কালিমাটি অনলাইন

দ্বাদশ বর্ষ / চতুর্থ সংখ্যা / ১২৪

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

দ্বাদশ বর্ষ / চতুর্থ সংখ্যা / ১২৪

রবিবার, ২৬ জুলাই, ২০১৫

তুষ্টি ভট্টাচার্য্য

আমি ও পাগলি 





এরকম হওয়ার কথা ছিল না অথচ হয়েছে এই যে আমি, আমারই কী এমন অদ্ভুতুড়ে, মতিচ্ছন্ন, উদাসীন হওয়ার কথা ছিল! বেশ তো মেপেজুপে জন্মেছিলাম দিব্যি সেয়ানা হয়ে যেতাম কিন্তু হতে হতেও হলাম না নিজেরই খুব অবাক লাগে কথায় বলে পাগলেও আপনা বুঝ বোঝে তাহলে নিশ্চয়ই আমি পাগল না কিন্তু আমি সবসময়েই দেখতে পাই আমার ভেতরে এক দিব্যকান্তি পাগলি বসে রয়েছে, আর কখনও হিহি করে হাসছে, কখনও খুনখুন করে কাঁদছে আমি খামোখাই রেগে উঠি এক একসময়ে, সেসময়ে কিন্তু রাগার কথা না আমার রাগ দেখে পাগলিটা খিকখিক করে হাসে, আমি দেখতে পাই আমি আরও রেগে যাই, কিন্তু অন্যরা তখন আমায় ভুল বোঝে, ভাবে কী খিটিয়াল, দজ্জাল মাইরি!

এরকম পরিস্থিতির পরে খুব বেজার হয়ে থাকি মুখটা নিমপাতার মতো লাগে আয়না দেখা ছেড়ে দিয়েছি সেই কবেই, তবু বুঝতে পারি এইসময়ে কেন কে জানে পাগলিটাও চুপ মেরে যায় আফিম খেয়ে ঝিমোয় মনে হয় একসময়ে আমিও ওর দেখাদেখি চুপ করে যাই অনুভব করতে থাকি শব্দের ঝংকার    একসময়ে ঝালা পার করে আরও তীব্র হয়ে ওঠে আশেপাশের শব্দেরা কানে আঙুল দিই চুপ থাকতে থাকতে বোর হয়ে উঠি তখন হঠাৎ যেন বিকট হাই তোলার আওয়াজ করে কেউ বুঝি, পাগলির ঝিমুনি কেটেছে এবার ঘুম ভেঙেই ও মোক্ষম এক চিমটি কাটে আমায়উঃকরে উঠি, আমার মৌনি ভাঙে, আর তাই দেখে পাগলি আবার তার বিচ্ছিরি হাসিটা হাসতে শুরু করে আর বসে না থেকে বকেয়া কাজগুলো সেরে ফেলতে চলে যাই বেশ লাগে একমনে কাজ করে যেতে সব ভুলে যাই নিজেকেও আর মনে থাকে না এ এক অন্যদেশ, এই কাজের দেশ বড় ভুলভুলাইয়ায় ভরা, বড় গোলকধাঁধা এখানে একবার ঢুকে গেলে বেরিয়ে যাওয়া খুব মুশকিল তবু বেশ লাগে, কেমন যেন লুকোচুরি খেলার মতো  লাগে আমি নিজকে লুকিয়ে ফেলি এই দেশে, আর পাগলিটা আমায় তন্ন তন্ন করে খোঁজে আমি নিঃশব্দে বলতে থাকি, ‘আমায় ধরতে পারেএএএএ না...’ 

কিন্তু ওই যে বলেছি, আমি পাগল না, আবার সেয়ানাও না, এর মাঝামাঝি  কোনো অজানা গোত্রে পড়ি তাই বোধহয় পাগলিটাকে খোঁচাতে ইচ্ছে করেকুউউডাক দিই, পাগলি হাজির হয়ে আমার চুলের মুঠি ধরে সজোরে নাড়িয়ে দেয় ওর মাথা থেকে কতগুলো উকুন বেয়ে উঠে পড়ে আমার চুলে আমিও খসখস করে মাথা চুলকোই আমার চুলগুলো ওর মতোই এলোমেলো হয়ে যায় এত   চুলকুনি আসে যে চুলকোতে চুলকোতে আমার মুখ থেকে লালা গড়িয়ে পড়ে চোখদুটো কোটর থেকে বেরিয়ে আসতে চায় আমাকেও বীভৎস দেখতে লাগে  পাগলিটা তখন আমায় নিজের মনে করে জড়িয়ে ধরে আমি ওর ছেঁড়া কাপড় থেকে টোকো দুধের গন্ধ পাই, কেমন যেন গা গুলিয়ে উঠে বমি পায় মুখে হাত দিয়ে কোনোরকমে বমি সামলে তখন আমি আবার দে ছুট স্নান-টান সেরে আমি  আবার ফিটফাট, সেয়ানা হতে চেষ্টা করি

সারাদিনের হিসেব নিয়ে বসি কত খরচা হলো আর কত রোজগার, কেমন গুলিয়ে  যেতে থাকে খরচের বহরই বেশি, এটুকু নিশ্চিত বুঝে গুটিয়ে ফেলি খাতা খরচ তো হবারই ছিল এত কেনাকাটা সারাদিন ধরে, কত কিছু যে প্রয়োজন আমার! সব কিনে ফেলি একে একে কেনাটা যেন এক খেলা আমার একটার বদলে দুটো রুটি কিনি, একটা পচে যায় নষ্ট হয়, নষ্ট করে ফেলি কত কিছুই আর হু হু করে খরচ বেড়ে যায় মাসের শেষে ধার করি, মাসের প্রথমে মেটাই, সেই শুরু হয় ঘাটতির কেন যে কিছু গুছিয়ে উঠতে পারি না! দরকারের সময়ে দরকারের জিনিস খুঁজে পাই না আমার সব হারিয়ে যায় কেমন বেমালুম হারাতে হারাতে কেমন যেন গা সয়ে গেছে আজকাল হারানোর কষ্টটাও চামড়ায় বেঁধে না দিব্যি ফ্যা ফ্যা করে ঘুরি, পাওনাদারের তাগাদা থেকে বাঁচতে কত যে নাটক করি! পেশাদার নাটকে কাজ পেলে তবু না হয় কিছু হিল্লে হতো আমার আমার কোনো  হিল্লে হয় না পাগলিটা তাই দেখে রাগে গরগর করে, দাঁত কিড়মিড় করে আমি ভয় পেয়ে চোখ বুজে ফেলি আর নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে পড়ি তারপর
আবারও বলি, যেহেতু পাগল নই, আমার জলে ভয় নেই জল, বৃষ্টি, নদীকে আমি হাত দিয়ে ছুঁয়েছি অনেকবার আমার হাতে ফোস্কা পড়ে নি কখনই আমি শীতল থেকে আরও শীতল হয়ে যাই শান্ত হয়ে হাঁটু গেড়ে বসি লক্ষ্মী মেয়ের মতো  আমার মাথায় তখন গুনগুন করে কেমন একটা অচেনা সুর ধাক্কা খায় কান খাড়া করে শুনতে গেলে, কিছুই শুনতে পাই না বুঝতে পারি না এটা কোনো সুর  নাকি জল পড়ার শব্দ টিপটিপ করে যেন জল পড়েই চলেছে কোথা থেকে, ট্যাঙ্ক খালি হয়ে যাচ্ছে ক্রমশ পাম্পের ঘরে তালা বন্ধ, মালিক কোথায় কেউ জানে না এই ট্যাঙ্ক খালি হয়ে গেলে, জল শূন্য হয়ে পড়বে এই শহর তখন তৃষ্ণা মেটাতে গেলে বৃষ্টির অপেক্ষায় থাকতে হবে, কিম্বা নদীর কাছে যেতে হবে কিন্তু খরার সময়ে? আকাশ মেঘশূন্য, নদীর বুকে জল শুকিয়ে পলি, তখন কী হবে? ওই পাম্পের ঘরের তালা ভেঙে ফেলা ছাড়া আর কোনো পথ নেই এই তো কেমন  সেয়ানার মতো বুদ্ধি খেলে যাচ্ছে মাথায়! কিন্তু তালা ভাঙার সময়ে যদি মালিক  ফিরে আসে আর চোর অপবাদ দেয়? থাক, তাহলে অনধিকার প্রবেশ নাই বা করলাম তার চেয়ে ছাতি ফেটে মরে যাই চাতকের মতো আকাশের দিকে তাকিয়ে হা জল হা বৃষ্টি বলতে বলতে প্রাণ বেরিয়ে যাক  

এইসব ভাবনার মধ্যে ডুবে গিয়ে পাগলিটাকে ভুলে গেছিলাম কেমন! মৃত্যুর কথা মাথায় এলো বলে, পাগলি আবার মাথা চাড়া দিল আমাকে টেনে একটা চড় কষিয়ে দিল বেমালুম আমি হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে থাকলাম কিছুক্ষণ তারপর বুঝলাম, এই পাগলি সেয়ানা বড়! আমি মরে গেলে যে ওকেও মরতে হবে! তাই এই চড়! তবে কাজ হয়েছে কিছুটা আপাতততৃষ্ণায় মৃত্যুএই হেডিংটা আসবে না কোনো কাগজের সাতের পাতায় খুদে অক্ষরে এবার আর কো্নো টিপটিপ সুর  নয়, সত্যি গান চালিয়ে দিলাম মনটা বেশ হালকা হয়ে আসছে, পাগলিও রাগ ভুলে খুনখুন করে কাঁদছে দেখছি! আহা কাঁদুক একটু কান্না ভালো ওরও তো পাগল-মন আছে একটা পাগল-কান্নাও আছে তার কাঁদুক না হয় এই অসময়ে সময়ের কান্না আমার জন্য তোলা থাক পাগলিকে কাঁদতে দিয়ে গান চালিয়ে রেখে আমি বারান্দায় এসে দাঁড়ালাম। 




বারান্দাটা আগে ঠিকই ছিল বয়সের ভারে এখন কেমন ধুঁকছে সব সময়ে পিলারে ফাটল ধরেছে, মেঝের টালিতে চিড় ধরেছে একটু যেন হেলেও গেছে! তবে যেমনই হোক না কেন, এখনও টিঁকে আছে আর আমি আজও দাঁড়িয়ে থাকতে পারছি এই বারান্দায় এখনও খোলা হাওয়ায় মন ভালো হয়ে যায় দুচোখের ভেতরে স্বপ্নের ডিম পারে কোনো প্রজাপতি আর ওই ডিম থেকে এক  ঝাঁক প্রজাপতির জন্ম দেখার জন্য এখনও আমি এই বারান্দায় এসে দাঁড়াই আমার পাগলিটারও এখানে এলে মন ভালো হয়ে যায় দেখেছি ও খুব শান্ত হয়ে যায় কখনও আবার গুনগুন করে গান গাইতে দেখা যায় ওকে অনেক তো ধারদেনা হলো, না হয় আরেকটু বাড়বে, এবার বারান্দাটা সারিয়ে ফেলতে হবে ফিটফাট, চকচকে হলে বারান্দার কদর আরও বাড়বে ঝলমলে নতুনের আকর্ষণ যতই হোক এড়ানো যায় না তখন নিশ্চয়ই এখানে অনেক পাখি এসে বসবে, তাদের গান  শুনিয়ে যাবে ভোরবেলা টবে লাগানো সবুজ সবুজ গাছ, আমরা গেলেই সাদরে অভ্যর্থনা জানাবে আচ্ছা, মানুষ পুরনো হলে এভাবে রাঙিয়ে নেওয়া যায় না!       
          

   

2 কমেন্টস্: