তরমুছুন