কালিমাটি অনলাইন

ত্রয়োদশ বর্ষ / চতুর্থ সংখ্যা / ১৩১

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

ত্রয়োদশ বর্ষ / চতুর্থ সংখ্যা / ১৩১

শনিবার, ১৪ জুন, ২০২৫

<<<< সম্পাদকীয় >>>>

 


কালিমাটি অনলাইন / ১৩১ / ত্রয়োদশ বর্ষ : চতুর্থ সংখ্যা

 


যোগ্য ও অযোগ্য, দুটোই বাংলাভাষায় বহুল প্রচলিত শব্দ, এবং একে অপরের বিপরীতার্থক শব্দ। ইদানীং বিভিন্ন সংবাদপত্রে, পত্র-পত্রিকায়, আড্ডা-আলোচনায় এই দুটি শব্দকে কেন্দ্র করে প্রবল চর্চা ও সমালোচনা চলছে। বিশেষত সাম্প্রতিক শিক্ষার ক্ষেত্রে, সাহিত্যের ক্ষেত্রে, সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে, সামাজিক তথা রাজনৈতিক ক্ষেত্রে এমন কিছু অনভিপ্রেত ঘটনার মুখোমুখি হতে হচ্ছে, তার পরিপ্রেক্ষিতে এই শব্দদুটি প্রায়শই উসকে উঠছে। আরও দুশ্চিন্তার কথা, অযাচিত কিছু পারিপার্শ্বিকতায় যেভাবে যোগ্যতাকে ছাপিয়ে উঠছে অযোগ্যতা, যোগ্যতাকে ক্রমশই কোণঠাসা করে ফেলছে, এমনকি যোগ্যতাকে প্রতিস্থাপন করে অযোগ্যতা যোগ্যতার স্থান দখল করছে, তাতে সাধারণ বিচার-বুদ্ধি রীতিমতো গুলিয়ে যাচ্ছে, ঘেঁটে ‘ঘ’ হয়ে যাচ্ছে।  

একটা প্রশ্ন এখানে উঠতেই পারে, যোগ্য ও অযোগ্যের তুলনামূলক বিচার কীভাবে করা যেতে পারে, যেখানে যোগ্যতার মাপকাঠি নির্দিষ্ট করে রাখা সত্ত্বেও অনেক যোগ্যই বস্তুত প্রকৃত যোগ্য নয়! ব্যাপারটা সত্যিই ভাবার। আমি পেশাগতভাবে দীর্ঘদিন অধ্যাপনা কাজে নিযুক্ত ছিলাম। সাহিত্যক্ষেত্রেও কাজ করছি অনেকদিন। আমার দেখা চেনা জানা অধ্যাপনার সঙ্গে যুক্ত সহকর্মীরা সবাই ছিলেন উচ্চশিক্ষিত অর্থাৎ কোনো একটা বিষয়ে স্নাতকোত্তর এবং অনেকেই পি এইচ ডি প্রাপ্ত। কিন্তু খুবই অবাক হয়ে লক্ষ্য করেছি, তাঁদের মধ্যে কেউ কেউ অধ্যাপনার জন্য যোগ্যতার মাপকাঠি অতিক্রম করলেও যথার্থ যোগ্য হয়ে উঠতে পারেননি। প্রকৃত শিক্ষিত হতে পারেননি। এবং তাই মনে হয়েছে, কোনো বিষয়ে ডিগ্রিপ্রাপ্ত মানেই কাউকে শিক্ষিত বলে চিহ্নিত করা ভুল। কীভাবে তাঁরা ডিগ্রি অর্জন করেছেন, তা খুবই বিতর্কের ব্যাপার এবং এখানে তা আলোচ্য নয়; শুধু এটুকু বলা যেতে পারে, এভাবেই অনেক ক্ষেত্রে প্রকৃত যোগ্যদের পাশাপাশি অনেক অযোগ্য যোগ্য বলে পরিগণিত হচ্ছে। ঠিক এই কথাটাই প্রযোজ্য হতে পারে সাহিত্যের ক্ষেত্রে, আমি এখানে বাংলাসাহিত্যের কথাই বোঝাতে চাইছি। বিভিন্ন প্রাতিষ্ঠানিকসাহিত্যসংস্থা যাঁদেরকে ঔপন্যাসিক, গল্পকার, কবি হিসেবে প্রচার করছে, তাঁরাই বাংলাসাহিত্যে ঔপন্যাসিক, গল্পকার, কবি রূপে প্রতিষ্ঠা পাচ্ছেন, পুরস্কৃত হচ্ছেন, বাণিজ্যিক পত্র-পত্রিকায় লেখা প্রকাশের সুযোগ পাচ্ছেন। কিন্তু তাঁদের মধ্যে সত্যিই কারা যোগ্য, আর কারা যোগ্য নয়, তার বিচার করবে কে? অবশ্যই করবে পাঠক-পাঠিকারা, কিন্তু সেই বিচার গৃহীত হবে কোথায়? অনেক অযোগ্য সাহিত্যিক যে যোগ্য সাহিত্যিকের মর্যাদা পেয়ে নিজেদের জাহির করছেন, আর প্রকৃত যোগ্য সাহিত্যিকরা তাঁদের যোগ্যতার মর্যাদা থেকে বঞ্চিত হয়ে হারিয়ে গেছেন, একথা অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই। আমরা যারা প্রচন্ড আশাবাদী, সুদিনের অপেক্ষায় আছি, অদূর ভবিষ্যতে বাংলাসাহিত্যের এইসব গরমিল উধাও হবে মনে করি।

জুন মাসের মৌসুমি শুভেচ্ছা শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা জানাই সবাইকে।   

 

আমাদের সঙ্গে যোগাযোগের ই-মেল ঠিকানা :

kajalsen1952@gmail.com / kalimationline100@gmail.com

দূরভাষ যোগাযোগ : 9835544675

 

 

 


<<<< কথনবিশ্ব >>>>

কথনবিশ্ব

 

অর্ঘ্য দত্ত বক্সী

 

বিনয়ের কাব্যভাবনা - আমার বিনয়ভাবনা ও স্কিৎজোফ্রেনিয়া  

 


স্কিৎজোফ্রেনিয়া হল a sane reaction to a insane environmental circumstances. অসম্ভবরকম ভাইব্রেট হতে থাকা চারপাশটার মধ্যে স্থির এক বিন্দু এই স্কিৎজোফ্রেনিক রোগী আর reference frameটা তাই সবাইকে সব্বাইকে স্বাভাবিক ধরে আর সেই স্থানু মানুষটাকে abnormal! আমরা প্রায় ধরে নেব যে বিনয়ের স্কিৎজোফ্রেনিয়া ছিল আর তার সঙ্গে এটাও আগাম জানিয়ে রাখব যে ম্যাডনেস নিয়ে কোন রোমান্টিকতা করতে আমরা এই লেখাটি লিখছি না।  প্রকৃতপক্ষে সাইকোঅ্যানালিটিক চিকিৎসা ধরেই নেয় যে সাইক্রিয়াটিস্ট ঈশ্বরের স্থান দখল করে সুউচ্চ মিনারে বসে আছেন আর মানসিক রোগী যেন ড্রেনের আরশোলা!! একজন সাইক্রিয়াটিস্ট রোগীকে শুধুই অর্থনৈতিকভাবে exploit করার যন্ত্র হিসাবে ভাবেন। তার সঙ্গে ক্যাপিটালিস্ট ব্যবস্থার বুর্জোয়াদের মধ্যে কোন পার্থক্য নেই। কিন্তু মনোচিকিৎসার ক্ষেত্রে রোগীর যা প্রয়োজন তা অন্যসব চিকিৎসার ক্ষেত্রের থেকে অনেক ভিন্ন প্রকৃতির। প্রাথমিকস্তরে রোগী পরিষেবা চায় না... চায় friendship to share, to be listened, to make catharsis বা ব্যাপক অর্থে relationship  যাকে পয়সার বিনিময়ে দেওয়া একপ্রকার prostitution তো হতে পারে!!

Psychology তে diagnostic criteriaর থেকে মিসলিডিং কিছু আর নেই কারণ DSM ম্যানুয়াল ক্রমশ পরিবর্তিত হয়ে চলেছে। একটি experiment করা হয় যেখানে ১০জন সম্পূর্ণ সুস্থ মনোবিদ স্কিৎজোফ্রেনিয়ার বিবিধ রোগলক্ষণ বলে সহজেই মানসিক হাসপাতালে ভর্তি হয়ে যায় এবং বেশকিছুদিন তাদের সময় লেগে যায় এটাই প্রমাণ করতে যে তারা সুস্থ। এই ঘটনার পর হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ সন্দিহান হয়ে পড়ে ও বেশকিছু সত্যিকারের স্কিৎজোফ্রেনিক রোগীকে তারা নকল ভেবে ভর্তি নিতে চায় না। সুতরাং স্কিৎজোফ্রেনিয়া সম্পূর্ণভাবেই qualitatively লক্ষণভিত্তিকভাবে উপর উপর দেখে নির্ণীত একটি রোগ যার ফলে ব্রেনের কোন অংশের কোন abnormality বাইরে থেকে চিহ্নিত করা সম্ভব নয়। যেন ধরেই নেওয়া হয় কানে অস্বাভাবিক শুনছে বা অস্বাভাবিক দেখছে (hallucinationই বা কাকে বলব?) মানেই স্কিৎজোফ্রেনিয়া!

মানসিক সমস্যার ডাক্তারবাবু, আপনি একমাত্র সেই সমস্যারই সমাধান করতে পারেন যে সমস্যার মধ্যে দিয়ে আপনি নিজে গেছেন এবং যাকে ওভারকাম করে বেরিয়ে আসার অভিজ্ঞতা আপনার আছে, কারণ বিশেষ করে এই রোগটি হলে কি অনুভূতি হয় বা কিজাতীয় experience তার sensory organs feel করে তা না জেনে শুধু কিছু লিথিয়াম সোডিয়াম লিখে দেওয়াটাই এযুগের চিকিতসাপদ্ধতি কিন্তু প্রাচীনকালে তা পদ্ধতি ছিল না তখন ছিল ওঝা বা পুরোহিত বা shaman. তাদের ভর হত । তারা ঈশ্বরীয় spirit থেকে আনকনশাসের গোল্ডেন ট্রেজার থেকে সাধারণ মানুষের মনের সমস্যার সমাধান করতেন সেই ব্যক্তির মানসিক স্টেটে গিয়ে তাকে ফিল করে এবং নিজে সেই সমস্যার সমাধান করে নিজের অভিজ্ঞতার মাধ্যমে রোগীকে চিকিৎসা করতেন। তাই কুলকুণ্ডলিনীর প্রথম জাগরণে পশুপ্রতীক হল মকর বা কুমীর যে হঠাত জলে পড়া যোগীকে গিলতে আসে কিন্তু গুরু নিজের অভিজ্ঞতা দিয়ে সেই পরিস্থিতিকে কিভাবে জয় করতে হবে তার উপায় বাৎলান। ভর আমাদের উপমহাদেশে আর আফ্রিকায় এক অতি কমন জিনিষ। আমরা আমাদের আধ্যাত্মিক শক্তি ও পূর্বপুরুষদের আত্মার শক্তিতে বিশ্বাস করি। আমরা মনে করি অন্তরের আত্মার শক্তিতে আমরা সব বিপদ থেকে মুক্তি পাব rather than materialistic way. তাই আমাদের সাইকোলজিকে American আর western European মনস্তত্বের বিজ্ঞান দিয়ে বিচার করার কোন যুক্তি নেই  আর স্কিৎজোফ্রেনিয়া আদৌ কোন সমস্যা কিনা সে প্রশ্নও আছে। capitalist world এর অচলায়তনের repression, exploitationmaddening rationalisation এর বিরুদ্ধে স্কিৎজোফ্রেনিয়া হল মুক্তি ও সৃষ্টিশীলতার জেহাদ। একজন সাধারণ মানুষকে স্কিৎজোফ্রেনিয়া অতিমাত্রায় সৃষ্টিশীল করে যে তোলে তা শুধু দার্শনিক পর্যায়েই সীমাবদ্ধ নয় ... বাস্তবপ্রত্যক্ষ। এবার মহাশয় আপনি বলবেন সে তো ভ্রম...error...sensory hallucination. কিন্তু যে মুহূর্তে আপনি ভ্রমটি দেখছেন তখন কি তাকে ভ্রম বলে নিজেই চিহ্নিত করতে পারেন? যখন দড়িতে সাপ দেখছি তখন আমি  সাপই দেখছি দড়ি দেখছি না। পরে ভ্রম ভাঙ্গলে বুঝতে পারছি যে দড়িকে সাপ দেখেছিলাম। কিন্তু আমার সেই moment এর ভয় অভিজ্ঞতাটা বা creativity টা কিন্তু ভুল নয়, তা প্রত্যক্ষবাস্তব। সুতরাং আমরা যদি মেনেও নিই স্কিৎজোফ্রেনিয়া রোগ তার positive aspect যে মস্তিষ্কের অতিকর্মময়তা যার ফলে এক unique creativity এর নতুন দিগন্ত খুলে যায় ... মানুষের অন্য সবার থেকে unique ভাবতে পারার সম্ভাবনার ক্ষমতা এত যে বাড়ে যায় তা তো এক আশীর্বাদ বা দৈববর। হিসাব না মেলানো বীভৎস animal instinct বাস্তবটার মুখোশ এক লহমায় টেনে ছিঁড়ে খুলে দিয়ে মুহূর্তে স্কিৎজোফ্রেনিয়া আমাদের ম্যাচিওরড করে দিয়ে যায়।  দ্বিতীয়ত আপনার সাপ ও দড়ি সম্বন্ধে বাস্তব জ্ঞান আছে... আছেই না হলে সাপ কি বস্তু না জানলে আপনি ভ্রমবশতও দড়িতে সাপ দেখতেন না। ভ্রমবশত কি আপনি ঘোড়ার ডিম দেখেন? তা অবাস্তব। সুতরাং ভ্রমেও অন্তত একটি কার্যকারণ যুক্তিশৃঙ্খলা পাওয়া যাচ্ছে। আপনি সাপ আর দড়ির যে স্টিমুলাস তার মধ্যে discrimination করতে পারেননি আপনার ইন্দ্রিয় দিয়ে তাই আপনি ভ্রম দেখেছেন। আপনার সুতরাং সব কটি cognitive functionই যেমন perception আর memory কাজ করছে। আপনার মেমোরি যে কাজ করছে তার প্রমাণ আপনি দড়ি ও সাপ উভয়কেই পূর্বজ্ঞান থেকে রিট্রিভ করছেন এবং যা আপনি উপলব্ধি বা প্রত্যক্ষ্যকরণ করছেন তা নেই ও বলা যাবে না তা আছে তাও বলা যাবে না ... তা অনির্বচনীয় ...undecided. ভ্রম আপনাকে যা দিয়ে গেল তা হল এক highly creative experience যা স্বপ্নেও মানুষ পায় যখন সে “ABSURD” স্বপ্ন দেখে এবং তা যে একটি bliss এবং তার মাধ্যমেই যে শ্রেষ্ঠ collective symbolগুলি উঠে এসেছে ও সভ্যতাকে শুভের দিকে এগিয়ে নিয়ে গেছে তা সবাই জানেন।

প্রাচীনকালে তাই পাগলদের মোটেও আধুনিক যুগের মতো মানসিক শক্তিতে দুর্বল, অর্থনৈতিকভাবে অচল ও লায়াবিলিটি আবার সামাজিক প্রস্টিজের পক্ষে অসম্মানজনক ও তার আগ্রাসনকে (ক্ষেপে যাওয়া) physically বিপদজনক বলে বিবেচনা করা হত না। তাদের ছিল অবাধ গতি... তারা ছিলেন সাধুর মতোই মুক্ত ও দিব্য স্বভাবজাত ও ঈশ্বরের সঙ্গে মানুষের যোগাযোগের মিডিয়াম। আধুনিক যুগ যখন তার inbuilt দর্শন বদলে rationalও ক্যাপিটালাইজড হয়ে উঠল তখন তারা asylum নিয়ে এসে এদের জনবিচ্ছিন্ন করল আর শুরু করল এদের চিকিৎসা (নিজেরাই এদের ভাগ্যবিধাতা হিসাবে self acclaim করে) যেন এরা অস্বাভাবিক এই বোধে ...আর সেই যুগ থেকে এদের alienated হয়ে যাওয়ার শুরু যার চরম প্রকাশ ফ্রয়েডীয়ান স্কুল এবং ক্রমশ উত্তরাধুনিক যুগ anti-psychiatry anti-Oedipus দিয়ে এর প্রতিবাদে মুখরিত হয়ে উঠছে।

মানসিক হাসপাতাল বা rehab গুলোর একটা পলিটিক্স আছে তা হল এই পরিবেশে টিকে থাকতে গেলে আপনি সুস্থ হোন বা অসুস্থ আপনাকে একটি লেবেল অবধি মানসিক রোগগ্রস্ত (অন্তত বাহ্যিক লক্ষণে) করে নেওয়া হবে সেই স্টেটে বাধ্য হয়ে না গেলে আপনি সেই environment কে মানাতেই পারবেন না আপনি এত odd হয়ে যাবেন যে total systemটাই তখন প্রশ্ন চিহ্ন হয়ে দাঁড়াবে অন্য সব কিছু কিছু এখনও বোধ আছে এমন man-made পাগলদের কাছে। এমনকি অতিরিক্ত ধূমপান ছাড়াতে আসা এক “client”ও এখানে চিকিৎসা করাতে এসে সেই ভুলভুলাইয়া অজানী দেশের না জানি কী রোগ স্কিৎজোফ্রেনিক হয়ে যায় ও তারপর সেখানেই শুরু হয়ে যায় তার সেই না-রোগের চিকিৎসা এমনই হল মানসিক হাসপাতাল। সে যেন নিজেই নিজের desireকে রিপ্রেস করার desire করল!! করতে বাধ্য হল। বস্তুত desire কোন কিছুর অভাব বোধ থেকে জাত নয়। একথা আমাদের ভারতীয় দর্শনও আলোচনা করেছে তার মত করে।  ডিজায়ার যে তার জন্য প্রয়োজনীয় objectএর ( যাকে লাঁকা বলছেন object a) এর সঙ্গে যুক্ত হয়ে একটি desire machine desire production system তৈরি করে যা autonomousযার ভিত্তিতে এই capitalist economy এর চাহিদা ও যোগান তত্ত্ব ভেঙ্গে পড়ে আর মানুষকে না ফ্রয়েডের আশ্রয় নিতে হয় systemএর চাপানো ইদিপাস রিপ্রশন থেকে মুক্তির জন্য না তাকে মার্ক্সের আশ্রয় নিতে হয় বুর্জোয়াব্যবস্থা ভাঙ্গার সক্রিয় বিপ্লবের রসদ যোগাড় করতে। desire নিজেই একটি বিপ্লব আর সেই তার জন্য প্রয়োজনীয় যাবতীয় complimentary parts যোগাড় করে নিয়ে নিজেই আত্মবলেবলীয়ান একটি স্বয়ংক্রিয় ব্যবস্থা হিসাবে গড়ে উঠতে পারে। যদি বিপ্লবের প্রয়োজন হয় তবে desire এর প্রবল libidinal sexual flow নিজেই তাকে নিয়ে আসবে এ বিশ্বাসে ভর করে উত্তরাধুনিক ভাবুকরা আনলেন স্কিতজোঅ্যানালিসিসের দর্শন যা postmodernism এর যাবতীয় literary বৈশিষ্ট মেনেই রাইজোম্যাটিক, স্বয়ংক্রিয় ও চক্রবৃত্তবৃদ্ধি ক্রিয়া। মনে হয় আধুনিকতা আবার যেন ক্ষমাপ্রার্থী হয়ে দাঁড়াল আর উদার postmodern তার দিকে সকরুণ বুদ্ধের দৃষ্টি নিয়ে তাকাল।

আসলে economy আর পলিটিকাল অ্যান্ড সোশ্যাল সিস্টেম মানসিক রোগকেও করে তোলে ছোঁয়াচে। rehab সত্যিই তাই এমন এক তীর্থ যেখানে ... u can check out any time u like but u can never leave .... এবং এই vicious circleই বিনয়কে ১৬টা শক দিইয়েছে। যেখানে শক থেরাপি লোবোটমি বাতিল হয়ে ক্রমশ মেডিকেশনও বাতিল হওয়ার পথে কারণ মাদকের মতোই mental drugsও বিরাট এক নেশা এবং নেশা ছাড়াতে যে drug dependency চলে এল তা বন্ধ করলে তার যে withdrawal তাও এক client এর সহ্যসীমার বাইরে!! মানসিক চিকিৎসার মানবিক মুখ এখন তাই talk therapy, client centred therapy... বহুবিধ positive, humanistic existential approach যা মানুষকে আত্মার মত অবিকারী অমৃতের সন্তান হিসাবেই ভাবছে।

বিনয়ের ‘কাব্যভাবনা’ (ধূসর জীবনানন্দ গ্রন্থের অন্তর্গত, কবিতীর্থ) প্রসঙ্গ নিয়েই এই টেক্সটটি আর ভাবছিলাম এ লেখা যেমন context কে ছেড়ে free flow করে যাচ্ছে যেমন খুশি তেমনই হঠাত বিনয় নিজের ‘কাব্যভাবনা’ নিয়ে বলতে গিয়ে চিরাচরিত কেন লিখি জাতীয় থোড়বড়িখাড়ার বদলে অমন  অদ্ভুতুড়ে পাগলামি বলতে বসলেন কেন? প্রথমত যে কথাটি বললাম হ্যাঁ তাই যে বিনয় এই ম্যাসেজ আগেই জানিয়ে নিলেন যে তিনি এর উত্তরে ধাঁধা ইঙ্গিতেই কথা বলবেন...কথা বলবেন semioticsএর গূঢ় দর্শনের মোড়কে দ্বিতীয়ত এই লেখ্যকৃতিটিকে এমনভাবেই centrifugalকরে নির্মাণ করলেন তিনি এবং তাতে  decontextualisation ধারণাকে( linguisticভাবে) যে ভাবে ফর্ম হিসাবে পাওয়া গেল তা থেকে বোঝা গেল শুধু কাব্যভাবনা নয়... তিনি লিখতে বসেছেন জীবনভাবনা জীবনদর্শন ও জীবনস্মৃতি ... যার অনেকটাই জুড়ে আছে তার আত্মজীবনীমূলক কবিতা ও মানসিক রোগ।

প্রথমত বিনয়ের এই লেখাটি পড়ে আমরা তাকে উন্মাদ ভাবতেই পারি। কি “হাসিচ্ছলে"ই না তিনি বলছেন দেখো আমার কি ভীষণ paranoid schizophrenic লক্ষণ!! সাধারণ এক সাইকোলজিস্ট এই লক্ষণ শুনেই বলবেন thought broadcasting হয়ে যাচ্ছে বা মনের চিন্তা অন্যে জেনে ফেলছে এই জাতীয় delusionএর symptom এটি। আবার সেই চিন্তার reactionও পাওয়া যাচ্ছে। এক অবাস্তব কথোপকথন চলছে ২০ মাইল দূরে থাকা দুটো মানুষের মধ্যে। এমনকি ঠাকুরনগরনিবাসী ও কলকাতানিবাসী দুজনের মধ্যে communication চলছে মনে মনে !! এমনকি যাবতীয় বিষয়েই কবি নিজের reference বা context পাচ্ছেন যেমন এমনকি টিভিতে যে প্রোগ্রাম চলছে বা খবর পড়া হচ্ছে তা সব তাকে নিয়েই!! এগুলি হল signature diagnosis criteria of acute schizophrenia. মনোবিদ ভাববেন external projection হচ্ছে যা আর defence mechanismএর control এ নেই। আপনাদের মনে পড়বে ভ্রমের কথা যেখানে আমার মনের সাপকে আমি দড়িতে প্রজেক্ট করেছিলাম। বিনয় কিন্তু এই সাড়ে তিন পাতা দিয়ে তার বিনয় মজুমদার জীবনতত্ত্ব বলে দিয়েছেন সাংকেতিকভাবে। সেই মনোবিদই যদি এই লেখাটি পড়েন, এই স্যাটায়ারিস্টিক সান্ধ্যভাষামূলক অথচ  চরম শান্ত অমোঘ casual  আর সুস্থির শান্তিমগ্ন এই লেখাটি ও তার যদি সাহিত্যবোধ ও নিজের পেশার যথেষ্ঠ অভিজ্ঞতা থাকে তবে আমি নিশ্চিত তার তবে লাঁকার মতোই একটি সুবিখ্যাত পারলয়েড লেটার নিয়ে পেপার লেখার বাসনা হবে...তারও আর ম্যানুয়ালে স্কিৎজোফ্রেনিয়ার কি লক্ষণ লেখা আছে সেই টিয়াপাখি বিদ্যা মনে পড়বে না... তিনি যা হবেন তা হল ‘কিংকর্তব্যবিমূঢ়’ ...

হ্যাঁ বিনয় মজুমদার এমন একজন মানুষ যিনি utterly introvert. তবে তিনি যেমন খুব গভীরভাবে কারোর সঙ্গে মিশতে চান না, নিজেকে অতিপ্রকটভাবে পরের কাছে মেলে ধরতে চান না তেমন complete isolationও তিনি  সহ্য করতে পারেন না এ এক অনন্ত টেনশন তৈরি করে যে কোন schizoid মানুষের মনে। বিনয় তাই বেছে নিয়েছেন মধ্যপন্থা। তিনি communicate করছেন কিন্তু ফিজিক্যালি নয়।

আমরা দেখব যে এই ছোট্ট লেখাটির মধ্যেও বিনয় ছোট ছোট প্রসঙ্গান্তর এনেছেন...আপাত contextহীন কিছু কথা বলেছেন। যাকে decontextualisation হিসাবে আমরা আগেই চিহ্নিত করেছি ( যেমন ৩ নং পাতায় উৎপল ভট্টাচার্যের সঙ্গে কথোপকথন)। আবার একই সঙ্গে তিনি context এর উপর এতই বেশি জোর দিয়েছেন যে উভয়কেই abnormal লাগে!! তিনি বলেছেন কারও কবিতা যদি মুখস্থ থাকে তা মনে মনে আবৃত্তি করা গেলে কবি যত দূরেই থাক তার মুখ দেখা দেবে । তার দিকে তখন চেয়ে তাকে ডেকে তার সঙ্গে কথা বলা যায়!! অত্যন্ত গুরুত্ব দিয়ে গোটা প্রসেসটাকে তিনি ১ ২ ৩ ৪ এভাবে সাজিয়েছেন যেন ফোন ডায়াল করার সর্বজনবিদিত পদ্ধতি

অনেক বিষয় ছুঁয়ে এমনভাবে প্রসঙ্গটি বলা যা এত বহুস্তরীয় যে একটু একটু করে ছাড়িয়ে ছাড়িয়ে ঢুকতে হবে। বিনয় চিরকাল লিখে গেছেন দিনলিপিমূলক আত্মজৈবনিক কবিতা ... তা সে যে কোন বিষয় নিয়ে ... না-কবিতাই লিখে গেছেন তিনি। এবং তাতে নেই কোন নির্মাণের চাতুরি নেই অপ্রয়োজনীয় সৌন্দর্যায়ন বা অভিনব বিষয়ভাবনার প্রচেষ্টা। তার কবিতা আদতেই decontextualised...যেমন তার মানসিক গঠন তেমনি তার কবিতা। তিনি ও তার কলম এক। তিনি ঠিক যেমন তার কবিতা ১০০% তেমনই... এর মধ্যে অন্য কিচ্ছু নেই । এ এক mundaneness  যা তার কবিতায় বড়ই প্রকট। তবুও তিনি কবি...নিজেকে ১০০% নিজের কবিতায় contextualiseকরেন তিনি...শুধু নিজেকেই... তিনি যার মূলগত নেচারই হল decontext বেসড। এই হল dualityএর জায়গা যেখানে sanity আর insanity তার validity হারিয়ে ফেলে। একইসঙ্গে তার context decontext করার ... প্রয়োগ ও নিবারণক্ষমতা এতই অমোঘ যে তা সত্যিই তা অস্বাভাবিকরকমের।  আর একেবারে শেষে এসে তিনি দিয়ে দেন একটি jerk...একটি ভূকম্পন...যা সদম্ভে ঘোষণা করে যে হ্যাঁ এটি কবিতাপদবাচ্যই আর এর লেখক আমি একজন সুস্থ মানুষ...কবি হিসাবে সম্মানের দাবিদার।

বিনয়ের কাছে এক পাঠক কবি কবিসত্ত্বা ও কবিতাসত্ত্বা অভেদ। যদি মেমোরি যথার্থভাবে কবির কবিতা বা contextটি মনে রাখতে পারে তবে আলাদিনের দৈত্যের মতোই ব্রেনের সিস্টেমের ক্লু কবিতাসিস্টেম থেকে কবিকে উদয় করবে। আলাদিনের প্রদীপ ও আলাদিনের দৈত্য অভেদ। signifier signified এর ক্রিয়াভিত্তিক দিকটি বাংলা ভাষার বৈশিষ্ট্য যেখেনে তার ভিত্তি অধ্যাত্মবাদ ও উপলব্ধি, পুরাণ ও প্র্যাকটিস, ইতিহাস ও দর্শনও বটে। বিনয়ের কাছে ঈশ্বরীর সৃষ্টি যেহেতু সার্বভৌম ও সমগ্র সত্ত্বা হিসাবে আসে তাই আলাদা করে কবি কবিতা স্মৃতি signifier signified context subject এগুলি আলাদা থাকে না। এক পঞ্চবিংশতি প্রকৃতিতত্ত্বের অন্তর্গত হয়ে যায় সব। Collective হয়ে যায়। All that is outside, also is in inside বোধ হয়। কবিতা সংকলন এর ক্ষেত্রে বিনয় স্মরণযোগ্য কবিতায় বিশ্বাস করতেন এবং বলতেন যতদিন বিনয় মজুদারের নাম reference হিসাবে ব্যবহৃত হবে ততদিন তিনিও জীবিত থাকবেন। কবির মধ্যে কবিত্ব থাকে, পাখির মধ্যে থাকে পাখিত্ব, পাথরত্ব থাকে না, তাই ঈশ্বরীর নিয়ম। তাই কবি মরে গেলে পাখি মরে গেলে তবু যদি context থেকে যায় তবে তবে সেই কবিত্ব পাখিত্ব জীবিতই থেকে যায়!!

ফুকো ম্যাডনেস ও সিভিলাইজেশনে যে rational structured ভাষার ব্যবহার করেছিলেন তাকে আক্রমণ করেছিলেন দেরিদা। এবং এই বিন্দু থেকেই বিনয় ও তার abnormality ও তার abnormal ভাষার প্রসঙ্গ চলে আসে। বিনয় ভাবের ঘরে চুরি করেননি। তার কবিসময়সারণী যত এগিয়েছে unique থেকে uniqueতর এক জার্নালধর্মী কবিতায় চলে গেছেন তিনি নিরলঙ্কার। তার ঘটনাহীন অর্থহীন খাদ্যহীন চরম পলিটিক্সের শিকার insecure পরিস্থিতিতে কবিতা নিয়ে নির্মাণ নির্মাণ খেলা তার পক্ষে সম্ভবও ছিল না। তার বিষয়, উপমা, রূপক সব সাধারণ...অসাধারণভাবে সাধারণ...abnormally normal! আর তাই দিয়ে main streamএর শিরদাঁড়ায় ঠাণ্ডা স্রোত বইয়ে দিতে পেরেছেন তিনি। না, বিনয় অনুকরণ করা সম্ভব নয়। তার কারণ এই নয় তিনি জটিল...তার কারণ তিনি অস্বাভাবিকরকম অসম্ভবরকম extraordinarily ordinary!!  বস্তুত যা কেউ একবার শিখলে ভোলে না যেমন semantic memory (মাতৃভাষা স্মৃতি) যেমন engineering এর সংজ্ঞাগুলো ... একটি প্যাটার্ন যা বারবার চিন্তনে অনুশীলনে তৈরি হয় এক মানুষের unique thought structure and personality patternA signature of a particular person। তাকে একেবারে বিনা defense mechanism এর বাধায় ড্যাম  থেকে ছাড়া জলের মতো তোড়ে প্রবাহিত হতে দেওয়া কবিতার নাম বিনয়ী কবিতা বা ‘না-কবিতা’ বা একান্ত বিনয়ীই কবিতা! একবার বলুন তো “কেন আরো একটি চাকা লিখতে পারছি না” এ জাতীয় হতাশা হীনমন্যতা আমরা কোথাও বিনয়ে পেয়েছি?!! হাগা মোতা খাওয়া কথা বলার মতো তার কবিতা লেখা যাকে সন্দীপন চট্টোপাধ্যায় বলেছিলেন যেন হাই তোলা তাই তো আমরা পেয়েছি এই নিষ্কাম প্রাজ্ঞ কবিটির কাছ থেকে... বুদ্ধের মতো!!

বস্তুত বিনয় বরাবরই তার কবিতায় পাঠককে কবির সঙ্গে আইডেন্টিফায়েড হতে দেন নি যেমন কিনা রূপকথাগুলোয় রাজপুত্রের সঙ্গে আমরা হয়ে যাইতিনি বরাবর বজায় রেখেছেন এক কাব্যিক alienation যার আশ্রয় তার নিজেরও দরকার ছিল নিজেরই সুস্থতার জন্য। এবং তিনি বরাবরই বড়ই অভিমানী তাকে নিয়ে পাগল পাগল পলিটিক্সে। বিনয় তাই নিজের মত করে একইসঙ্গে পাঠক ও সমুদয় ‘হাঙর’দের (ডাক্তার, রাজনীতিবিদ, পিঠে ছুরি মারা কবিরা) মুখে ঋত্বিকের মতোই ছুঁড়ে দিয়ে রাখলেন এই কাব্যভাবনা থুড়ি থাপ্পড় যে যাকে তুমি বলছ আমার মানসিক রোগ স্কিৎজোফ্রেনিয়া যাকে বলছ আমার দুর্বলতা তাই আমার greatest weapon কারণ তাকে আমি তত্ত্বতঃ জেনে হজম করে ফেলেছি।তুমি ভাবছ আমি সাপভ্রম দেখছি এবং আমিও চাই যে তুমি সেই ভ্রম নিয়েই থাকো!! আমার মধ্যে এই স্কিৎজোফ্রেনিক লক্ষণের উর্ধে আছে অমোঘ শান্ত সংযত casuality যা তোমার  melancholia/mania principle ছুঁতে পারে না। না পারে তোমার স্কিৎজোফ্রেনিয়া রোগলক্ষণের ফলাফল হিসাবে সন্দেহবাতিকতা আত্মহত্যাপ্রবণতা aggression বা depression কিছুই ছোঁয় না আমায় অথচ দেখ তোমার মেডিক্যাল স্কিৎজোফ্রেনিক রোগলক্ষণের পাখিপড়া বুলি!! আমার চারপাশ আমার দ্বারা এমতই নিয়ন্ত্রিত যে আমার DESIRE SYSTEM যাকে যেভাবে আমি চাই দেখে কথা বলে নিতে বা কাজ করিয়ে নিতে পারি এমনকি হে ডাক্তার তোমাকে দিয়েও!!! হ্যাঁ আমি বিনয় মজুমদার... I am the CONTEXT!!!

না এই লেখাটিতে একেবারেই বিনয়ী নন আমার বিনয়...

Project Guide: দেবপ্রসাদ বন্দ্যোপাধ্যায় ...  ভ্রান্তিগুলি একান্তই আমার


গৌরাঙ্গ মোহান্ত

 

কায়সুল হকের কবিতা: 'পিপাসার আশ্চর্য নিখিল'

 


'যাকে আমরা বাস্তব বলি তাই বিকার্য শুধু কটি স্বপ্নই বুঝি অবিনাশী, মৃত্যুহীন।'

'স্বপ্নের চারু কারু' অন্নদাশঙ্কর রায় প্রসঙ্গে কবি কায়সুল হক বিকার্য বাস্তবতার প্রতিকূলে স্বপ্নের অবিনাশিতা নিয়ে যে প্রগাঢ় প্রত্যয় ব্যক্ত করেন তার সপ্রমাণ স্বাক্ষর তিনি উৎকিরণ করেন 'জ্যোৎস্নার বকযন্ত্রে পরিশ্রুত' কবিতার ভূমণ্ডলে।

ওয়ালডেন-আকৃষ্ট ইয়েটসের ইনিসফ্রি-নির্জনতা আত্মপ্রচার-বিমুখ এ কবির মগ্ন চৈতন্যে বিস্তার করে এক শিল্পিত আধিপত্য; 'কারো অতল কান্নার মতন' স্তব্ধতা কবির সংবেদী স্নায়ুকে উদ্বেলিত করে 'সারারাত'। কায়সুল হক মালদহ জেলার বতুয়া থানাস্থ তাজপুর গ্রামে ভূমিষ্ঠ হন ১৯৩৩ খ্রিস্টাব্দের ২৯ মার্চ; ১৯৩৫ খ্রিস্টাব্দ হতে রংপুরে আরম্ভ হয় তাঁর অবস্থিতি। একদিন আমি দূরভাষে কবির সকাশে প্রশ্ন তুলি, 'কোনটি আপনার জন্মভূমি'? ধাত্রেয়ী রংপুর কবির ছায়াস্নিগ্ধ বাসভূমি, চৈতন্যলোকের প্রতীকী ধরিত্রী। রবীন্দ্রনাথের মতো হয়তো তিনি অনুভব করেন, 'মানুষের বাসস্থান পৃথিবীর সর্বত্র। মানুষের বস্তুত বাসস্থান এক। মানুষের কাছে পৃথিবীর কোনো অংশ দুর্গম নয়। পৃথিবী তার কাছে হৃদয় অবারিত করে দিয়েছে' (রবীন্দ্রনাথ ২০ খ- ৪২১)। ১৯৫৫ খ্রিস্টাব্দ হতে ঢাকায় বসবাসের পূর্বমুহূর্ত পর্যন্ত রংপুরের অকৃত্রিম প্রতিবেশ-পরিমণ্ডল কায়সুল-মানসের পরিপুষ্টি বিধানে সক্রিয় থাকে। ১৯৪৯ খ্রিস্টাব্দ হতে তিনি আধুনিক ধ্যান-ধারণার পিয়াসী হয়ে ওঠেন। তখন সঞ্জয় ভট্টাচার্য সম্পাদিত 'পূর্বাশা' পত্রিকার মাধ্যমে তিনি অন্নদাশঙ্কর রায়ের সঙ্গে পরোক্ষভাবে পরিচিত হন। তাঁকে তিনি 'বাঙালি যুক্তিবাদী মনীষী লেখক' হিসেবে বিবেচনা করেন এবং তাঁর নিকট থেকে 'শিল্পী হওয়ার দীক্ষা' গ্রহণ করেন (কায়সুল জ. পাক্ষিক ৪৬)। অন্নদাশঙ্কর তাঁর প্রবন্ধে অজ্ঞেয়বাদী বারট্রান্ড রাসেলকে 'সংজ্ঞাতীত সত্যের পূজারী ' হিসেবে অভিহিত করেন; রাসেলের 'পূজা মুক্ত মানবের পূজা, দাস মানবের নয়'। তিনি মানুষকে 'মুক্ত দেখতে চান, জীবিত দেখতে চান' (অন্নদাশঙ্কর ৯৬)। রবীন্দ্রনাথও রাসেলকে 'প্রখর আলোকে দীপ্যমান' চিত্তের অধিকারী রূপে প্রত্যক্ষ করেন (রবীন্দ্রনাথ ২৬ খ- ৫৩৮)। 'যুক্তিবাদী হওয়ার পথ অন্বেষণে নিবিষ্ট' হয়ে কায়সুল হক প্রথম যৌবনেই বারট্রান্ড রাসেলকে দীক্ষা গুরুর মর্যাদা দান করেন (কায়সুল জ. পাক্ষিক ৪৬)। রাসেলীয় দর্শনে আবিষ্ট কায়সুল হক স্বসংস্কৃতিসঞ্জাত বিশ্বমানবিকতাবোধ ও আত্মোপলব্ধির নিরঞ্জন প্রস্রবণে অভিষিক্ত হবার জন্য প্রতিনিয়ত রবীন্দ্রনাথের সন্নিধান কামনা করেন। তাঁর ভাষ্য, 'পরিপূর্ণ মানুষ হওয়ার সাধনায় র বীন্দ্রনাথ আরাধ্য' (কায়সুল স্বদেশ, সংস্কৃতি ৯)। জীবনানন্দের কাব্য 3 জীবনবোধের প্রভাবও কায়সুল হকের ওপর দুর্নিরীক্ষ্য নয়। সাহিত্য পত্রিকা সম্পাদনার সূত্র ধরে জীবনানন্দের সঙ্গে তাঁর গড়ে ওঠে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক। পঞ্চম দশকে কায়সুল হক কবিতার স্বপ্নঋদ্ধ ভূখণ্ডে আত্মানুসন্ধানে ব্রতী হন। একজন কবিকে 'কাল্পনিক ইংরেজি-মার্কা দশক নামক ঐতিহাসিক যুগসংখ্যায়' চিহ্নিত করা অর্বাচীনতার নামান্তর মর্মে বিষ্ণু দে অভিমত প্রকাশ করেন (বিষ্ণু দে ২৩৮)। কায়সুল হককে শুধু মাত্র পঞ্চম দশকের কবি হিসেবে বিবেচনা করা সঙ্গত নয়; তাঁর কাব্যিক আবেদন শাশ্বতিক বলে উপলব্ধ হয়। যদিও তিনি কবি শামসুর রাহমানের মতো অতিপ্রজ কাব্যকার নন, তাঁর সৃষ্ট কাব্যসম্ভার উপলব্ধি-বিভূতি-প্রত্যয়গত দিক থেকে বিশিষ্টভাবে ব্যঞ্জনাদীপ্ত। তাঁর প্রথম কাব্য 'শব্দের সাঁকো' ১৩৮১ বঙ্গাব্দের বৈশাখে, দ্বিতীয় কাব্য 'রবীন্দ্রনাথের নিরুপম বাগান' ১৪০৭ বঙ্গাব্দের ফাল্গুন মাসে, প্রবন্ধ গ্রন্থ 'স্বদেশ, সংস্কৃতি ও রবীন্দ্রনাথ' ২০০৪ খ্রিস্টাব্দের মার্চ মাসে এবং 'আলোর দিকে যাত্রা' ২০০৬ খ্রিস্টাব্দের ফেব্রুয়ারি মাসে প্রকাশিত হয়।

'কী সুন্দর এ পৃথিবী'

পৃথিবীর সৌন্দর্য, নিসর্গ-অরণ্য-ঋতুর চমৎকৃতি কায়সুল হকের করোটিতে জাগায় উৎকর্ষী উৎকম্পন। 'মায়াবী আকাশ সচকিত করে' 'গোলগাল চাঁদ' লাফ দিয়ে উঠলে কবি মুগ্ধ হন। 'পূর্ণিমার চাঁদ'-এর সাথে তিনি অনুভব করেন সপ্রেম অনুবন্ধ; 'জ্যোৎস্নার গুঁড়ো মেখে পাখির শুভ্র পালকের মতো নিজেকে ছড়িয়ে দিতে' তিনি 'সুখ' বোধ করেন। 'গাছের পত্রালি' যখন ঝরে যেতে শুরু করে তখন নিসর্গপ্রেমী কবির নিকট 'সুন্দরের স্নিগ্ধরূপ' তিরোহিত হয়; 'আকাশের চাঁদকে তখন শুধু ফ্যাকাশে বেল্লিক ছাড়া আর কিছু মনে হয় না।' অরণ্য 'পৃথিবীর সিঁথির সিঁদুর'; অরণ্যহীন ভূখণ্ড বরণ করে বৈধব্য-পীড়ন। একজন স্বাপ্নিকের 'inner weather'-এর সঙ্গে বৃক্ষের 'outer' আবহের সম্পর্ক রবার্ট ফ্রস্ট যেমন আবিষ্কার করেন (Frost 252), তেমনি কায়সুল হক 'মানুষের হৃৎস্পন্দন'-এর সঙ্গে 'পত্রাদির কম্পন'-এর সাযুজ্য প্রত্যক্ষ করেন।

বৈদিক যুগের আদিকবি বর্ষার বিমল ধারায় অনুসন্ধান করেছেন অমোঘ সঞ্জীবনী। ঋগ্বেদের একটি সূক্তে শুনি বর্ষার সমাগমে মণ্ডুকের মুক্তির ধ্বনি (শ্রী হিরণ্ময় ১৮১-১৮২)। কায়সুল হকও 'উতল শ্রাবণ'-এ দেখেন, 'অতি পুরাতন মেঘদূত/ নবীনতা নিয়ে ফিরে আসে।' 'যৌবনকে খুঁজে নিতে' তখন তিনি 'বৃষ্টির ধবল ধারায়' স্নাত হন। 'মাহ ভাদর'-এ বিদ্যাপতির মতো 'শূন্য মন্দির মোর' বলে তিনি বিরহ-মথিত ব্রজবুলি উচ্চারণ করেন না। 'আকাশ ছাড়পত্র না' দিলে কবিতায় তিনি ভরে তোলেন শূন্য প্রহর। কায়সুল হক একদিন 'হেমন্ত আকাশ থেকে' ঝরতে দেখেন 'শিশিরের মতো উৎসব'। সেই থেকে জীবনানন্দের মতো তিনি হেমন্ত-অনুরক্ত হয়ে ওঠেন; তাঁর 'মনের মাটিতে একেবারে নিজের মতন ক'রে/ সমস্ত সময় ধ'রে হেমন্তে র রৌদ্র আর শিশিরের কণা' ঝরতে থাকে। জীবনানন্দের হৈমন্তিক ভূমণ্ডল শস্য-সমৃদ্ধি, আলস্য, লাবণ্য, পূর্ণতা, সভ্যতা-সংকট, বিনষ্টি ও জীবন-জীবনান্তের সংশ্লেষণে প্রোজ্জ্বল (নরেশ কবিতা ১১০)। কায়সুল হকের হৈমন্তী ভূখণ্ড নির্জনতা, প্রেম, মাধুর্য, ঋদ্ধি, সংস্কৃতি ও দীপ্তির সুষম সংযোগে সমুদ্ভাসিত। নরেশ গুহ 'হেমন্তের ঢালু বেলায় নরম রোদে ঘুরে ঘুরে' প্রেয়সীকে হৃদয়ের কথা শোনাবার জন্য 'লগ্ন' কবিতায় ব্যাকুলতা অনুভব করেন (নরেশ ২১)। আর কায়সুল হক হেমন্তের নির্জন পরিবেশে প্রিয়তমার উদ্দেশ্যে পূর্ব-কথিত পঙ্ক্তিমালা রোমন্থন করেন :

'কখনও কি পাণ্ডুর আকাশ তোমাকে বিষণ্ণ করে?

বেদনা শিশির হয়ে ঝরেছে কি সারা রাত ধ'রে?

লেখা হয়ে গেছে নাকি সেখানে তোমার অদ্বিতীয় এই নাম?

 ... ... ...

আকাশের নীলিমায়

হে নারী, তোমার স্তন হয়েছে পূর্ণিমা;

বিস্ময়কর সে মধুরিমা।'

('মনোনীতা, তোমার জন্যে' ১১-১২)

হেমন্ত কায়সুল হকের কবিতার একটি বহুমাত্রিক প্রতীক। কখনও তা জ্যোতির্ময় জগৎকে, কখনও তা চেতনাত্মক সত্তাকে প্রকট করে তোলে। কবির চৈতন্য-ভাষ্যের নিদর্শন :

'এই হেমন্তের কাল উল্লাসের চিরদীপ্রতায়

চৈতন্যের বীজমন্ত্র রেখে যায়।

কৃষকের ঘরে ঘরে মাঙ্গলিক উৎসবের সূচনায়

হয়ে ওঠে এই ঋতু এক শাশ্বত প্রান্তর

যেখানে প্রাণের ঋদ্ধতায় উচ্চারিত অস্তিত্বের স্বর।'

('এই যে এখন' ১৬-২০)

বৃহদারণ্যক উপনিষদে অসৎ হতে সৎস্বরূপে, অন্ধকার হতে আলোকে ও মৃত্যু হতে অমৃতলোকে উর্ত্তীণ হবার প্রার্থনা উৎকীর্ণ রয়েছে : 'অসতো মা সদ্গময় তমসো মা জ্যোতির্গময় মৃত্যোর্মামৃতং গময়েতি' (অতুলচন্দ্র ৬৮৮)। ঔপনিষদিক এ প্রার্থনার প্রতিধ্বনি প্রমূর্ত হয় কায়সুল হকের হেমন্ত-বন্দনায় :

'হেমন্ত, তোমার শিশিরের জলে ধুয়ে দাও

আমার হৃদয়, ছুঁয়ে যাক

অমল প্রাণের ডাক

বিষণ্ণ আমাকে

বিদ্বেষের অন্ধকার থেকে নিয়ে যাক

আমাকে আলোর সমুদ্দুরে—'

('হেমন্তের লোকালয় ও আমি' ১-৬)

'তোমার ইচ্ছার ধ্বনি বেজে ওঠে হৃদয়ের তারে'

প্রেম, মানবিক সম্পর্ক, স্মৃতি, নষ্টালজিয়া, নিঃসঙ্গতা কায়সুল হকের কাব্যের প্রসাদ-মাধুর্যকে করেছে প্রগাঢ়। কৈশোরোত্তীর্ণ কালে যে সঙ্গিনীকে নিয়ে কবি চেতনার সিঁড়িতে পা রাখেন তাকে সহসা মনে হয় 'অপ্সরী', কবি-সৃষ্ট 'প্রতিমা অপরূপ'; সে 'বশীকরণের মন্ত্র। কবিতার জন্মদাত্রী'। কবি উ পলদ্ধি করেন 'প্রেম জন্ম দেয় এক নতুন সত্তার/ নারীকে বুঝতে শুরু করি। বৃক্ষের মতন প্রাণদায়িনী সে—বিশল্যকরণী'। এ মঞ্জরিত নারীর চিত্তে প্রতিধ্বনিত হয় 'প্রেমের মহার্ঘ রূপময় ধ্বনি', কবি তার লালিত্য-তত্ত্ব-মাহাত্ম্য উন্মোচন করেন:

'বৃক্ষের স্বভাব নিয়ে দেখি পত্রালির

প্রথম উন্মেষে যৌবনশ্রী;

কখনও আবার ফাল্গুনের দীপ্রতা শরীরে তার।

ইচ্ছার ধবল পালে লাগিয়ে হাওয়া

ডেকে নেয় প্রিয়তমা নারী হৃদয়ের কারুকাজে

বিশল্যকরণী নিত্য হয় মুকুলিত।

এদিকে প্রথার বেড়া ভেঙে প্রেম দেখি হৃদয়মথিত গান—

প্রেয়সীর হাতের গোলাপে যেন বিনম্র চুম্বন।’

('জীবনের খড়কুটো' ২৬-৩৪)

প্রিয়চিকীর্ষু নারীর সিঁথি 'কল্যাণের শিখা' ও 'মঙ্গলপ্রদীপ' রূপে কবির নিকট প্রতিভাত। 'সাহসিকতার প্রতাপলালিত মন' নিয়ে নারী বন্ধু হয়ে ওঠেন বলে কবি হৃদয়ঙ্গম করেন, 'শরীর মনে পূর্ণ বিকাশই মানুষকে শ্রেষ্ঠত্বে আসীন করে...'। কবির স্মৃতি 3 অতীত বিধুরতা প্রধানত প্রেম-উৎসারিত 'কনক রোদের মতো' যে নারী 'আনন্দের নদী হয়ে ডেকে নিয়েছিলো একদিন' নিবিড় মমতায় আজো কবিকে 'ডাকে তার নরম আঙুল'। কবির 'পঞ্চাশ বছরের স্মৃতি' প্রাচীনতায় হারিয়ে যায় না :

'কত স্নিগ্ধ কিংবা রুক্ষ বাক্য আমরা বিনিময় করেছি বন্ধুতা নিয়ে।

নারী-পুরুষের আলাদা আলাদা সত্তা সেখানে অনুপস্থিত। রুচিশীল

সব কৃতি নতুন ভোরের সোনালি রশ্মি নিয়ে কম্পমান। মুহূর্ত অমরত্ব পেয়েছে

আলিঙ্গনে। আমরা পটুয়া হয়ে গড়ে নিয়েছি উভয়ের এমন মূর্তি

যেখানে বিবর্ণ কোনো রঙের ছোপ পড়েনি।

আমরা উভয়ে পেতে চেয়েছি সুন্দরের স্পর্শ—'

('স্মৃতি সব দুয়ার খুলে এসে দাঁড়ায়' ১৯-২৪)

স্মৃতিবিধুর কবি বন্ধু-রিক্ত পরিবেশে বিপন্নতা বোধ করেন। 'অত্যাগসহনো বন্ধুঃ' প্রেমাস্পদদ্বয়ের মধ্যে যিনি অপরের ত্যাগ সহ্য করতে পারেন না এরূপ স্বজন বিরল বৈকি! 'উদয়াস্ত ঘুরে ঘুরে সারাটি শহর' কবিও এমন কারো দেখা পান না 'যাকে নির্দ্বিধায় বন্ধু বলা যেতে পারে'। কবির নিকট সমগ্র পরিবেশ হয়ে ওঠে বিষাদাচ্ছন্ন; 'বিষণ্ণ মেয়ের চোখ' তখন 'ম্লান জ্যোৎস্নার ভেতর আকাশ'-এর প্রতিমান। প্রাতিস্বিক চিত্রকল্পেও কবির করুণ একাকিত্ব হয় স্ফুটিত, 'আমার দুঃখের সরোবরে আমি একা'। কবিতা, কবির বিবিক্ত প্রহরের পরম সখা। 'জীবনের গভীরে আরেক/ জীবনকে উপলদ্ধি' করার জন্য কবি সার্বক্ষণিকভাবে শরনাপন্ন হন এ সখার।

'সময়ের কালো দাগ হতেছে উজ্জ্বল সম্ভবত'

'জীবনের থরে থরে' সজ্জিত 'মঙ্গলের আল্পনা'-র প্রতি কায়সুল হকের সানন্দ দৃষ্টি নিবদ্ধ থাকলেও ইহজাগতিক অমঙ্গলবোধ তাঁর চেতনাকে নিষ্কৃতি দেয় না। মঙ্গল-অমঙ্গলবোধ ও আশা-নিরাশার স্বাভাবিক দোলাচলতা কবির আধুনিক জীবনবোধকে উন্মোচন করে। কবি কালের 'রুগ্ন বোধির ভিতরে' আশোকের অবলুপ্তির কথা প্রচার করেন। 'মানুষের প্রাণের শিকড়ে' তিনি প্রত্যক্ষ করেন কীটের আবাস যার 'গাঢ় চিহ্ন' সর্বত্র পরিব্যাপ্ত বলে 'নিমেষেই গুঁড়ো হয় আশার মিনার'। ফাল্গুনের সজীবতা-শূন্য ধূসর শহরে দৃশ্যমান হয় 'সুতীক্ষ্ণ নখরে দীর্ণ প্রাণের মৃণাল'। ইয়েটস তাঁর কবিতায় তমসা-ঘোর রাজনৈতিক নৈরাজ্যের রূপকল্প চিত্রণের পাশাপাশি খ্রিস্টীয় মূল্যবোধের বিপ্রতীপ পরিস্থিতি ও জান্তব দেবতার অভ্যুত্থান কল্পনা করেছেন :

Things fall apart; the centre cannot hold;

Mere anarchy is loosed upon the world,

The blood-dimmed tide is loosed and everywhere

The ceremony of innocence is drowned;

('The Second Coming' 3-6)

ইয়েটসের মতো কায়সুল হকও পতনচিহ্নিত কালবেলার শব্দচিত্র অংকন করেন :

মানুষের হৃদয়ের থেকে প্রেম প্রীতি ভালোবাসা,

অবলুপ্ত আজ, উল্লসিত সুন্দরের হন্তারক;

অনাথ পৃথিবী শুধু শোনে সর্বনাশা

ঘন্টার বিরামহীন ধ্বনি।

নেই ত্রাতা, নেই কোনো সাহসী নায়ক;

দূষিত রক্তের চাপে স্ফীত আজ প্রতিটি ধমনী;

গলিত শবের মতো

সুস্থতা ভাগাড়ে আছে প'ড়ে;

('কালবেলা' ১-৮)

কায়সুল হকের এ অমঙ্গলবোধ নির্বেদ-উৎসারিত, 'সযত্নচর্চিত', 'মাত্রাজ্ঞানরহিত' ও অপ্রতিকার্য নয়। শার্ল বোদলেয়ারের মতো নিশ্চয়ই তাঁর প্রতীতি জন্মে না যে, 'The strings that move us are held by the Devil! We find charm in disgusting things; every day we go a step further down towards Hell, withouth horror, through stinking darkness: (Baudelaire 4). বোদলেয়ার স্বর্গ-সন্ধানী নন; কায়সুল হক 'অন্তরের অমল নির্দেশ'-এ স্বর্গের স্বরূপ অন্বেষণ করেন। শেলির মতো তিনি আশাবাদ পোষণ করেন, 'এইতো ক'দিন পর। কাঙ্ক্ষিত বসন্তকাল কড়া নেড়ে এসে দাঁড়াবে, ভাস্বর/ স্বপ্নরা মেলবে পাখা'। তিনি অসন্দিগ্ধ যে, 'অমল নদী এক ধুয়ে দেয় গ্লানি গভীর গভীরতর ভালোবেসে'। তাঁর 'শাণিত আলোর নদী' অভীপ্সিত 'প্রাণের বিকাশ'-কে করে সুনিশ্চিত।

'জীবনের মতো দেশ'

দেশ-সমাজ, মাটি-মানুষের জন্য কায়সুল হকের মমত্ববোধ ও অনুচিন্তন অতলস্পর্শী। বিজয়-পূর্ব প্রবাসকালে উদ্বাস্তু কবি যখন 'স্মৃতির আগুনে ক্লেদ পুড়িয়ে-পুড়িয়ে' নিজেকে নির্মাণ করতে থাকেন তখন 'উজ্জ্বল বিজয়' সম্পর্কে তিনি হন সুনিশ্চিত। 'লাশের ভেলা' সজ্জিত 'ন'মাসের দীর্ঘবেলা' পেরিয়ে 'জীবনের ঋদ্ধ কাল'-এ সারা দেশ হয়ে ওঠে 'একমনপ্রাণ' যা 'জীবনকে আশীর্বাদের মতন' সাতপাকে ফেলে বেঁধে। কবি মেহনতি মানুষের উন্নয়নের জন্য সামাজিক পরিবর্তনের বিষয়ে চিন্তামগ্ন হন। 'আঁধারের হিম' ও যুক্তিহীনতার প্রসারতার কারণে তাঁর দৃষ্টিতে সামাজিক অগ্রগমন হয় ব্যাহত; 'ফলে আবিলতায় ঢাকা পড়ে/ আমাদের পরিপার্শ্ব।/ মনের আনন্দে আমরা জতুগৃহে প্রবেশ করতে থাকি'। কবি বিশ্বাস করেন 'বোধের প্রসার না ঘটলে' এবং 'প্রতিবাদী না হলে সমাজকে পাল্টানো যায় না'। সুভাষ মুখোপাধ্যায় উদ্যত 'সঙিন' এবং 'বাঁধার দেয়াল' উপেক্ষা করে 'দুহাতে অন্ধকার ঠেলে ঠেলে' যেমন 'দুরন্ত দুর্নিবার শান্তি' উপহার দেয়ার শপথ গ্রহণ করেন (সুভাষ ৪১) কায়সুল হকও তেমনি অন্ধকার অতিক্রম করে জীবনের মুক্তি অন্বেষণের অভীপ্সা ব্যক্ত করেন :

আমি সব বাঁধা ডিঙোতে ডিঙোতে

সমাজের নতুন রূপের কাছে পৌঁছাতে চাই

যেখানে জীর্ণতার গ্লানি স্পর্শ করবে না।

যেখানে অন্ধকারের বিবর হা মেলে নেই।

আন্দোলনের পর আন্দোলন

অন্ধকার সরানোর আন্দোলন।

মনের সব দরজা জানালা খুলে রাখার বহতা নদী

আমাকে পৌঁছে দেবে মানুষের মহামিলনে।

('নতুনের সন্ধানে সুমনের গান' ১৮-২৫)

'রবীন্দ্রনাথের নাম উচ্চারণ ক'রে বুঝে নিই পরিপূর্ণতার রূপ'

শৈল্পিক, ঐতিহ্যিক ও তাত্ত্বিক প্রয়োজনে চতুর্থ দশক থেকে রবীন্দ্রনাথ দুষ্পরিহর হয়ে উঠেছেন। দেবেশ রায়ের স্পষ্টোক্তি, 'এই ঘটনাটি আমরা সব সময় খেয়ালে রাখি না যে রবীন্দ্রনাথের জীবৎকালে যাঁরা কাব্যকল্পনায় ও প্রকরণে বা উপন্যাস নির্মাণে বা মননসংগঠনে রবীন্দ্রনাথকে পেরোতে চাইছিলেন, তাঁরাই রবীন্দ্রনাথের প্রতিভাকে আমাদের শিল্পচর্চার ও জীবনযাপনের ঐতিহ্যে পরিণত করার জন্যে সেই চল্লিশের দশক থেকেই লেখালেখি করে আসছেন' (দেবেশ ৩১২)। রবীন্দ্রনাথকে পরিগ্রহণের ক্ষেত্রে যাঁরা অম্লান প্রয়াস গ্রহণ করেছেন তাঁদের মধ্যে সুধীন্দ্রনাথ দত্ত, জীবনানন্দ দাশ, বুদ্ধদেব বসু, বিষ্ণু দে, অমিয় চক্রবর্তী, হুমায়ুন কবির, অন্নদাশঙ্কর রায়, আবু সয়ীদ আইয়ুব, শঙ্খ ঘোষ প্রমুখ কবি-মনীষীগণ অগ্রগণ্য; এঁদের সঙ্গে কৃতবিদ্য কায়সুল হকের দীপিত প্রয়াসও তাৎপর্যপূর্ণ বলে প্রতীত হয়। বিষ্ণু দে রবীন্দ্রনাথকে '... প্রায় ঐশ্বরিক প্রকৃতির মতো, বছরে বছরে ঋতুতে ঋতুতে সংকট ও উন্মোচনের আনন্দরূপেন বিভাসিত শত রূপে' প্রত্যক্ষ করেন (বিষ্ণু ২৩৯)। কায়সুল হক রবীন্দ্রনাথকে 'বাঙালি সংস্কৃতির বিধাতা', 'সর্বার্থ আধুনিক মানুষ' 'মনুষ্যত্বের অতন্দ্র প্রহরী' ও 'বৈশ্বিক মানব' হিসেবে মূল্যায়ন করেন। রবীন্দ্রনাথের প্রতি তাঁর ঐকাগ্রের সকারণ ব্যাখ্যা, 'মানুষের সপক্ষে তথা মানবিকতার পক্ষে তাঁর বক্তব্যের স্পষ্টতা এবং আধুনিক মননশীলতা ও শিল্পবোধই তাঁর প্রতি আমাদের পক্ষপাতিত্বের প্রধান কারণ' (কায়সুল স্বদেশ, সংস্কৃতি ৮৩)। রবীন্দ্রনাথের 'নিরুপম বাগানে' কবি কায়সুল হকের 'ভ্রমণের শেষ নেই'। কবির সনম্র স্বীকৃতি:

রবীন্দ্রনাথের হাত ধ'রে হাঁটতে হাঁটতে

আমরা তো চিনতে শিখেছি

গাছ ফুল পাখি গুল্মলতা

চিনতে শিখেছি মাস ঋতুর চেহারা।

('পুরোহিত হে বৈশাখ' ৭-১০)

রবীন্দ্রনাথের দাক্ষিণ্যে নিসর্গের রূপবৈচিত্র্যই শুধু উন্মোচিত হয় না, 'চড়াই উৎরাইয়ের সমারোহ', অন্ধকার ও 'আলোর নাচন' সংবলিত দ্বন্দ্বসংকুল জীবনের পূর্ণ স্বরূপও হয় উদ্ঘাটিত। জীবন যে 'কোনো সরল রেখায় আঁকা পট নয়' রবীন্দ্রচেতনা তা সহজেই করে পরিস্ফুট:

'...তিনিই তো এত রকমের

শিল্পিত সম্ভার দিয়ে দন্দ্বে ফেলে দিয়েছেন আমাদের।

আর তাই তাঁকে না হলে আমাদের এক মুহূর্ত চলে না;

সুকুমার বোধের যে শিরোমণি তিনি।

সব জাগরণের ভূখণ্ড তিনি; আমাদের সত্তার বিশাল মহীরুহ।'

('আমাদের জীবনে রবীন্দ্রনাথ' ১৪-১৮)

কবিতার মতো প্রবন্ধেও তিনি অভিন্ন প্রত্যয় ব্যক্ত করেন, 'রবীন্দ্রনাথ আমাদের জাতিসত্তার ভূখণ্ডের প্রায় সবটাই জুড়ে বিরাজিত। ঈদৃশ সর্বত্রগামী প্রতিভার সন্ধান পৃথিবীর আর কোথাও খুঁজে পাওয়া যাবে না। নানা পরিপ্রশ্নের উত্তর তাঁর কাছ থেকে পাওয়া যাবে' (কায়সুল স্বদেশ, সংস্কৃতি ৩২)। কায়সুল হক রবীন্দ্রনাথের সমগ্র কর্মে খুঁজে পান 'আমাদের সংস্কৃতির এমন ঋত্বিককে যিনি মগ্ন থেকেছেন আমাদের অর্থাৎ বাঙালি জাতির স্বপ্নলোক তৈরীর কাজে' (কায়সুল স্বদেশ, সংস্কৃতি ১৬)। তিনি রবীন্দ্রনাথের অনুবর্তী হয়ে স্বীয় সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের হীরকদ্যুতিতে স্বদেশ ও ভাষার নব উদ্ভাসন কামনা করেন :

আমার স্বদেশ

আমার ভাষা নতুনভাবে নির্মিত হোক রবীন্দ্রনাথের

অনুশাসন মেনে;

('নুতনের সন্ধানে সুমনের গান' ৩৫-৩৭)


মধুবন চক্রবর্তী

 

বৈষ্ণব কবিতার প্রতি গভীর অনুরাগের ফলশ্রুতি ভানুসিংহের পদাবলী

 


কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জন্ম দিবসটিকে দেশ গন্ডির সীমানা ছাড়িয়ে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তের মানুষ নিজেদের মত করে পালন করেন। আসলে এতগুলো বছর পেরিয়ে পঁচিশে বৈশাখ এক অনুভূতির জন্ম দেয়। হৃদয়ের একুল ওকূল দুকূল জুড়ে এক কবির বাস। যেখানে চারিদিকে খেলা করে মেঘ বালিকা, সবুজের সমাহার। মনের ছয় ঋতুর অন্তঃস্থলে আনন্দ বিরহের বিবিধ স্তর। এই বিরহ আনন্দ দুঃখ যন্ত্রণা গভীর জীবন রস ও বোধের মধ্যে দিয়ে শ্রুতির মত বয়ে গেছে যা সংগীতে মানবিক ও আত্মিক চেতনার এক পূর্ণ রূপ দিয়েছে যা চিরপ্রবসমান। অনন্ত প্রেমের পথে নিয়ে চলে। সে প্রেম কখনও মানবিক। কখনোও ঐশ্বরিক। যেন স্বর্গীয় অনুভুতি। আবার কখনোও রক্ত মাংসের। সৃষ্টির সঙ্গে স্রষ্টার এক অবিচ্ছেদ্য সম্পর্ক। কবি সীমার মাঝে অসীমের কথা বলেছেন বারবার। আবার অসীমও চায় সীমার মধ্যে  দিয়ে আত্মচেতনা আত্ম অনুভূতির কথা বলতে। এখানেই রবীন্দ্রনাথের বৈষ্ণবতার জন্ম। জগতের আনন্দ যজ্ঞে যেখানে সবার নিমন্ত্রন সেই পঁচিশে বৈশাখ উদযাপন শুধু কবির জন্মের কথা বলে না। এই জন্মের মধ্যেই লুকিয়ে থাকা সেই ভানুসিংহের বীজকে লালন করার কথাও বলে। মাত্র ষোলো বছর বয়সে ভানুসিংহ নামে তাঁর জন্ম। অর্থাৎ চেতনার জন্ম। সেই চেতনার নাম বৈষ্ণবীয় চেতনা যার প্রকাশ ভানুসিংহ ঠাকুরের পদাবলী।

ভানুসিংহ ছদ্মনামে সেইসময় বৈষ্ণব পদকর্তাদের লিখে ফেলেছিলেন একের পর এক গীতিকবিতা। ১৮৮৪ সালে সেই কবিতাগুলি ভানুসিংহ ঠাকুরের পদাবলী নামে প্রকাশিত হয়। কবিতাগুলি গ্রন্থাকারে প্রকাশের পূর্বে বিভিন্ন সময় ভারতী পত্রিকায় প্রকাশ হয়েছিল। কবি বলেছেন। "অক্ষয়চন্দ্র সরকার ও সারদাচরণ মিত্রের সংকলিত প্রাচীন কাব্য সংগ্রহ আমি বিশেষ আগ্রহের সহিত পড়িতাম। তার মৈথিল মিশ্রিত ভাষা আমার পক্ষে দুর্বোধ্য ছিল। সেই জন্যই এত অধ্যাবস্যায়ের সঙ্গে আমি তাহার মধ্যে প্রবেশের চেষ্টা করিয়াছিলাম".. প্রাচীন পদকর্তাদের অনুকরণে ব্রজবুলিতে রবীন্দ্রনাথ ভানুসিংহের পদাবলী রচনা করেছিলেন তাই বৈষ্ণব পদাবলীর খানিকটা প্রভাব তো পাওয়াই যায় তার রচিত পদাবলীতে ভানুসিংহের পদাবলীর প্রথম পদে হল গাহানা কুসুম কুঞ্জ মাঝে এ সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, "একদিন মধ্যাহ্নে খুব মেঘ হলো.. সেই মেঘলা দিনের ছায়াঘন অবকাশে আনন্দে বাড়ির ভিতরে এক ঘরে খাটের উপর উপুড় হইয়া পড়িয়া একটা শ্লেট লইয়া লিখিলাম "গাহন কুসুম কুঞ্জ মাঝে" (জীবনস্মৃতি)।

জ্যোতিরীন্দ্রনাথ ঠাকুরের স্ত্রী কাদম্বরী দেবী স্মৃতির উদ্দেশ্যে উৎসর্গ পত্র থেকে জানা যায় নতুন বৌঠান কাদম্বরী দেবী তাকে ভানু সিংহের কবিতাগুলি ছাপাতে অনুরোধ করেছিলেন। কবিতাগুলির মধ্যে বৈষ্ণব পদাবলীর মত পালাবদ্ধ ক্রমপরিনতি ছিল না। বিভিন্ন পর্যায়ে বিভক্ত ছিল এই কবিতা। কখনো বংশীধ্বনি রস পর্যায়ে আবার রস পর্যায়ের মধ্যে রাধাবিরহ বিষয়ক কবিতা মিলন বিষয়ক কবিতা ও পড়ে। বাল্যকাল থেকে জয়দেব বিদ্যাপতি পদাবলী নান্দনিক চেতনায় মগ্ন ছিলেন। 'গীতগোবিন্দম' তাঁকে এতটাই মুগ্ধ করেছিল যে বারবার আবৃত্তি করা সত্ত্বেও, তা অণুলিপি করেছিলেন। ভানুসিংহের পদাবলী রাধাকৃষ্ণ প্রেম বিষয়ক তথা রাধা কৃষ্ণ লীলার পটভূমিতে স্পষ্ট হলেও শুধুমাত্র রাধা কৃষ্ণ লীলার পদাবলী নয় এবং কীর্তনের শুরুতে একমাত্র বাহন নয় তার পদাবলীর মাধ্যমে ভক্তি রস ও ভগবত প্রেম ছাপিয়ে লৌকিক প্রেম জায়গা করে নিল যেখানে যেখানে সুখ দুঃখ রসিকতা স্থান পেল নির্ভুলভাবে রাধিকার মধ্যে মানবপ্রেম ও তার চির আকুলতাই আত্মপ্রকাশ ঘটেছে এই পদাবলীতে।

বৈষ্ণব কবিদের অনুপ্রেরণায় রবীন্দ্রনাথ শৈশবেই হয়ে উঠেছিলেন স্বতন্ত্র এক গীতিকবি। মধ্যযুগীয় বৈষ্ণব কবিদের দ্বারা যেমন অনুপ্রাণিত হয়েছেন, তেমনি প্রভাবিত হয়েছিলেন টমাস চ্যাটারটন নামক এক ইউরোপীয় কিশোর কবির দ্বারা। অক্ষয়চন্দ্র সরকারের কাছ থেকে জেনেছিলেন, টমাস চ্যাটারটন নামক এই বালক কবির কথা। যিনি প্রাচীন কবিদের অনুকরণে কবিতা লিখতেন। আর এই জায়গাতেই ভানুসিংহের সঙ্গে কবি চ্যাটরটনের অসম্ভব মিল।

পদাবলী অনুকরণে রবীন্দ্রনাথের মধ্যে একাধিক বৈষ্ণব কবি ও কাব্য প্রবাহের সম্মেলন ঘটেছে। যেমন উদ্ধব দাসের 'আষাঢ় গত পুণ্য মাহ শাভান সুখদ যমুনাক তীর...' এবং গোবিন্দ দাসের 'মন্দির বাহির কঠিন করাট চলোইতে শঙ্কিত পঙ্কিল বাট' রবীন্দ্রনাথ বললেন, শাওন গগনে ঘোর ঘনঘটা নিশীথযামিনী রে...

ব্রজবুলিতে রচিত ভানুসিংহের পদাবলীর সংখ্যা রবীন্দ্রকাব্যে এবং সংগীতের অন্যতম দিকচিহ্ন। কাব্যের ধ্বনিমাধুর্যে, রস নির্মাণেও এক নতুন দিক। যেখানে বৈষ্ণবীর রাধার প্রশ্ন অপার অতৃপ্তির, ঠিক সে রকম জায়গাতেই ভানুসিংহের রাধার প্রশ্ন অজানা বিস্ময়ের। বৈষ্ণব পদাবলীর স্বভাবকে রবীন্দ্রনাথ গ্রহণ করেছেন একান্তভাবে।

কিশোর বয়সের রবীন্দ্রনাথের সৃষ্টি ভানু সিংহের পদাবলী কিশোর রবীন্দ্রনাথ নির্মাণ করলেন এই পদাবলী যেখানে তার চিন্তার মৌলিকতা যেরকম রক্ষা পেল পাশাপাশি বয়স্ক প্রাজ্ঞ আরও এক রবীন্দ্রনাথের জ্ঞান সমৃদ্ধির সুস্পষ্ট ছাপ প্রকাশ পেল। যেমন মরণ ঋতুহু মম শ্যামো সমান এই পথটিতে ভানুসিংহের কিশোরত্ব লোভ পেয়েছিল যেখানে জন্ম নিয়েছিল ভানু সিংহ ও রবীন্দ্রনাথের চিন্তাভাবনার অভিন্ন রূপ। মৃত্যু মহা জীবনের রূপান্তর মৃত্যুর মধ্যে দিয়েই জীবনের প্রকাশ কিশোর বয়সেই সেই মহানুভবতার কথা তিনি প্রকাশ করেছিলেন যা আমাদের এক প্রাপ্য রবীন্দ্রনাথকেই চিনতে সাহায্য করে। তার চিন্তায় জীবন মৃত্যু চলমান সৃষ্টির নিরন্তর আবর্তন। মৃত্যুর যে সুন্দর রূপ ভানু সিংহের চিন্তায় প্রকাশ পেয়েছে যেখানে নেই মৃত্যুর ভয়াবহতার কথা দুশ্চিন্তার কথা মৃত্যুর সুন্দর মোহন রূপ ভানু সিংহের চিন্তায় যেন নব ঘন স্বামীর সুন্দর মূর্তি। এই বলা যেতেই পারে, ভানুসিংহ পদাবলী শুধু বাংলার ঐকান্তিক সম্পদ নয়,।আন্তর্জাতিক সাহিত্যের ইতিহাস এক আধ্যাত্মিক ঐশ্বরিক প্রেম বিষয়ক সাহিত্যের নব দিগন্তের সূচনা করে। তার পদের ভাব ও গভীরতা প্রাচীন পদকর্তাদের রচনা থেকে কোন অংশেই কম ছিল না। পদ গুলির মধ্যে ছিল স্বকীয়তা, স্বতন্ত্রতা প্রত্যেকটি পদ যেন স্ব মহিমায় উজ্জ্বল।

কবি সীমার মাঝে অসীমের কথা বলেছেন বারবার। আবার অসীমও চায় সীমার মধ্যে  দিয়ে আত্মচেতনা আত্ম অনুভূতির কথা বলতে। এখানেই রবীন্দ্রনাথের বৈষ্ণবতার জন্ম। জগতের আনন্দ যজ্ঞে যেখানে সবার নিমন্ত্রন, সেই পঁচিশে বৈশাখ উদযাপন শুধু কবির জন্মের কথা বলে না। এই জন্মের মধ্যেই লুকিয়ে থাকা সেই ভানুসিংহের বীজকে লালন করার কথাও বলে। মাত্র ষোলো বছর বয়সে ভানুসিংহ নামে তাঁর জন্ম। অর্থাৎ চেতনার জন্ম। সেই চেতনার নাম বৈষ্ণবীয় চেতনা যার প্রকাশ ভানুসিংহ ঠাকুরের পদাবলী। ভানুসিংহ ছদ্মনামে সেইসময় বৈষ্ণব পদকর্তাদের অনুপ্রেরণায় লিখে ফেলেছিলেন একের পর এক গীতিকবিতা। ১৮৮৪ সালে সেই কবিতাগুলি ভানুসিংহ ঠাকুরের পদাবলী নামে প্রকাশিত হয়। কবিতাগুলি গ্রন্থাকারে প্রকাশের পূর্বে বিভিন্ন সময় ভারতী পত্রিকায় প্রকাশ হয়েছিল। কবি বলেছেন। "অক্ষয়চন্দ্র সরকার ও সারদাচরণ মিত্রের সংকলিত প্রাচীন কাব্য সংগ্রহ আমি বিশেষ আগ্রহের সহিত পড়িতাম। তার মৈথিল মিশ্রিত ভাষা আমার পক্ষে দুর্বোধ্য ছিল। সেই জন্যই এত অধ্যাবস্যায়ের সঙ্গে আমি তাহার মধ্যে প্রবেশের চেষ্টা করিয়াছিলাম".. প্রাচীন পদকর্তাদের অনুকরণে ব্রজবুলিতে রবীন্দ্রনাথ ভানুসিংহের পদাবলী রচনা করেছিলেন। তাই বৈষ্ণব পদাবলীর খানিকটা প্রভাব তো পাওয়াই যায় তার রচিত পদাবলীতে। ভানুসিংহের পদাবলীর প্রথম পদ হল " গহন কুসুম কুঞ্জ মাঝে"..

এ সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, "একদিন মধ্যাহ্নে খুব মেঘ হলো.. সেই মেঘলা দিনের ছায়াঘন অবকাশে আনন্দে বাড়ির ভিতরে এক ঘরে খাটের উপর উপুড় হইয়া পড়িয়া একটা শ্লেট লইয়া লিখিলাম "গহন কুসুম কুঞ্জ মাঝে" (জীবনস্মৃতি)।

জ্যোতিরীন্দ্রনাথ ঠাকুরের স্ত্রী কাদম্বরী দেবী স্মৃতির উদ্দেশ্যে উৎসর্গ পত্র থেকে জানা যায়, নতুন বৌঠান কাদম্বরী দেবী, তাঁকে ভানুসিংহের কবিতাগুলি ছাপাতে অনুরোধ করেছিলেন। কবিতাগুলির মধ্যে বৈষ্ণব পদাবলীর মত পালাবদ্ধ ক্রম-পরিণতি ছিল না। বিভিন্ন পর্যায়ে বিভক্ত ছিল এই কবিতা। কখনোও বংশীধ্বনি রস পর্যায়ে, আবার রসপর্যায়ের মধ্যে রাধাবিরহ বিষয়ক কবিতা মিলন বিষয়ক কবিতাও আছে। বাল্যকাল থেকে জয়দেব, বিদ্যাপতি, পদাবলী নান্দনিক চেতনায় মগ্ন ছিলেন। 'গীতগোবিন্দম' তাঁকে এতটাই মুগ্ধ করেছিল যে বারবার আবৃত্তি করা সত্ত্বেও, তা অণুলিপি করেছিলেন। ভানুসিংহের পদাবলী রাধাকৃষ্ণ প্রেম বিষয়ক তথা রাধাকৃষ্ণ লীলার পটভূমিতে স্পষ্ট হলেও, শুধুমাত্র রাধাকৃষ্ণ লীলার পদাবলী নয় এবং কীর্তনের শুরুতে একমাত্র বাহন নয়। তাঁর পদাবলীর মাধ্যমে ভক্তিরস ও ভগবত প্রেম ছাপিয়ে লৌকিক প্রেম জায়গা করে নিয়েছে, যেখানে সুখ দুঃখ রসিকতা স্থান পেয়েছে নির্ভুলভাবে। রাধিকার মধ্যে মানবপ্রেম ও তার চির আকুলতার আত্মপ্রকাশ ঘটেছে এই পদাবলীতে। বৈষ্ণব কবিদের অনুপ্রেরণায় রবীন্দ্রনাথ শৈশবেই হয়ে উঠেছিলেন স্বতন্ত্র এক গীতিকবি।

বৈষ্ণব কবিতার প্রতি কবির গভীর অনুরাগের ফলশ্রুতি ভানুসিংহের পদাবলী নয়, শুধুমাত্র নিছক অনুকরণ নয়, বৈষ্ণব কবিতার প্রতি আকৃষ্ট হয়ে কাব্যরসের প্রতি অমোঘ আকর্ষণ থেকেই তরুণ কবির ভালোবাসার আত্ম মুক্তি বলা যায়।

ছন্দ ভাষায় এবং কাব্য প্রসাদের উপরে কবির জন্মগত প্রতিভার অভিজ্ঞান। ১৮৭০ খ্রিস্টাব্দে জগবন্ধু ভদ্র মহাজনপদাবলী

করেছিলেন। আর সেসব জ্যোতোরিন্দ্রনাথ ঠাকুর সংকলন করতেন। তাঁর একমাত্র পাঠক ছিলেন বারো বছরের রবীন্দ্রনাথ। পদাবলীর কাব্য ছন্দ ও ভাবের প্রভাব পড়েছিল বালক কবির ওপরে।

কবি নিজে বলছেন--

"What give me boltness when I was young was my early acquaintance with old vaishnava poems of Bengal.

Full of freedom of metre and courage of expression. I think I was only 12 when these poems we can to be reprinted. I surreptitiously got hold of copies from the desk of my elders.

I must also admit that the greater part of these lyrics was erotic and not quit suited to a boy just about to reach his teens. But my imagination was fully occupied with the beauty of their forms and the music of their words'...

বৈষ্ণব কবিদের অনুপ্রেরণায় রবীন্দ্রনাথ শৈশবেই হয়ে উঠেছিলেন স্বতন্ত্র এক গীতিকবি। মধ্যযুগীয় বৈষ্ণব কবিদের দ্বারা যেমন অনুপ্রাণিত হয়েছেন, তেমনি প্রভাবিত হয়েছিলেন টমাস চ্যাটারটন নামক এক ইউরোপীয় কিশোর কবির দ্বারা। অক্ষয়চন্দ্র সরকারের কাছ থেকে জেনেছিলেন, টমাস চ্যাটারটন নামক এই বালক কবির কথা। যিনি প্রাচীন কবিদের অনুকরণে কবিতা লিখতেন। পদাবলী অনুকরণে রবীন্দ্রনাথের মধ্যে একাধিক বৈষ্ণব কবি ও কাব্য প্রবাহের সম্মেলন ঘটেছে। যেমন উদ্ধব দাসের 'আষাঢ় গত পুণ্য মাহ শাভান সুখদ যমুনাক তীর...' এবং গোবিন্দ দাসের 'মন্দির বাহির কঠিন করাট চলোইতে শঙ্কিত পঙ্কিল বাট' রবীন্দ্রনাথ বললেন, শাওন গগনে ঘোর ঘনঘটা নিশীথযামিনী রে...

ব্রজবুলিতে রচিত ভানুসিংহের পদাবলীর সংখ্যা রবীন্দ্রকাব্যে এবং সংগীতের অন্যতম দিকচিহ্ন। কাব্যের ধ্বনিমাধুর্যে, রস নির্মাণেও এক নতুন দিক। যেখানে বৈষ্ণব পদাবলীর রাধার প্রশ্ন অপার অতৃপ্তির, ঠিক সে রকম জায়গাতেই ভানুসিংহের রাধার প্রশ্ন অজানা বিস্ময়ের। বৈষ্ণব পদাবলীর স্বভাবকে রবীন্দ্রনাথ গ্রহণ করেছেন একান্তভাবে। কিশোর বয়সের রবীন্দ্রনাথের সৃষ্টি ‘ভানু সিংহের পদাবলী’। নির্মাণ করলেন এমন এক পদাবলী, যেখানে তাঁর চিন্তার মৌলিকতা যেরকম রক্ষা পেল। পাশাপাশি বয়স্ক, প্রাজ্ঞ আরও এক রবীন্দ্রনাথের জ্ঞান সমৃদ্ধির সুস্পষ্ট ছাপ প্রকাশ পেল। যেমন "মরণ রে তুহু মম শ্যাম সমান" এই পদটিতে ভানুসিংহের কিশোরত্ব লোভ পেয়েছিল, যেখানে জন্ম নিয়েছিল ভানুসিংহ ও রবীন্দ্রনাথের চিন্তাভাবনার অভিন্ন রূপ।

মৃত্যু মহা-জীবনের রূপান্তর। মৃত্যুর মধ্যে দিয়েই যে জীবনের প্রকাশ, কিশোর বয়সেই সেই মহানুভবতার  কথা প্রকাশ করেছিলেন, যা আমাদের এক প্রাজ্ঞ রবীন্দ্রনাথকেই চিনতে সাহায্য করে। তাঁর চিন্তায় জীবন মৃত্যু চলমান সৃষ্টির নিরন্তর আবর্তন। মৃত্যুর যে সুন্দর রূপ ভানু সিংহের চিন্তায় প্রকাশ পেয়েছে, যেখানে নেই মৃত্যুর ভয়াবহতার কথা, দুশ্চিন্তার কথা মৃত্যুর সুন্দর মোহন রূপ ভানু সিংহের চিন্তায় যেন নব ঘন স্বামীর সুন্দর মূর্তি। এভাবে বলা যেতেই পারে, ভানুসিংহ পদাবলী শুধু বাংলার ঐকান্তিক সম্পদ নয়, আন্তর্জাতিক সাহিত্যের ইতিহাসে এক আধ্যাত্মিক ঐশ্বরিক প্রেম বিষয়ক সাহিত্যের নব দিগন্তের সূচনা করে। তাঁর পদের ভাব ও গভীরতা প্রাচীন পদকর্তাদের রচনা থেকে কোন অংশেই কম ছিল না।

পদ গুলির মধ্যে ছিল স্বকীয়তা, স্বতন্ত্রতা প্রত্যেকটি পদ যেন স্ব মহিমায় উজ্জ্বল। সত্যি ভাবতে অবাক লাগে, মাত্র বারো বছর বয়সে বৈষ্ণব কবিতায় অনুপ্রাণিত হয়ে লিখতে শুরু করলেন। বয়স যতই বারো বছর হোক, অথবা ষোলো, বালক বয়সেই হয়ে উঠেছিলেন পরিণত মনের কবি। পদাবলী সাহিত্যের দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে ভাবের রাজপ্রাসাদ গড়ে তুলেছিলেন। যদিও ভানুসিংহের পদাবলী সম্পর্কে পরিণত বয়সের রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন-- "তাহাদের ভাবের মধ্যে কৃত্রিমতা ছিল না ভানুসিংহের কবিতা একটু বাজাইয়া বা কুশিয়া দেখলেই মেকি বাহির হইয়া পড়ে” (জীবনস্মৃতি)। অর্থাৎ বৈষ্ণব দর্শনের সঙ্গে কবির দর্শনের মিল অনেকটাই কম ছিল বলে তিনি নিজেই দাবি করছেন। কিন্তু কাব্য দর্শনের মিল খুঁজলে সেভাবে পাওয়া না গেলেও, কবির অভিনব দর্শন এখানে অভূতপূর্ব ভাবে ধরা দিয়েছে। বৈষ্ণব কবিদের দ্বারা যেরকম প্রভাবিত হয়েছিলেন তেমনি প্রভাবিত হয়েছিলেন টমাস চ্যাটারটন নামক এক ইউরোপীয় কিশোর কবির দ্বারা। অক্ষয়চন্দ্র সরকারের কাছ থেকে জেনেছিলেন, টমাস চ্যাটারটন নামক এই বালক কবি সম্পর্কে, যিনি প্রাচীন কবিদের অনুকরণে কবিতা লিখতেন। এই জায়গাতেই ভানুসিংহের সঙ্গে কবি চ্যাটরটনের অসম্ভব মিল। পদাবলী অনুকরণে রবীন্দ্রনাথের মধ্যে একাধিক বৈষ্ণব কবি ও কাব্য প্রবাহের সম্মেলন ঘটেছে। যেমন গোবিন্দ দাসের

'মন্দির বাহির কঠিন করাট চলোইতে শঙ্কিত পঙ্কিল বাট' রবীন্দ্রনাথ বললেন, 'শাওন গগনে ঘোর ঘনঘটা নিশীথযামিনী রে.."....

ব্রজবুলিতে রচিত ভানুসিংহের পদাবলীর সংখ্যা রবীন্দ্রকাব্যে এবং সংগীতের অন্যতম দিকচিহ্ন। কাব্যের ধ্বনিমাধুর্যে, রস নির্মাণেও এক নতুন দিগন্ত নির্মাণ করছিলেন তিনি।যেখানে বৈষ্ণব কবির কল্পনায় রাধার প্রশ্ন অপার অতৃপ্তির, ঠিক সে রকম জায়গাতেই ভানুসিংহের রাধার প্রশ্ন অজানা বিস্ময়ের। বৈষ্ণব পদাবলীর স্বভাবকে রবীন্দ্রনাথ গ্রহণ করেছেন একান্তভাবে। কিশোর বয়সের সৃষ্টি ভানুসিংহের পদাবলী হলেও, বাঙালির কাব্য চেতনায় চিন্তার জাগরণ যেরকম ঘটিয়েছিল, সেরকম প্রেমের জোয়ার এনেছিল সাহিত্য ভাবনায়। এই পদাবলীসাহিত্যে তাঁর চিন্তার মৌলিকতা যেরকম রক্ষা পেল, পাশাপাশি পরিণত প্রাজ্ঞ আরও এক রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে পরিচিতি ঘটল বিশ্ব সাহিত্যের। সমৃদ্ধির সুস্পষ্ট ছাপ প্রকাশ পেল।

যেমন "মরণ রে তুহু হু মম শ্যাম সমান'…

এই পদটিতে ভানুসিংহের কিশোরত্ব লোপ পেয়েছিল। সেখানে  জন্ম নিয়েছিলেন ভানুসিংহ ও রবীন্দ্রনাথের চিন্তাভাবনার অভিন্ন রূপ। কবি মরণের মাধ্যমে শ্যামের অভাব পূর্ণ করতে চেয়েছেন অর্থাৎ মরণকে শ্যামের আসনে বসিয়ে। কিন্তু বৈষ্ণব বা বৈষ্ণব কবিরা কোন কিছুকেই শ্যামের বিকল্প মানতে পারেন না। সমস্ত বিশ্ব এমনকি নিজের প্রাণও। এখানেই কবি হয়ত মেকিত্ব বলতে চেয়েছেন। মৃত্যু এখানে মহাজীবনের রূপান্তর। মৃত্যুর মধ্যে দিয়েই জীবনের প্রকাশ। কিশোর বয়সেই সেই মহানুভবতার কথা তিনি প্রকাশ করেছিলেন যা আমাদের এক প্রাজ্ঞ রবীন্দ্রনাথকেই চিনতে সাহায্য করে। তাঁর চিন্তায় জীবন মৃত্যু চলমান সৃষ্টির নিরন্তর আবর্তন। মৃত্যুর যে সুন্দর রূপ ভানুসিংহের চিন্তায় প্রকাশ পেয়েছে, যেখানে নেই মৃত্যুর ভয়াবহতার কথা, দুশ্চিন্তার কথা, রয়েছে মৃত্যুর সুন্দর মোহন রূপ। ভানুসিংহের চিন্তায় যেন নব ঘন শ্যামের সুন্দর মূর্তি। বলা যেতেই পারে, ভানুসিংহের পদাবলী শুধু বাংলার ঐকান্তিক সম্পদ নয়, আন্তর্জাতিক সাহিত্যের ইতিহাসে এক আধ্যাত্মিক ঐশ্বরিক প্রেম বিষয়ক সাহিত্যের নব দিগন্তের সূচনা করে। তাঁর পদের ভাব ও গভীরতা প্রাচীন পদকর্তাদের রচনা থেকে কোন অংশেই কম ছিল না। ব্রজবুলিতে রচিত ভানুসিংহের পদাবলীর সংখ্যা মাত্র কুড়িটি হলেও রবীন্দ্র কাব্য এবং সংগীতের অন্যতম দিক চিহ্ন বলা যায়। বৈষ্ণব পদাবলীর ভাষার সঙ্গে অনেকটাই তফাৎ থাকলেও, পদাবলী সাহিত্যের মতোই উজ্জ্বল এবং ভাবরসসমৃদ্ধ। কাব্যের ধ্বনিমাধুর্য, রস নির্মাণে এক নতুন দিগন্ত তৈরি করেছিলেন ভানুসিংহ।

এ প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথ নিজেই মন্তব্য করেছিলেন "পদাবলী শুধু কেবল সাহিত্য নয়, তার রসের বিশিষ্টতা বিশেষভাবে সীমানার দ্বারা বেষ্টিত। নেই-সীমানার মধ্যে আমার মন স্বাভাবিক স্বাধীনতার সঙ্গে বিচরণ করতে পারে না। তাই ভানুসংহের সঙ্গে বৈষ্ণব চিত্রে অন্তরঙ্গ আত্মীয়তা নেই'। পদগুলির মধ্যে ছিল স্বকীয়তা, স্বতন্ত্রতা। গবেষকরা মনে করেন, ভানুসিংহের পদাবলীতে রবীন্দ্রনাথ বৈষ্ণবকবিদের নিছক অনুকরণ না করে, যথার্থ অনুসরণ করেছেন।  প্রত্যেকটি পদ যেন স্বয়ংসম্পূর্ণ। ভাবের গভীরতায়, ব্যঞ্জনার মাধুর্যে, ভাস্বর। পদাবলী শুধু কেবল সাহিত্য নয়, তার রসের বিশিষ্টতায় শেষ ভাবের সীমানার দ্বারা বেষ্টিত।