কালিমাটি অনলাইন

দ্বাদশ বর্ষ / চতুর্থ সংখ্যা / ১২৪

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

দ্বাদশ বর্ষ / চতুর্থ সংখ্যা / ১২৪

বুধবার, ১৪ অক্টোবর, ২০২০

নিবেদিতা আইচ

 

সমকালীন ছোটগল্প


খেলাঘর


তবু মনে রেখো ।। উপলের কথা

এমন কাকতালের মানে নেই। একদম মানে নেই।

কীসের মানে নেই?

কটেজের বারান্দায় দাঁড়িয়ে চায়ের কাপে চুমুক দিচ্ছিলাম আমি। সাহানা কখন পেছনে এসেছে দাঁড়িয়েছে খেয়াল করিনি। ফলে ওর গলা শুনে ভীষণ চমকে গেলাম। চা ছলকে গায়ে পড়লো।

এত অন্যমনস্ক থাকো কী করে বুঝি না আমি!

টিস্যু দিয়ে আমার শার্টের দাগ মুছতে মুছতে সাহানা মাথা নাড়ছে। ভ্রুজোড়া কুঁচকে গেছে ওর। চোখেমুখে বিরক্তি।

আমার অন্যমনস্কতা নিয়ে বরাবরই ওর অভিযোগ। আরো অনেক কিছু নিয়েই অভিযোগ আছে, সে আমি জানি। আমি এমন এক মানুষ অভিযোগ না থাকাটা  বরং অস্বাভাবিক।

মুখ দিয়ে চুকচুক শব্দ করতে করতে মাথা দুলিয়ে সাহানা বললো - বদলে নাও এটা।

কী দরকার, এমনিতেই দেরি হয়ে গেছে।

আমার আপত্তিটুকু অগ্রাহ্য করে দিয়ে প্রায় ধাক্কা দিতে দিতে আমাকে ভেতরে পাঠালো সে। ছবিতে নাকি দাগ বোঝা যায়। সাহানা এমন নাছোড়বান্দা, ছেলেমানুষও।

আমি এখনো মাঝেমাঝে ভাবি এই স্বভাবটা যদি দোলার থাকতো তবে হয়ত, হয়ত অনেক অন্য রকম হতো সবকিছু এই যে শার্ট বদলে ফেলার মতো তুচ্ছ বিষয়  থেকে শুরু করে যে কোন বড় সিদ্ধান্তে জোর খাটানো, মাত্রার ভেতরে থাকলে ব্যাপারটা মন্দ নয় কিন্তু। এটুকু অধিকারবোধ তো থাকা চাই। নইলে একটা সম্পর্ক টিকবে কেন! এক তরফা সম্পর্ক যে কী ভীষণ অস্বাস্থ্যকর আমি তা বুঝেছিলাম। তাই নিজের সাথে যুদ্ধ করে হলেও সরে এসেছিলাম।

যা হোক। জীবন খুব সুন্দর এখন, যেমন আমি চেয়েছিলাম। সাহানার হাতের মুঠোবন্দি হয়ে বেশ চলছি। সুন্দর একটা ভ্রমণ হচ্ছে গত দুবছর ধরে। সাহানা আমার সঙ্গ ছাড়ে না। এই এখন যেমন ওর মুঠোবন্দি হয়ে গাড়িতে উঠে বসলাম। আমাদের গাইড বললো আগে সোয়াম্প ফরেস্টে যাওয়া যাক। আমি জানালা দিয়ে ভিউটা দেখছিলাম। কাল অনেক রাতে এসে পৌঁছেছি এখানে। তখন জায়গাটাকে গা ছমছম নিষ্প্রাণ মনে হলেও এই ঝকঝকে দিনের আলোয় চোখ ফেরাতে পারছি না। চমৎকার বাগান চারদিক জুড়ে। কটেজের নামটাও বেশ। ভরা জোছনায় এই বাগানে বসে ঝিল্লিময় বনের গান শুনতে বেশ লাগবে।

সাহানার সাথে ফ্রন্টক্যামেরায় চোখ রেখে হাসতে হাসতে ভাবছি আমি কি তবে বনকেও ভালোবাসতে শুরু করেছি, ওর মতো! আজকে যদি দোলা সঙ্গী হতো তবে জঙ্গলে বেড়াতে না এসে বোধ হয় সমুদ্রে যেতাম আমরা। এসব ব্যাপারে ভাববার মতো সময় দোলার বরাবরই কম ছিল। ফলে এক কথাতেই রাজি হয়ে যেত সেও সাথে থাকলে এবার সমুদ্রেই যেতাম আমরা, আমার সমুদ্র ভীষণ প্রিয়।

ধুর! একটা ছবিও ভালো আসেনি।

ঝুপ করে শরীরটা গাড়ির সিটে ছেড়ে দিয়ে মুখ বাঁকালো সাহানা।

ওর গালটা আলতো করে ছুঁয়ে দিতেই কাঁধে মাথা রাখলো। আনমনে গুনগুন করছে সাহানা। জানালার বাইরে তীর্যক রোদ। মন ভালো করা ঝকঝকে সকাল। বাগানে আধফোটা বনগোলাপ, হলদে ডালিয়া, আরো কিছু অজ্ঞাতনামা ফুলদল। ওদের দেখতে দেখতে ভাবছি দোলার কি সমুদ্র ভালো লাগে নাকি বন? না, বোধহয় পাহাড় ওকে বেশি টানে। তবে সমুদ্রে কেন গেল? ভোরবেলা ওর নাম লিখে একবার খুঁজতে ইচ্ছে করেছিল। অমনি সমুদ্রের ছবি ভেসে উঠলো। আমি চমকে গেলাম খুব। সাহানা রাজি হলে আজকে সেই একই সৈকতে থাকতাম আমরা।

দোলা আর আমি, আমরা কখনো একসঙ্গে সমুদ্রে যাইনি৷ তবু একবারের জন্য হলেও এ'কদিনে আমার কথা ওর মনে পড়বে। যেমন আমিও ভাবছি ওর কথা।

দোলা এখনো তেমন আছে। বরাবরের মতো চোখেমুখে মেকি কিছুর প্রলেপ নেই, ওর ঝকঝকে হাসিটাই ওর প্রসাধন। স্বভাবেও নেই কিছুর আড়াল। যে স্বভাব দেখে ওর প্রেমে পড়েছিলাম সে স্বভাবের কারণেই শুধু আমার ভালো লাগবে বলে শেষ দিনটিতেও দুটো নরম কথার আদর সে দেয়নি। আমি বুঝলাম আদতে এতটা স্পষ্টভাষ কিংবা নিরাবেগ, গ্রন্থিহীন যৌথতা মেনে নিতে পারঙ্গম নই আমি। তাই আমাদের সম্পর্কের ইতি অনিবার্য ছিল।

তবু মাঝেমাঝে দোলার কথা ভাবতে, বুকের ভেতর পুরনো সেই গুমোট ব্যথাটা নিয়ে নাড়াচাড়া করতে এখনো ভালো লাগে আমার।

যদি জল আসে আঁখিপাতে,

এক দিন যদি খেলা থেমে যায় মধুরাতে,

তবু মনে রেখো।

রিয়ার ভিউ মিরর বলছে আমার হাতটা মুঠোয় ভরে চোখ বুজে আছে সাহানা আয়না থেকে চোখ সরিয়ে আনত মুখটা দেখি। চোখ বন্ধ রেখেও কি আমার ভেতরটা পড়তে পারছে সে?

ও কি জানে ওর এত কাছে থেকেও কেন মাঝেমাঝে এমন করে নির্বাসিত হয়ে থাকি? গুমোট ব্যথাটার কথা কখনো তো বলিনি ওকে!

খেলাঘর বাঁধতে লেগেছি ।। সাহানার কথা

কাল সকালে ফিরছি আমরা কতদিন পর বের হলাম ঘর থেকে সেই যে বিয়ের  দু'মাস পর সমুদ্র দেখতে যাওয়া, একঘেয়ে বালির স্রোত পেরিয়ে সমুদ্র স্নান, নতুন নতুন উপলকে চেনা। মনের থৈ না পেলেও শরীর চেনাও একপ্রকার পরিচয় বটে।

দু'বছরেও আমি থৈ পাইনি। কী করে সময় কেটে যায় চোখের নিমিষে! আমি ভীষণ জোর খাটাই। এবারেও সমুদ্রে যেতে চেয়েছিল উপল, আমার অফিসের ট্যুর আছে জানার পর। তবু আমি সেই ট্যুরে না গিয়ে জেদ করে ওকে নিয়ে বনে আসতে চেয়েছি। উপল অমনি এককথায় রাজি হয়ে গেল। আমি ভেতরে ভেতরে খেপে উঠেছি কিন্তু মুখ ফুটে বলতে পারিনি কিছু। এমন ঝিমিয়ে পড়া স্বভাব কেন ওর!

নিরবচ্ছিন্ন মনোযোগ ছাড়া আর কিছু তো চাইনি ওর কাছে! যেমনটা আমি ওকে  দিই তার চারভাগের একভাগ পেলেই আমি বর্তে যেতাম। এই যে এমন চিরকালের জেদ, ঘাড় ত্যাড়ামো যার সবটুকু ওর ওপর প্রয়োগ করি আজকাল, ব্যতিব্যস্ত রাখি, আমি জানি ও ক্লান্ত হয়ে যায় ভেতরে ভেতরে কোথাও। একের পর এক দীর্ঘশ্বাস জমা হয় কোনো অতলে লুকানো চৌখুপি বাক্সে। আমি জেনেশুনে ঝড় তুলি,  ক্রমাগত, অবিশ্রান্ত। যদি বাক্সটা উপচে পড়ে, যদি আগল খুলে যায়। কিন্তু খোলে নাআমি ক্রমশ বুঝে গেছি উপল আমার চেয়েও জেদী। আমি ওকে ছুঁতে যাই, ও পালিয়ে বেড়ায়। ও বোঝে না আমারও কখনো কখনো ক্লান্ত লাগে।

টানা দেড় বছর বাড়িতে বসে থেকে আমার বোধ হয় মন খারাপের অসুখ হয়ে গেছে। বন্ধুরা শুরু থেকেই বলছিল এত ভালো রেজাল্ট নিয়ে কাজ না করে বসে আছি কেন। কানেই তুলিনি ওদের কথা। আমার ঘরকন্না খুব ভালো লাগছিল। তারপর যখন মাও একই কথা বলতে শুরু করলো, আমি একদিন ঘুম ভেঙ্গে গা  ঝাড়া দিয়ে বসলাম। শুরু করলাম ছোটাছুটি। বন্ধুদের অনুমান সত্যি হলো। আমার চাকরিটা হয়ে গেলো খুব দ্রুত।

আমি জানি আমার ব্যস্ততায় উপলও স্বস্তি পেয়েছে। ওকে উৎফুল্ল হতে দেখে আমি মনে মনে কুঁকড়ে গিয়েছি। তবে কি সে সত্যিই হাঁপিয়ে গেছে? আবার মাঝেমাঝে মনে হয় আমারই ভুল। ওর আগল খুলতে চেয়ে কোনো চেষ্টা তো বাকি রাখিনি। এমনকি রক্তিমের প্রসঙ্গেও কিছুটা বলেছিলাম। সেটাই হয়ত আমাদের তার জুড়বার আগে সুরভঙ্গের কারণ হয়ে গেছে। কখনো দুমিনিট চুপ করে বসলে যখন উপল প্রশ্ন করে 'কী ভাবছো?' আমি ভীষণ অস্বস্তিতে পড়ে যাই। আর আমার ভেতরের চোরকাঁটাটা উঠতে বসতে সারাটা দিন খুঁচিয়ে যায় আমাকে। বলে - রক্তিম হলে এমনটা হতো না, ও তোকে সত্যিই ভালোবাসতো রে, ওরকম করে কেউ বাসতে পারে না, ইত্যাদি।

আমি বলি - তা হোক, আমিও তো ওর মতো করে বাসিনি, আমার তরফ থেকে যা ছিল তা যদি সমান না হয় তবে ভারসাম্য থাকতো কী করে? দুদিকের পাল্লা সমান না হলে মরতেই হয় একজনকে।

কাঁটা বলে - মরতে হয়?

আমি বলি- মরণ নয়ত কী? ওরকম দমবন্ধ করা গলাঅব্দি ভালোবাসা আমার চাই না

কাঁটা বাঁকা হাসে। বলে - তোর নিজের বেলা? এই যে এমন প্রবলভাবে জুড়ে থাকিস বরের চারপাশে?

সে আমি থাকবোই!

এই তবে বেশ আছিস বল? রক্তিমও বেশ আছে।

থাকুক সেও ভালো। ফেসবুকে ওর স্ত্রীর প্রোফাইলে ঝলমলে পারিবারিক ছবি, যুগল ছবি দেখতে আমার তো ভালোই লাগে। দোলা চৌধুরী আমার অফিসের কলিগ, ভীষণ ব্যক্তিত্ববান মেয়ে। সকালে দেখেছি দোলার সাথে ট্যুরে গিয়েছে রক্তিম। সৈকতে দাঁড়িয়ে সূর্যডুবি দেখছে ওরা।

রক্তিম ভালো আছে। শুধু আমি প্রতিদিন ক্লান্ত হচ্ছি উপলকে ছোঁব বলে। ওকে বাঁধবার চেষ্টায় প্রতিমাসে নতুন করে ছক কেটে রাখি। সেদিন বেড়াতে এসে মা বলে গেছে আকারে ইঙ্গিতে। তারও আগে থেকে আমি ভাবতে শুরু করেছি, হয়ত এটাই আমাদের বাঁধবার সুন্দরতম গ্রন্থি।

'যে আমার নতুন খেলার জন তারি এই খেলার সিংহাসন,

ভাঙারে জোড়া দেবে সে কিসের মন্তরে।'

ভোরবেলা ঘুম ভেঙ্গে গেল প্রবল অস্বস্তি নিয়ে এ অস্বস্তিটুকু খুব চেনা। পাশ ফিরে  দেখি বিছানা ফাঁকা। বোধহয় বারান্দায় আছে সে। নিচু ভলিউমে গান বাজছে ফোনে। আরো খানিকটা এপাশ ওপাশ করে খুব বিতৃষ্ণা নিয়ে বিছানা ছাড়লাম। তারচেয়ে ধীরগতিতে বাথরুমে গেলাম। যা ভেবেছি তাই। রক্তমাখা তরল গড়িয়ে পড়ছে আমার হাঁটু বেয়ে। অক্ষম কান্নায় ভেঙ্গে পড়তে পড়তে বুঝলাম এবারেও আমি হেরে যাচ্ছি উপলকে ছোঁবার দৌড়ে।

 

 

 


4 কমেন্টস্: