সমকালীন ছোটগল্প |
স্বভূমির সিঁড়িতে
আমাকে আবার সেই রক্তরাগেই সাজতে হল -সাততারার অভিজাত হোটেল। বেয়ারা, সিকিউরিটি, ফ্রন্ট ডেস্ক এ্যাটেন্ডেন্ট, বার টেন্ডার, ডেকরেটর সবাইকে নিখুঁত তালিম দেওয়া হচ্ছে। ম্যানেজার আর শেফের অস্থির আনাগোনা। বিশাল ব্যাঙ্কোয়েট হলটার মেজেতে বেলজিয়াম আয়নার চাকচিক্য। বাঁধানো সাবেক ছবির ফ্রেমে, দেওয়াল জোড়া দরজা জানলার কাচে, তেলপালিশ বার্ণিশের ওপর, সীলিং-এর অতিকায় ঝাড়লন্ঠনের ছটায় রামধনুর বিভ্রান্তি। সবাই ব্যস্ত, শঙ্কিত, তটস্থ। শহরের ওপরতলার মানুষেরা আজ আসবেন এখানে। দেশবিদেশের নানা খাদ্যসম্ভারের ঢেউ নামবে, তরঙ্গ ছুটবে রঙিন পানীয়ের, বিদেশী সুগন্ধির সন্মোহনী আকর্ষণে নাচবে স্বপ্নের আবেশ, ত্রিশহাজারী শাড়ি আর স্যূটের পাটভাঙা গন্ধে আকুল হবে ঘরের হিমেল হাওয়া।
আজ ফোটো সেশন। আসবেন বাংলা রূপালীপর্দার অপ্রতিদ্বন্দ্বী নায়ক - অনিন্দকান্তি চ্যাটার্জি, আর আমার ষষ্ঠেন্দ্রিয় বলছে, ওঁর শ্যুটিংটা হবে আমারই সঙ্গে। আমি এখন মৌন শীতলতার কঠিন আলিঙ্গনে নিশ্চুপ বসে আছি, ঠিক যেখানে বসানো হয়েছে। আমার তো কোন ডায়লগ নেই, কিছুই বলার ক্ষমতা নেই আমার।
গত বছরে স্বভূমিতে, বৈশাখের বিকেলটা মনে জ্বালা ধরাচ্ছে। সেদিনও ঐ অনিন্দ্যর সঙ্গেই ছিল আমার শ্যুটিংপর্ব। অভিনয় তো জানা আছে - তবে সেটা এরকম স্বাভাবিক হতে পারে, জানা ছিল না। অবশ্য তা না হলে কেনই বা তাঁর ছবি দেখতে হাজার মানুষের ঢেউ আছডে পড়ে? নিজের চোখেই তো দেখলাম, অভিনয় কাকে বলে!
সেদিনও এই লাল পোশাকেই তৈ্রি ছিলাম আমি। দুপুর গডিয়ে তখন বিকেল নেমেছে। লাইট, সাউন্ড, ক্যামেরা, রিফ্লেক্টর সব গাছগাছালির ফাঁক-ফোকরে রেডি হয়ে আছে। জেনারেটরটা অধৈর্য হয়ে গজরাচ্ছে। সূর্যের সোনারোদ তখন উঁচু হোটেলের বাধা টপকে, কৃষ্ণচূডার পাতা আঁচডিয়ে স্বভূমির সিঁড়িতে আলপনা কাটছে। সবাই নীরব। অপেক্ষায় উন্মুখ।
সিঁড়ি বেয়ে তরতরিয়ে নেমে এসেছিলেন অনিন্দকান্তি। ছিপছিপে বেতের মত সটান দাঁড়িয়েছিলেন চাতালের ওপর। দুধ-আলতা গায়ের রং। কপালে, নাকে ছিটেফোঁটা ঘামের আভাস। ওটা যে গ্লিসারিনের কেরামতি তা তো জানাই ছিল, তবু ঐরকম পাগল-পাগল বিধ্বস্ত মুখ আর ঐরকম খুঁজে-না-পাওয়া অসংলগ্ন বিবশ চাহনি! সেগুলোও কি মিথ্যে ছিল? আশপাশের চারাগাছ, পেছনে পাহাড়ি ছন্দের পটভূমি, লতানো গাছ আর ফুলের রঙিন পাঁপডিগুলোকে আলতো ছুঁয়ে ঐ চোখদুটো এসে থেমেছিল আমারই ওপর। জ্বলে উঠেছিল এক অপার্থিব আলো তাঁর দেবদূর্লভ মুখে। চোখের পরিপূর্ণ সম্মোহনী দৃষ্টি তখন আমার ওপর। ছুটে এসে সবাইকে উপেক্ষা করে রঙিন সমারোহের মধ্যে থেকেই তুলে ধরেছিলেন আমাকে দু’হাতের শক্ত বাঁধনে। বিদ্যুৎগতিতে নিয়ে এসেছিলেন তাঁর ভুবন মাতানো ঠোঁট দুটোর কাছে… কাছে… আরো কাছে… নি:শ্বাসের অবশ করা গন্ধে আমার স্নায়ু তখন বিকল। কানের ভেতর গমগম করে উঠেছিল মেঘমল্লার – “এতদিন কোথায় ছিলে, তৃষ্ণার শান্তি আমার?”
উফ্! বুক আমার ফেটে পড়ছিল। ভেতরে রবিশংকরের ঝালা, আল্লারাখার ঝড় আর বিরজুমহারাজের দুরন্ত গতি। ইচ্ছে করছিল চীৎকারে আকাশ বাতাস কাঁপিয়ে বলি – “এই তো আমি, তোমারই পাশে, তোমারই কাছে!” কিন্তু আমি পারছি না, মুখ ফুটে কথা বেরোচ্ছ না আমার, আসলে আমা্কে তো কথা বলার অধিকারই দেয় নি আমার সৃষ্টিকর্তা! বিবশ, নি:ঝুম আমি। ক্যামেরা তখন 'জুম' চোখে আমায় দেখছে।
হঠাৎ তাঁর
আঙ্গুলের নিষ্ঠুর চাপে আমার শীতল ওষ্ঠাধর ফাঁক করে দস্যুর মতো নিঃশেষে শুষে নিলেন
আমার ফেনায়িত যৌবনের উদ্দাম তরলতা। বলে উঠলেন
‘আ-আ-আহ্’!
পৃথিবী কি তখন থেমে গেছিল? বাইপাসের গাড়িরাও কি গতিহীন, নিস্তব্ধ হয়ে পড়েছিল? কৃষ্ণচূড়া কি অবাক বিস্ময়ে স্তব্ধ বিভ্রান্ত হয়েছিল বৈশাখের তপ্ত হাওয়ায়? বিশ হাজার ওয়াটের আলো কি আলতো করে চোখের পাতা নামিয়ে নিয়েছিল?
তারপর হাতদুটো
আলগা করে দিয়েছিলেন অনিন্দ্য। আর ঠিক তখনই আমার আবেশবিহ্বল শরীরের নিষ্পেষিত
খাঁচাটা আছডে পড়েছিল মাটিতে তাঁরই পায়ের কাছে আয়নাপালিশ জুতোর ওপরে। একবারও আর
ফিরে তাকালেন তিনি। দর্পভরে, চরম উপেক্ষায়, দৃপ্ত নায়কোচিত ভঙ্গিমায় সোজা হেঁটে
চলে গেছিলেন।
পড়ে থাকলাম
আমি একলা স্বভূমির সিঁড়িতে। অবহেলিত, উপেক্ষিত, নি:শেষিত আমি এক কোকাকোলার টিন।
বাহ, খুব ভালো লাগল। শেষের পাঞ্চটা দারুন।
উত্তরমুছুনশেষ লাইনটার ওপর পুরো গল্পটা দাঁড়িয়ে আছে.
উত্তরমুছুনভালো হয়েছে۔
অনেক ধন্যবাদ তথাগত , নীতা - পাঠকদের অভিমতটা সবসময়েই জ্বালানি স্বরূপ । ধন্যবাদ কাজলকেও , অজানা লেখককে এই পপুলার ম্যাগাজিনে সুযোগ দেবার জন্যে । ভালো থেকো সাংস্কৃতিক প্রবাহে -
মুছুন