কালিমাটি অনলাইন

দ্বাদশ বর্ষ / চতুর্থ সংখ্যা / ১২৪

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

দ্বাদশ বর্ষ / চতুর্থ সংখ্যা / ১২৪

রবিবার, ২৬ জুলাই, ২০১৫

মেঘ অদিতি

কিছু বিচ্ছিন্নতার গল্প


(১)
খুব ভোরের দিকে রেলওয়ে প্ল্যাটফর্ম তখন ফাঁকাপ্ল্যাটফর্ম চত্বরে চায়ের প্রথম জল  অবশ্য ফুটতে শুরু করেছিল, আর রোঁয়া ওঠা একটা নেড়ি কুকুর ঘুমোচ্ছিল ঠিক  তার কাছ ঘেঁষে ছিল একে অন্যকে জড়িয়ে থাকা ঠিকানাবিহীন কিছু পথশিশু, যারা  দাঁত পড়ার বয়স থেকেই বিড়ি ফুঁকতে গিয়ে হঠাৎ চিনে নেয় মাদকের টান আর তার ঠিক পুবদিকে শ্রাবণের বৃষ্টি মাখছিল যে খবরের কাগজের স্টলটা, যা এত  ভোরে খোলে না, তার নামানো শাটারের গায়ে এক পা মুড়ে হেলান দিয়ে তখনও  দাঁড়িয়ে ছিল প্রত্ন।
শরীর ভিজে। ভিজে চুলগুলো এলোমেলো পড়ে আছে বিষণ্ণ কপালের কাছে।
আর তখনও তার পা চুঁইয়ে গড়িয়ে নামছে রক্ত।

(২)
চব্বিশ থেকে চৌত্রিশ, বয়স যা কিছু হতে পারে। একটা সাদা চুড়িদার, বৃষ্টির  কাদাজলে তাতে বাটিকের ছোপ ধরেছেযদিও বৃষ্টি, তবু তার হাতে ধরা মুঠোফোন।  বারবার সে কারো নাম্বারে ডায়াল করে যাচ্ছে সকাল সাড়ে আটটা, ফোন সুইচড   অফ। এমনিতে বেলা এগারোটা পর্যন্ত যাকে সে ফোন করছে তার ফোনের সুইচ অফই থাকে, কিন্তু টেলিভিশনে সংবাদ পাঠিকার নির্বিকার মুখের পরিবেশনায় সকাল সাতটায়  ঘটে যাওয়া একটা দুর্ঘটনার কথা কানে আসতে সে হুড়মুড়িয়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে এসেছে।
ফ্যাকাসে মুখ আর সাদা হয়ে ওঠা ঠোঁট নিয়ে অতসী এখন শাহজাহানপুর রেলগেটের সামনে দাঁড়িয়ে।
ঝাঁকড়া চুল বেয়ে আর চোখ থেকে নেমে আসছে শ্রাবণধারা টুপটাপ।

(৩)
বেলা বারোটা। সুমন উদ্বিগ্ন মুখে ঘরে ঢুকল এক ঝুড়ি ফল নিয়ে। ঢোকার মুখেই মা  বলে উঠল, বাবু শুনেছিস খবরটা? সুমন নিরুত্তর, একটু অস্থিরও যেন। ঝুড়িটা টেবিলে রেখে নিজের ঘরে ঢুকে ওয়ারড্রোব খুলে কিছু বের করে এক ছুট্টে বেরিয়ে গেল আবার, যেমন এসেছিলমা তখনও দরজার এপাশে, সুমন খেয়ে যা বাবা...   সুমন... ও সুমন... বলে চলেছেন
মা'র কথায় উত্তর দিতে গেলে এবার তার সত্যিই দেরি হয়ে যাবে। আর কে জানে  কোথায় কে ওৎ পেতে আছে...! সিঁড়ি বেয়ে দুদ্দাড় নামতে গিয়ে সুমনের মনে পড়ল  ওর ফোনটার কথা। তাড়াহুড়োয় ঘরে ফেলে এলো না তো! পকেটে হাত দিয়ে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল। তারপর ফোনের সুইচ অফ করতে গিয়ে দেখল চল্লিশহাজারি ফোনের স্ক্রিনে তখনও রক্তের ছোপ

(৪)
অগ্নিবীণার প্ল্যাটফর্ম বদলের সাথে সাথে ট্রেন ছাড়ার বিলম্বের খবরটি জানাচ্ছে কমলাপুর রেলওয়ের ডিজিটাল ডিসপ্লে বোর্ড। সকাল থেকে বেলা এগারোটা। এখনও   পর্যন্ত লাইন ক্লিয়ার হলো না। দেশটার কী হাল! পুরো মুখের জোরে দেশ চালিয়ে নিচ্ছে সরকার... আর বলবেন না, এ দেশে মানুষ থাকে... আরে মরতে লাইনে শরীর   দিলি কেন, আর কোনো রাস্তা ছিল না! কে জানে আজকালকার ছেলেপিলের কীসের এত ফ্রাস্টেশন, এই করেই জেনারেশন শেষ... নানা অভিব্যক্তিতে অপেক্ষমান যাত্রীদের   ভেতর এবার বিরক্তির শুরু।
টেলিভিশনের স্ক্রলিং নিউজ জানাচ্ছে, কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশন থেকে সামান্য দূরে  শাহজাহানপুর রেলগেটের আগে তিস্তা এক্সপ্রেসে সকাল সাড়ে সাতটায় লাইনে কাটা  পড়েছে কেউ। সেই অজানা যুবকের কোনো পরিচয় এখনও পাওয়া যায়নি। লাইন ক্লিয়ার না থাকায় যাত্রীরা ভোগান্তির সম্মুখীন।  
বৃষ্টি তখনও ছিন্নবিচ্ছিন্ন একটা শরীর থেকে ধুয়ে নিচ্ছে রক্তধারা

(৫)
সুমন বা অতসী। অতসী বা প্রত্ন।
অথবা প্রত্ন, সুমন, অতসী এই তিনটি বিচ্ছিন্ন চরিত্রের সাথে রেললাইনে কাটা পড়া মানুষটির কোনো যোগসূত্র নেই।


7 কমেন্টস্:

  1. আপনার লিখা মুগ্ধতা পেরিয়ে অনেক দূর চলে গেল। সবচাইতে ভাল লাগার দিকটা হচ্ছে, আপনার লিখাগুলি পাঠকের মনে অজস্র ভাবনার জন্ম দেয়। লিখাটা পড়ার পরে আচ্ছন্ন ছিলাম অনেকক্ষণ। নিজেকে কাছাকাছি কোন দৃশ্যপটে খুঁজে পাচ্ছিলাম। জানি না কেন... এমনটা হয়। গল্পটা আমাদের না, আবার আমাদের সবার। আরও লিখুন। অপেক্ষায় রইলাম।

    উত্তরমুছুন
  2. বৃষ্টি তখনও ছিন্নবিচ্ছিন্ন একটা শরীর থেকে ধুয়ে নিচ্ছে রক্তধারা... :)

    উত্তরমুছুন