বৃত্ত
ঈশ্বরী দাঁতহীন মুখে হাসছেন। কে
বা কারা দু’দিন আগে ঈশ্বরীর ডানা ধরে টেনে
এনে বসিয়ে রেখে গেছে এই পাকুড় গাছের নিচে। সকালে স্কুলে যাওয়ার পথে সেই চোখাচোখি, তারপর বাড়ির বারান্দা থেকে কয়েকবার ঘুরে ফিরে লক্ষ্য করা
গেছে,
আশপাশে দিয়ে যারা যাচ্ছেন প্রণাম ছুঁড়ে দেওয়া তো দূর বাক্য, এই সৃষ্টির ধারক কর্ত্রী যিনি, তিনি আর সামান্য মানুষের দৃষ্টিপাতেই আসছেন না। ঠাম্মাকে
বলতেই কোন অদৃষ্টের উদ্দেশ্য দু’হাত মাথায় ঠেকিয়ে বল্লেন “ও যে বাসিঠাকুর রে”... ঠাকুর... আবার বাসি? বেচারি দুই দিন ধরে বসে আছেন ঠাঁয় এইভাবে, তায় গত রাতের ঝড়জলের পর কাজলপড়া চোখ ধেবড়ে, ঘামতেল গলে ঝরে পড়েছে রঙের পাপড়ি, চুলের নক্সা ঘেঁটে খানিক দানবীপ্রায় হয়ে উঠেছেন। তার হাতেই
তো বিশ্ব-ব্রহ্মান্ড থর থর, অথচ তথাস্তু
মুদ্রার সৌখিন আঙুল ভেঙেচুরে জবজবে কাদামাটি, বিসদৃশ পুত্তলিকা। তবুও ঈশ্বরী হাসছেন। একই রকমভাবে... দাঁতহীন মুখে।
পাকুড় গাছের নিচেই দিনরাত গবা
পাগলার থান। ঈশ্বরীর মতোই দাঁতহীন মুখে সেও উদয়াস্ত হেসে চলে। তবে মানতেই হবে
ঈশ্বরের প্রভূত ক্ষমতা তার কব্জিতে। সে ঠোঁট উল্টিয়ে চুপিচুপি বলে, “ঝড়জল থেকে নিজেকে বাঁচাতে পারলি নে! তুই ক্যামনে ঈশ্বরী? আবার এই মাটির জগৎ তুই নাকি রক্ষা করিস? দূর হ দূর হ পোড়ারমুখী”। দূর থেকে দেখি, ঘোষ পাড়ার মোচ্ছবের থেকে আনা শালপাতায় মোড়া খিচুড়ি খেতে
খেতে গবা ঈশ্বরীর ঝুলে পড়া রঙহীন ঠোঁটে গুঁজে দিতে থাকে পরমস্নেহে। অর্ধেক খসে পড়া
খিচুড়ি মুখে তখনো দেবী দাঁতহীন হেসে চলেন বিশ্ব-সংসারের দিকে চেয়ে। একসাথে
খাওয়া-বসায় গবার বোধহয় মায়া পড়ে গিয়েছিল। সেদিন স্কুল ফেরতা পথে দেখা গেল ঈশ্বরী
ধীরে ধীরে সমাধি নিচ্ছেন। মাটির সাথে মাটি মিলেমিশে একাকার। গবা মাটি আগলে কাঁদছে, ঠিক সন্তান হারাবার বেদনায়। কয়েকদিন পরে পাকুড়ের পায়ের নিচে
ওই ঈশ্বরীমাটির ঢিপিতে এক তরতাজা তুলসীর চারা। আহা! হাওয়ায় দোল খায়। পাড়ার ভুলু
বোধহয় তক্কে তক্কেই ছিলো, লেজ নাড়িয়ে
ঠ্যাং তুলে মুতে দিয়ে গেল ঈশ্বরীর মাথায়। আমরা সামান্য প্রাণী, সব সয়ে গেলে বয়ে যায়, কিন্তু গবা তো আমাদের অতিমানবীয় প্রাণ। গবা বাখারি নিয়ে তেড়ে যায় ভুলোর দিকে
আর গালি দিতে থাকে, “শালার ঠাকুর
তুই নিজের রক্ষা পারিসনে, এয়েচিস
মানুষের মাতায় চড়তে!”
হঠাৎ দেখি উলু, কাঁসরের ধ্বনি। ওই পাকুড়তলা দিয়েই সুসজ্জিত ঈশ্বরী আসছেন
একই ভাবে দাঁতহীন মুখে হাসতে হাসতে বিধুভূষণের মাথায় চড়ে। বউ-মেয়েরা সামনে ছড়াচ্ছে
গঙ্গাধারা আর ফুটেফুটে সাদা খই। দেবী আসছেন। গবা পাগলার মনে বড়ই ফূর্তি ধরেছে, সে ওই ঢাকের তালে নেচে চলেছে। আজ তো বিধুকাকার বাড়ি
লক্ষ্মীপূজো, দেখেছেন মনেই ছিল না!
আপনারা এই লেখাটা পড়ুন, টুক করে টাটকা
ঠাকুরের আশীর্বাদ নিয়েই ফিরছি।
ভালো লাগল রে
উত্তরমুছুনভাল লাাগল
উত্তরমুছুনভাল লাাগল
উত্তরমুছুন