কালিমাটি অনলাইন

দ্বাদশ বর্ষ / চতুর্থ সংখ্যা / ১২৪

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

দ্বাদশ বর্ষ / চতুর্থ সংখ্যা / ১২৪

বৃহস্পতিবার, ৩ জানুয়ারী, ২০১৯

তুষ্টি ভট্টাচার্য




পদাবলি -



(আমি- আমি সামান্য শখের কলমচি যা ইচ্ছে হয় তাই লিখি আর কী! আমার লেখার পাঠক খুবই কম যদিও বড় বড় সাহিত্য সভায় আমাকে পাবেন না পুরস্কারের বদলে তিরস্কারই পাই বরং মনের দুঃখে ইচ্ছে জেগেছে পদাকে নিয়ে লিখতে যদি যুগান্তকারী কিছু লেখা হয়ে যায়, অন্তত পদার নাম করে 

  পদা— পদাকে আমি ছোটবেলা থেকেই চিনি। আমারই বয়সী বলে ওকে আমার বন্ধু ভাববেন না। গরীব নয়, কিন্তু গরীব সেজে থাকে। বিচ্ছিরি রকম ড্রেস সেন্স, হয় পাজামার ওপরে টিশার্ট, নয় লুঙ্গির ওপরে ফুল শার্ট! আর পায়ে হয় কাপড়ের জুতো নয় প্লাস্টিকের চটি। সময়ে অসময়ে হুটহাট আবির্ভূত হয়। আমাদের সম্পর্ক আদায়-কাঁচকলায়। কথাবার্তার টপিক বিবিধ ভারতী থেকে বিলিতি আমড়া পর্যন্ত। গায়ে পড়ে এসে পিত্তি জ্বলানো কথা বলে। আমিও মাঝে মাঝে ওকে কিছু নিরীহ প্রশ্ন করে থাকি।

  মাদাম তুভোঁ— আদপে ফরাসী হলেও এদেশের বাসিন্দা, রঙ জন্মসূত্রে সাদাই ছিল। এখন তাঁর তামাটে মোটা চামড়ায় খসখসে খড়ির দাগ। অত্যন্ত নাক উঁচু টাইপের। এবং জ্ঞানদা। এঁর কথা অর্থাৎ বাণী না শুনলে আমার আর পদার সম্পর্কটা ঠিক খোলসা হবে না। ইনি সঙ্কটপূর্ণ অবস্থায় এসে বাণী বিতরণ করে আমাদের আরও বিপাকে ফেলে প্রস্থান করেন।)



  

এই পদাবলির শুরু ২০১৮র ফুটবল ওয়ার্ল্ড কাপের সময়ে বাঙালি বোধহয় সাতজন্ম চেষ্টা করলেও ওয়ার্ল্ড কাপে কোয়ালিফাই করতে পারবে না আর। ক্রিকেট নিয়ে তবু এক আধটা বাঙালিকে খুঁজে পাওয়া যায়। ভারত অবশ্য ক্রিকেটে আছে, ভীষণ ভাবেই আছে। তাই বাঙালির বাচ্চারা আজকাল ফুটবল না শিখে ক্রিকেট কোচিং-এ ভর্তি হয়। যদি অন্তত একটা আইপিএল-এ চান্স হয়! ফুটবল ব্রাত্য থাকে। আবার থাকেও না! লিগ শুরু হলে শোনা যায় চিৎকার। আর এখন, এই ওয়ার্ল্ড কাপের সময়ে কোন দেশ খেলুক আর নাই খেলুক, বাঙালি ফুটবল খেলবেই। না না, ভারতের হয়ে নয়। ব্রাজিল, আর্জেন্টিনা, জার্মানি, উরুগুয়ে, স্পেন, নিদেন পক্ষে ইতালি। বাঙালির মত বিশ্ব নাগরিক আর আছে কেউ? এখন কী মোদের চুলের ছাঁট, কী মোদের জার্সির বাহার! একেক জন একেকটি দেশ যেন! পাবে আর কেউ কোন জাতিকে এমন খ্যাপামি করতে দেখতে? আর শুধু ফুটবলই বা কেন, বিভিন্ন ক্ষেত্রে দেখেছি, এত যে বাঙালির দোষ ত্রুটি, বাঙালিত্ব হারিয়ে ফেলা, ইত্যাদি নিয়ে এত ক্ষোভ, শুধু এই প্যাশনটি এখনো টিকে থেকে আর পাঁচজনের থেকে বাঙালিকে আলাদা করেছে। মূর্খতাই বল আর যাই বল!

এইরকম ফুটবল ম্যানিয়ার সময়ে একদিন পদা হাজির হল। খেলা নিয়ে চারিদিকে এত তুমুল হৈচৈ চলছে অথচ আমি বুঝে উঠতে পারিনি কোন দলকে সাপোর্ট করব আর কোন দলই বা সেরা অথবা বিজয়ী হবে। তাই পদা আসা মাত্র ওকে নিরীহ মুখ করে জিজ্ঞেস করলাম, ‘ভাল খেলা কাকে বলে রে পদা?’ ব্যাস্‌! আগুনে যেন ঘি পড়ল। উল্টে আমাকেই জিজ্ঞেস করল, ‘ভাল লেখা কাকে বলে রে?’ আমি মিনমিন করে কিছু বলার চেষ্টা করছি লেখার গুরুত্ব নিয়ে। বলতে চাইছিলাম আসলে ওভাবে কী আর ভাল লেখা কাকে বলে বলা যায়! ভাল’র কী আর মাপকাঠি আছে রে! যদিও বলার আগেই এসবের মধ্যে দিয়ে না গিয়ে ও সরাসরি রাস্তায় দাঁড়িয়ে চিৎকার করে আমাকে উদ্দেশ্য করে বলল, ‘মেসি ম্যাসাকার আজও হবে। দেখে নিও জনগণ




এদিকে বাঙালিদের বেশির ভাগই মেসি ভক্ত। পদার এ হেন বাণী শুনে উল্টে না পাবলিকই আমাকে মারতে আসে – এই ভয়ে দরজা জানলা বন্ধ করে সে রাতটুকু কাটিয়ে দিলাম। পরের দিন যথারীতি পদার দৈববাণী ফলে যাওয়ায় শোকের আবহাওয়া চলছে। এরই মধ্যে যথাসম্ভব দুঃখী দুঃখী মুখ করে বেরোলাম। বেরিয়ে  দেখলাম আবহাওয়া ধীরে ধীরে উন্নতি হচ্ছে। তার মানে আমি এখন সেফ্‌। যাক বাবা! বাড়ি ফিরেই দেখি হতভাগাটা আবার এসেছে। ওকে বললাম, ‘মেসি ভক্তদের হাত থেকে বেঁচে গেলাম এযাত্রা। আজ ব্রাজিল ভক্তদেরও বাঁচিয়ে দিস রে পদা! হ্যাঁ, জার্মান ফ্যান গুলোকেও। কাউকে মনে দুক্কু দিতে নেই রে!’ পদা দেখলাম বেশ প্রসন্ন মুখে জাবর কাটছে। চালছোলা ভাজা কিনেছিল নাকি দু’টাকার। দু’ঘন্টা হয়ে  গেল এখনও চিবিয়ে যাচ্ছে। একে জাবর কাটা ছাড়া আমি আর কীই বা বলব! ওকে বসিয়ে রেখে আমি বাথরুমে ঢুকলাম স্নান করতে। আর স্নানে গিয়ে কোন বাঙালি না গান গায়? ফলে আপনমনে গলা ছেড়েছিলাম-  'মেনেছি গোওওওও হার মেএএএনেছিইই...’ এদিকে ততক্ষণে যা হওয়ার হয়ে গেছে জার্মানি গো হারান  হেরেছে সে তো আর আমি জানতে পারি নাই!  

যেই বাথরুম থেকে বেরিয়েছি, ওমনি পদা কষে এক ধমক দিল। 'ছিঃ! তোর লজ্জা করে না? হার মানি বলছিস! harmony বল harmony! 'আমিও জিভ কেটে বললাম শান্তি, শান্তি, শান্তিতারপরেও ভয় গেল না। পদাকে জিজ্ঞেস না করে আর পারলাম না! বললাম, 'হ্যাঁ রে, এরপরও যদি আমায় মার মার করে তেড়ে আসে?' পদা দার্শনিকের মত চোখ উলটে বলল, 'নেই মার দে ওদের।'

ইতিমধ্যে বাড়ির বাইরে লাঠির শব্দ শোনা গেল। বোঝা গেল মাদাম তুভোঁর আবির্ভাব হইয়াছে। দরজা খুলিয়া দেখিলাম- প্রবল কাশির দমক সামলাইতে সামলাইতে এক দলা গয়ের নিক্ষেপ প্রবণ তাঁহার মুখমণ্ডলী। দর্শন কাহাকে কয়, প্রশ্ন আসিল মনে তৎক্ষণাৎ। প্রশ্ন গিলিয়া লইলাম নিরাসক্ত ভাবে। বুঝিলাম, ইহার পর আমার বা হতচ্ছাড়া পদার আর কোন ভূমিকা থাকিবে না, শ্রোতা ব্যতীত। শ্রবণেচ্ছা সঞ্চয় করিয়া তাঁহাকে বাটিতে আমন্ত্রণ করিলাম। আমন্ত্রণ এক্ষণে অধিকন্তু। তিনি সবলে প্রবেশ করিতেনই দরোজা দিয়া। কৌচে উপনিবেশ করিয়া তিনি বারকয়েক কাশিয়া, কন্ঠা ঝাঁকাইয়া অবশেষে বলিলেন— ‘খেলা আর লেখা, লেখা আর খেলা দুইই সমান। খেলা লেখা হয় মাঝমাঠে। আর লেখা খেলা হয় খাতার মাঝখানে। এই দুইই যে আয়ত্ব করতে পারবে, সেই লিখিয়ে, সেই খেলুড়ে। মোদ্দা কথা, মাইক্রোফোনের সামনে দাঁড়ানো যাঁর ছবি আমরা দেখব, তিনিই কবি, তিনিই লেখক, আর তিনিই খেলোয়াড় ইহার পরে পদাকে আর খুঁজিয়া পাওয়া যাইল না যথারীতি। আর আমিও উপায়ান্তর নাই দেখিয়া পুনরায় কলঘরে পতিত হইলাম।



                                       
                        


4 কমেন্টস্: