কালিমাটি অনলাইন

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

শুক্রবার, ২২ মে, ২০১৫

অপরাহ্ণ সুসমিতো

ভেসে যাই জলে

বাবা মারা গেলে আমরা খুব অসহায় হয়ে পড়ি। তিন ভাই বোন নিয়ে মা মহা সংকটে। জমি জিরোত খারাপ না। মা সারাদিন কান্না। কী হবে তার সামনের অদৃষ্ট। আমি তখন ১৭গৌরনদী কলেজে ভর্তি হই আর তখনই রাজনীতির সাথে জড়িয়ে পড়িবড় ভাইরা আমাকে লাল মলাটের বই দেন, পড়ি। শ্রেণীশত্রু চিনতে শেখাননকশাল বাড়ি নিয়ে পড়তে পড়তে ডুবে  যাই অনাগত বিপ্লবে।  

কলেজ থেকে বাড়ি ফিরলে মার অসহায় মুখ দেখিমধ্যরাতে আচমকা শব্দে ঘুম ভাঙ্গলে দেখি মা একাকী ফুঁপিয়ে কাঁদছেনঅসহায় হয়ে জড়োসড়ো হয়ে কানে বালিশ চেপে ঘুমাতে চেষ্টা করি ভোররাতে যখন সবাই ঘুমায়, আমি জেগে থাকি সেনাপতির মতোমুখ গুজে সিরাজ সিকদার  পড়ি, মেহনতী মানুষের স্বপ্ন দেখি...

আমাদের গ্রামের বাড়ি বাটাজোরসকালে কখনো ঘুম চোখে বাটাজোর বাজারে পোদ্দার কাকুর দোকানে রসগোল্লার সিরা দিয়ে গরম পরোটা খাইকাকু কেন যেন মাঝে মাঝে আমার কাছে পয়সা নিতে চাইতেন নাকাকুর মেয়ে শর্বরী মাঝে মাঝে আমার কাছে অংক করতে আসতোদুনিয়ার লাবণ্য স্নান করা যেন শর্বরী।  

শর্বরী সারাক্ষণ মন খারাপ করে থাকত, ওরা ওপার বাংলা চলে যাবেপোদ্দার কাকু নাকি ভেতরে ভেতরে ব্যবস্থা করছেন, ওপারে চলে যাবারকলেজে বড় ভাইদের সাথে আলাপ করতে গেলে বলেন : হিন্দু মুসলমান বিষয় না । বিষয় হলো : ভূমিপ্রথা । সামন্তবাদ আর শ্রেণীশত্রু

একদিন কলেজ থেকে বাড়ি ফিরে এসে দেখি বোনেরা হুলুস্থুল কান্নাকাটি করছেমা ধামুড়া গ্রামের সরফরাজ ইমাদুল নেহাল হাওলাদার কাকার সাথে পালিয়েছেন, আমাদের সবাইকে ফেলে  তার পেছনের সমস্ত ঘর বাটি, মায়াবী ধূলোর সংসার, আত্মজ, আত্মজা ফেলে রেখে

সরফরাজ ইমাদুল নেহাল হাওলাদার কাকুকে আমরা আগে থেকে চিনতাম। অবস্থা সম্পন্ন জোতদারধানী জমি, বাটাজোরে ব্যবসা, বরিশাল-ভুরঘাটা লাইনে ৪টা বাস পরিবহন, সুদের ব্যবসা --  কী নেই তার!  আমাদের বিপদ আপদে পারিবারিক বন্ধু

আশেপাশের লোকজনের টিটকারী, হাসাহাসি, কপট সান্ত্বনা নিয়ে সন্ধ্যা নামেআমি শান্ত দিঘির মতো একলা পুকুর  পাড়ে বসে থাকিকালো ওড়না পরে ঝুপ করে সন্ধ্যা আমাকে নিরিবিলি ছুঁয়ে যায়। কী রকম আজ শান্ত লাগেআচমকা মনে হলো, আহ আজ রাতে আরাম করে ঘুমানো যাবে, গভীর নিশি পাওয়া আমার নরম মাটার আর কান্না শোনা যাবে নাপুকুর পাড়ে কালো কালির মতো, আফ্রিকার সরল মানুষের গতরের মতো নিকষ অন্ধকার নামে। শর্বরীকে দেখতে ইচ্ছে করে খুবইচ্ছে করে ওর কলাবেনী চুলে নাক ডুবাই, নারকেল তেলে আমতলা জামতলা সাজাই

শর্বরীর ঘ্রাণ নাকে থাকতে থাকতে উঠে পড়িহাঁটতে হাঁটতে বাটাজোর বাজারে এলে কেমন যেন প্রাণ আসে ১৭ শরীরে। ভ্যান ভাড়া করি

দাদা, কোম্মে যাবেন?
ধামুড়া ।
এই সন্ধ্যা ওয়াক্ত?
কাম আছে

সেই রাতেই আমার মায়ের ভাতার হাওলাদার কাকুকে আমি রামদা দিয়ে জবাই করি।
ফিনকি রক্তে জোতদার খতম। জামা ভিজে গেলে খুলে ফেলে দিইআহ, শ্রেণীশত্রু নিপাতিত
বাটাজোর বাজারে এসে পোদ্দার কাকুর দোকানে বড় ২ টা পরোটা আর ৪টা রসগোল্লা দিয়ে পেট ভরে খাইসবার সামনে এক গ্লাস পানি খেয়ে শব্দ করে ঢেকুর তুলিআমার যে খালি গা, ভ্রুক্ষেপ করি না

রাত বাড়লে বাড়ির দিকে হাঁটা শুরু করি। ঘুটঘুট ছিনালী অন্ধকার। আমার প্রবল ঘুম পাচ্ছে। পা চলে নাঘুম তাড়ানোর জন্য গান শুরু করি :

ও মন হরি বলো মন রসনা

মানব দেহের গৈরব কইরো না
মানব দেহ মাটির ভান্ড
ভাঙ্গলে হবে লন্ডভন্ড
ও মন জোড়া দিলে তো লাগে না
ও হরি বলো মন রসনা...

আমাদের পুকুর পাড়ে এসে দাঁড়ালে আচানাক মনে হয় আমার সারা গায়ে জমাট কুচকুচ রক্ত। বমি বমি লাগে। প্যান্টটা খুলে ঝাঁপ দিই জলে... আহা কী ঠান্ডা ...

হাত পা ছড়িয়ে ভাসিয়ে রাখি জলে... ধুয়ে যাচ্ছে জমাট রক্ত বুঝি... ঘুম পায়... ঘুম লাগে আদুল শরীরে... মনে হচ্ছে আমার নরম মার  বুকে মুখ গুঁজে ঘুমাচ্ছি।

মা রে!  ও মা ...  মাগো...



0 কমেন্টস্:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন