কালিমাটি অনলাইন

দ্বাদশ বর্ষ / চতুর্থ সংখ্যা / ১২৪

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

দ্বাদশ বর্ষ / চতুর্থ সংখ্যা / ১২৪

শুক্রবার, ১২ নভেম্বর, ২০২১

পায়েল চট্টোপাধ্যায়

 

কালিমাটির ঝুরোগল্প ১০২


লোকটা

 

আবার সেই লোকটা। ব্রতীর এবার রাগ হচ্ছে। ব্রতীর দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে রয়েছে। লোকটার চোখ দুটো ধূসর। দৃষ্টি স্থির। কী যে বিরক্তিকর লাগে! একে  তো গুঁতোগুঁতি করে এই সকালে বাসে ওঠা। প্রতিমার সুস্বাদু রান্না পেট ঠেলে উঠে আসার উপক্রম হয়! মেয়েটা রাঁধে ভালো। পরিপাটি করে সাজিয়ে দেয়। ফুলো ফুলো হাতে ভাত বেড়ে দিয়ে যায় নিজে। বাটি ভরা নানা তরিতরকারি। তারপর দিবানিদ্রা ইশারা করে ব্রতীকে।‌ সাদা ধবধবে বিছানা, বালিশ, সঙ্গে প্রতিমার নরম শরীর! এসব আবেশ ছেড়ে অফিসের নীরস পথে পা বাড়ানো। ভিড়ে ঠাসাঠাসি করে কোনোমতে শরীরটাকে গলিয়ে দেওয়ার যন্ত্রণাটা উপরি পাওনা। গোদের ওপর বিষফোঁড়া এই উটকো লোকটা। হাতে কালো ব্যাগ। রোজ এই সময় বাসে থাকে। লোকটার দৃষ্টিটা বড় চেনা লাগে ব্রতীর। তবে মনে করতে পারে না।

একদিন ভিড় বাসের মধ্যে বেশ জোরে বলে উঠেছিল ব্রতী, ''কী ব্যাপার বলুন তো দাদা! কী দেখছেন? কিছু প্রয়োজন?''নিজের গলার আওয়াজেই চমকে উঠল ব্রতী। ওর জলদগম্ভীর কণ্ঠস্বর হঠাৎ করে ন্যাতানো পাঁপড়ের মত পাতলা হলো কী করে! কিছু বোঝার আগেই পাশের লোকজনের ব্রতীর দিকে অদ্ভুত দৃষ্টি  আরো মিইয়ে দিল ওকে। ওর গলা কি আটকে যাচ্ছে! এই ফাঁকে সেই উটকো লোকটা উধাও! বাসে একটা নির্দিষ্ট জায়গায় রোজ দাঁড়ায় লোকটা। সেই জায়গা তখন অন্য যাত্রীর দখলে।

প্রায় রোজই এমন চলে। ব্রতী মাঝে মাঝে ইচ্ছে করে বাস থেকে নেমে যায় অর্ধেক রাস্তায় গিয়ে। অস্বস্তি হয়। আজ আবার মুখোমুখি লোকটার। রাগ হচ্ছে ব্রতীর। দুটো স্টপেজ পার করেই বাস আজ বেশ খালি। অর্ধেক সিটে লোক নেই। তবুও বসছে না লোকটা। সেই স্থির দৃষ্টি। হঠাৎ করে রাক্ষুসে রাগ ভর করল ব্রতীর উপর। সেদিনের মত! কলার টেনে ধরতে গেল ব্রতী। চলন্ত বাসে। কোথায় কী! কোথায় লোক! ব্রতীর হাত জুড়ে শুধুই রক্ত। শুধু দুটো চোখের স্থির  মণি দেখতে পাচ্ছে ও। ‌ চিৎকার করতে চাইল। পারছে না। ফ্যাঁসফ্যাঁসে গলা। দম আটকে আসছে। স্থির চোখ দুটো এবার চিনতে পারছে ও। প্রতিমার বর। অনেক বছর আগের কথা। প্রতিমাদের বাড়ি রোজ যাতায়াত ছিল ব্রতীর। ইনসিওরেন্স- এর কাজের সূত্রে। তারপর ভাললাগা। বাঁধ ভেঙেছিল অনেকদিন। একদিন ধরা পড়ে গেল প্রতিমার বরের কাছে। ওদের বাড়িতেই। উত্তপ্ত কথা চালাচালি দিয়ে শুরু। রাক্ষুসে রাগ ব্রতীর। রাগের মাথায় একটা ভারী গোলক ছুঁড়ে মেরেছিল  লোকটাকে। রক্তারক্তি কাণ্ড। মৃত্যুর সময় অদ্ভুতভাবে চোখদুটো স্থির হয়ে গিয়েছিল। ধূসর রঙের মণি। অনেক কষ্টে প্রমাণ লোপাট করে ব্রতী ও প্রতিমা পুলিশের কাছে ‘ঘটনা’কে ‘দুর্ঘটনা’য় পরিণত করেছিল। তারপর সামাজিক বাধা  উধাও। দুজনের সংসার। আজ কি তবে এই বাসে… ব্রতী দেখল বাসটা হঠাৎ  করেই একটা গোলকে পরিণত হচ্ছে। অন্ধকার গোলক। আর তাতে জ্বলজ্বল করছে ধূসর দুটো চোখ।

 


3 কমেন্টস্: