আওয়ার লেডি অব ফাতিমা
আমি যখন আওয়ার লেডি অব ফাতিমা গার্লস
স্কুলে পড়তাম, তখন এক শ্রাবণীতে বাড়ি থেকে অপহৃতা হই।
আমার বাবা খুব নিরীহ গোছের মানুষ। কান্দিরপাড়ে বাবার কাপড়ের দোকান। খাদির কাপড়ই বেশি। আমার ঠাকুরমায়ের নামে দোকান। রমলা খাদি বিতান। লোকজন খুব বাকি করত। যে বছর বাবরি মসজিদ ভাঙা হলো, লোকজন আর বাবার বকেয়া শোধ করে না। হালখাতা করেও কাজ হয় না। বাবা খুব বিনয়ের সাথে বাকি ফেরত চাইতে গেলে লোকজন বলে,
আমার বাবা খুব নিরীহ গোছের মানুষ। কান্দিরপাড়ে বাবার কাপড়ের দোকান। খাদির কাপড়ই বেশি। আমার ঠাকুরমায়ের নামে দোকান। রমলা খাদি বিতান। লোকজন খুব বাকি করত। যে বছর বাবরি মসজিদ ভাঙা হলো, লোকজন আর বাবার বকেয়া শোধ করে না। হালখাতা করেও কাজ হয় না। বাবা খুব বিনয়ের সাথে বাকি ফেরত চাইতে গেলে লোকজন বলে,
: শত্রু সম্পত্তি আইনে ফালাই দিমু হরিহরণ
বাবু!
তখনি অভাব আমাদের ঘরের ফাকঁফোকড় দিয়ে ঢুকতে শুরু করে। তারপরেও বাবা আমার জন্য সংগ্রাম করছিলেন। মেয়ে বড় হলে তাঁর অভাব ঘুচবে।
আমার বান্ধবী সুরাইয়ার ভাই ফরাস উদ্দিন, যাকে আমরা দুষ্টুমি করে ফসফরাস বলতাম, সে এই অঘটনটি ঘটায়। কী সুন্দর বৃষ্টি থেমে যাবার পর যখন কুমিল্লার সমস্ত আকাশ চাঁদের বাণভাসি আলো, অপূর্ব শ্রাবণী, ফসফরাস ভাই তার তিন চারজন বন্ধু নিয়ে বাবার মুখের ভিতর পিস্তল ঢুকিয়ে আমাকে টেনে হেঁচড়ে মোটর সাইকেলে তোলার চেষ্টা করে।
মা ফসফরাস ভাইয়ের পায়ের উপর আছড়ে চিৎকার করে কাঁদে।
: বাবারে তুমি আমার ধর্ম ছেলে। আমি তোমার মা লাগি। আমার পদ্মরে ছাইড়া দাও।
ফসফরাস ভালো ফুটবল খেলত। মাকে সোজা কিক করে বলে,
: সামনে থেইকা সর মাগি!
আমার নাম পদ্মিনী সাহা। মা আমাকে আদর করে পদ্ম বলে ডাকে।
বাবা পাগলের মতো পাশের বাড়ি দৌড়ে যায়, এ বাড়ি ও বাড়ি করে। লোকজন যেন মজা পাচ্ছিল, কেউ এগিয়ে আসেনি।
তিনটি মোটর সাইকেল ছুটে চলে রাতের নোলক সুন্দর চকচকে আলোতে। বৃষ্টি হয়ে যাবার পর সদর রাস্তা স্নান সেরে ওঠার মতো শোভন। গাছের পাতায় চন্দ্রভূক আলোতে শচীনদেব বর্মণের গানের মতো মধুমাখা। মোটর সাইকেলে আমি শক্ত হয়ে বসে আছি। আমি মাঝে। চালাচ্ছে ফসফরাস, পেছনে ওর এক বন্ধু। পেছনের লোকটা আমাকে ঠেসে ধরে আছে, লোকটার নি:শ্বাসে দুর্গন্ধ। কতদিন দাঁত ব্রাশ করেনি, কে জানে!
তখনি অভাব আমাদের ঘরের ফাকঁফোকড় দিয়ে ঢুকতে শুরু করে। তারপরেও বাবা আমার জন্য সংগ্রাম করছিলেন। মেয়ে বড় হলে তাঁর অভাব ঘুচবে।
আমার বান্ধবী সুরাইয়ার ভাই ফরাস উদ্দিন, যাকে আমরা দুষ্টুমি করে ফসফরাস বলতাম, সে এই অঘটনটি ঘটায়। কী সুন্দর বৃষ্টি থেমে যাবার পর যখন কুমিল্লার সমস্ত আকাশ চাঁদের বাণভাসি আলো, অপূর্ব শ্রাবণী, ফসফরাস ভাই তার তিন চারজন বন্ধু নিয়ে বাবার মুখের ভিতর পিস্তল ঢুকিয়ে আমাকে টেনে হেঁচড়ে মোটর সাইকেলে তোলার চেষ্টা করে।
মা ফসফরাস ভাইয়ের পায়ের উপর আছড়ে চিৎকার করে কাঁদে।
: বাবারে তুমি আমার ধর্ম ছেলে। আমি তোমার মা লাগি। আমার পদ্মরে ছাইড়া দাও।
ফসফরাস ভালো ফুটবল খেলত। মাকে সোজা কিক করে বলে,
: সামনে থেইকা সর মাগি!
আমার নাম পদ্মিনী সাহা। মা আমাকে আদর করে পদ্ম বলে ডাকে।
বাবা পাগলের মতো পাশের বাড়ি দৌড়ে যায়, এ বাড়ি ও বাড়ি করে। লোকজন যেন মজা পাচ্ছিল, কেউ এগিয়ে আসেনি।
তিনটি মোটর সাইকেল ছুটে চলে রাতের নোলক সুন্দর চকচকে আলোতে। বৃষ্টি হয়ে যাবার পর সদর রাস্তা স্নান সেরে ওঠার মতো শোভন। গাছের পাতায় চন্দ্রভূক আলোতে শচীনদেব বর্মণের গানের মতো মধুমাখা। মোটর সাইকেলে আমি শক্ত হয়ে বসে আছি। আমি মাঝে। চালাচ্ছে ফসফরাস, পেছনে ওর এক বন্ধু। পেছনের লোকটা আমাকে ঠেসে ধরে আছে, লোকটার নি:শ্বাসে দুর্গন্ধ। কতদিন দাঁত ব্রাশ করেনি, কে জানে!
ধর্মসাগর পার হয়ে একটা বাড়ির সামনে ভটভট করে মোটর সাইকেল তিনটি থামে। ফসফরাসের কঠিন কন্ঠ এবারে,
: শোনো পদ্ম, তুমি সুরাইয়ার বান্ধবী। তোমার লগে ভালো ব্যবহার
করছি, তুমিও
আমার লগে ভালো থাকবা। এইটা কাজী সাহেবের অফিস। তোমার লগে আমার বিয়া হইব এখন। কাজী সাহেব যদি জিংগায়, বলবা নিজের ইচ্ছায় আইছো। আর শোনো, কলেমা জানো?
আমার কোনো অনুভূতি কাজ করছেনা । সমস্ত শরীর বরফের মতো ভয়ে ঠান্ডা। মনে হচ্ছে আমাকে কেউ ফ্রিজের ভিতর ঢুকিয়ে রেখেছে।
কাজী সাহেব এসে প্রথমেই আমাকে দেখে বললেন,
: মা, গরম দুধ খাইবা?
এত আপন করা ডাক শুনে আমার বুকটা মোচড় দিয়ে ওঠে। কাজী সাহেব খাতাপত্র আনেন। প্রশ্ন শুরু করেন।
আমার কোনো অনুভূতি কাজ করছেনা । সমস্ত শরীর বরফের মতো ভয়ে ঠান্ডা। মনে হচ্ছে আমাকে কেউ ফ্রিজের ভিতর ঢুকিয়ে রেখেছে।
কাজী সাহেব এসে প্রথমেই আমাকে দেখে বললেন,
: মা, গরম দুধ খাইবা?
এত আপন করা ডাক শুনে আমার বুকটা মোচড় দিয়ে ওঠে। কাজী সাহেব খাতাপত্র আনেন। প্রশ্ন শুরু করেন।
: নাম কি মা তোমার? বয়স কত?
: পদ্মিনী সাহা।
কাজী সাহেব চমকে ওঠেন। আমার মুখের দিকে অপলক তাকিয়ে থাকেন। মুহূর্তে মুখ উজ্জ্বল করে হেসে বলেন,
: ঘর থেইকা পালাইছো? মা জানো তো, তোমারে তো মুসলমান হওন লাগব। নিজের ইচ্ছায় আইছো তো? বয়স ১৮ হইছে তো?
তাঁর আন্তরিক স্বর শুনে আমার আর কিছু মনে থাকে না। চেয়ারে বসা থেকে এক দৌড়ে কাজী সাহেবের কাছে ছুটে গিয়ে তাঁর পা’টা জড়িয়ে ধরি। হাউমাউ করে উঠি। আমার সমস্ত জমাট কষ্ট, ভয় গোমতী নদীর ঢেউয়ের মতো উছলে ওঠে।
: বাবা... আমারে বাঁচান! বাবা আমারে বাঁচান!
কোথাও যেন মনে হলো গুলি’র শব্দ। সিনেমার দৃশ্যের মতো সব কিছু স্লো মোশনে এলোমেলো হয়ে যায়। আমার আর কিছু মনে থাকে না।
ভোর রাতে অস্পষ্ট বিরামহীন ধাতব শব্দে ঘুম ভেঙে গেলে প্রথমে বুঝে উঠতে পারি না, কোথায় আমি! একটু পরে আবিষ্কার করি, আমি একটা চট গায়ে জুবুথুবু শুয়ে আছি। তীব্র মাথা ভারি। মনে হলো, আমি কোনো ট্রাক বা ট্রেনের ছাদে আছি। রাতের আকাশ আর অগণন তারা মাথার উপর।
লাফ দিয়ে উঠে বসতে যাব, দেখি মোটর সাইলের পেছনে বসা সেই দুর্গন্ধ লোকটা, খপ করে আমার ঊরু চেপে ধরল। হাড়ি পাতিলের মতো খনখনে গলায় আমার কানের কাছে মুখ এনে বলল,
: ফরাস উদ্দিন তোমারে বেইচা দিছে আমার কাছে।
গ্যাভার্ডিন কাপড়ের মতো পুরু রাতের সেলাই ছিঁড়ে ছুটছে ট্রাক। মাথার চুলের বিনুনী ছুঁয়ে উড়ে যাচ্ছে আমার স্বপ্ন ডানা, বাবার ধবধবে ধুতি, মা’র গায়ের নরম ওম ওম গন্ধ, আমার পড়ার বই, হেডস্যারের গমগমে কন্ঠ।
হু হু করে কান্নার ময়ূর নেচে যায় পেখমে পেখমে।
: পদ্মিনী সাহা।
কাজী সাহেব চমকে ওঠেন। আমার মুখের দিকে অপলক তাকিয়ে থাকেন। মুহূর্তে মুখ উজ্জ্বল করে হেসে বলেন,
: ঘর থেইকা পালাইছো? মা জানো তো, তোমারে তো মুসলমান হওন লাগব। নিজের ইচ্ছায় আইছো তো? বয়স ১৮ হইছে তো?
তাঁর আন্তরিক স্বর শুনে আমার আর কিছু মনে থাকে না। চেয়ারে বসা থেকে এক দৌড়ে কাজী সাহেবের কাছে ছুটে গিয়ে তাঁর পা’টা জড়িয়ে ধরি। হাউমাউ করে উঠি। আমার সমস্ত জমাট কষ্ট, ভয় গোমতী নদীর ঢেউয়ের মতো উছলে ওঠে।
: বাবা... আমারে বাঁচান! বাবা আমারে বাঁচান!
কোথাও যেন মনে হলো গুলি’র শব্দ। সিনেমার দৃশ্যের মতো সব কিছু স্লো মোশনে এলোমেলো হয়ে যায়। আমার আর কিছু মনে থাকে না।
ভোর রাতে অস্পষ্ট বিরামহীন ধাতব শব্দে ঘুম ভেঙে গেলে প্রথমে বুঝে উঠতে পারি না, কোথায় আমি! একটু পরে আবিষ্কার করি, আমি একটা চট গায়ে জুবুথুবু শুয়ে আছি। তীব্র মাথা ভারি। মনে হলো, আমি কোনো ট্রাক বা ট্রেনের ছাদে আছি। রাতের আকাশ আর অগণন তারা মাথার উপর।
লাফ দিয়ে উঠে বসতে যাব, দেখি মোটর সাইলের পেছনে বসা সেই দুর্গন্ধ লোকটা, খপ করে আমার ঊরু চেপে ধরল। হাড়ি পাতিলের মতো খনখনে গলায় আমার কানের কাছে মুখ এনে বলল,
: ফরাস উদ্দিন তোমারে বেইচা দিছে আমার কাছে।
গ্যাভার্ডিন কাপড়ের মতো পুরু রাতের সেলাই ছিঁড়ে ছুটছে ট্রাক। মাথার চুলের বিনুনী ছুঁয়ে উড়ে যাচ্ছে আমার স্বপ্ন ডানা, বাবার ধবধবে ধুতি, মা’র গায়ের নরম ওম ওম গন্ধ, আমার পড়ার বই, হেডস্যারের গমগমে কন্ঠ।
হু হু করে কান্নার ময়ূর নেচে যায় পেখমে পেখমে।
আমি বিড়বিড় করি... আওয়ার লেডি অব ফাতিমা, আওয়ার লেডি অব ফাতিমা...
অসামান্য! কী আশ্চর্য মায়াবী ভাষায় লেখা হলো এই পাশবিক আখ্যান। আর সেটাই বোধ হয়, শেষ অবধি, একটা কাচের টুকরোর মতো, আটকে রইলো গলার কাছে, পাঁজরের ভাঁজে। কুর্নিশ। বাহবা। ইত্যাদি আর যা কিছু, এক সামান্য পাঠকের তরফে।
উত্তরমুছুন