মেয়েখেলা (পর্ব - ১৫)
পাব্লিক প্লেসে, মার্কেটিং বা যাতায়তের পথে কয়েকটি বাক্য পাঁচালির মতো শুনে
অভ্যাস হয়ে যায় মহিলাদের। আপনি চাকরি করেন? স্কুলে হলে অবধারিত প্রশ্ন, হাইস্কুল
না প্রাইমারী? অন্য ডিপার্টমেন্ট হলে তৎক্ষণাৎ
প্রশ্ন, বিবাহিত? স্বামী কী করেন? যদি স্বামী কর্মসূত্রে বাইরে থাকেন, তবে প্রশ্নকর্তা কী গভীর মায়ায় ও আবেগে উদাস হয়ে পড়েন! আফসোস করে ওঠেন, ওহ! মহিলা
থাকবে সংসারে আর স্বামীর উপস্থিতি ছাড়া সংসার তো রইল না, মানে আপনি হাফ বিধবা হয়েও
হাতে শাঁখা আর পলা পড়ে বা চিহ্ন ধারণ করে
জানান দিয়ে যাচ্ছেন! কোথায় আছে সেটাই মেইন ফোকাস। আপনার বেডরুম যা থেকে আপনি
প্রত্যহ উঠে আসেন সেটা কি ফাঁকা শয্যা নাকি স্বামীর অনুপস্থিতিতে আপনি বিচলিত! যদি
বিচলিত না হন তবে আপনার সতীত্বের কুণ্ডলী মাঠে মারা পড়বে। হাসতে হাসতে নির্লজ্জ উর্বশী ক্যাটাগরিতে আপনার জায়গা পাক্কা। যদি
আপনি স্বামী নিয়ে সদা বিলাপ করেন তবে আপনি কল্যাণী মানে গৃহলক্ষ্মী ক্যাটাগরি। সমাজে
আপনি উদাহরণযোগ্য আদর্শ। চর্চা চলবে – অমুককে দেখেছেন? স্বামী থাকে
না, একহাতে বাজারঘাট সব করে, কাজে যায়, কোনোদিন কোনো গেষ্ট দেখা যায়
না বাড়িতে, সব সময় মাথা নিচু করে চলে। দেশের
সম্পদ দীপা, সাক্ষীরও এত পাবলিক ভ্যালু
নেই। ‘ভালো’ মহিলা এতটা
গর্বের! পুরুষের আগে কোনো অ্যাডজেক্টিভ বেমানান, কিন্তু মেয়ে কখনোই কোনো বয়সেই স্বয়ংসম্পূর্ণ হয়ে
উঠতে পারেনি। আসলে জীবনে সবরকম আইসোলেসনের কাছে আত্মসমর্পণ করা মেয়েরাই অপ্রতিবাদী, নম্র। এই সার্টিফিকেট প্রাইসলেস। কোনো বিশ্ববিদ্যালয়
শংসাপত্র বা বিশেষ মানপত্রের সাথে তা কম্পিট করতে ব্যর্থ।
পরিবারিক বৈষম্য, পাড়ার ছেলেদের টিজিং, প্রেমিকের শয়তানি, স্বামীর
ব্যাভিচার, ছেলের স্বেচ্ছাচার, মেয়ের স্বাধীনতাহীনতা সব যখন সে একাধারে গোপনে সহন করতে
পারে, তখন সে মহীয়সী মানে দাম্পত্যের
সারভাইভ্যাল অফ দ্য ফিটেষ্ট পরীক্ষায় সাফল্যের সাথে উত্তীর্ণ। তারপর মরেও সুখ। ফটো দেখে উত্তরসূরীরা বলবে, মা শিক্ষিত ছিলেন কিন্তু চাকরির জন্য
কোনোদিন জেদ করেন নি! স্বামী, রান্নাঘর, সংসার তাঁর বেশি পছন্দ ছিল। বাবা তো বাড়িতে সময় দিতে
পারতেন না, কিন্তু তাঁর কোনও অভিযোগ ছিল না। ব্যাস স্মৃতিচারণার পর ফ্রেমে আবার
টকটকে প্লাস্টিক মালা পড়বে। কেউ জানল না, সেই মা একা মরলেন নাকি পরিবারের অনেক মেয়েকেই মেরে গেলেন
নিজের নারীত্বের, মাতৃত্বের
সর্বপরি অস্ত্বিত্বের জায়গাটা নড়বড়ে রেখে দিয়ে। নড়বড়ে সেই ভিতে আজও ইমারত গড়তে
পারল না মেয়েরা। মধ্যযুগীয় পারিবারিক দাসত্বের কন্সেপ্ট থেকে ছুটি তারা পেল না। মেয়েদের
সবচেয়ে বড় সমস্যা তারা স্বপ্ন দেখে ঠিকই, কিন্তু নিজেদের নিয়ে নয়। কেন্দ্রে সমাজ, বিবাহ, দাম্পত্য, সন্তান পালন, সংস্কার রেখে সে নিজে কম্পাস হয়ে বৃত্ত রচনা করে, তারপর নিজে আর ব্যাসার্ধের মধ্যে ঢুকতে পারে না। আউটার লেয়ারে
থেকে পুরো পরিধি সুরক্ষিত করার দায় সে মাথায় তুলে নেয় বা বাধ্য হয়। এই বাধ্যতা
থেকে মুক্তি মেলেনি মেয়েদের। মানুষের মতো ব্যবহার করতে গেলেই সে লাঞ্ছিত ও
বিচ্ছিন্ন। পোশাকের স্বাধীনতা তার নেই, রাজনীতিতে তাদের সংখ্যার আধিক্য নেই, অন্যান্য উচ্চপদে তারা সীমিত। কিন্তু দাম্পত্যে, সংসারে তারা এখনো চ্যাম্পিয়ন। সেটাই তাদের কম্ফোর্ট জোন। মেয়েদের যেটা মানায়
সেটাতেই হয়তো তারা বিস্তার ঘটিয়ে চলেছে নিজেদের আবহমান কাল ধরে। শিক্ষিত পুরুষরাও
মাঝে মধ্যে বলে থাকেন একবিংশ শতকের হিউম্যানিজিমের গালভরা স্লোগানের ফাঁকে যে, স্ত্রী বলছিল মেয়েদের শাসন রাখতে গেলে মাঝেমধ্যে মার জরুরী।
মেয়েরাই তো বলছে মেয়েদের মারা যেতে পারে, তবে পুরুষের আর কি দোষ! একদম খাঁটি কথা। সমাজ
যা শেখায় বলায়, তাই পুরুষের সিলেবাস। কোনো চাকুরিরতা মেয়ে অবিবাহিত ও নরম মেজাজের
না হলে তারাই ঘোষণা দিয়ে দেয়, বিয়ে না হবার কারণে সে খিটখিটে। স্বামীর মৃত্যুর পর সাজ না বদলালে
তারাই দেগে দেয় চারিত্রিক রহস্যের তত্ত্ব। নইলে বাড়ির মহিলাদের দিয়ে সাবধান করানো
হয়, এটা করা চলবে না! বাড়ির একটা সম্মান আছে বাইরে! সম্মানের ঠেকা চিরকাল মেয়েদের
কাছে রেফার করা হয়ে আসছে। শুধু তাই নয় বাচ্চার চরিত্র ও শিক্ষা মায়ের ক্রেডেলে, কোলে, হাঁটুতে ফেলে
দিয়ে রেহাই নিয়েছে সমাজ। সেখানে পুরুষের ক্লিনচিট।
ছেলেমেয়ের বিরুদ্ধাচারণের
অভিযোগে বাবার নামটির ডাক পড়ে মাত্র, কিন্তু আসলে বাড়িতে যিনি সর্বক্ষণের কর্মী সেই মায়ের দিকে নিশানা
সাধা হয়। মা কী করে সারাদিন, বাড়িতে কথাটা
মুখে এসে পড়ে সব্বার। চেহারায় যথাযথ না হতে পারার কারণে পরিবারকে বিয়েতে কনসেসন এনে না দিতে পারা অপরাধী
মেয়ে মা হয়েও রেহাই পায় না। বাবার পেনসনের টাকা ফুরানোর নিঃস্বতা ও ভাইদাদা-বোনের
একগুচ্ছ অভিমান, সব টাকা দিদির বিয়েতেই গেল
এই অভিশাপ নিয়ে সে বাড়ি ছাড়ে। নতুন বাড়িতে আবার
কড়ায় গণ্ডায় হিসেব বোঝানোর চাপ, তারপর ক্রোমোজোমের তথাকথিত দায় মেটানোর পর সে দেখে,
যার হাত ধরে সে বাড়ি ছেড়েছে, সেই মানুষটি আসলে তার বন্ধু বা সহযোদ্ধা কম, বরং পুরুষ বেশি। এবার বিধাতার নির্মিত আধেক
ফুটো আকাশ পুরোপুরি মাথায় ভেঙেই পড়ে তার। অচিরেই চেয়ে দেখে তার চুল বিবর্ণ হচ্ছে, মুখে ষ্ট্রাগলের ছাপ। নিজের সাথে নিজের আন-অফসিয়াল ওয়ারে
সে ক্লান্ত, কিন্তু পলাতক নয়। তার আকাশে সে একটিই ধ্রুবতারা দেখে, সন্তান, যা ছাড়া কিচ্ছুটি নেই তার নিজের। নিয়ন্ত্রকের ভূমিকায়
তার সব অনুভব, চেতনা, শুধু মাতৃত্বটুকুর কাছে
সে বড্ড অসহায়। জীবনে প্রথম প্রেমের মতো নিজেকে উজাড় করে নিঃস্ব, তবু সম্পূর্ণ।
খুব ভালো লেখা, বাস্তব। সমস্যা রয়েছে, সমাধানের রাস্তা আগামীতে নিশ্চয়ই পাব।
উত্তরমুছুন