ফ্ল্যাশব্যাকে থিয়েটার পাঁচালি: হিরো নন, ক্লাসিক অভিনেতা
রবি ঘোষ
প্রতি,
এ খোলা চিঠি। সম্পাদক কাজল সেন–এর প্রয়াস যে, আন্তর্জাতিক অন্ত্রজাল মাধ্যমে কলকাতার থিয়েটার আলোচিত হোক। সেই সূত্রে, এই
প্রতিবেদন। থিয়েটারের প্রকৃতি হল অনেকটা গাছের মতন। একসময়ে একই স্থানে অভিনীত হতে
পারে। তাই, থিয়েটার এমন একটি মাধ্যম পেয়ে গেলে আনন্দিত হই। আর সম্পাদককে সাধুবাদ
জানাই যে, থিয়েটারের প্রতি তাঁর ফল্গু-টানের জন্যে।
এই পর্বের কিস্তিতে দর্শক বনাম অভিনেতার গল্প উঠে এল ফ্ল্যাশব্যাকে। সেই
পাঁচালির প্রধান অবতার দর্শক। কলকাতার দর্শক। দর্শক এসেছেন ঠিক
সময়েই। টিকিট হাউসফুল। দর্শকই যে লক্ষ্মী, সেকথা থিয়েটার-করিয়েমাত্রই জানেন। এদিকে সব প্রস্তুত। মানে, মঞ্চ।
হল। দর্শক। কিন্তু তিনি এখনও আসেননি, তাই
শো শুরু হবে অন্য আর্টিস্ট দিয়ে।
নয়ত?
ওঁর জন্যে অপেক্ষা করলে, আজ নির্ধারিত সময়ে হতে পারছে না।
জানিয়ে রাখি, এটা হাসির নাটক।
গোমড়া মুখে ঢুকে পড়া দর্শকের ইচ্ছে একটু হাসি যেন পায়। আর সেই হাসি আনতে খটখটে
শুকনো মঞ্চকে জল ভাবতে হয়। আর যিনি এমন পারেন, তিনিই
অভিনেতা। বাঙালির হিরো-র তালিকায় অনেক নাম এসেছে। আবার চলেও
গেছে। এরই মধ্যে কোন সে রসায়নে ক্লান্ত ধ্বস্ত হিংসুটে পাংশুটে বাঙালিকে হাসাতে
শিখিয়েছেন। কে বা কারা?
সেই তাঁদের নাম ভাবতে থাকুন। ততক্ষণে ঘটনাটা লিখি, কী হয়েছিল সেদিন। হ্যাঁ, লিড ক্যারেক্টার এসে
পৌঁছাননি। কানাঘুষো থেকে কথাটা যে সত্যিই জানতে পারলেন উপস্থিত দর্শকমণ্ডলী। সারকারিনা। কলকাতার বিখ্যাত
থিয়েটার পাড়ার চেনা নাম। থিয়েটার পাড়া। যে পাড়া অনেক পরিবারের পেটের ভাত জুটিয়েছে
বছরের পর বছর। কিন্তু কি হয়েছিল সেখানে, তা শুনুন। ঘোষণা
করা হয়… আপনাদের জানাই যে, যদি আজকে
ওঁর জন্যে অপেক্ষা করতে হয়, তবে সাড়ে ছটায় শো শুরু হবে না।
তবে?
তবে আর কি, দেরি হবে।
উনি কে? উনি কেন দেরি
করলেন? কেন প্রফেশনাল থিয়েটারের উনি প্রফেশনাল আর্টিস্ট নন? কেন টাকা
দিয়ে বসে থাকব? কেন ওঁর জায়গায় অন্য কেউ এসে বলবেন, দেরি হচ্ছে? অনুগ্রহ করে আপনারা দেখতে থাকুন। হবে না, চলবে না, হল্লা চেল্লানো? সিট
ভাঙা। কলারে হাত। না এসব কিছুই হয়নি। দর্শক বুঝেছিল যে, আগে
থেকে কেউই জানতেন না যে দেরি হবে। সারকারিনার দর্শক শুনে কি বলল জানেন?
বলল, উনি ঠিক আছেন তো।
হ্যাঁ, উনি ঠিকই আছেন।
তবে, একটা বিশেষ কাজে আটকে পড়ে দেরি হয়েছে। উনি রওনা দিয়েছেন,
আর কিছুক্ষণের মধ্যে আমাদের মধ্যে উপস্থিত হবেন। তবে, শো শুরু হোক।
ফের আরেকজন দর্শক জিজ্ঞেস করলেন, কতক্ষণ আগে জানিয়েছেন? কোথা থেকে?
ও আচ্ছা। তাহলে তো চলেই আসবেন। কাছাকাছি হয়ত এসেও
পড়েছেন। হল- কর্তৃপক্ষের উত্তর, হবে ছটা চল্লিশ
পয়তাল্লিশ। আচ্ছা, তবে অপেক্ষা করি।
হল চুপ নেই। গুঞ্জন উঠেছে। কাঠের মঞ্চ ফ্যালফ্যাল
চেয়ে এক অভিনেতার জন্যে। কে তিনি? কার টিআরপি একুশ শতকের মিডিয়ার ভাষায়
এত বেশি যে… নাটকের জন্যে সময়, ঘড়ি মিলিয়েই চলে। ঐ চরিত্রে অন্য একজন অভিনেতা দিয়েই শুরু হল। তাতে দর্শক গুঞ্জনে
না থাকা অভিনেতার মূল্যায়ন চলছিল। তবে, সে মৃদু। তারচেয়ে
বেশি ছিল দর্শকের অনুভূতি। যে ঐ চ্যালেঞ্জ নিয়েছেন। বাংলার সিনেমায় বা বাঙালির
সিনেমায় নাটকে তিনি যথেষ্ট ছাপ রেখেছেন। ছাপ মানে অভিনয়। অভিনয় দেখতেই দর্শক যান,
সেই দর্শক তিনি কখনও থিয়েটারে অভিনয় করেননি। অথচ, তিনিই সেই বিচারক। অলিখিত এই
নিয়মটি মেনে চলে প্রফেশনাল থিয়েটার। যেখানে হাসির নাটকের হাসি-দর্শকের, গুরুত্ব। এবং দর্শকের বিচারেই তুলসী চক্রবর্তী, রবি ঘোষ, ভানু
গোয়েন্দা আর সহকারী জহরের বিকল্প হয় না। যাঁদের হাসানোর
আর্ট অভিনয়ে তুফান ওঠে। সেই তুফান-ঝড়ের একটি নাম রবি
ঘোষ। সবাই এসে গেলেও উনি আসেননি। আর তিনিই সেই হিরো, যিনি
না এলে দর্শক অপেক্ষা করতে রাজি হাসিমুখে।
এদ্দিন জানতাম যে, হিরো না এলে সিনেমার শুটিং শুরু হয় না। এখানেই হিরোর কদর। আর মঞ্চ-অভিনেতার কদরও যে সেখানেই, তা বুঝতে এবং বোঝাতে এই কাহিনি। কাহিনি সময়ের সঙ্গে সঙ্গে গল্প বা মিথ হয়ে উঠেছে। আর যে গল্প গল্প হলেও সত্যি। তো, এখানেই তিনি না এলে ঐ চরিত্র অভিনয় করার জন্যে দ্বিতীয় কুশলী, শিল্পী তৈরি থাকেন। যিনি নেপথ্যে থেকে যেতেও পারেন সারাটি জীবন। কিন্তু তিনি থাকেন যখন মূল অভিনেতা-শিল্পী নেই সেই জায়গায় অভিনয় করবেন বলে। হ্যাঁ, এভাবেই ক্যারেক্টার তোলা থাকে। গণকযন্ত্রের ভাষায়, বলা যায় ব্যাকআপ। দর্শকের আগে প্রোডাকশনের লোকজন বুঝতে পারেন আসতে দেরি হচ্ছে। কিন্তু জনজীবন তো তখনও এত যান্ত্রিক যোগাযোগ মাধ্যম পায়নি। কালো একটা ফোন সশব্দে বেজে উঠলেই বোঝা যায়, খবর জরুরি। রবিবারের থিয়েটারমুখী বাঙলি তখন ঠাণ্ডা খেয়ে। চা পান করে বাদাম চিপসের জিভে সোয়াদ নিয়ে রেডি। কিন্তু অভিনেতা কোথায়? আলোচনা চলছে, আজকে আসতে দেরি হচ্ছে। আটকে গেছেন উনি। এই উনি হলেন, রবি ঘোষ। সব প্রস্তুত সারকারিনা উপচে গেছে। গ্যালারি করে বসা দর্শক। না, অভিনেতার জন্যে অপেক্ষা না করেই শোয়ের শুরুয়াৎ। বিকল্প–শিল্পী অভিনয় করছেন। আর দুঁদে দর্শক প্রতিটি মুহূর্তে তাঁর চুলচেরা বিচার করে চলেছেন। দর্শকের আলোচনা থেকে বোঝা যাবে, এঁদের অনেকেই আগেও এই নাটক দেখেছেন। ফলে, একজন নামী অভিনেতার রোল, আরেকজন অপেক্ষাকৃত অনামি শিল্পীর পক্ষে করে চলা যে কী দুরূহ, তা বুঝতে অসুবিধে হয় না। এভাবেই আধঘণ্টা অতিক্রান্ত হয়ে যায়। এরই মধ্যে দৃশ্যান্তর ঘটে। সারকারিনার মাঝখানে স্টেজ। আর গ্যালারির মধ্যে যেখান দিয়ে দর্শক প্রবেশ করেন, সেখান দিয়েই অভিনেতারাও। আমাদের সেবারের সিট ছিল গ্যালারির রোয়ের ধারে। সেখান দিয়ে কলাকুশলীরা আসছেন, মানে প্রবেশ করছেন। সেই বয়সেই বোঝার ক্ষমতা ছিল না, অভিনয় কাকে বলে। কী ধরনের অভিনয় ইত্যাদি। শুধু দেখা ছিল দুচোখ ভরে। মেকআপ বুঝতাম না তখন। চরিত্রের পোশাক নিয়েও ধারণা ছিল না। কজন মানুষ মঞ্চে আলোতে দাঁড়িয়ে কী কী করেন, সংলাপ বলেন, হাসির কথায় দর্শক হাসে। কান্নার কথায় কাঁদে বা মন খারাপ করে দুঃখ পায়। এভাবেই দর্শকের সঙ্গে অভিনেতা-অভিনেত্রী তথা কলাকুশলীদের সংলাপ চলে। এবং, একেই বলে অভিনয়। এসব বুঝতে সময় লেগেছে আরও বিশ বছর। ততদিনে সারকারিনা নেই। মানে বন্ধ। সেখানে আর রবিবারের থিয়েটার থিয়েটার গন্ধ নেই। নিঝুম পাড়া শুধু যাতায়াতের পথে চোখে পড়ে। আর বলে, ফ্ল্যাশব্যাকে আসি একবার।
এসব ঘটনা আশ্চর্যের বলেই মনে থেকে গেছে। অর্থাৎ, ফ্ল্যাশব্যাকে থিয়েটার পাঁচালি। সেদিন, অভিনয় চলার এক মুহূর্তে বিমূর্ত আলোতে পাল্টে গেছেন অভিনেতা। কখন? কীভাবে? সে রহস্যের সমাধান দিতে পারতেন ঐ কলাকুশলীরাই। যাঁদের অভিনয়- দর্পণে ছিল দর্শককে আনন্দ দেওয়া। অভিনয়ের জাদু দেখান। সেই জাদু অভিনেতা রবি ঘোষ। একুশ শতকের এক থিয়েটার স্বত্বাধিকারীর পক্ষে যিনি আলোচিত হলেন। এবং আরও আলোচনা হবে আগামীতে। অন্তত থিয়েটার নিয়ে আলোচনায় তিনি সেই শিল্পী। হিরো নন, ক্ল্যাসিক অভিনেতা রবি ঘোষ। যিনি ছোট্ট গোঁফে ঢুকে পড়েছিলেন। সেদিনের চরিত্রটি নিয়ে গ্যালারির মধ্যে দিয়ে নন-অ্যাক্টর থেকে অ্যাক্টর হয়ে উঠলেন। আবার, অভিনয়ের শেষে তিনি ক্ষমা চাইতে গিয়ে জানালেন যে, আমি ক্ষমা চাইছি। আজকের জন্যে। দেরি হওয়ায় জন্যে। দেরি কারণ যদিও পথ দুর্ঘটনা, যাতে রাস্তা আটকে যায়। তখন তিনি হলুদ ট্যাক্সিতে চেপে সারকারিনার দিকেই আসছিলেন। তবুও, তাঁর ঐ ক্ষমা চাওয়া শিল্পী-মূর্তি আজও স্মৃতিতে প্রবাহমান। আর তাঁকে নিয়েই ডটকম দুনিয়ার পাঠকের জন্যে পাঁচালি, ফ্ল্যাশব্যাকে থিয়েটার...
ইতি
একুশ শতকের ফ্ল্যাশব্যাক সত্ত্বাধিকারী
(ক্রমশ)
আহা্ আহা্ বেশ বেশ
উত্তরমুছুনপড়ে সুখ অনিঃশেষ
ইচ্ছে হয় আরও পড়বার।
ওহে নামহীন উহ্য, প্রীতি জানবেন।
মুছুননাম কীভাবে নথিবদ্ধ করতে হয়?
উত্তরমুছুনআমার নাম কমল আইচ
উত্তরমুছুনআমাকে সূচিত করুন লিখলে নাম দর্শায়
উত্তরমুছুনকমল
মুছুনবাহ
উত্তরমুছুনখুব সুন্দর লিখেছ মৌ। রবি ঘোষ কত বড় অভিনেতা বলার অপেক্ষা রাখে না। তুমি যে শব্দ বিন্যাসে ঘটনাটা ধরেছ তা সত্যিই দারুণ।
উত্তরমুছুনআপনার মতন লেখকের মন্তব্য আমাকে উৎসাহিত করল।
মুছুনআপনি শুধরে দেবেন।
মুছুনএলেখা একমাত্র মৌ তোমার দ্বারা সম্ভব। অসাধারণ।
উত্তরমুছুনআমি বিভূতি ভূষণ বিশ্বাস
প্রাণিত হলাম অধ্যাপক দাদা ...✍️
মুছুনDarun, khub sundor
উত্তরমুছুন
উত্তরমুছুনখুব ভালো লাগলো অসাধারণ অনেকদিন পর এরকম একটা লেখা পেলাম আবার বলি অভূতপূর্ব অসাধারণ
Very nicely written. Simple, interesting & full of life. Please keep on writing such articles.
উত্তরমুছুনTheatre activists have reflected the joys & sorrows of the common people throughout the world. Theatre activists have also shown the way forward.
রবিদা আমাদের প্রণম্য। "তুষার যুগ আসছে " নাটকে সুলতা চৌধুরী চলে যাবার পর রবিদা ঐ চরিত্রে অভিনয় করার জন্য বলে পাঠান। আমি কাজটা করি। এছাড়া ও অন্য কয়েক জায়গায় আমাকে রেফার করার জন্যে আমি আজীবন ওনার কাছে ঋণী।
উত্তরমুছুনএই লেখাটির ভঙ্গী অত্যন্ত সুখপাঠ্য। এমন লেখার জন্য অপেক্ষা করতে রাজি!
আমি আপনার সেই অভিজ্ঞতা লিপিবদ্ধ করতে চাই। সুযোগ দেবেন প্লিজ।
মুছুন