কালিমাটি অনলাইন

দ্বাদশ বর্ষ / চতুর্থ সংখ্যা / ১২৪

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

দ্বাদশ বর্ষ / চতুর্থ সংখ্যা / ১২৪

সোমবার, ১৪ জুন, ২০২১

পায়েল চ্যাটার্জী

 

কালিমাটির ঝুরোগল্প ৯৭


সাইকেল

১৯৪৮। সাইকেলে চেপে কোনমতে স্টেশনে পালিয়ে এল কুঞ্জ। মহুলপুর গ্রামের জমিদার-কন্যা হৈমবতী তখন অন্তঃসত্ত্বা। পিতা কুঞ্জবিহারী দাস। পিতৃত্ব কি তবে বাঁচতে শেখায়? পালিয়েও? সিটে বসতেই স্মৃতিরা হুড়মুড় করে ধরা দিল। হৈমবতী। স্নিগ্ধতা, চঞ্চলতা। হৈমবতীকে পড়াতে আসতো কুঞ্জ। ষোড়শী, সুন্দরী। বইয়ের পাতা ওল্টানোর অজুহাতে একে অপরের হাত ছুঁয়ে দেওয়া। অন্তরের ঘনিষ্ঠতা। অগোচরে বেশ চলছিল লুকোচুরির ভালোবাসা। হঠাৎ করেই অন্দরমহলের ফিসফিস। 'কালো মাস্টার' এতক্ষণ ধরে কী পড়ায় জমিদারের সুন্দরী মেয়েকে?  তারপর একদিন হাতেনাতে ধরা পড়লো দুজনে। কালো মাস্টারের পাঠ চুকল। কিছুদিন পরেই জানা গেল, হৈমবতী অন্তঃসত্ত্বা। পালিয়ে গেল কুঞ্জ।

১৯৭১। মুক্তিযুদ্ধ। মহুনপুর গ্রামের বিকেল।

-আমায় যেতেই হবে মা! ঝুলনের ওষুধ প্রয়োজন”।

- চারিদিক মিলিটারিরা ঘিরে ফেলেছে। এই অবস্থায়...

-ডাক্তাররা একমাত্র রোগীর প্রাণের মায়া করে

হুশ হুশ করে সাইকেল ছুটিয়ে বেরিয়ে গেল মহুলপুর গ্রামের একমাত্র মহিলা-ডাক্তার। হৈমবতীর চোখ ছল ছল করছে। কার মত হয়েছে মেয়েটা? তার জন্মদাতা বাবার মত? নাকি সেই মানুষটার ছোঁয়াও আছে কোথাও?

সেদিন কুঞ্জ না থাকলে কী যে হত! নিজের অজান্তেই হৈম নজরবন্দি ছিল তার  মাসতুতো দাদা রমাপদর। সে-ই প্রথম অন্দরমহলে খবর দেয়। মহুলপুর গ্রাম ছাড়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিল কুঞ্জ। সুযোগ পেয়ে রমাপদ ধর্ষণ করে হৈমবতীকে। শোকে, যন্ত্রণায় পাথর তখন হৈমবতী।

জমিদারবাড়ির কঠিন নিরাপত্তার ঘেরাটোপ পেরিয়ে সকলের অলক্ষ্যে শেষবারের মতো হৈমর সঙ্গে দেখা করতে এসেছিল কুঞ্জ। পাথরের চোখে জলধারা নামল। হৈম সেদিন পেয়েছিল একটা কাঁধ আর সকলের সঙ্গে লড়াই করার সাহস। হৈমর সন্তানের সঙ্গে জুড়ে গিয়েছিল কুঞ্জর নাম।

কুঞ্জকে না পেয়ে স্টেশন থেকে ফিরে এসে ওর সাইকেলটা দড়াম করে জমিদার বাড়ির উঠোনে ফেলে দিয়ে রমাপদ চিৎকার করে বলেছিল, 'বজ্জাতটা পালিয়েছে'।

তারপর অনেকটা পথ পেরিয়েছে হৈম আর তার সন্তান। অন্য গ্রাম, অন্য বাসা। হৈম আর গুঞ্জার লড়াই। পাঁচ বছর হলো হৈম ফিরেছে গুঞ্জাকে নিয়ে। সেই মহুলপুর, স্মৃতি।

-মা, নয়না বৌদিকে আজ সারারাত লক্ষ্য রাখতে হবে আমায়। ব্যথাটা বড্ড বেড়েছে ওর। আমি ওখানেই থাকবো আজ রাতে”।

হৈম আটকালো না গুঞ্জাকে। জানে, লাভ নেই। ও কি কুঞ্জর মতই হয়েছে? যার সঙ্গে ওর নাম জুড়ে আছে। মেয়েটা বেরোলো। সঙ্গী সেই ভাঙ্গা-চোরা সাইকেল। চলে যাওয়ার দিন স্টেশনে ফেলে যাওয়া কুঞ্জর গন্ধ-মাখা সাইকেল। মেয়ে ফিরলে হৈম পরিষ্কার করতে বসবে ওটা, রোজকার মতই। সঙ্গে ঝালিয়ে নেবে নিজের স্মৃতি আর অপেক্ষা

 

 


1 কমেন্টস্: