রেলা-৩
আমি পকেটে হাত দিয়ে বুঝলাম, গেছে! এ সেই সময়ের কথা যখন এ.টি.এম প্রায় ২০ বছর দূরে! আমার প্রায় সব কিছুই ছিলো ওই মানিপার্সে, সঙ্গের পিঠব্যাগে পরিধেয় ছাড়া কিছু নেই। আর আমারও গান গাওয়া ছাড়া কিছু করার নেই, তো মনে মনে গাইতে লাগলাম, ‘কি করি আমি কি করি /বল রে সুবল /বল দাদা...’
সুবলের বলার কিছু ছিলো না, ভাগ্যিস টিকিটটা আমার বুক পকেটে অমিতাভ বচ্চনের জীবনদায়ী বিল্লা নাম্বার ৭৮৬’র মতো লেপটে আছে! আমিতাভকে সাধারণতঃ এই বিল্লা যোগাতো তার মেগাকপাল, আমি এক যাযাবরীয় নগণ্য মানুষ, কী করবো? ক্যালানোবেজার হয়ে নিজের বার্থে এসে বসি, ক্ষিদে জানান দিচ্ছে এতটাই যে, আর কিছুক্ষণের মধ্যেই আমি ক্ষুৎকাতর অবস্থায় চলে যাবো...। আজ দাড়িও কামাইনি, শালা ঠিক সময় বুঝে চুলকোচ্ছে!
-আপনি কি কিছু হারিয়েছেন?
তাকালাম! হারালাম!! কথা!!!
আমি পথিক নই, পথ হারাইনি, তবু হঠাৎই এক বঙ্কিমী আবহাওয়া এসে আমায় মনে করিয়ে দিল যে, আমি একটু আড়া প্রোফাইল রাখলে রাজেশ খান্না আমায় ছুঁয়ে যায়, তো রাখলাম!
সে দেখলো কিনা জানি না, আমি তো দেখছিই... সম্বলপুর এক্সপ্রেস নড়ে উঠলো!
আমি বললাম, মানিপার্স... বলার আগে খাঁকারি দিয়ে জমা মেঘ সরাতে হলো কন্ঠনালী থেকে। কারণ, আমি কথা প্রায় হারিয়েই ফেলেছিলাম। এত মনটাচি সৌন্দর্য ওই বয়সে ভেতরে বিহ্বলতা তৈরি করে, পেটে সামান্য ব্যথা হয়, অবশ্য আমারটা ক্ষিদে থেকেও হতে পারে!
আমার দিকে তাকিয়ে সে বললো, সরি...
বলা উচিত ছিলো, আপনি সরি বলছেন কেন; বলে ফেললাম, কলকাতা যাচ্ছি
-ও, তাই? কি করে হলো? বুঝতে পারেননি না? আপনাকে দেখলেই মনে হয় আপনি একটা যা তা...
আমি নিভে যাই... যা তা?...
মেয়েটি হাসে। আমিও হাসি।
-কিছু মনে করলেন না তো? আসলে বোঝা যায়, মেয়েরা বুঝতে পারে...
আমি না বুঝে হাসি...
আমার নিচের বার্থ। তাহলে পাশাপাশি? রোমে বেহালা লাগে আমার, ভেতরে ‘ও মেরে দিলকে চয়েন’ গানটা উসকে উঠছিলো, সামলে নিই...
-আমার নাম এলিজাবেথ!
আমি দেখি এক মনোরম তীব্র আঁধারে হারানো সালোয়ার কামিজে সেই মেয়েটি কী সহজ, কী আন্তরিক...
আমিও নিজের নাম বলি, কালো সালোয়ার কামিজে রাখা তার ঘিয়ে রঙের দোপাট্টায় মুগ্ধতা ছড়াতে ছড়াতে...
-আমার মা ব্রিটিশ, বাবা বাঙালি... আপনি?
এবার স্মার্ট হাসি দিয়ে বলি, কেন বাঙালি মনে হয় না আমায়?
-হয়, তবে একটা নেপালি লুক রয়েছে আপনার...
রাম বাহাদুর! শ্যাম থাপা!! দুই ফুটবলার ভেসে উঠলো। কেউ কেউ বলে, আর একটু লম্বা হলে রাজেশ খান্নার ডুপ্লিকেট মনে হতো। এ বলছে নেপালি... কী মুশকিল! এলিজাবেথ হোক বা ক্লিওপেট্রা, বিভ্রম তৈরি করবেই! আমার পাশের যাত্রী ভ্রু নাচায়, একটু ঝুঁকে জিজ্ঞেস করে, আগে থেকেই চেনা, না এখন? তারপর দাঁত বের করে, হলুদাচ্ছন্ন...। আমি বললাম, আগে থেকেই চেনা, মানে আগের জন্মে আমি আর ও... বুঝেছেন তো? আমি একটা চা বাগানের ম্যানেজার হয়ে ডুয়ার্সে গিয়েছিলাম। আমার নতুন চাকরি, মনে আনন্দ, গান গাইছিলাম, সুহানা সফর, ঔর ইয়ে মৌসম হসিঁ... ও গানের টানে চলে এসেছিলো... তারপর আর কী, চুটিয়ে প্রেম... আমাদের বিয়েও ঠিক হয়ে গিয়েছিলো... কিন্তু...
লোকটা হাঁ, বললো, কিন্তু কি?
-মারাত্মক একসিডেন্ট হলো আমার, মরে গেলাম আর কী... তারপর এই ট্রেনে আবার ওকে দেখলাম... দেখেই গত জন্মের স্মৃতি মনে পড়ে গেল... আমি ফিরে পেলাম মুনিয়াকে!
-মুনিয়া?
-ওর আগের জন্মের নাম!
লোকটা সোজা ওপরের বার্থে চলে গেল এরপর, যাওয়ার আগে বললো, আমি কিন্তু গান্ডু না...
তবে আমাদের কথা কিন্তু হতেই থাকে। এলিজাবেথ এখন লিজ, আমি পিল্টু।
আমি লিজের কথায় ভেসে ওঠা বুজকুড়ির শব্দ পাই। আমি আরও পাই শরীরের অনাস্থা প্রস্তাব। পেতে থাকি
মনকে আমন দেওয়া এক প্রস্থ উসখুসে রেলতাল, সেই গতির টানে আমার সামনে বসে থাকা লিজের দোপাট্টা যতবার পড়ে, আমি ততবার শক্ত হতে থাকি, হাল ধরার চেষ্টা করি বিবেকানন্দকে ভেবে, তাঁর তেজ, তাঁর শিকাগো ভাষণ... আর লিজ এই তরুণতাপসের অন্যমনস্ক হওয়ার তাগিদে ফুরফুরে দক্ষিণী হাওয়া ছড়িয়ে দিয়ে বলে, কী এত ভাবছেন বলুন তো! আমি কি আপনাকে বোর করছি?
তারপর ফ্লাস্ক কাৎ করে চা ঢালে, অপাঙ্গে তাকায় ঢালতে ঢালতে। আমি শিথিল হতে গিয়েও পারি না, ‘ও কেন এত সুন্দরী হলো...’ মান্না দে... এবারের পুজোর গান... সত্যি তো, কেন হলো?
লিজ ওর রাসবিহারীর ঠিকানা দেয়। আমি ওকে রাউরকেলার। লিজ ওর কাকার কাছে এসেছিলো। একা, একাই ফিরছে...! স্বাভাবিক, ও তো তখনকার বাঙালি মেয়ে নয় যে, বাবা অথবা ভাই সঙ্গে থাকবে! লিজ বলে, তোমায় কিন্তু এখন পুরো বাঙালি মনে হচ্ছে!
-কেন?
-জানি না! বলে মুচকি হাসলো। আমার চায়ে সেই হাসির আসঙ্গ মিশে যায়! আমিও হাসি। ক্যাবলার মতো। বাঙালির মতো।
ট্রেন ছোটে, রাত বাড়ে। লিজ টিফিন ক্যারিয়ার বার করে। ওর আঙুলে লেগে থাকা গরজের চাঁপা কী এক মায়ায় অনবদ্য হয়ে যায়! আমি ক্ষিদে ভুলে তাকিয়ে থাকি। কাগজের প্লেটে রাখা সেইসব স্বাদান্নে আর আমি যেতে পারি না।
লিজ বলে, কী হলো... নাও!
আমি নিতে থাকি... নিতেই থাকি, সারারাত...
ঘুম ভাঙে কোলাহল আছড়ে পড়ায়। চমকে উঠে বসি। হাওড়া! ট্রেন থেমে আছে। নেমে যাচ্ছে যাত্রীরা। সেই সহযাত্রী নামার আগে বলে গেল, উঠুন এটাই হাওড়া, আর আপনার মুনিয়াও উড়ে গেছে...। আমি বিরক্ত হতে গিয়েও হলাম না। লিজের সিট ফাঁকা। যেন লম্বা ছুটি রেখে চলে গেছে ও, সে রকমই একদলা নরম রোদ ওই সিটের ওপর এসে পড়েছে!
আমি নেমে আসি, ঠিকানাটা যেন কী... কী যেন ঠিকানাটা...
আমি পকেটে হাত দিয়ে বুঝলাম, গেছে! এ সেই সময়ের কথা যখন এ.টি.এম প্রায় ২০ বছর দূরে! আমার প্রায় সব কিছুই ছিলো ওই মানিপার্সে, সঙ্গের পিঠব্যাগে পরিধেয় ছাড়া কিছু নেই। আর আমারও গান গাওয়া ছাড়া কিছু করার নেই, তো মনে মনে গাইতে লাগলাম, ‘কি করি আমি কি করি /বল রে সুবল /বল দাদা...’
সুবলের বলার কিছু ছিলো না, ভাগ্যিস টিকিটটা আমার বুক পকেটে অমিতাভ বচ্চনের জীবনদায়ী বিল্লা নাম্বার ৭৮৬’র মতো লেপটে আছে! আমিতাভকে সাধারণতঃ এই বিল্লা যোগাতো তার মেগাকপাল, আমি এক যাযাবরীয় নগণ্য মানুষ, কী করবো? ক্যালানোবেজার হয়ে নিজের বার্থে এসে বসি, ক্ষিদে জানান দিচ্ছে এতটাই যে, আর কিছুক্ষণের মধ্যেই আমি ক্ষুৎকাতর অবস্থায় চলে যাবো...। আজ দাড়িও কামাইনি, শালা ঠিক সময় বুঝে চুলকোচ্ছে!
-আপনি কি কিছু হারিয়েছেন?
তাকালাম! হারালাম!! কথা!!!
আমি পথিক নই, পথ হারাইনি, তবু হঠাৎই এক বঙ্কিমী আবহাওয়া এসে আমায় মনে করিয়ে দিল যে, আমি একটু আড়া প্রোফাইল রাখলে রাজেশ খান্না আমায় ছুঁয়ে যায়, তো রাখলাম!
সে দেখলো কিনা জানি না, আমি তো দেখছিই... সম্বলপুর এক্সপ্রেস নড়ে উঠলো!
আমি বললাম, মানিপার্স... বলার আগে খাঁকারি দিয়ে জমা মেঘ সরাতে হলো কন্ঠনালী থেকে। কারণ, আমি কথা প্রায় হারিয়েই ফেলেছিলাম। এত মনটাচি সৌন্দর্য ওই বয়সে ভেতরে বিহ্বলতা তৈরি করে, পেটে সামান্য ব্যথা হয়, অবশ্য আমারটা ক্ষিদে থেকেও হতে পারে!
আমার দিকে তাকিয়ে সে বললো, সরি...
বলা উচিত ছিলো, আপনি সরি বলছেন কেন; বলে ফেললাম, কলকাতা যাচ্ছি
-ও, তাই? কি করে হলো? বুঝতে পারেননি না? আপনাকে দেখলেই মনে হয় আপনি একটা যা তা...
আমি নিভে যাই... যা তা?...
মেয়েটি হাসে। আমিও হাসি।
-কিছু মনে করলেন না তো? আসলে বোঝা যায়, মেয়েরা বুঝতে পারে...
আমি না বুঝে হাসি...
আমার নিচের বার্থ। তাহলে পাশাপাশি? রোমে বেহালা লাগে আমার, ভেতরে ‘ও মেরে দিলকে চয়েন’ গানটা উসকে উঠছিলো, সামলে নিই...
-আমার নাম এলিজাবেথ!
আমি দেখি এক মনোরম তীব্র আঁধারে হারানো সালোয়ার কামিজে সেই মেয়েটি কী সহজ, কী আন্তরিক...
আমিও নিজের নাম বলি, কালো সালোয়ার কামিজে রাখা তার ঘিয়ে রঙের দোপাট্টায় মুগ্ধতা ছড়াতে ছড়াতে...
-আমার মা ব্রিটিশ, বাবা বাঙালি... আপনি?
এবার স্মার্ট হাসি দিয়ে বলি, কেন বাঙালি মনে হয় না আমায়?
-হয়, তবে একটা নেপালি লুক রয়েছে আপনার...
রাম বাহাদুর! শ্যাম থাপা!! দুই ফুটবলার ভেসে উঠলো। কেউ কেউ বলে, আর একটু লম্বা হলে রাজেশ খান্নার ডুপ্লিকেট মনে হতো। এ বলছে নেপালি... কী মুশকিল! এলিজাবেথ হোক বা ক্লিওপেট্রা, বিভ্রম তৈরি করবেই! আমার পাশের যাত্রী ভ্রু নাচায়, একটু ঝুঁকে জিজ্ঞেস করে, আগে থেকেই চেনা, না এখন? তারপর দাঁত বের করে, হলুদাচ্ছন্ন...। আমি বললাম, আগে থেকেই চেনা, মানে আগের জন্মে আমি আর ও... বুঝেছেন তো? আমি একটা চা বাগানের ম্যানেজার হয়ে ডুয়ার্সে গিয়েছিলাম। আমার নতুন চাকরি, মনে আনন্দ, গান গাইছিলাম, সুহানা সফর, ঔর ইয়ে মৌসম হসিঁ... ও গানের টানে চলে এসেছিলো... তারপর আর কী, চুটিয়ে প্রেম... আমাদের বিয়েও ঠিক হয়ে গিয়েছিলো... কিন্তু...
লোকটা হাঁ, বললো, কিন্তু কি?
-মারাত্মক একসিডেন্ট হলো আমার, মরে গেলাম আর কী... তারপর এই ট্রেনে আবার ওকে দেখলাম... দেখেই গত জন্মের স্মৃতি মনে পড়ে গেল... আমি ফিরে পেলাম মুনিয়াকে!
-মুনিয়া?
-ওর আগের জন্মের নাম!
লোকটা সোজা ওপরের বার্থে চলে গেল এরপর, যাওয়ার আগে বললো, আমি কিন্তু গান্ডু না...
তবে আমাদের কথা কিন্তু হতেই থাকে। এলিজাবেথ এখন লিজ, আমি পিল্টু।
আমি লিজের কথায় ভেসে ওঠা বুজকুড়ির শব্দ পাই। আমি আরও পাই শরীরের অনাস্থা প্রস্তাব। পেতে থাকি
মনকে আমন দেওয়া এক প্রস্থ উসখুসে রেলতাল, সেই গতির টানে আমার সামনে বসে থাকা লিজের দোপাট্টা যতবার পড়ে, আমি ততবার শক্ত হতে থাকি, হাল ধরার চেষ্টা করি বিবেকানন্দকে ভেবে, তাঁর তেজ, তাঁর শিকাগো ভাষণ... আর লিজ এই তরুণতাপসের অন্যমনস্ক হওয়ার তাগিদে ফুরফুরে দক্ষিণী হাওয়া ছড়িয়ে দিয়ে বলে, কী এত ভাবছেন বলুন তো! আমি কি আপনাকে বোর করছি?
তারপর ফ্লাস্ক কাৎ করে চা ঢালে, অপাঙ্গে তাকায় ঢালতে ঢালতে। আমি শিথিল হতে গিয়েও পারি না, ‘ও কেন এত সুন্দরী হলো...’ মান্না দে... এবারের পুজোর গান... সত্যি তো, কেন হলো?
লিজ ওর রাসবিহারীর ঠিকানা দেয়। আমি ওকে রাউরকেলার। লিজ ওর কাকার কাছে এসেছিলো। একা, একাই ফিরছে...! স্বাভাবিক, ও তো তখনকার বাঙালি মেয়ে নয় যে, বাবা অথবা ভাই সঙ্গে থাকবে! লিজ বলে, তোমায় কিন্তু এখন পুরো বাঙালি মনে হচ্ছে!
-কেন?
-জানি না! বলে মুচকি হাসলো। আমার চায়ে সেই হাসির আসঙ্গ মিশে যায়! আমিও হাসি। ক্যাবলার মতো। বাঙালির মতো।
ট্রেন ছোটে, রাত বাড়ে। লিজ টিফিন ক্যারিয়ার বার করে। ওর আঙুলে লেগে থাকা গরজের চাঁপা কী এক মায়ায় অনবদ্য হয়ে যায়! আমি ক্ষিদে ভুলে তাকিয়ে থাকি। কাগজের প্লেটে রাখা সেইসব স্বাদান্নে আর আমি যেতে পারি না।
লিজ বলে, কী হলো... নাও!
আমি নিতে থাকি... নিতেই থাকি, সারারাত...
ঘুম ভাঙে কোলাহল আছড়ে পড়ায়। চমকে উঠে বসি। হাওড়া! ট্রেন থেমে আছে। নেমে যাচ্ছে যাত্রীরা। সেই সহযাত্রী নামার আগে বলে গেল, উঠুন এটাই হাওড়া, আর আপনার মুনিয়াও উড়ে গেছে...। আমি বিরক্ত হতে গিয়েও হলাম না। লিজের সিট ফাঁকা। যেন লম্বা ছুটি রেখে চলে গেছে ও, সে রকমই একদলা নরম রোদ ওই সিটের ওপর এসে পড়েছে!
আমি নেমে আসি, ঠিকানাটা যেন কী... কী যেন ঠিকানাটা...
কি রসিক রে আমার। আমি যে রসের কাঙাল। চেটে পুটে পড়লাম ।
উত্তরমুছুনTHANX,BARINDA!SWAPAN
মুছুন