কালিমাটি অনলাইন

দ্বাদশ বর্ষ / চতুর্থ সংখ্যা / ১২৪

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

দ্বাদশ বর্ষ / চতুর্থ সংখ্যা / ১২৪

বুধবার, ১৫ জুলাই, ২০২০

নভেরা হোসেন



কবিতার কালিমাটি ১০২


ভোর

‘আমি যামিনী তুমি শশী হে’  
রাতের শেষঘন্টা বাজলো প্রহরীরা সব ফিরতে শুরু করেছে
শিউলি বোঁটা ছাড়ছে
কমলাডাঁটার ঠোঁট নিয়ে মাটিতে শরীর বিছালো
কুলকুল স্রোতে নদী বয়ে যায়
পাখিরাও জাগছে
সূর্যের কুসুমচোখ প্রথমে কমলা
ধীরে ধীরে সিঁদুররাঙা হয়ে ফুটতে শুরু করলো
কলপাড়ে বাড়ছে লোকের আনাগোনা
এই হচ্ছে ভোর
মিলের সিটি বেজে যার শুরু
এখন সমস্ত দিন জাগিয়ে তুলবে ভোরকে
বইহাতে ভোর স্কুলে যায়
মোড়ের দোকান হতে ক্রিমরোল
শত শত গাড়ি আর বাসের ভিড়ে
হারিয়ে যেতে থাকবে সকালের নির্মলতা
ধোঁয়া আর হর্নের একটানা শব্দ মনে করিয়ে দেবে আজ সপ্তমী
দুদিন পরেই বিজয়া
সমস্তদিন শাড়ি আর পাঞ্জাবির দোকানে ঘোরাঘুরি
দুপুরে ভাতসিদ্ধ, ড্রাইফিশ
এইসব করেই ভোর শেষ হয়ে গেলো
কারখানায় বিকালের ঘন্টি
দূর দূরান্ত থেকে লোকের দল
পায়ে চাকা লাগিয়ে ছুটছে
কেউ সিনেমাহলে, পার্কে, বাজারে
কেউ বাড়ির পথে
একটু একটু করে ছাইবর্ণ হয়ে এলো সন্ধ্যার আকাশ
পশ্চিম আকাশে গায়ত্রীমন্ত্র, বিজলীর আলো
সারা শহরে আলোর ফুল
কোথাও দীর্ঘশ্বাস, প্রেমিকের অপেক্ষা
মিলনের চূড়ান্ত মুহূর্ত
সবাই একে একে পোশাক ছাড়ছে
শাড়ি, ব্লাউজ, জামা-পাজামা, প্যান্ট, শার্ট
শরীরে রাতপোশাক
রাত ঘননীল হতেই
বিছানায় কোমল হাত, শিশুর কোলাহল
এভাবে একটু একটু করে রাত নেমে এলো
চোখ থেকে খসে পড়লো চশমা
রাত শিথিল হয়ে এলো
আরেকটি ভোরের অপেক্ষায়


নো-ম্যানসল্যান্ড চিত্র

মধ্যরাতে ঘুম ভেঙে গেলে
পায়ের আঙুলে এসে ভর করে
শীতের তুহিন হাওয়া,
জ্ঞান হাতড়ে দেখি
অন্ধকার দালানের ফোঁকর
পরিত্যক্ত সিঁড়িঘর।

বহু হাজার বছর ধরে
বিকশিত পৃথিবীর পথে
মিশে গেছে
আমাদের সকল নিঃশ্বাসের ভার
অতিক্রান্ত দিনলিপি,
তারই জারিত রসে সিক্ত হয়ে
খরখরে মাটিতে
এঁকে চলেছি
নো-ম্যানসল্যান্ড চিত্র।


সন্তাপ সে তো আমার নয়

জল পতনের তরঙ্গায়নে
উৎকীর্ণ হয়ে উঠি,
কান পাতি ক্ষয়িষ্ণু দেয়ালের ভাঁজে।
নোনাধরা পাঁজরের হাড়
চুন হয়ে গলে পড়ে
ফেনিল সমুদ্রের বুকে।

অবিশ্বাসীর জ্বলজ্বলে চোখে
ক্রূরতার গ্লানি খুঁড়ে, আনি
নির্লোভ, নিষ্কাম সন্তের বাণী।
নৃশংসতার ক্ষুর বুকে চেপে
রক্তাক্ত হয়ে ভাসি
মন্থনহীন দীর্ঘ বালুকায়

সন্তাপ সে তো আমার নয়।


জীবন কড়া নাড়ছে দরজার ঐপারে

আকাশে সাদা মেঘ
জল ঝরছে, মেঘ ডাকছে
উড়ন্ত শ্বেতপায়রা
ছাদে ছাদে নয়নতারা
অনেকেই চলে যাচ্ছে
আজ চলে গেলো দুজন মন্ত্রী
গতকাল দুজন চিকিৎসক
প্রাণবন্ত যুবক
সিরাজগঞ্জে একজন কৃষক
নওগাঁয় অষ্টাদশী তরুণী
এভাবে যেতে যেতে মৃত্যু আজ তোমার দরজায়
হাতে গ্লাভস, মুখে মাস্ক
জর্জ ফ্লোয়েডও চলে গেলো
সাদা সাদা গোলাপের পাপড়ি কালো শরীরে
নিঃশ্বাস নিতে পারছো না
একটা শক্ত হাঁটু চেপে বসেছে গলার কাছে
সভ্যতার হিংস্রদাঁত
বিদ্ধ করছে নিরীহ জনপদ
আরবসাগর আজ শান্ত
ঝড়ের কোনো পূর্বাভাস নেই
তবু কলকাতার ঘরে ঘরে এমফানের বিভীষিকা
প্রকৃতি আজ নৃশংস হয়ে উঠেছে
তারও আগে মানুষ
একজন অন্যজনের উপর চেপে বসেছে
বাঁচা-মরার লড়াই
করোনার দিন একদিন শেষ হবে
ইতিহাসের পাতায় জায়গা করে নেবে
মানুষের ইতিহাসও একদিন ইতিহাস হয়ে যাবে
স্মৃতিতে অমরতা
হৃদয়ে স্পন্দন
জীবন কড়া নাড়ছে দরজার ঐপারে।







1 কমেন্টস্:

  1. নভেরা হোসেনের কবিতা পাঠে মুগ্ধ হই। তার লেখার মেধাসূধা পান করতে মগজকে তেমন কসরৎ করতে হয় না। কেমন সাবলীল ছন্দময় গতিতে কবি এগিয়ে যান চরণের পর চরণ নির্মান করে চলেন! কত কত ভাবনা, পরিস্থিতির মোকাবেলা করতে হয় তাকে তার প্রতিটি কবিতায়। কবিকে সাধুবাদ জানাই।

    উত্তরমুছুন