অংশত দেহ ও অংশত আত্মা
গ্রীসে বোধহয় এত এথিক্যাল দার্শনিক আর আগে আসেন নি। এখানে
আলোচ্য বিষয় প্লেটো-ফিদো এবং প্লেটো-ফিদ্রাস নামক দুটি মাস্টারপিস। বলা হয়
সক্রেটিস যদি কোনো বুদ্ধিবৃত্তিক ধারার প্রতিষ্ঠাতা না হয়ে বিশ্বধর্মের
প্রতিষ্ঠাতা হতেন, তবে তাঁর পবিত্রতম
ধর্মগ্রন্থের মর্যাদা পেত ফিদো। সক্রেটিসের জীবনাবসান কালে (হেমলক গাছের নির্যাস
তথা বিষপান করিয়ে তাঁর মৃত্যু ঘটানো হয়েছিল, তৎকালীন অ্যাথেন্সে এইভাবেই মৃত্যুদন্ড দেওয়া হত) তাঁর যে দর্শন তিনি তাঁর শিষ্য বা সহচরদের বলে গেছেন, তাই ফিদো দ্বারা সংরক্ষিত
হয়েছে। সক্রেটিস লেখাকে জ্ঞানার্জনের সঠিক
পথ মনে করতেন না, তাঁর মনে হত,
একবার লেখা সমাপ্ত হলে তা স্থবির হয়ে যায়, কিন্তু জ্ঞান হল জীবন্ত জিনিস যা
সংলাপের মাধ্যমে পরিবর্তিত ও পরিবর্ধিত
হয়ে শুদ্ধতর হয়। এই ভাবনার জন্য বোধহয় তিনি নিজে কিছু লেখেননি। সক্রেটিস একথাও
বলেছেন, জীবনে যা যা শিক্ষা তিনি আহরণ করেছিলেন, পরবর্তীতে বহু কিছুরই সহজ হিসেব পরিস্থিতি তিনি মেনে নিতে
পারেন নি, তাই তাঁকে অনুসন্ধানের পথে এগোতে হয়েছে, যেমন গ্রহণ দেখার সময় প্রত্যক্ষ দেখলে ইন্দ্রিয় খারাপ হওয়ার সম্ভাবনা
থাকে, তাই কোনো এক মাধ্যম জল বা কাচ লাগে; তেমনই তাঁর মতে বৌদ্ধিক দর্শন বা যে
কোনো উচ্চমাত্রার জ্ঞান ব্যক্তি কখনোই
হুটহাট গ্রহণ করলে তাঁর স্থিতি নষ্ট হয়, তাকেও ঠিক কোনো সূত্রের মাধ্যম অবলম্বন করতে হয়।
জীবনের অন্তিম পর্বে
এসে শিষ্য দ্বারা পরিবৃত হয়েও তিনি ছিলেন স্বচ্ছ এবং নিজেরই ভাবনাগুলোকে নিজেই
প্রতিষ্ঠা করছিলেন না অচিরেই, তিনি তার ফাঁক
,
তার দুর্বল অংশকে তার শিষ্যদের প্রশ্নের মাধ্যমে সংলাপে
সংলাপে উত্তরণের পথ তৈরী করছিলেন , যেন এই মুহূর্তেই সৃষ্টি হচ্ছে তার ভাব। তিনি প্রশ্নে-উত্তরে-সূত্রে, যুক্তিতে নিজেকে ছেনে ছেনে প্রমাণ করাচ্ছিলেন তাঁর ভাবনা,
এই আমরা অংশত দেহ ও অংশত আত্মা, তাই কখনও কোনো মিথ বা প্রচলিত আখ্যান থেকে উদ্ধৃত নয়, তিনি তা যুক্তির
দ্বারা দেখিয়েছেন। ব্যক্তির দর্শন যদি
মৌলিক হয় তাঁর মৌলিকত্বের কারণেই তা মৌলিক হয়, তাই তিনি কখনো চাপিয়ে দেননি তাঁর
ধারণা। মৃত্যুর শেষ সময়টুকু অবধি তিনি তাঁর শিষ্যদের বলেছিলেন, তাঁর যুক্তিতে টান
পড়লেই যেন তাঁকে প্রশ্ন করা হয়। তাঁর মৃত্যুর
জন্য ব্যথিত মানুষদের তিনি কী নির্মোহ ও বাস্তবিক সহজ থাকতে শিখিয়েছিলেন, তা
অনবদ্য। তিনি জীবনকে বৈপরীত্যের সূত্র দিয়ে অসাধারণ প্রয়োগ শিখিয়েছিলেন - যেমন ক্ষুদ্র/বৃহৎ কিম্বা লম্বা/বেঁটে
এই সকল বৈপরীত্য দুদিকেই যায়, যেন একে ওপরের
উৎসের মতো কোনো একটা কিন্তু অন্তিম নয়, ঠিক তেমন নিদ্রা আর জাগরণ। যদি নিদ্রা
ধ্রুবক হতো তাহলে তো জাগরণের অস্তিত্ব
থাকতো না অথচ আছে, তাই যদি জীবনের বিপরীত মৃত্যু হয় তবে মৃত্যুর বিপরীত জীবন। অতএব জীবনও মৃত্যু থেকেই আসে অর্থাৎ
মৃত্যুই অন্তিম সত্য নয়, এরপরেও কিছু আছে যা এই চক্রকে বজায় রাখছে আর তা কখনোই
দৃশ্যমান বিষয়ের ওপর নির্ভরশীল নয়। অদৃশ্য বহু কিছু আছে যা এই পার্থিব উপাদানই। জীবনের অবসান
মানে চামড়া তথা আকৃতি তথা দৃশ্যের অবসান কিন্তু তাতে অদৃশ্যের অবসান হয় কী!
দৃশ্যমান ইন্দ্রিয় তার নিজস্ব সুখে নিমজ্জিত থাকে বলে তার অদৃশ্যকে অনুধাবন করতে
পারে না, প্রজ্ঞা আসে না, ফলে এক দেহ কেবল নিষ্কৃতি পায় বাকি সব ব্যর্থ হয়। ট্রয়ের যুদ্ধের
সময় অদিসিয়াসের অনুপস্থিতিতে সুন্দরী স্ত্রী পেনেলপিকে বহু পুরুষ প্রেমপ্রস্তাব
দিতেন আর তা এড়ানোর জন্য তিনি বলেছিলেন, তিনি এখন বিশেষ কিছু বুনছেন, যেদিন তা শেষ
হবে সেদিন তিনি সিদ্ধান্ত নেবেন, আর তাই
দিনে যা বুনতেন রাতে আবার তা খুলে দিতেন সময়কে লম্বা করার জন্য। প্রকৃত
জ্ঞানহীন দেহ এই সুতো বুনে খুলে ফেলার মতোই, কারণ এই অংশত দেহ ও আত্মার অংশে যদি দেহ জিতে যায় তবে
আত্মা আর অমরত্ব পায় না। এই অদৃশ্য, ঈশ্বরীয়, প্রজ্ঞামূলক, ইন্দ্রিয়রহিত, সঙ্গত অস্তিত্বকে তিনি জিততে বলেছেন, আর তা কেবল সম্ভব জ্ঞানের দ্বারা যা না
হলে ভারসাম্যই থাকে না।
এবার আসি প্লেটো-ফিদ্রাসের কথায়। এখানে প্রেম, বাগ্মিতা ও দর্শন নিয়ে সংলাপ আলোচিত হয়েছে। এখানে শুরুতে সক্রেটিস প্রেম
সম্পর্কে বলেন যে, প্রেম হল বাসনা আর ফলে
তা জীবনের পক্ষে ক্ষতিকর। পরে
তিনি মত বদলেছিলেন। এখানে
বিষয়টির সূত্র এসেছে গ্রীসের সুপরিচিত
বাগ্মী লাইসিয়াসের প্রেম সম্পর্কিত বক্তৃতা দিয়ে। ফিদ্রাস কথার
অর্থ উজ্জ্বল। ফিদ্রাস এখানে সক্রেটিসের সঙ্গে দীর্ঘ আলোচনায়
প্রেম,
বাগ্মিতা ও দর্শন বিষয়ে কথা বলেছেন। বিষয়টি পাঠকের কাছে প্রাথমিক ভাবে খাপছাড়া মনে
হলেও পরে তা অনুসরণ করা যায়। সক্রেটিস পরবর্তীতে প্রেমকে ‘ঐশী উন্মাদনা’ বলেন কিন্তু তার প্রসঙ্গ আসে লাইসিয়াসের বক্তৃতা দিয়েই যথা - যে যার প্রেমে পড়েছে তাদের
বাসনা যখন চরিতার্থ হবে তখন তাদের নিবেদিত জিনিসপত্রের প্রতি তাদের অনুশোচনা হবে,
আর ভালবাসা মানে এ ধরনের ভালবাসা যোগ্য-অযোগ্য ভেদ ভোলে, তাই তা লাভজনক কখনো নয়। কারণ যারা আপনাদের প্রেমে পড়েছে তাদের মধ্যে
থেকে নির্বাচন খুব ক্ষুদ্র, আর যারা প্রেমে পড়েনি এই মোট অংশটা বিরাট, এখানে যোগ্য
পাওয়া যেতেই পারে। আরও বিষয়, প্রেমিকেরা
সাধারণত আপনাদের চরিত্র বা বৈশিষ্ট্য জানার আগে দেহলাভের কামনা আনে, ফলে এই অধিকার ও আকাঙ্ক্ষা
বোধের জালে বন্ধুত্বও টেকে না! যে কথাটি
এখানে গুরুত্ব পায় তা হলো প্রেমিকের প্রতি নয় বরং অপ্রেমিকের প্রতিই আনুকূল্য
দেখানো উচিত। আনুকূল্য বলতে যৌনসম্পর্ক বোঝানো হয়েছে। তাই বাসনার পর মনে হবে এখানে
সুযোগ না দেওয়াই ভাল ছিল। অপ্রেমিকদের ক্ষেত্রে হবে না তা! যেহেতু প্রেমিক নিজেও
জানে প্রেম এক উন্মাদনা, তাই ঘোর কেটে গেলে সে লজ্জিত বোধ করে, তাই পুরাতন প্রেমাস্পদের প্রতি সে অসদাচারণ
করবে। এই ধারণা ‘কাউন্টার’ করেই সক্রেটিস ‘লাভক্ষতি’ মূল্য|য়ন আনেন। এক্ষেত্রে তিনি দু’বিষয়ে গুরুত্ব দেন। এক -
আমাদের ভোগসুখগত বাসনা, দুই - বিচারবোধ। এখন বিষয় টিকে থাকার লড়াইয়ে কে কার ওপর
আধিপত্য করবে! তাই তিনি বলেন, নেকড়ে কী মেষকে ভালবাসে? আর ভালবাসলে এ
ভালবাসা নিশ্চয় তার খাদ্যপ্রিয় হওয়ার কারণে। কিন্তু পরবর্তীতে তিনি মত বদলান। বলেন, যেখানে প্রেমিকের দেখা মেলে সেখানে
অপ্রেমিকের প্রতি আনুকূল্য না দেখানোই ভাল। আর প্রেম হল উন্মাদনা। আর এমন বহু
উন্মাদনা আছে যা ইতিবাচক তাই প্রেম যখন ঐশী হয়, আত্মার অভিব্যক্তি হয়ে ওঠে , তখন সেই ঐশী উন্মাদনাই প্রেম। এই দুই ‘মাস্টারপিস’ সত্যিই
ভাবনার মোচড়কে স্থাণু করে। এগুলি এই সংকটময় মুহূর্তের উপাদেয় অংশ।
[ আলোচনা সংগৃহীত হয়েছে ‘প্লেটো-ফিদো’
ও ‘প্লেটো-ফিদ্রাস’ এই বই দুটি থেকে। পাঠক সমাবেশ প্রকাশনীর এই দুটি বই অনুবাদ
করেছেন লেখক আমিনুল ইসলাম ভুইয়া। পাঠক সমাবেশ (১৭/এ আজিজ মার্কেট, গ্রাউণ্ড ফ্লোর, শাহবাগ, ঢাকা-১০০০) ও ভারতী বুক স্টল (৬বি, রমানাথ মজুমদার স্ট্রিট। কলকাতা–৭০০০০৯]
একদম ঠিক। প্রেম 'ঐশী উন্মাদনা'। সহজভাষায় গভীর আলোচনা।
উত্তরমুছুন