কালিমাটি অনলাইন

ত্রয়োদশ বর্ষ / সপ্তম সংখ্যা / ১৩৪

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

ত্রয়োদশ বর্ষ / সপ্তম সংখ্যা / ১৩৪

শনিবার, ১৩ সেপ্টেম্বর, ২০২৫

অচিন্ত্য দাস

 

ভ্রমণিকা (৩)

 


নীল বরফের কাহিনী

আলাস্কার সিওয়াড জায়গাটিতে আগে সোনা-সন্ধানীরা ভীড় করত। এখন আর মাটিতে যেখানে সেখানে সোনার নুড়ি পড়ে থাকে না তবে ভীড় এখনও হয়। ট্যুরিস্টদের ভীড়। শহর হিসেবে সিওয়াড খুবই ছোট, জাহাজঘাটটিও দেখলাম তেমন বড়সড় কিছু নয়। বড় আট-দশ তলা ট্যুরিস্ট জাহাজ নোঙর করে ঠিকই তবে এখান থেকে যে নৌকাগুলো ছাড়ে সেগুলো ছোট স্টীমার ধরনের। খুব বেশি হলে ষাট-সত্তর জন চড়তে পারে। এরা অবিশ্যি নিয়ম মেনে চলে, যে কটা আসন আছে ততজন লোকই নেয়। গুজরাটের দ্বারকা দেখতে গিয়ে খালি দেখে একটা নৌকাতে আগেভাগে বসে গিয়েছিলাম। ভেবেছিলাম বেশ সাগরের হাওয়া খেতে খেতে শ্রীকৃষ্ণের রাজত্ব দেখে আসব। কিছুক্ষণের মধ্যে এত লোককে নৌকাতে ঠেসে ঠেসে ওঠাল যে আমাদের ভয় হচ্ছিল সশরীরেই সাগরতলের দ্বারকায় পৌঁছে যাব না তো!

নৌকো ছাড়তে একটু দেরি আছে তাই জাহাজঘাটে অপেক্ষা করতে হবে। ছ-ঘণ্টার সফর, একেবারে আলস্কা উপসাগর অবধি নিয়ে যাবে। শুনেছিলাম এই নৌকাযাত্রায় নাকি অনেক কিছু দেখা যায় – তা অবশ্য কিছু ভুল শুনিনি।

আমেরিকা ব্যবসায়ীদের দেশ, এরা ব্যাবসা করতে জানে। যেখানে কিছু লোক জমা হতে পারে বা যাত্রার পথে অপেক্ষা করার জন্য দাঁড়াতে পারে সেখানেই এরা দোকান খুলে বসে যায়। জাহাজঘাটের দোকানটায় দেখলাম অপেক্ষমান যাত্রীরা এটা সেটা কিনছে। যেমন ক্লিণ্ট ইস্টউডের মতো বাঁকানো টুপি, হাল ফ্যাশনের কালো চশমা, পকেট দূরবীণ ইত্যাদি। তাকে এবং দেয়ালে রাখা আছে নরম তুলতুলে টেডি বিয়ার জাতীয় খেলনা, অদ্ভুত রকমের আদিবাসীদের মুখোশ, তামার ফলকে খোদাই করা ঈগল কিংবা ভাল্লুক – নীচে দার্শনিক বাণী। যেমন – প্রকৃতির মধ্যে হারিয়ে গেলে তবেই নিজেকে খুঁজে পাবে, এইসব। রোজ সকালবেলা হোয়াটস অ্যাপে সুপ্রভাতের সঙ্গে যেমন উপদেশ আসে সেরকম ধরনের।

আমার কিছুই কেনার নেই তবু সময় কাটাবার জন্য দেখছিলাম। ডলারে দাম যা লেখা তাকে ছিয়াশি দিয়ে মনে মনে গুণ করে দেখছিলাম টাকায় কত হয়। এই ধরনের মুখে মুখে অঙ্ক করলে নাকি ‘ব্রেন’এ মরচে পড়ে না। আমার সঙ্গে যারা যাচ্ছে তারা দুজনেই ডাক্তার। একজন একটা ওষুধের শিশি কিনে বলল, “একটা বড়ি খেয়ে নাও।”

“কেন?”

“মাথা ঘুরতে পারে।”

“না রে, আমার মাথা ঠিক আছে, ছিয়াশি দিয়ে দিব্যি গুণ করতে পারছি।”

“আরে না, আজ সমুদ্রে ঢেউ আছে, গা গুলোতে পারে…”

কথা না বাড়িয়ে অনিচ্ছার সঙ্গে একটি বড়ি গিলে নিলাম। কিন্তু তখন জানতাম না কথাটা এরা ঠিকই বলছিল। একটার জায়গায় দুটো বড়ি খেয়ে নিলে ভালো হতো।

একটা ঘোষণা শোনা গেল। আজ হাওয়া বইছে বেশ জোরে তাই নৌকো অন্যদিনের চেয়ে বেশি দুলবে। ঘণ্টা দুয়েক পরে যে অঞ্চলে আমরা পৌঁছব, সেখানে সমুদ্র এমনিতেই অশান্ত থাকে। আজ হাওয়ার গতি বেশি থাকায় সেখানে দশফুট অবধি ঢেউ উঠতে পারে। দশফুট ঢেউ! মনে মনে আন্দাজ করে একটু অস্বস্তি লাগলো – নৌকাচালক সামলাতে পারবে তো!

এবারে বলা হলো – সেই পর্যন্ত গিয়ে যদি দেখা যায় সমুদ্র খুব বেশি অশান্ত তাহলে নৌকো ফিরে আসবে এবং সবাইকে দু-ঘন্টার পয়সা ফেরত দেওয়া হবে। যাঁরা এই অবস্থায় না যেতে চান তাঁরা কাল এই টিকিটেই যেতে পারেন। দেখলাম কেউই নড়াচড়া করল না।

নৌকাটি চমৎকার। তিনজন বা দুজন করে বসার গদি আঁটা সীট। কাচের বিরাট বিরাট জানালা – আকাশ জল স্থল সব দেখা যায় বাধাহীনভাবে। সীট ছেড়ে গোটা নৌকার ডেকে ঘুরে বেড়ানোতে কোনো বাধানিষেধ নেই। নৌকাতে একজন ‘প্রকৃতিবিদ’ বা ন্যাচারালিস্ট থাকেন। সেই প্রকৃতিবাবুটি চারিদিকে যা দেখা যাচ্ছে তার বিবরণ দিতে থাকেন আর চারপাশে কোথাও পশু, পাখি বা মাছ নজরে পড়লে দেখিয়ে দেন।

দেখলাম নৌকাটির বেশ গতি আছে। সামনের ডেকে গিয়ে দাঁড়ালাম। দুপাশে জল কেটে সাদা ফেনা তুলে জলযান চলেছে। কানঢাকা টুপি, গরম জ্যাকেট ভেদ করে কনকনে ঠাণ্ডা হাওয়া যেন ঢুকে পড়ে হাড় কাঁপিয়ে দিচ্ছে! সামনে কোনো স্থলভাগ নেই – মনে হলো এই বাতাস বোধহয় সরাসরি উত্তরমেরু থেকেই আসছে। এমন সময় প্রকৃতিবাবু মাইকে বলে উঠলেন, ‘ওয়ান ও ক্লক’ মানে একটার দিকে দেখ।

নৌকা যেদিকে যাচ্ছে সেটা ঘড়ির বারোটা ধরে নিতে হবে। তার মানে একটু ডান দিকে কিছু একটা আছে। দেখলাম হ্যাঁ, কালো পানা কী একটা যেন ভাসছে। সী ওটার মানে সামুদ্রিক ভোঁদর। আমার মনে হচ্ছিল যেন একজোড়া। কিন্তু একেবারে কাছে আসতে বুঝলাম, না একটাই। আকারে বেশ বড়, তা ফুট ছয়েকও হতে পারে। প্রকৃতিবাবু বললেন, এরা শুধু মাছ খায়। সে তো বুঝলাম, কিন্তু আমাদেরও যে বেশ খিদে পেয়েছে।

স্যাণ্ডউইচ আর কী একটা পানীয় দিয়ে গেল। জিনিসটা ভালোই, পেটও ঠাণ্ডা হলো। আবার ডেকে গিয়েছিলাম কিন্তু সমুদ্রে ঢেউ বাড়ছিল, ডেকে দাঁড়াতে না পেরে নিজের জায়গায় এসে বসে পড়লাম। উফ, কী ঢেউ রে বাবা! নৌকা ভীষণ দুলছে – কখনো ডানদিকে নিচু হয়ে আবার বাঁ দিকে গোত্তা খাচ্ছে। কখনো নৌকার সামনেটা অনেকটা উঠে যাচ্ছে। টেবিল থেকে নৌকার মেঝেতে পড়ে যাওয়া তিন-চারটে জলের বোতল মনের আনন্দে এদিক থেকে ওদিক গড়াগড়ি দিচ্ছে।

বসে বসে বুঝলাম আমার অবস্থা ভালো নয়, গা গুলোচ্ছে আর বুঝতে পারছি স্যাণ্ডউইচটি আর পেটে থাকতে চাইছে না। প্রতিটা সীটেই গোটা চার-পাঁচ স্যানিটরি ব্যাগ রাখা থাকে। আমি একটা ব্যাগ খুলে মুখের সামনে ধরে রইলাম। ইস, ওষুধ খেয়েও কিছু হলো না? একটার জায়গায় দুটো বড়ি খেয়ে নিলে ভালো হতো। এরা বলেছিল ফুট দশেক ঢেউ হতে পারে, আমার তো মনে হচ্ছিল আরও বেশি। আমাদের বাড়ির সামনে গণেশ পুজোর মেলায় ‘কলম্বাসের নৌকো’ নামে একটা খেলা আসে। বিরাট একটা নৌকা ইষ্পাতের খুটিতে ঝোলানো থাকে আর সেটাকে বেশ জোরে দোলানো হয়। ভেতরে বাচ্চারা (বড়রাও যে থাকে না, তা নয়) তোলপাড় হওয়ার খুশিতে হৈচৈ করে। তাদের তো স্যানিটরি ব্যাগফ্যাগ লাগে না!

একটা মৃদু ওয়াক শব্দ করে স্যাণ্ডউইচ বাবাজি আমার গলা দিয়ে মুক্তি পেয়ে স্যানিটরি ব্যাগে আশ্রয় নিল। অপ্রস্তুত হয়ে পড়েছিলাম – এবার কী করবো?

প্রায় সঙ্গে সঙ্গে নৌকার একজন কর্মচারী এসে আমার হাত থেকে ব্যাগটা নিয়ে চলে গেল। বলল, “এটা খুব স্বাভাবিক, নৌকার অর্ধেক যাত্রীই তোমার মতো বমি করেছে…।” শুনে সান্ত্বনা পাওয়া গেল – আমি একাই তাহলে সমুদ্রপীড়ায় ভুগছি না!

কয়েক মিনিটেই শরীরটা বেশ ঝরঝরে মনে হলো। ঢেউও কমে এলো – মানে সেই অশান্ত অঞ্চলটি পেরিয়ে গেছে। চারিদিকে তাকিয়ে অবাক হয়ে গেলাম। একটা সবুজ দ্বীপ দেখা যাচ্ছে। মাঝখানে উঁচু একটা পাহাড়, আর একটা ছোট টিলা। টিলাতে সাদাসাদা বিন্দু দেখা যাচ্ছে – প্রকৃতিবাবু বললেন – এটা সামুদ্রিক পাখিদের ডেরা। নৌকা দ্বীপটির আরো কাছে নিয়ে আসা হলো।

এরকম সুন্দর প্রাকৃতিক দৃশ্য আমি দেখেছি বলে মনে পড়ে না। মনে হলো এটা যেন ‘তাসের দেশের’ রাজপুত্রের নৌকা। রাজপুত্র খোলা গলায় গাইছে – নীলের কোলে শ্যামল সে দ্বীপ, প্রবাল দিয়ে ঘেরা / শৈলচূড়ায় নীড় বেঁধেছে সাগর-বিহঙ্গেরা…

প্রবাল ছাড়া বাকি সবই দেখা যাচ্ছে এখানে! নৌকা থেকে ঝাঁপ দিয়ে ডুব দিলে হয়তো প্রবালের দেখাও পাওয়া যাবে! দু-একটা সাগর-বিহঙ্গ উড়ছিল, এদের ডানা খুব বড়। শুনেছি সামুদ্রিক পাখিদের, যেমন অ্যালবাট্রসের ডানা খুব প্রশস্ত হয়ে থাকে। প্রকৃতিবাবু এই পাখিগুলোর কী একটা নাম বলেছিলেন, ভুলে গেছি।

সাগর-বিহঙ্গ দেখার উচ্ছাস কাটতে না কাটতে শুনলাম প্রকৃতিবাবু বলছেন, “নটার দিকে দেখ, নটার দিকে!”

প্রথমটায় কিছু ঠাহর করতে পারলাম না কিন্তু একটু পরেই চোখে পড়ল জল কেটে তরতরিয়ে চলেছে একটা কালো তিনকোণা পতাকা। তিমি মাছের ল্যাজ। একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকতে থাকতে তিমির পিঠের পাখনাটা দুতিনবার ভেসে উঠতে দেখলাম। তিমিঠাকুর বোধ হয় টের পেয়েছিলেন যে অনেক মানুষজন ভক্তের মতো একটা নৌকার ডেকে দাঁড়িয়ে আছে তাঁর দর্শনের অপেক্ষায়। তিনি একবার তাঁর মিশকালো দেহের খানিকটা আর মাথাটি জল থেকে হুস করে তুলে আবার ডুব দিলেন। অনেকটা ‘ঝাঁকি-দর্শনের’ মতো।

তিমি দেখার উত্তেজনা তখনো কাটেনি, সকলে ওই নিয়েই কথা বলছিল। টিপ টিপ বৃষ্টি এল, তাপমাত্রা পাঁচ-ছ ডিগ্রি হবে। আরও কম হলে বৃষ্টির জায়গায় তুষারপাত হতে পারত। এমন সময় প্রকৃতিবাবাবুর ঘোষণা আবার শোনা গেল। “টেন ও ক্লক, টেন ও ক্লক...” দেখলাম ওদিকটায় স্থলভাগ দেখা যাচ্ছে – নৌকা আর একটু এগোতেই বুঝলাম স্থলভাগটি গভীর অরণ্যে ঢাকা। পাড়ের দিকে খানিকটা খালি জায়গা, যেন একটা বনপথ। সেখান দিয়ে ধীরেসুস্থে হেঁটে চলেছে একটি কালো ভাল্লুক। আন্দাজ করাই যায় যে ভাল্লুকটি আকারে বিশাল। নাকের ডগা থেকে ল্যাজের শেষ মাপলে কম করে দশ-এগারো ফুট তো হবেই।

ঘড়িতে দেখলাম ঘন্টা তিনেক হয়ে গেছে। মানে আমরা সফরের দূরতম অঞ্চলে চলে এসেছি। শেষের দ্রষ্টব্যটি যা দেখলাম তা কিন্তু পুরোপুরি অন্য ধরনের।

আমাদের বাঁদিকে স্থলভাগ, ডানদিকে অকূল সমুদ্র। স্থলভাগটি পর্বত-সঙ্কুল। সবজে কালো পাহাড়ের গায়ে বিক্ষিপ্তভাবে ছড়িয়ে আছে বহু সরু বা চওড়া তুষারনদী। সবজে-কালো ঈষৎ ঢালু মেঝেতে এক শিশু যেন অসাবধানে দুধ ফেলে দিয়েছে। তুষারনদী বা হিমবাহ বা গ্লেসিয়ার এর পরিণতি কী? এরা পাহাড়ের গায়ে রাস্তা কেটে চলতে চলতে কোনো এক জায়গায় জল হয়ে ঝরনার রূপ নিয়ে শব্দ করে ঝরে পড়ে। অনেকগুলো ঝরনার ধারা মিশে বড় জলস্রোত তৈরি হয়, যাকে আমরা নদী বলি। নদী দেশ-বিদেশ গ্রাম-শহর অরণ্য-প্রান্তর পেরিয়ে শেষে সাগরে এসে পড়ে। কিন্তু আমারা সামনে যা দেখছি তার বৃত্তান্ত অন্য ।

পাহাড়ের সারি উঠেছে একেবারে সমুদ্র থেকে, দুজনের মধ্যে এক ইঞ্চিও জমি নেই। পাহাড়ের খাঁজ বেয়ে নেমে এসেছে একটা বড়সড় গ্লেসিয়ার বা বরফনদী। বেচারা নেমে এসে দেখছে তার আর ঝরনা-টরনা হওয়া হলো না। তাকে সোজা সমুদ্রেই ঝাঁপ দিতে হবে! আমাদের তরীটি এই বিশালাকার হিমবাহের যতটা কাছে আসতে পারে ততটা কাছে এসে থামল। প্রকৃতিবাবু বললেন – গ্লেসিয়রটি এক মাইল চওড়া। এক মাইল মানে সতেরশো ষাট গজ। একটা ছবি তুললাম – ছবিটা দেখে আন্দাজ করলাম গ্লেসিয়রের মাঝখানের উচ্চতা প্রস্থের দশ ভাগের এক ভাগ মতো হবে। তার মানে প্রায় একশ ছিয়াত্তর গজ অর্থাৎ পাঁচশ ফুটের ওপর!! বাপ রে, পঞ্চাশতলা বাড়ির সমান উঁচু গ্লেসিয়র!

সমুদ্রের পাখি, তিমি বা ভাল্লুক দেখে নৌকাযাত্রীরা সকলে উচ্ছাসের বশে হৈচৈ চেঁচামিচি করছিল। ফোনে কেমন ছবি উঠেছে তা এ ওকে দেখাচ্ছিল। কিন্তু এই বিরাট হিমবাহটির সামনে এসে সকলে যেন এক যাদুমন্ত্রে চুপ করে গেল। সমুদ্র, পাহাড়, অরণ্য বা প্রকৃতির বিশালতার মধ্যে একটা ব্যক্তিত্ব থাকে। সরাসরি তার সামনে দাঁড়ালে মানুষ সম্ভ্রমে নির্বাক হয়ে যায়।

নৌকার ইঞ্জিনও বন্ধ, চরাচর জুড়ে শান্ত নিস্তব্ধতা। কিছুক্ষণ কান পাতলে শোনা যায় পাঁচ-সাত মিনিট অন্তর অন্তর কড়-কড়-কড়াৎ গোছের শব্দ। জমাট বরফে ফাটল ধরছে আর হিমবাহ ভেঙে ভেঙে জলে পড়ছে ঝপ-ঝপাস করে। নৌকা আর হিমবাহের মাঝখানের জলে অজস্র বরফের টুকরো ভাসছে। এ এমন একটি দৃশ্য যে দেখতে দেখতে মনে হয় এরপর আর কীই বা দেখার জন্য বাকি থাকল? বিস্ময়-বিহ্বল আবেশটুকু চোখে ভরে নিয়ে এ মুহূর্তে ইহলোক ছেড়ে যেতেও বিন্দুমাত্র অনুশোচনা হবে না।

প্রজাপতি ধরার জাল দিয়ে নৌকার কর্মচারীরা বেশ খানিকটা ভাসমান বরফ তুলে নিল। বরফের সঙ্গে সেলফি উঠল অনেক। গ্লেসিয়রের টাকটা বরফ বলে কথা! কিন্তু আগেই বলেছি আমেরিকা ব্যবসায়ীর দেশ। বার-এর ওপরে সাইন-বোর্ড লেগে গেল – ‘হুইস্কি অন গ্লেসিয়র আইস’। সে পানীয় কিনতে লাইনও  পড়ে গেল সঙ্গে সঙ্গে। গ্লেসিয়র বরফের জন্য দামটা অবশ্য চার-পাঁচ ডলার বেশি।

তুষার আর বরফ দুইই আদতে জল হলেও তারা আলাদা। মেঘ থেকে বাতাস বেয়ে তুষার পেঁজা তুলোর মত মাটিতে নেমে আসে। যদি ফুট দুয়েক তুষারপাত হয় তাহলে তার মধ্যে দিয়ে হাঁটতে গেলে পা ডুবে যাবে। থসথস শব্দ হবে। কিছুদিন থাকলে তুষার আর ঝুরোঝুরো থাকে না, জমাট বেঁধে বরফ হয়ে যায়। বরফের পাতলা স্তর যদি রাস্তায় রয়ে যায় তাহলে খুব সাবধানে পা ফেলতে হয়। কাচের মতো স্বচ্ছ হওয়াতে অনেক সময় বোঝা যায় না বরফ আছে কি না। বরফ জিনিসটা বিশ্রি ধরনের পিচ্ছিল। খেয়াল করে না হাঁটলে তুষারের মতো থসথস না হয়ে একটাই ‘দড়াম’ শব্দ হতে পারে।

চিড় খেয়ে ভেঙে পড়ছে বলে এখানে গ্লেসিয়রের ভেতরটা বেশ বোঝা যায়। জায়গায় জায়গায় বরফের রং নীল। যেমন ছবিটির ডান দিকটায় বরফ স্পষ্টতই নীলবর্ণ। কেন?

বরফের মধ্যে খুব সামান্য পরিমানে হলেও বাতাস আটকে থাকে। বহুদিন, মানে কয়েকশো বছর ধরে বরফ যদি অত্যধিক চাপ মাথায় নিয়ে থাকে তাহলে সে আটকে থাকা বাতাসটুকু বেরিয়ে যায়। বাতাসশূন্য বরফের রং নীল। মানে নীলবর্ণ বরফ দেখলে বুঝতে হবে এ বরফ অনেক যুগের পুরনো!

কোন জায়গায় গিয়ে অনেক কিছু দেখার পরেও কোন একটা বিশেষ দৃশ্য মনকে বেশি করে টানে। এর কি কোন কারণ থাকে? থাকলেও তা কেউ জানে না। সমুদ্রপাখি, কালো ভালুক, তিমি এসব ছেড়ে ফেরার পথে বারবার আমার মনে ভাসছিল সাগরের কিনারায় এসে দাঁড়ানো নীল বরফের ছবিটা ।

কতশত বছর আগে কে জানে, সে ছিল এক ঘন মেঘের বেলা। কনকনে ঠাণ্ডা বাতাসে কেঁপেকেঁপে উঠছিল সেডার, স্প্রুস, পাইন গাছের পাতা। এমন সময় শুরু হলো তুষারপাত। পেঁজা তুলোর মতো তুষার হাওয়াতে ভাসতে ভাসতে নাচতে নাচতে পাহাড়ের গায়ে এসে নামছিল। যেন কিন্ডারগার্টেন ছুটি হবার পর চার-পাঁচ বছরের শিশুরা ছাড়া পেয়েছে! কিছুদিন ঝুরঝুরে হালকা হয়েই রইল তুষারের স্তুপ কিন্তু তারপর এল জমাট বেঁধে যাওয়ার দিন। ‘দিনে দিনে কঠিন হলো কখন বুকের তল…’ । ক্রমে বাড়তে লাগলো চাপ। মাথার ওপর, শরীরের ওপর। যেটুকু বাতাস রয়ে গিয়েছিল তা আস্তে আস্তে বেরিয়ে যেতে লাগলো। চেহারায় ধরল নীল রং। তারপর একদিন সমুদ্রের ডাক শোনা গেল – অবাক হয়ে দেখল সে এসে পড়েছে একেবারে জলের কিনারায়! আহা এ জীবনে না হলো চঞ্চল ঝরনাধারা হয়ে পাথর থেকে পাথরে লাফ দিয়ে নামা। না হলো নদী হয়ে দেশ প্রান্তর জনপদ গ্রামগঞ্জের ভেতর দিয়ে বয়ে যাওয়া! এসব ভাবতে ভাবতে নীল বরফ অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছিল। হঠাৎ অনুভব করল তীব্র এক ব্যথা তার বুকে তড়িৎ বেগে প্রবাহিত হয়ে গেল। সে বুঝল শরীরে ফাটল ধরেছে – চারপাশের সাথীদের থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে সে! টাল সামলাতে পারছে না আর, সামনে অগাধ জল তাকে কোলে নেওয়ার জন্য অপেক্ষা করে আছে …

হয়তো তখন অপরাহ্ন বেলা। দূরে কারা যেন নৌকায় যেতে যেতে অবাক চোখে তাকে দেখছে। অথবা হয়তো তখন নিশুতি রাত্তির। আকাশে হলদেটে ভাঙা চাঁদ। ঠাণ্ডা পড়েছে খুব। গাছেরা সকলে যেন সরে সরে এসে একে অন্যকে জড়িয়ে ধরে দাঁড়িয়ে আছে। বনভূমিতে তাই জমাট অন্ধকার। কটা নক্ষত্র মিটিমিটি চেয়ে আছে, এরা কি তাকে কিছু বলতে চায়!

ঝপাস!

একদিন কোনো নিবিড় মেঘের জলকণা দিয়ে তার শরীর গড়ে উঠেছিল। আজ তার অণু-পরমাণু নিঃশেষে বিলীন হয়ে গেল মহাজলধির বুকে। মনে হচ্ছিল আমাদের এই অপরূপ সুন্দর সবুজ-নীল পৃথিবীতে সৃষ্টি-স্থিতি-লয়ের জীবন-চক্র এমনি করেই চলতে থাকে, চলতেই থাকে।



 

 

 

 

 


2 কমেন্টস্:

  1. অপরূপ লাগছে, জীবন্ত হয়ে উঠেছে নৌকা ভ্রমণ। সাথে ভূগোল ও বিজ্ঞানের কথা আরো আকর্ষণীয় হয়েছে।

    উত্তরমুছুন
  2. আপনার চোখ দিয়ে আলাস্কার অপরূপ সমুদ্র যাত্রা দেখলাম। উপভোগ করলাম আপনার লেখনীর জাদুকেও।

    শর্মিষ্ঠা বিশ্বাস

    উত্তরমুছুন