কালিমাটি অনলাইন

দ্বাদশ বর্ষ / চতুর্থ সংখ্যা / ১২৪

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

দ্বাদশ বর্ষ / চতুর্থ সংখ্যা / ১২৪

শনিবার, ২৫ জুন, ২০১৬

কাজল সেন

ছাদের গল্প 


একটা দমকা হাওয়া উঠতেই ঝুম্পা আমার হাত ধরে অনুনয় করল, চল্‌ মুন্না, আমরা ঘরে ফিরে যাই!

ঝুম্পা আমার বান্ধবী এবং অদূর ভবিষ্যতের সম্ভাব্য বউ। খুব সাধারণ গলায় ঝুম্পা কথাটা বলেছিল। কিন্তু আমার কেমন যেন খটকা লাগল। ঘরে ফিরে যাই! মানে! কোন্‌ ঘরে! ঝুমাকে বললাম, তুই কোন্‌ ঘরে ফিরে যাবার কথা বলছিস? এখন ঘরে ফেরা মানে তো তুই তোর বাবার ঘরে ফিরে যাবি আর আমি আমার বাবার ঘরে। তাই না?
ঝুম্পা একটু হকচকিয়ে গেল। বিষণ্ন গলায় বলল, সত্যিই তো, আমাদের এখনও তো কোনো ঘর নেই! তাহলে কী হবে আমাদের?

আমি ঝুম্পাকে বুঝিয়ে বললাম, তুই আর একটু তলিয়ে ভেবে দেখ ঝুম্পা। আজ সামান্য একটা দমকা হাওয়া, যৎসামান্য এলোমেলো ঝড়, চোখে মুখে ধুলোর ঝাপটা;  আর তাতেই আমার চোখে জল আর তোর মুখে লালা। এরপর যদি ঘূর্ণিঝড় ওঠে, তাহলে কী হবে! তুই আর একটু এগিয়েও ভাবতে পারিস, এই যেমন ধর আরও বড় কোনো ঝড়, যেমন ধর আয়লা বা লায়লা অথবা ক্যাটরিনা...! তখন কী হবে! আমরা কী করব! আমার বা তোর কারোরই কিন্তু কোনো ঘর নেই এখনও। আমরা কোন্‌ ঘরে ফিরে যাব? 
ঝুম্পা অনেকক্ষণ ভাবল। গভীর ভাবনায় ঝুম্পার মুখটা থমথমে আর টসটসে হয়ে উঠল। ঝুম্পাকে জড়িয়ে ধরে চুমু খেতে খুব ইচ্ছে করছিল আমার। কিন্তু ঝুম্পা আমার দিকে তাকালো না। চুপচাপ তাকিয়ে থাকল আকাশের দিকে। তারপর সমস্যার একটা আপাত সমাধান খুঁজে পেয়ে প্রসন্ন গলায় বলল, চল্‌ মুন্না, আমরা বিয়েটা তাহলে চটপট সেরেই ফেলি!

আমি জানতাম, ঝুম্পা আমাকে এই কথাটাই বলবে। এটাই সরল সমীকরণ। বিয়ে করা মানেই প্রথাগত ভাবে একসঙ্গে থাকা। আর একসঙ্গে থাকতে হলে একটা ঘরের প্রয়োজন। জরুরি প্রয়োজন। যে ঘরে দিনের বেলা অন্য কেউ প্রবেশ করতেই পারে, কিন্তু রাতে প্রবেশ করা দন্ডনীয়।

আমি ঝুম্পাকে আবার বোঝালাম, তুই কি ভাবছিস আমাদের একটা ঘর হলেই আমরা নিশ্চিন্তে থাকতে পারব? সেই ঘরে ধুলোবালি ঢুকবে না? ঝড় ঘূর্ণিঝড় হানা দেবে না? তুই তো ভালো করেই জানিস ঝুম্পা, এইসব ঘূর্ণিঝড় কত কত ঘর বাড়ি প্রাসাদ আজ পর্যন্ত ধ্বংস করেছে, উড়িয়ে নিয়ে গেছে; কত কত মানুষের জীবন ধুলোয় মিশিয়ে দিয়েছে! আয়লা... লায়লা... ক্যাটরিনা... শুধুই নয়, সেই যে সেই বছর সুনামি আক্রমণ করল... কত ঘর যে ভেসে গেল, উজাড় হয়ে গেল...

ঝুম্পা এবার সত্যি সত্যিই খুব দুশ্চিন্তায় পড়ল। কিছু বলার জন্য হাতড়াতে লাগল তার অর্জিত যুক্তিভান্ডার ও শব্দভান্ডার। কিন্তু যুতসই বা লাগসই তেমন কোনো যুক্তি পাচ্ছিল না। নিতান্তই বেকায়দায় পড়ে চোখদুটো ছলছল, গালদুটো টোপাটোপা। চুমু খাবার পাগলামিটা কিছুতেই আর দমিয়ে রাখতে পারছিলাম না আমি। আমার ঠোঁট ক্রমশই উগ্র হয়ে উঠছিল। কিন্তু ঝুম্পাও এত সহজে হেরে যাবার মেয়ে নয়। তার গ্রে ম্যাটার খুবই উর্বর। আর সেই উর্বর মাঠে দাঁড়িয়ে ঝুম্পা এবার আমাকে লক্ষ্য করে ছুঁড়ে মারল একটা সাংঘাতিক গুগলি। পাল্টা আমাকে প্রশ্ন করে বসল, তাহলে তুই বল মুন্না, ঘর বেঁধেও যদি কোনো দুর্যোগ এড়াতে না পারা যায়, তাহলে কি ঘর না বাঁধাই ভালো? তার থেকেও বড় কথা, ঘর না বেঁধে একা একা থেকেও কি এই দুর্যোগ এড়িয়ে যাওয়া সম্ভব?
এবার আমার সেই সাংঘাতিক গুগলির মোকাবিলা করার পালা। আমি শক্ত করে ঝুম্পার হাত ধরলাম। একটা আলতো টান দিতেই ঝুম্পা আমার সঙ্গে নিবিড় হলো। আমি বললাম, তুই ঠিক কথাই বলেছিস ঝুম্পা। ঘর বা ঘরের বাইরে, কোথাও আমরা এড়িয়ে যেতে পারি না এইসব প্রাকৃতিক দুর্যোগ এবং সেইসঙ্গে পারিবারিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক যে কোনো দুর্যোগ।

ঝুম্পা বলল, জানিস মুন্না, আমি আজকাল ছাদের কথা খুব ভাবি। মাথার ওপর একটা ছাদ। নিশ্চিন্ত। নিরাপদ। এই পৃথিবীর অধিকাংশ মানুষেরই মাথার ওপর কোনো ছাদ নেই। তারাও নিশ্চয়ই ছাদের স্বপ্ন দেখে, তাই না মুন্না! কিন্তু ছাদ থাকলেই বা কী লাভ বল! ছাদও তো দুর্যোগে উড়ে যায়, ভেসে যায়...


এবার আমারও অর্জিত শব্দভান্ডারে টান পড়ছে। শব্দ হাতড়াতে হাতড়াতে বললাম, আসলে কি জানিস ঝুম্পা, আমরা সবাই শুধু ছোট ছোট নিজস্ব ছাদের স্বপ্ন দেখি। কিন্তু যদি সবাই মিলে একসঙ্গে বড় খুব বড় অনেক বড় বিশাল বড় একটা ছাদের স্বপ্ন দেখতাম...  

2 কমেন্টস্:

  1. ভালো লাগলো। ঘর না বেঁধে একা একা থেকেও কি এই দুর্যোগ এড়িয়ে যাওয়া সম্ভব?,ঘর বেঁধেও যদি কোনো দুর্যোগ এড়াতে না পারা যায়, তাহলে কি ঘর না বাঁধাই ভালো?--- লাইনগুলি অন্য মাত্রা আনে।

    উত্তরমুছুন