৭২ ঘন্টা
“আমার বাচ্চাটার নাম কী ছিলো দিদি? দুই নাম্বার বাচ্চাটার যে পাঁচ মিনিট পরে এসেছিলো? কিছুতেই মনে পড়ছে না তো!” প্রীতি বোনের হাত চেপে ধরেছে। বড়বোন তাকে রুই মাছ বেছে বেছে খাওয়াচ্ছে। “হাঁ করো তো প্রীতু, দেখি তো!” ফট করে প্রীতির মুখে লেবুঘ্রাণ এক গাল ভাত দিয়ে দিয়েছে। এখন মুখভর্তি ভাত। প্রীতির কথা কিছুই বোঝা যায় না, তাও সে বলবে। “আমি আর কতদিন ওদের বিবিয়া বিবিয়া বলে ডাকবো বলো তো!” গাল ফুলিয়ে ফুলিয়ে খায় আর কথা চলে।
“উফফ এত কথা বলে না বুন্নু! এই নাও পটলটা কত্ত বড় দেখো! কত্ত মজা করে রান্না করেছি বলো তো! নারকেলের দুধও দিলাম”।
“খুব মজা দিদি”। প্রীতির গাল আবার খালি হয়েছে। পেট মোটা পটল আঙ্গুল দিয়ে গুঁতো দিলেই পেটের মধ্যে থেকে কিমা আর সবজিরা বের হয়ে আসে।
“আমার পেটটাও এরকম ফুলো ছিলো, তাই না দিদি?” দিদি আনমনা।
“পেটের ওপরে পেটিকোটের ফিতে তো ঢিল করে বাঁধতে হতো। হিহিহিহি। পেটের মধ্যে বাবুরা ছিলো যে। আচ্ছা ওদের নাম যেন কী ছিলো?”
ভালো করে খাইয়ে মুখ ধুইয়ে দিয়ে আঁচল দিয়ে মুখ মুছিয়ে দিলো বোনের। যতই তোয়ালে থাকুক তাকে আঁচল দিয়েই মুখ মোছাতে হবে। প্রীতি খুব পছন্দ করে দিদির পারফিউম ঘ্রাণ কাপড়ে নাক ডোবাতে।
“এখন চলো প্রীতুমণি ঘুমাবে”।
“ঘুমাবে না জানো তো! আমি ঘুমালেই তুমি দরজা খুলে বেরিয়ে যাবে প্রীতুকে রেখে”।
চোখ গোল গোল করে প্রীতি বলতে থাকে পাঁচ বছরের বাচ্চাদের মতো। তার মানসিক বয়স অবশ্য পাঁচের বেশি আর হবে না কখনও। মানসিক বয়স বাড়ে না, কেবল কমে কমে যায়। বেপরোয়া দুর্ঘটনায় প্রীতির বয়স এগিয়ে যাবার বদলে পিছিয়ে জন্মের শুরুর দিকে চলে গেছে। সাদাকালো ঘোলাটে রঙের দিকে। ঘষা কাচের মতো ঝাপসা ছবির দিকে। সেই সাইকেল সময়টাতে, যখন তারা পাড়ার ‘এভারনিউ স্টুডিও’তে ছবি তুলে সারাদিন বেড়াতো এবং রাতের খাবার মোরগপোলাও দিয়ে সেরে মৌরি চিবোতে চিবোতে হেঁটে হেঁটে বাড়ি ফিরতো। সেসব গল্পগুলো কী মিষ্টি টুংটাং আওয়াজের অনেক সেজেগুজে ঘুরে বেড়ানো রিকশাগুলোর মতো সুন্দর ছিলো। বৈশাখী মেলায় মাটির হাতি ঘোড়ার সাথে রংচঙে চুমকি ঠাসা কাপড়ের বউপুতুলের ভেজাটানা কাজল চোখের দৃষ্টির মতো জান্তব যেন এখনই পুতুলেরা কথা বলে দেবে।
“সব কথা এখন বন্ধ, ফুলস্টপ। প্রীতুর চোখ বন্ধ করে দেখি তো!”
“আমি দেখি তো!” প্রীতি বোনের মতোই সুর তোলে।
“আহা তুমি চোখ বন্ধ করো, আমি দেখি বুন্নু!” আস্তে আস্তে থাবা দিয়ে দিয়ে তিন বছরের ছোটবোনকে ঘুম পাড়ালো বীথি।
ওষুধের প্রতিক্রিয়ায় প্রীতুর সাথে ঘুমিয়ে পড়েছে যেন সারাবাড়ি। সারাবাড়ির সব কিছুর সুর কেটে তছনছ হয়ে গেছে।
এই তো ছ’মাস আগেই যমজ সন্তান হয়েছিলো প্রীতির। বিয়ের প্রায় ন’ নছর পর। অনেক সাধ্য সাধনার বাচ্চা। জন্মের সময় কোনো কমপ্লিকেসি এরাইজ না করলেও জন্মের একদিন পর প্রথমে ছোটজন এবং পরদিন বড়বাচ্চার প্রচুর শ্বাসকষ্ট শুরু হয়। দ্রুত ইনক্রুবেটারে শিফট করা হয় তাদের।
একসাথে পৃথিবীতে আসা দুইবোন একই সাথে কঠিন এই পৃথিবীকে হাত নাড়তে নাড়তে চলন্ত সিড়ি বেয়ে চলে যায় বাহাত্তর ঘন্টা পর। যেন তাদের দু’টি সত্ত্বা এখানেই ছিলো, এখানেই আছে। শুধু তাদের বদলে অদৃশ্য কনো অস্তিত্বের কামিনী ঘ্রাণ তাদের বুঁদ করে রেখে গেছে।
পোস্ট অপারেটিভের পর থেকে এক এক করে দুই সন্তানকেই পেয়েছিলো মা। বাহাত্তর ঘন্টার মা দু’হাতে স্যলাইন উপেক্ষা করে বাচ্চাকে বুকে ধরে রেখেছিলো। মেয়ের মুখের দিকে তাকাতে গিয়ে প্রীতি কিছুই দেখতে পাচ্ছে না। সিস্টার তখন যত্ন করে চোখের জল মুছে দেয়। “এই যে দেখেন, আপনার পরী মেয়ে দেখেন। আপনার চোখ ভর্তি পানি ছিলো তাই দেখতে পাননি”। চোখে প্রাণ ভরে দেখেই নাম ঠিক করে ফেলে প্রীতি।
বীথির চোখে এই দৃশ্যে নেশা ধরে গেছে। কিম্বা নেশা হয়েছে অন্য কিছু।
ফিডারগুলো প্রতি দিনের মতো একবার ফুটিয়ে নিলো বীথি। মায়ের বুকের দুধ না এলে বাচ্চাদেরকে গুঁড়ো দুধ বানিয়ে খাওয়াতে হবে। প্রীতি নেহাৎই ছেলেমানুষ, ও এসব পারবে না। ধীরে ধীরে গরম পানি থেকে ফিডারগুলো তুলে শুকনো কাপড়ে মুছতে থাকে নিঃসন্তান বীথি। মনে মনে বোনের মেয়েদের ডাকে, রানিয়া-মুনিয়া, চলো সোনা মণিরা, দুধ খাবে এখন!
সুন্দর গল্প ! ভালো লেগেছে ।
উত্তরমুছুন