চক্রব্যুহ
কানে মোবাইল ধরতেই ওপার থেকে ভেসে আসে অচেনা কণ্ঠস্বর। রেশমি
বলে, মানে বাড়িটা ঠিক খুঁজে পাচ্ছি না। দাদাকে একটু দিন না!
সঙ্গে সঙ্গে হাত বদল, পুরনো চেনা স্বরটি বলে উঠে, একটা স্কুল দেখতে পাচ্ছেন? দেখুন
তার পাশ দিয়ে সোজা একটা সরু গলি, তার দক্ষিণ দিকে একটা হলুদ... কথা শেষ না হতেই
রেশমি দেখে সামনে একটি মেয়ে সেজেগুজে একা হেঁটে যাচ্ছে। কোনো কথা না বাড়িয়ে
সে তার পিছু হাঁটতে থাকে। সে নিশ্চিত এই সেই মেয়ে। আজ তার সন্দেহ নিরসনের
শেষ রাত। বড় রাস্তার আলো দেখে থমকে যায় রেশমি। অচেনা মেয়েটি তো
একটি অন্য বাইকে চলে গেল! নিমেষে তারা
হাওয়া হয়ে যেতেই চমকে ওঠে রেশমি। আবার ফোন লাগায়, দাদা বাড়িটা? রাত এখন ৯.৩০
মিনিট। রেশমি হয়রান হয়ে যায়, কিন্ত হলুদ বাড়ি আর মেলে না! চোখ দিয়ে
গড়িয়ে পড়তে থাকে জল। আনমনে বাড়ি ফিরতে গিয়ে হঠাৎ মনে পড়ে রেশমির, অনিমেষ বলছিল
একদিন তার নতুন পরিচিত এক মানসিক
প্রতিবন্ধীর এক কন্যার কথা। স্মৃতি স্পষ্ট না হতেই টুকটুক ঘোরায় রেশমি। একজন
দপ্তরের নেতাকে ফোন লাগায়। সে বলে আর্জেন্ট নাকি? কাল সকালে... কথা থামিয়ে দিয়ে
রেশমি বলে, না না, দেরি নয়, আজই দেখা করব।
অনিমেষকে দেখলে আজকাল একটু অবাক হতে হয়। এমন কি
তার এই বদল রেশমির চোখ এড়িয়ে যায়নি। সকালে হাঁটতে যাবে বলে অনিমেষ রেশমিকে তুলে
দিতে বলে ঠিক ভোর ৫টায়। অনিমেষকে তুলতে গিয়ে রেশমি আবিষ্কা্র করে মোবাইলে
পাসওয়ার্ড লাগানো। এত বছরে এই প্রথম। এমন ধাক্কায় নিস্তেজ হয়ে যায় রেশমি। মনে পড়ে
অনিমেষের সততার কথা। পরিচয়ের প্রথম দিকেই সে রেশমিকে তার শালিনীর সঙ্গে সম্পর্ক ভেঙে
যাওয়া ও তা কাটিয়ে ওঠার করুণ কাহিনী বর্ননা করে। অনিমেষ রেশমির সামনে
তার আত্মপরাজয় ভুলতে পতিতালয়ে যাওয়ার কথা স্বীকার করে নির্দ্বিধায়। আর রেশমির মনে
সে এক অসামান্য মানুষ হিসেবে ধরা দেয় সেই
মুহূর্ত থেকেই।
ঘরে ফিরে রেশমি দেখে তার ফোনে অনেকগুলো কল। খুঁজতে
যাবার আগেই রিং, সঙ্গে সঙ্গে ধরে রেশমি। ফোন থেকে জেনে নেয় কী করতে হবে তাকে।
ঠিক কাঁটায় কাঁটায় বারোটা। গনগনে দুপুর। তিনমাথার
মোড়ে পেট্রোল পাম্পে দাঁড়ায় রেশমি। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে চলে আসে তার গাড়ি। প্রশাসনিক ভবনের
দরজা বড় করে খুলে যায়। রেশমির দম বন্ধ হয়ে আসতে থাকে, চোখ ঝাপসা হয়ে যায়। গাড়ি থেকে বেরিয়ে আসে এক পঞ্চাশের কোঠার বয়সের
প্রায় পক্ককেশের মানুষ। তাকে ধরে অনিমেষ সিঁড়ি
দিয়ে নিয়ে যেতে থাকে উপরে।
বাড়ি ফিরে কান্নায় আছড়ে পড়ে রেশমি। চোখ মুছে
আবার ১টা বেজে ৩০ মিনিটে গিয়ে দাঁড়ায়। দেখতে পায় অনিমেষ তার গাড়িতে করেই এসেছে। কেউ
নেই, তবে সঙ্গে একটি টিফিন বক্স। ঠিক আধ ঘন্টা পরে সে নেমে আসে সেই সিঁড়ি বেয়ে
খালি হাতে।
আজ রেশমি হলুদ বাড়ি খুঁজে বার করবেই। প্রতিজ্ঞা
মতো এগিয়ে যায় সন্তর্পণে। দূর থেকে দেখে, এক ছাপোষা
কেরানী পরিবারকে। কোনো আড়ম্বড় নেই, এমন কি বসার কোনো ভালো চেয়ারও নেই। সাদামাটা এক
বিছানায় বয়স্ক মহিলাকে শুয়ে থাকতে দেখে
সাহস করে ডাকে রেশমি, দাদা আছেন? বৃদ্ধা উত্তর দেন, কে মা? ভেতরে এস। রেশমি এতক্ষণে নিজেকে ধিক্কার দিতে থাকে ও
অনিমেষের মহানুভবতায় গর্ব করতে থাকে। সত্যি,
কত বড় মনের মানুষ হলে এমন করে অন্যের পরিবারকে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেওয়া যায় ভাবতে ভাবতে রেশমি
নিজের কাছে নিজেই ছোট হতে থাকে। মাসিমা বলতে থাকেন অনর্গল অনিমেষের কথা। এবারে
শেষমেষ ভাঙা চেয়ার ছেড়ে উঠতে গিয়ে ওড়নায় টান পড়ে রেশমির। ছাড়াতে পেছন ফিরতেই
সব অন্ধকার হয়ে যায়। তার সামনে দাঁড়িয়ে এক কিশোরী। অসম্ভব সুন্দর তার চেহারা। হাতে
দামি ফোন। কালো রঙের থ্রী কোয়ার্টার চুড়িদার। পায়ে সুন্দর গোলাপী জুতো। মাসীমা বলতে থাকেন, আমার মেয়ে কলকাতায়
থাকে। ওকে নিয়ে আসা, রাখতে যাওয়া এখন সব
দায়িত্ব অনিমেষ নিয়েছে। মুখে হাসির ঝলক এনে মেয়েটি বলে, অনিমেষদা এখন এই বাড়ির সব।
রেশমি বাইরে বেরিয়ে দেখে ঝড়ের পূর্বাভাষ। আকাশে ঘন কমলা রক্তিম
সূর্য বিদায় নিচ্ছে পশ্চিমে। এমন এক স্বর্নালী সন্ধ্যায় এসে ছেঁড়া জামা গায়ে
এক কিশোর বলেছিল, গাড়িটা চালাতে দিন না! গরীব বলে অবিশ্বাস করবেন না। তারপরে এই বাড়ির গাড়ি,
গয়নার লকারের চাবি, ব্যাঙ্ক আকাউন্ট, এ-টি-এম সব এক এক করে দখলে যায় অনিমেষের। বাড়ির
মালি্ক হয়ে ওঠে সে।
রেশমি এবার এই পাকা খেলোয়াড়ের সঙ্গে খেলার জন্য
তৈ্রি হয়। বাড়ির সামনে দেখতে পায় অসংখ্য অনিমেষের মুখওয়ালা মাথা তাকে ঘিরে ফেলেছে।
হঠাৎ বাড়িতে ঢোকার মুখে জমাট অন্ধকারের মধ্যে ভুলে যাওয়া ক্যারাটের পোজে দাঁড়ায়
রেশমি। চক্রব্যুহে মুষ্টিবদ্ধ দুই হাত বাড়িয়ে এক পা
তুলে ঘিরে ধরা মাথাগুলোর দিকে বৃত্তাকারে ঘুরে ঘুরে চিৎকার করে, কাম অন! হিট মি
কাওয়ার্ড! হেয়ার ইজ অ্যানাদার অভিমণ্যু! হি ইজ হেয়ার টু উইন
দ্য ব্যাটল!
ভালো লাগলো জিনাত।
উত্তরমুছুনThanks prokolpo punoradhunik.
উত্তরমুছুন