শান্তি ও সুনীতি
(১)
নবম শ্রেণী থেকেই শাড়ি পরা বাধ্যতামূলক। সাদা রং আর সবুজ পাড়। শান্তির ছোটমামা বিলেত থেকে ব্যারিস্টারি পাস করে মাত্রই কলকাতায় ফিরেছেন। সেখান থেকে সেজদিদির বরের পোস্টিংয়ের জায়গা কুমিল্লায় ঘুরে গেছিলেন সপ্তাহ খানেক। বিলেত থেকে সাদা মিহিন জর্জেটের থান এনেছেন বিশগজ। বিশগজ থান কেটে কয়েকটি শাড়ি হলো।
‘জর্জেটের শাড়িতে ফলস পাড়
লাগিয়ে সবুজ রং করলে রোজকার ক্লাসে না হলেও স্কুলে পুরষ্কার বিতরণী বা অন্য কোন
অনুষ্ঠানে পরতে পারবি শান্তি!’ মা বলেছিলেন।
সত্যি সত্যি পুরষ্কার
বিতরণীর দিনে সুনীতি ‘নওয়াব ফয়জুন্নেসা বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় (স্থাপিত: ১৮৩২
সাল)’-এ বেলজিয়াম গ্লাসের মত কাঁচস্বচ্ছসাদা জর্জেটের শাড়ি পরে ঢুকলো। তৃতীয় থেকে
দশম শ্রেণী অব্দি সাত ক্লাসের মেয়েদের ভেতর প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় স্থান
অধিকারীণী এবং বার্ষিক ক্রীড়া-সঙ্গীত-নৃত্য সহ নানা শাখায় স্থান পাওয়া মেয়েদের
পুরষ্কার বিতরণী চলছিল স্কুলের মাঠের ভেতর পেল্লাই সামিয়ানা টাঙ্গিয়ে। শান্তি এবার
উঠলো অষ্টম থেকে নবম শ্রেণীতে। স্কুল মাঠে শুরুতে সোফা আর তাতে বসা শহরের জেলা
প্রশাসক, ম্যাজিস্ট্রেট, শিক্ষক-শিক্ষিকাদের পর কিছু চেয়ার আর বেঞ্চিতে বসেছে
ছাত্রীরা। শান্তির ঠিক পাশে এসে বসলো - আরে ক্লাস নাইন থেকে টেনে উঠলো যে এবার সেই
প্রফুল্লদি না? প্রফুল্লনন্দিনী ব্রম্ম! ওরা ব্রাম্ম! এবার বার্ষিক পরীক্ষায়
প্রফুল্লদি তার সামনের বেঞ্চে বসেছিল। একটি ত্রৈরাশিকের অঙ্ক সে পেরে উঠছিল না।
প্রফুল্লদি তাকে সাহায্য করেছে। প্রফুল্লদি’কে দেখে তাই খুশি হয়ে উঠলো শান্তি।
মাইকে এখন চলছে স্বান্তনা
পুরষ্কার পর্বের ঘোষণা। আর তারই সুযোগে প্রফুল্লদি’র দিকে ঝুঁকে তার কানের কাছে
ফিসফিসিয়ে কুশল শুধালো শান্তি, ‘দিদি - কেমন আছেন?’
‘এই ত - তুমি কেমন?’
একটু অবাক হয়ে প্রফুল্লদি’র
শাড়িটির দিকে তাকালো শান্তি। মেয়েরা আজ ছুটির দিনে কত বাহারি রংয়ের শাড়ি পরে
এসেছে। অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত মেয়েরা ফ্রক, মিডি বা ঝুলের গাউন পরেছে কেউ কেউ মেম
সাহেবদের কেতায়! শান্তি নিজে পরেছে চোখ ধাঁধাঁনো সাদা বিদেশী জর্জেটের শাড়ি। মা এই
শাড়িতে আবার পুঁতি আর কাঁচের আয়না সেলাই করে বসিয়েছে গত দেড় মাস ধরে। আর এই
প্রফুল্লদি কেমন ম্যাটমেটে একটি মোটা থান পরে এসেছেন! কেমন কালচে মেটে রং আর কোন
পাড় নেই!
‘আমি ভাল আছি দিদি - কিন্ত
আপনি-?’
‘বলো?’
‘দিদি - আজ বছর শেষের একটা
ফাংশন। আর আপনি কেমন একটা শাড়ি পরে এসেছেন?’
‘তাই?’
প্রফুল্লদি মুচকি হাসলেন,
‘কিন্ত আমাদের মা যে দীন দু:খিনী শান্তি! এর চেয়ে বেশি যে উনি আমাদের দিতে পারেন
না!’
‘মা- মানে?’
‘দেশমাতৃকার কথা বলছি!’
শান্তি অবাক হয়ে তাকিয়ে
থাকলো প্রফুল্লদি’র দিকে।
‘কাল ত’ রবিবার। মাঘ মাসের
প্রথম দিন। আমাদের পাড়ায় আসতে পারবে একটু?’
খেয়েছে! ব্রাম্মরা নাকি
ঠাকুর-দেবতা মানে না? একটা সময় ত’ হিন্দুর বাড়ির সব কলেজে পড়া ছেলেকে এরা ধরে ধরে
ব্রম্মজ্ঞানী বানাতো। তবে এখন নাকি ব্রাম্মদের সে দিন নেই। ওদের মেয়েরা আবার সব
হিন্দুর বাড়ির বউ হয়ে এসে শাঁখা-সিঁদুর পরে দিব্যি ঠাকুর-দেবতার সামনে গড় হচ্ছে।
‘ভয় নেই ভাই! তোমাকে
একেশ্বরবাদী বানাবো না। কাল আমাদের মাঘ উপাসনা। উপাসনার পর আমরা কিছু ছেলে-মেয়ে
মিলে - সে দেখবে তখন!’
‘ঠিক আছে দিদি - আপনি
নিমন্ত্রণ করলে ত’ আসতেই হয়! দিদি- সুনীতিকে আনব? ও আমার সবচেয়ে কাছের বন্ধু! আমার
ক্লাসেই পড়ে।’
‘নিশ্চয় এনো। এসো কিন্ত।’
(২)
প্রফুল্লদি’দের পাড়ায়
ব্রাম্ম মন্দিরে মাঘ উপাসনা চলছিল। আচার্য যে বেদিতে বসে উপনিষদ থেকে পাঠ করছিলেন,
তাঁর পেছনে রামমোহন রায়ের জোব্বা-টুপি পরা একটি বড় ছবি। ছবিটিতে বেল ফুলের মালা
পরানো। উপনিষদ থেকে পাঠ শেষ হলে শুরু হলো গান। প্রফুল্লদি নিজেই হারমোনিয়াম ধরলেন।
সমবেত কণ্ঠে সুর উঠলো:
‘জগত জুড়ে উদার সুরে আনন্দ গান বাজে,
সে
গান কবে গভীর রবে বাজিবে হিয়া মাঝে?
আকাশ
জল বাতাস আলো,
সবারে
কবে বাসিব ভালো!
হৃদয়
সভা জুড়িয়া তারা বসিবে নানা সাজে!’
প্রার্থনা ও গানের পর সব্জী খিচুড়ি বিতরণ হলো। সবাই মিলে খাওয়া শেষ হলে প্রফুল্লদি বললেন, ‘চলো ভাই - এবার আমরা ধর্মসাগরের পাড়ে যাই!’
‘প্রফুল্লদি - ও কিন্ত
সুনীতি। আমাদের ক্লাসেই পড়ে।’
‘হ্যাঁ - চিনি ত’ ওকে! তোমার
পুরো নাম কি?’
‘আজ্ঞে - সুনীতি চৌধুরী!’
‘দেশ কি কুমিল্লাতেই? নাকি
শান্তির মতো তোমারও জন্ম কলকাতায়? বাবার পোস্টিংয়ের জন্য এখানে এসেছো?’
‘আজ্ঞে না - আমাদের দেশ
কুমিল্লাতেই। ইব্রাহিমপুর আমাদের গাঁয়ের নাম!’
‘বছর চারেক আগে ওদিকটায় ত’
রায়ট হলো?’
‘হ্যাঁ- বাসন্তী দুর্গার
প্রতিমা ভেঙ্গেছিলো মুসলিম লীগের গুন্ডারা - বড় মেয়েদের উপর নাকি অত্যাচার হয়েছে।
আমার ত’ তখন বয়স মোটে দশ!’
‘তোমাদের ধর্মসাগর কোনটি বলো
ত’? সেই যে ত্রিপুরার মহারাজা ধর্মমাণিক্য যেটি সেই সাড়ে চোদ্দশ’ সালের দিকে
প্রতিষ্ঠা করেছিলেন?’
বছর বাইশের এক দাদা
প্রফুল্লদি আর সুনীতির কথোপকথনের ভেতর হঠাৎ জিজ্ঞাসা করলেন। জানা গেল তিনি
প্রফুল্লদি’র জেঠতুতো দাদা। কলকাতায় প্রেসিডেন্সিতে পড়েন। তার সাথে আরো একটা/দু’টো
ছেলে এসেছে কলকাতা থেকে। মেয়েও শান্তি, সুনীতি আর প্রফুল্লদি ছাড়া আরো দু/তিন জন
রয়েছেন।
‘হ্যাঁ - যাবেন দাদা ওখানে?
ওখানে বসেই বরং আমরা আলাপ করি!’
‘চলো!’
(৩)
‘ভাবতেই রোমাঞ্চ বোধ হচ্ছে যে বিপ্লবী উল্লাসকর দত্তের দেশ এই কুমিল্লাতে আমি এলাম,’ প্রফুল্লদি’র দাদা একটি সিগারেট ধরালেন, ‘তোমরা সেই বীর কুমিল্লার ছেলে-মেয়ে!’
হ্যাঁ, উল্লাসকর দত্তের নাম
শান্তি আর সুনীতি দু’জনেই হাল্কা হাল্কা তাদের বাবা আর বাবাদের বন্ধু মানে কাকাদের
বৈঠক ঘরের চায়ের আড্ডায় শুনেছে। সে নাকি এই ব্রাম্মণবাড়িয়ার কালিকচ্ছ গ্রামেরই
ছেলে। তাঁর বাবা দ্বিজদাস দত্তও নাকি এই প্রফুল্লদি’দের মতই ব্রাম্ম সমাজের ছেলে।
লন্ডন থেকে ডিগ্রি করেছেন। বছর চার আগে এন্ট্রান্স পাশ করে কলকাতায় প্রেসিডেন্সি
কলেজে পড়ার সময় এক সাদা প্রফেসর বাঙালীদের চেহারা নিয়ে বাজে কথা বলায় প্রফেসরকে মারতে
গিয়ে তাঁর ছাত্রত্ব চলে যায়। পরে ত’ এই কুমিল্লারই ছেলে উল্লাসকর আর হেমচন্দ্র দাস মিলে একটি বোমা বানিয়েছে। যে
বোমা মারতে গিয়ে আলীপুর বোমা মামলায় ধরা পড়েছিল খোদ ক্ষুদিরাম বোস। পত্রিকার পাতায়
এদের সবার ছবি দেখেছে শান্তি আর সুনীতি। বোমা বানানোর দায়ে বছর দুই আগে যখন তাঁর
ফাঁসির হুকুম হয়েছিল, তখন রোজই কলকাতা থেকে কুমিল্লায় আসা পত্রিকা ‘বসুমতী’তে
উল্লাসকর দত্তের ছবি এসেছে। পরে অবশ্য আপিল হয়ে তাঁর এখন আন্দামানে দ্বীপান্তর
হয়েছে।
‘তোমরা অনুশীলন আর
যুগান্তরের নাম শুনেছো ত’?’
শান্তি আর সুনীতি এ ওর দিকে
তাকায়। ঝাপসা এসব নাম শুনেছে তারা। তবে খুব স্পষ্ট নয়। শুধু জানে যে বাবা-মায়েরা
সবাই আজকাল খুব চিন্তিত থাকে। কার বাড়ির ছেলেরা না ‘বন্দে মাতরম’ হয়ে যায় - কবে না
কে খদ্দের পরে স্বদেশী হওয়া শুরু করে!
‘আনন্দমঠ পড়েছো বোনেরা? এ বই
ত’ শুধু ছেলেদের পাঠ্য নয় - এখন মেয়েরাও পড়ছে!’
নাহ্ - সেজো মাসীর ছেলে
গ্রাম থেকে কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজে পড়তে এসে একদিন তার বালিশের নিচে থেকে
‘আনন্দমঠ’ পাওয়ায় বাবা মা’কে খুব বকলেন। বকতে বকতে বলেছিলেন, ‘এই বয়সের ছেলের
বালিশের নিচে বটতলার চটি পেলে রাগ হতো না। কিন্ত- বাপরে- এ যে আনন্দমঠ!’
‘প্রফুল্ল - পরাধীন
স্বদেশমাতার গ্লানি দূর করতে গোটা জাতির ভেতর দৈহিক শক্তি ও সামর্থ্য বাড়াতে হবে।
নারীকে আমরা অবলা করে রেখেছি। শুধু ছেলেরাই ব্যায়াম করবে আর দৈহিক শক্তি বাড়াবে
তা’ কেন? তুই শান্তি আর সুনীতিকে- চেনা-জানা সব মেয়েকে ছাত্রী সঙ্ঘে ভর্তি করে নে।
তলোয়ার আর লাঠি খেলা, বন্দুক ছোঁড়া- সব শিখুক। তার আগে ব্যায়াম, মুষ্টিযুদ্ধ,
ঘোড়ায় চড়া গোপনে গোপনে শিখতে হবে!’
(৪)
‘মায়ের দেওয়া মোটা কাপড় মাথায় তুলে নে রে ভাই!
দীন-দুঃখিনী
মা যে তোদের এর চেয়ে বেশি সাধ্য নাই!’
দাউ দাউ করে জ্বলছে সার দেওয়া বিলিতি কাপড়ের স্তপ। শান্তি নিজেই সেখানে ছোট মামার দেয়া জর্জেট শাড়িটা যা মাত্র ক’দিন আগেই স্কুলে পুরষ্কার বিতরণীর অনুষ্ঠানে পরেছিল, সেটা ছুঁড়ে ফেলে দিল। তার পরনে আজ প্রফুল্লনন্দিনীদি’র মতই মোটা খদ্দেরের শাড়ি। স্কুলে ক্লাসে সে এখনো রোজই যাচ্ছে। যাচ্ছে সুনীতিও। তবে স্কুলের শেষে গোপনে তারা শরীরচর্চ্চার ক্লাসে যায়। হাঁটা, দৌড়ানো, কুস্তি করা, লাঠি চালানো, ছোরাখেলা, গোমতী নদীর পাড়ে ঘোড়ায় চড়ে আসা - সব কিছুর পরে রাতে বাসায় ফিরে তারা এক মনে ‘শ্রীমদ্ভাগবত গীতা’ পড়ে। এত কিছু পড়তে পড়তেও মনটা খচ খচ করে মাঝে মাঝে শান্তির। এই ত’ গত সপ্তাহে দেশের বাড়ি যাবার পর মালো পাড়ার এক মাসী এলো মাছের চুবড়ি নিয়ে। মা তাঁকে উঠোনে ঢুকতে দিলেন না। দরজার সামনে থেকে মাছ বিক্রি করে সে চলে গেলো।
‘ওকে ঢুকতে দিলে যে না মা?’
‘আরে - ও ত’ মেছুনী!’
‘কিন্তÍ ওর কপালে যে সিঁদুর,
হাতে শাঁখা!’
‘তবু জাতে ত’ মালো!’
রাতে ঘুমের আগে ‘গোরা’ পড়তে
পড়তে বিষণ্ণ লাগে শান্তির। গোরা গ্রামে গিয়ে দ্যাখে হিন্দুর বড় অনৈক্য আর মুসলিমের মাঝে
একতার অভাব নেই। একদিন মা না থাকার সময়ে শান্তি অবশ্য সেই মেছুনীমাসী আবার মাছ
নিয়ে এলে তাকে উঠোনে ঢুকতে দিয়েছিল।
‘আমি উঠোনে ঢুকেছি যদি তোমার
বাড়ির বড়রা দেখে ফ্যালে খুকী?’
‘কিচ্ছু হবে না। নাম কি
তোমার মাসী?’
‘আমার নাম সত্যবতী! সত্যবতী
মল্লবর্মণ!’
বলে কি! ‘মহাভারত’-এ
বেদব্যাসের মায়ের নামও ত’ সত্যবতী - রাজা শান্তনুর দ্বিতীয় স্ত্রী। সে কী করে
মেছুনী হয়েও রাণী হয়েছিল?
‘বন্দে মাতরম!’
একটা প্রবল শব্দের হল্কা বয়ে
যায়।
শান্তিও সবার সাথে গলা তোলে,
‘বন্দে মাতরম!’
‘এই হয়েছে এক কেতা - হিন্দু
বাবুদের কেতা - তোমাদের পয়সা আছে তাই বিলিতি কাপড় পোড়াতে পারো! খদ্দের পরার ঢং
করো। আমরা গরীব মুসলমান- কীভাবে কুলাই?’ হাটের ভেতরে ডান দিকের এক বুড়ো মুসলিম
হাটুরে বিরক্তিতে বিড়বিড় করে। অস্বস্তি হয়
শান্তির। সব কিছু সে বোঝে না। বেশি অস্বস্তি হলেই সে তার চোদ্দ বছরের অগাধ বিশ্বাস
আর সরলতার সবটুকু নিয়ে, সবটুকু দিয়ে ‘আনন্দমঠ’ আর ‘শ্রীমদ্ভাগবত গীতা’ আরো জোরে
আঁকড়ে ধরে।
‘শুভ্র-জ্যোৎস্না-পুলকিত-যামিনীম
ফুল্লকুসুমিত-দ্রুমদল
শোভিনীম
সুহাসিনীং সুমধুরভাষিণীম
সুখদাং বরদাং মাতরম’---
(৫)
‘শান্তি আর সুনীতি - এই নাকি তোমরা মেয়ে বলে শুধুই স্বদেশী কাপড় পোড়ানোর সময় ছেলেদের হাতে গয়না বা টাকা তুলে দেবার কাজে বিরক্ত হয়ে যাচ্ছো! ছেলেদের মত বড় দায়িত্ব চাও - মা চামুন্ডার কাছে নিজেকে বলি দিতে চাও! সত্যি যদি আজ বলি দেবার সময় আসে, তবে পারবে?’
‘কী বলছো প্রফুল্লদি? সত্যি
কি তেমন ভাগ্য আমাদের কোনদিন হবে?’
‘হবে বোনেরা - খুব তাড়াতাড়ি
হয়তো বলিদানের সময় আসছে তোমাদের!’ প্রফুল্লদি ওদের কাছে ঝুঁকে পড়ে ফিসফিস করেন,
‘বাঙালীর ঘরের কিশোর-যুবক ছেলে সব ফাঁসিতে-জেলে-দ্বীপান্তরে শেষ! এছাড়া বৃটিশ এখন
বাঙালী ছেলেদের এত ভয় পায় যে কোন সভা-সমিতি-অনুষ্ঠানে ছেলেদের ঘেঁষতে দেয় না। পাশে
না ঘেঁষতে পারলে মারবে কী করে? তোমাদের উপর একটি বড় দায়িত্ব দিতে যাচ্ছে যুগান্তর
জেলা কমিটি।’
‘বলো দিদি- আমরা করব!’
‘আমাদের কুমিল্লা শহরের
ডিস্ট্রিক্ট ম্যাজিস্ট্রেট স্টিভেন্স সাহেব আছেন না? ওনার অফিসে যেতে হবে তোমাদের।
একটি এ্যাপ্লিকেশন মানে আবেদনপত্র নিয়ে যাবে। নওয়াব ফয়জুন্নেসা স্কুলের ছাত্রীদের
জন্য একটি ‘সুইমিং ক্লাব’ প্রতিষ্ঠার অনুমতি চেয়ে আবেদন। শাড়ির ভেতর, ব্লাউজের
নিচে পিস্তল লুকিয়ে নিয়ে যাবে। স্টিভেন্স যেই না আবেদনপত্র দেখতে যাবেন, তোমরা
তাকে গুলি করবে। পারবে ত’?’
‘পারব দিদি - বন্দে মাতরম!’
(৬)
দিনটা ছিল ১৪ ডিসেম্বর। ১৯৩১ সালের সেই মাঘ মাসে কেমন জাঁকালো শীত যে ছিল! আচ্ছা, গোমতীর তীরে আজো কি মাঘ মাসে তেমন কনকনে হাওয়া বয়? মালো পাড়ায় মেয়েরা ‘মাঘমন্ডলীর ব্রত’ সাজায়? সেই ডিসেম্বরে সে আর সুনীতি পরেছিল দু’টো লাল উলের সোয়েটার। নিচে ঘিয়ে রঙের খদ্দরের শাড়ি আর শাড়ির নিচে তাদের ব্লাউজের ভাঁজে ছিল দু’টো রিভলবার। ঐ বয়সে মেয়েরা তাদের প্রথম প্রেমপত্র হয়তো গুঁজে রাখে ব্লাউজের ভাঁজে। তারা রেখেছিল গুলি ভরা দু’টো পিস্তল।
‘মা - এই আপনার হরলিকস।’
শান্তি একটি গভীর শ্বাস ছেড়ে
টেবিল থেকে মুখ তুলে তাকান। ‘অরুণ বাহিনী’ নামে কৈশোর যৌবনের সেই সংগ্রামের
দিনগুলো নিয়ে একটি স্মৃতিকথা লিখছেন তিনি। জীবন তাঁকে কম দেয় নি। আবার যেন অনেক
কিছু নেইও তাঁর। চাইলেও কৈশোরের সেই কুমিল্লায়, তিতাস বা গোমতীর তীরে তাঁর আর ফেরা
হবে না। ১৯৫২-৬২ সাল এবং ফিরে ১৯৬৭-৬৮ সালে দু’দফায় পশ্চিম বাংলার প্রাদেশিক আইন
পরিষদের সদস্য হয়েছেন তিনি। স্বামী চিত্তরঞ্জন দাসের সাথে সুন্দর সংসার। অথচ,
বাঁচারই কথা ছিল না---ছিল কি?
(৭)
‘মিস্টার চার্লস জিওফ্রে বাকল্যান্ড স্টিভেন্স।
ডিস্ট্রিক্ট ম্যাজিস্ট্রেট
এ্যান্ড কালেক্টর, কুমিল্লা।
প্রভিন্স অফ টিপেরা,
ইন্ডিয়া।’
সাদা দোতলা বাংলো বাড়ি তথা
ম্যাজিস্ট্রেট অফিসের গেটে পেতলের নেমপ্লেট। বাড়ির সামনে মোরাম বিছানো সবুজ ঘাসের
লন। উর্দি পরা মালী সযত্নে ফুটিয়ে তুলছে শীতকালীন বাহারি নানা ফুল- ডালিয়া, গাঁদা,
জিনিয়া।
‘তোমরা নওয়াব ফয়জুন্নেসা
উচ্চ বালিকা বিদ্যালয়ের ছাত্রী?’
ম্যাজিস্ট্রেটের সহকারী
জিজ্ঞাসা করলেন। এই লোকটি বাঙালী। পরণে ধূতি আর সাধারণ শার্ট। গলায় মাফলার।
‘বেশ - স্যারের সাথে দেখা
করতে চাও কেন?’
‘আমাদের স্কুলে একটি সুইমিং
ক্লাব প্রতিষ্ঠার জন্য আবেদন করতে এসেছি।’
‘গুড। মিনিট পনেরো বসো ঐ
বারান্দার বেঞ্চিতে। স্যারের কাছে এখন অন্য ভিজিটর আছেন। তারা চলে গেলেই তোমাদের
ডাক পড়বে। এক পিওন এসে দোতলায় নিয়ে যাবে তোমাদের, কেমন?’
ম্যাজিস্ট্রেটের পিএস ওদের
দু’জনকে বিস্কুট আর চা-ও পাঠিয়েছিলেন। অনেক পুরুষ দর্শনার্থীর ভিড়ে দু’টো মেয়ে
হিসেবে বাড়তি খাতির আর কি! চা-য়ে বিস্কুট ডুবিয়ে
খেয়েছিল তারা দু’জন। তারপরই ডাক এলো।
‘সো - গার্লস! গুড মর্ণিং!’
মুচকি হেসেছিলেন গোরা
ম্যাজিস্ট্রেট স্টিভেন্স তাদের দিকে চেয়ে।
‘স্যার - উই হ্যাভ এ্যান
এ্যাপ্লিকেশন। উই নিড আ সুইমিং ক্লাব ফর গার্লস ইন আওয়ার স্কুল!’
‘শিওর’
স্টিভেন্স হাত বাড়িয়ে
দরখাস্ত নিয়ে মাথা নিচু করা মাত্র দুই বান্ধবী অসামান্য ক্ষিপ্রতায় সোয়েটার আর
শাড়ির নিচে ব্লাউজের ভাঁজ থেকে বের করলো দু’টো রিভলবার। দুম্ দুম্ শব্দে গর্জে
উঠলো দু’টো পিস্তল! প্রথম গুলিটি সুনীতির পিস্তল থেকেই বের হয়েছিল। প্রথম গুলিই
ভেদ করেছিল বিদেশী ম্যাজিস্ট্রেটের বুক। পরে পোস্ট মর্টেম রিপোর্ট তেমনটাই বলেছে।
‘যিশাস্!’
নিপুণ লক্ষ্যভেদ। এক আর্ত
শব্দে মুখ থুবড়ে কার্পেটের উপর পড়ে গেলেন ম্যাজিস্ট্রেট।
(৮)
‘ভয় কি মরণে/ রাখিতে সন্তানে
মাতঙ্গী মেতেছে আজ সমররঙ্গে/
তাথৈ তাথৈ থৈ দ্রিমি দ্রিমি
মৃদঙ্গে
মাতঙ্গী মেতেছে আজ
সমররঙ্গে।’
...ম্যাজিস্ট্রেটের বাংলো
থেকে কুমিল্লা জেলখানা অব্দি প্রিজন ভ্যানে হাসতে হাসতে আর হাতে তালি দিয়ে গান
গাইতে গাইতে পুরো পথটা গেছিলো তারা দু’জন। গুলির শব্দে নিচ থেকে অনেকেই ছুটে
এসেছিলো। একদিকে দু’টো হাল্কা-পল্কা বছর চোদ্দর মেয়ে আর অন্যদিকে গোটা
ম্যাজিস্ট্রেট অফিসের যত সিপাই-সান্ত্রী, পুলিশ কনস্টেবল সব! সাথে সাথে হাতে
হাতকড়া পরিয়ে গ্রেপ্তার করা হলো তাদের। কিছুক্ষণ চললো লাগাতার চড়-ঘুষি-চুলের মুঠি
ধরা-লাথি আর অকথ্য গালাগালি। শান্তি আর সুনীতি ভেঙ্গে পড়লো না একটুও। এই চারণ কবি
মুকুন্দ দাসের গান ধরে ত’ সেই বিদ্রোহী কবি কাজি নজরুলের: ‘কারার ঐ লৌহকপাট/ভেঙ্গে
ফেল্ কররে লোপাট/রক্তপূজার পাষাণ বেদি’ গাইতে গাইতে আর হাসিমুখে হাততালি দিতে দিতে পৌঁছে গেছিল তারা
জেলখানায়। ভারতীয় দন্ডবিধির ধারা ৩০২, ৩২৪, ৩০৭/১০৯-এর আওতায় কুমিল্লা কোতোয়ালি
থানায় এফ,আই,আর দায়ের হয়েছিল তাদের দু’জনের বিরুদ্ধে। পোস্ট মর্টেম রিপোর্টে
মিস্টার স্টিভেন্সের দেহ থেকে .৪৫০ বোর আর .৩২০ বোরের দু’টো গুলি পাওয়া গেছিল।
প্রথমে গোটা ঘটনায় প্রায় ৪১জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল। পরে সাক্ষ্য প্রমাণ যা
মিললো এই দুই কিশোরীর বিরুদ্ধেই। শান্তি ঘোষ, পিতা- দেবেন্দ্রনাথ ঘোষ ও সুনীতি
চৌধুরী, পিতা - উমাচরণ চৌধুরীকে কলকাতা হাই কোর্ট নরহত্যার দায়ে অভিযুক্ত করলো।
অন্য অভিযুক্তদের কিছুদিনের জন্য ‘বাংলার অপরাধ (সংশোধিত) আইন’-এর আওতায় রাখা
হয়েছিল। সুনীতিরই শাস্তি হলো বেশি। তার পিস্তলের প্রথম গুলিতেই মারা গেছিল
স্টিভেন্স। তাই ওকে রাখা হয়েছিল নির্জন কারাবাসে। পনেরো বছরের একটি মেয়ে দিনের পর
দিন, মাসের পর মাস একটি নির্জন প্রকোষ্ঠে কাটিয়েছে। কেউ পাশে যায় নি। কথা বলার কেউ
ছিল না। তুলনায় শান্তির কষ্ট কমই ছিল খানিকটা...।
(৯)
১৯৩২-এর ফেব্রুয়ারিতে কুমিল্লা থেকে কলকাতার আদালতে তোলার পর যাবজ্জীবন কারাদন্ড হয়েছিল তাদের। ওরা দু’জনেই মনে মনে খুব আশা করেছিল যেন মৃত্যুদন্ড হয় তাদের: ‘জননী জন্মভূমিশ্চ স্বর্গাদপি গরিয়সী!’ জননী ও জন্মভূমির জন্য আত্মদান কত বড় পূণ্য! কলকাতা হাইকোর্ট অবশ্য দুই নাবালিকার বয়স বিবেচনা করে আপিলে মৃত্যুদন্ড রদ করেছিল। কলকাতা জেলে ঢোকা মাত্র জমাদারনীরা শান্তিকে অভ্যর্ত্থনা জানিয়েছিল চড়-ঘুষি আর লাঠির বাড়ি মেরে। সুনীতিকে নিয়ে যাওয়া হলো সলিচারি সেলে। তবে, ন্যায়পর বৃটিশ সংবাদপত্রগুলোয় এই দুই কিশোরীর দুর্দ্ধর্ষ আত্মত্যাগকে বলা হলো ‘আর্ল অফ উইলিংডন’ কর্তৃক ভারতীয়দের বেসামরিক অধিকার এবং বাক-স্বাধীনতা খর্ব করার জন্য জারিকৃত অধ্যাদেশের প্রতি ভারতীয়দের প্রতিবাদের স্বাভাবিক রূপ হিসেবে দেখা হলো। ভারতীয় সংবাদপত্র বৃটিশ ম্যাজিস্ট্রেটদের মন্দ আচরণ যা কিনা ভারতীয় নারীর সম্মানহানি পর্যন্ত কখনো কখনো গড়ায়, তার বিরুদ্ধে দুই কিশোরীর প্রতিবাদ হিসেবে এই হত্যাকান্ডকে বর্ণনা করলো। তবে, দুই কিশোরীর যাবজ্জীবন কারাদন্ড ঘোষিত হবার পর সেদিন রাজশাহী জেলায় ডিটেকটিভ পুলিশ বাহিনী একটি লিফলেট খুঁজে পেয়েছিল যেখানে স্কটিশ কবি রবার্ট বার্ণসের কবিতার সাথে শান্তি আর সুনীতির ছবি জুড়ে দিয়ে তাদের বীরত্বের প্রশংসা করা হয়। ইংরেজ অত্যাচারের বিরুদ্ধে স্কটিশ বিদ্রোহের নায়কদের স্তব সেই কবিতা।
Scots, wha hae wi' Wallace
bled,
Scots, wham
Bruce has aften led;
Now's the day, and now's
the hour;
See the front o'
battle lour;
Wha will be a
traitor knave?
Wha can fill a
coward's grave!
Wha sae base as
be a slave?
Let him turn and
flee!
By oppression's
woes and pains!
By your sons in
servile chains!
We will drain
our dearest veins,
But they shall
be free!
Lay the proud
usurpers low!
Tyrants fall in
every foe!
Liberty's in
every blow!—
Let us do or
die!
(১০)
জেলখানায় সলিচারি সেলে থাকতে থাকতে মানসিক ভাবে ভেঙ্গে পড়েছিল সুনীতি। তার বৃদ্ধ বাবার পেনশন বন্ধ করে দেয়ায় কুমিল্লায় তার ছোট ভাইটি অনাহার আর অপুষ্টিতে মরেই গেছিলো। সাত বছর পর সে আর শান্তি দু’জনেই ছাড়া পায়। শান্তি কমিউনিস্ট আন্দোলনে জড়িয়ে পড়লো আর বিয়ে করলো এক সহযোদ্ধাকেই। মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করে সুনীতি ডাক্তারি পড়া শুরু করলো - ডাক্তার হলো। ১৯৪৭ সালে মানে ঐ দেশভাগের বছরে বিয়ে হলো তার। তবে দেশে মানে গোমতীর পাড়ে আর ফেরা হয়নি সুনীতির। কুমিল্লার ছেলে উল্লাসকর দত্তের সাথে একবার দেখা হয়েছিল তার। আন্দামানে বহু বছর কাটিয়ে দেশভাগের পর কুমিল্লাই ফিরে গেছিলেন তিনি। দশ বছর একা একা কাটিয়ে কলকাতা যান। একটি অসুস্থ মেয়েকে বিয়ে করে আসামের শিলচরে চলে যান। সেখানেই বাকি জীবন কাটান তিনি। মাঝে মাঝে শান্তির সাথে কথা হয় সুনীতির। কুমিল্লার নওয়াব ফয়জুন্নেসা স্কুলের কথা। গোমতীর পাড় আর ধর্মসাগর দীঘির কথা যা আর একজীবনে ফিরে পাবার নয়।
...মৃত্যু অবধি দুই সখীই
গোমতীর কথা মনে করে গ্যাছে।
ভালো লাগলো। স্যালুট, ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামীদের!
উত্তরমুছুন