বাংলা কবিতার সেকাল-একাল
ফাল্গুনী মুখোপাধ্যায়
বাংলা কবিতার সেকাল-একাল বিষয়ে কলম চালানোর আগে একটা খুচরো গৌরচন্দ্রিকা করে নেওয়া দরকার। তা হলো এ বিষয়ে কিছু বলার এক্তিয়ার আমার আছে কি না, সে বিষয়েই আমি সন্দিহান, কারণ আমি কবি নই, তাত্বিকও নই। নির্ভেজাল পাঠকের দৃষ্টিকোণ থেকে সেকাল ও একালের কবিতার বিষয় ভাবনাকে বুঝতে চেয়েছি এবং সমকালীন সময়ের অনুষঙ্গে বাংলা কবিতার কয়েকটি ঝোঁক বুঝতে চেষ্টা করেছি।
রবীন্দ্রোত্তর বাংলা কবিতাকে আধুনিক, অতি আধুনিক, উত্তর আধুনিক ইত্যাদি নানান অভিধায় দাগিয়ে দেবার প্রবণতা চলে আসছে বরাবরই। এখন আবার একালের কবিকুলের একাংশ বলছেন, শূন্য দশকের কবিতা, যেন একুশ শতকে সমাজ ভাবনায় কোনো মৌলিক পরিবর্তন ঘটে গেছে! আমরাই বাংলা কবিতার আসল আগমার্কা প্রতিনিধি, আমরাই আধুনিক, আধুনিকের চেয়েও আধুনিক, এমন শূন্যগর্ভ দাবি সেকাল একাল সবকালের কবিকুলই করে থাকেন। গত শতাব্দীর তিরিশের দশকে ‘পথ ছাড়ো রবীন্দ্রনাথ’ বলে ‘কল্লোল’ গোষ্ঠীর কবিরা নিজেদের জানান দিয়েছিলেন যে, ভাবের দিক দিয়ে রবীন্দ্রপ্রভাব মুক্ত তাদের কবিতাই ‘আধুনিক কবিতা’। বললেন বটে, কিন্তু আধুনিক বাংলা কবিতার যে সংকলনগুলি তাঁরা প্রকাশ করলেন, তার কোনোটি থেকেই রবীন্দ্রনাথকে বাইরে রাখতে পারলেন না। ১৯৫৪তে প্রকাশিত বুদ্ধদেব বসু সম্পাদিত ‘আধুনিক বাংলা কবিতা’ সংকলনে রবীন্দ্রনাথের ১৬টি কবিতা স্থান পেয়েছিল এবং সংকলনটির ভূমিকায় তিনি স্বীকার করেছিলেন, “রবীন্দ্রনাথের পর নতুন তো রবীন্দ্রনাথ নিজেই”। বাংলা কবিতার অনুরাগী পাঠক হিসাবে আমার মনে হয়, বাংলা কবিতার ক্ষেত্রে আধুনিক, অতি আধুনিক, উত্তর আধুনিক এইসব অভিধাগুলি সাময়িক বাগাড়ম্বর মাত্র, আমি বলতে চাই ‘বাংলা কবিতা’।
বাংলা কবিতার সেকাল-একাল কথাটির মধ্যে একটা বৃহত্তর ক্ষেত্রের ইঙ্গিত থেকে যায়। রবীন্দ্র পরবর্তী পর্বে নানান ধারায় বিবর্তিত হয়ে সে শক্তি সঞ্চয় করেছে – তার বিন্যাস ও নির্মাণ কৌশল বিবর্তিত বয়েছে নানান ধারায়, কোনো একটি ধারা দিয়ে বাংলা কবিতাকে চিহ্নিত করা যায় না।
এই একুশ শতকের আমরা, যারা স্বাধীনতার আগে চল্লিশের দশকে জন্মেছি, তাদের সকলেরই কবিতার কাছে আসার শুরু পঞ্চাশের দশকে – রবীন্দ্রোত্তর পর্বে। তার আগেই তিরিশের দশকে বাংলা কবিতার দিক পরিবর্তনের সূচনা হয়েছিল রবীন্দ্রনাথের জীবদ্দশাতেই। দেশকাল, সমাজ পারিপার্শ্বিক, জীবন সম্পর্কে সচেতন আগ্রহের প্রকাশ, সংকট, অবসাদ, আত্মানুসন্ধান ইত্যাদি যে ভাবনাসমূহকে আধুনিকতার লক্ষণ ধরা হয়, সেগুলি তো ছিল রবীন্দ্রনাথের শেষ পর্বের কবিতাতেও। সুতরাং বলা যায়, বাংলা কবিতার আধুনিক হয়ে ওঠার সূচনা রবীন্দ্রনাথের হাতেই।
বাংলা কবিতার রবীন্দ্রপ্রভাব বলয়ের চৌকাঠ পেরনো শুরু হলো তিরিশের দশকে ‘কল্লোল’, ‘কালিকলম’, ‘পরিচয়’ পত্রিকার হাত ধরে, প্রবল উপস্থিতি জানালেন বুদ্ধদেব বসু, বিষ্ণু দে, সুধীন্দ্রনাথ দত্ত, অমিয় চক্রবর্তী, প্রেমেন্দ্র মিত্র, জীবনানন্দ দাশ প্রমুখ। আধুনিক নগর জীবনের সংশয়, ক্লান্তি, বিতৃষ্ণা, মূল্যবোধের বিপর্যয় নিঃসঙ্গতা বোধ ও বিশ্বাসের সংকট - এসবই ছিল তাঁদের কাব্যসৌন্দর্য সাধনার উপকরণ। তাঁদের কবিতার বিরুদ্ধে দুর্বোধ্যতার প্রবল অভিযোগও উঠেছিল।
মধ্যতিরিশ থেকে চল্লিশের দশক জুড়ে বাংলা কবিতার বিষয় ভাবনায় আর একটি ধারা স্পষ্ট রূপ পেল – যার প্রভাব বাংলা কবিতার ক্ষেত্রে হলো সুদূর প্রসারি, এই ধারাটিকে কেউ কেউ বলেন ‘বিপ্লবী আধুনিকতার ধারা’। আমার মতো যাঁদের বাংলা কবিতার কাছে আসা শুরু পঞ্চাশের দশকে, তাঁদের কাছে এই ধারাটি চিহ্নিত ছিল প্রগতিবাদী বা জীবনবাদী ধারা রূপে। স্বল্পায়ু সুকান্ত ভট্টাচার্য লিখলেন, “প্রয়োজন নেই কবিতার স্নিগ্ধতা - / কবিতা, তোমায় দিলেম আজকে ছুটি /ক্ষুধার রাজ্যে পৃথিবী গদ্যময়; / পূর্ণিমা চাঁদ যেন ঝলসানো রুটি”। ১৯৩৭এ দীনেশ দাশ লিখলেন, “চাদের শতক আজ নহে তো / এযুগের চাঁদ হ’ল কাস্তে”।
১৯৩০এ জার্মানীতে হিটলারের উথ্বান, ফ্যাসিবাদর মানবতা বিরোধী আগ্রাসন, ২য় বিশ্বযুদ্ধের দামামা বেজে ওঠা এই সংকটময় বিশ্ব পরিস্থিতিতে ভারতেও গঠিত হয়েছিল ফ্যাসিবিরোধী লেখক সঙ্ঘ। ১৯৩৬এ কলকাতায় প্রগতি লেখক সঙ্ঘের প্রথম সম্মেলনে পৌরোহিত্য করলেন স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ। এ দেশে তখন এক তোলপাড় করা সময় বিয়াল্লিশের আগস্ট বিপ্লব, তেতাল্লিশে মানুষের তৈরি করা মন্বন্তরে কলকাতার রাস্তায় মৃত্যুর মিছিল, গণনাট্য সঙ্ঘের প্রবল আবির্ভাব, ডাক ও তার ধর্মঘট, ছেচল্লিশের নৌ বিদ্রোহ, দাঙ্গা, সাতচল্লিশে দেশভাগ ও ছিন্নমূল উদ্বাস্তু স্রোত। এই উত্তাল সময়ের আবহে বাংলা কবিতা আর শুধু ‘কলা কৈবল্যবাদী’ থাকে কি করে? থাকলো না, বিষয় ভাবনায় এলো আমূল পরিবর্তন। এই কাব্যধারার মূল কথা ছিল এই যে, কবিতা শোনাবে সময়ের শব্দ, তার শরীরে থাকবে গণ মানুষের জীবন। কবিতা হবে সহজ, আবেদন প্রত্যক্ষ, সমাজ বাস্তবতা ও সদর্থক আশাবাদের চিত্রকল্প, কবিতার দায় নতুনতর এক বন্দোবস্তের স্বপ্ন দেখানো। পঞ্চাশের দশকের মাঝামাঝি পর্যন্ত এই ধারাটি প্রবলতর ছিল। এমনকি দুর্বোধ্যতার দায়ে অভিযুক্ত বুদ্ধদেব বসু, বিষ্ণু দে প্রমুখদেরও যেন জন্মান্তর ঘটে গেল এই জীবনবাদী ধারার ছোঁয়ায়। আপনভোলা নির্জনতায় আত্মমগ্ন জীবনানন্দ দাস মুখোমুখি হলেন ‘মহাপৃথিবী’র, লিখলেন, “তবুও নগরে, যুদ্ধে, বাজারে, বন্দরে / জেনে গেছি কারা ধন্য / কারা স্বর্ণ প্রাধান্যের সূত্রপাত করে”। বুদ্ধদেব বসু লিখলেন, “... শুধু জেগে আছে তাই নয়, কাজ করে যাচ্ছে গোপনে- গোপনে, / সৃষ্টি করে যাচ্ছে মৃত্যুর বুকে নতুন জন্ম, কবর ফেটে অবুঝ / অদ্ভুত উৎসারণ, পাথর ভেঙে স্রোত, বরফের নিথর আস্তরণে” (‘স্পন্দন’), – “যখন ঘোমটা ছিঁড়ে উঁকি দেবে ক্ষীণ, প্রবল, উজ্বল আশ্চর্য সবুজ / বসন্তের প্রথম চুম্বনে ...” (‘শীত রাত্রির প্রার্থনা’)। চল্লিশের দশকে এলেন সুভাষ মুখোপাধ্যায়, মঙ্গলাচরণ চট্টোপাধ্যায়, জ্যোতিরিন্দ্র মৈত্র, সমর সেন, সুকান্ত ভট্টাচার্য, বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায় প্রমুখ – যাঁদের কবিতার শব্দে গভীরতর জীবনবোধ ও সামাজিক চৈতন্যের অঙ্গীকার। সমর সেন লিখলেন, “তবু জানি কালের গলিত গর্ভ থেকে বিপ্লবের ধাত্রী / যুগে যুগে নতুন জন্ম আনে, / তবু জানি জটিল অন্ধকার একদিন জীর্ণ হবে, চূর্ণ হবে, ভষ্ম হবে / আকাশ গঙ্গা আবার পৃথিবীতে নামবে... / ততদিন নারী ধর্ষণের ইতিহাস / পেস্তাচেরা চোখ মেলে শেষহীন পড়া / অন্ধকূপে স্তব্ধ ইঁদুরের মতো, / ততদিন গর্ভের ঘুমন্ত তপোবনে / বণিকের মানদন্ডের পিঙ্গল প্রহার”।
পঞ্চাশের কবিতায় বিপ্লবী আধুনিকতার প্রভাব স্তিমিত হলো বটে কিন্তু জীবনবাদী আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রকাশ আরো বিচিত্র বিন্যাসে সমৃদ্ধ হয়ে উঠলো। আর এই পঞ্চাশের দশকেই যেন তিরিশের জীবনানন্দ নতুন ভাবে আবিষ্কৃত হতে থাকলেন। ১৯৫৪য় মাত্র পঞ্চান্ন বছর বয়সে প্রয়াত হবার আগে নির্জনতা প্রিয় জীবনানন্দ সমকালীন অন্যান্যদের মতো আলোচিত ছিলেন না। কিন্তু এই উচ্চারণে সংশয়ের জায়গা নেই যে, পঞ্চাশ ও ষাট দশকের কবিদের ঋণ প্রধানত জীবনানন্দের কাছেই, তিনিই সেকাল- একালের সার্থক যোগসূত্র। জীবনানন্দের পরের প্রজন্মের কবি প্রয়াত সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় তো বলেছিলেন, “তিনি কবিদের কবি”। সেই কবে ১৯৫২তে ‘নতুন সাহিত্য’ পত্রিকায় লেখা একটি নিবন্ধে বুদ্ধদেব বসু লিখেছিলেন, “বাঙালি কবির পক্ষে বিশ শতকের তৃতীয় ও চতুর্থ দশকে প্রধানতম সমস্যা ছিলেন রবীন্দ্রনাথ। কোনো কবি জীবনানন্দের মতো রবীন্দ্রনাথকে পাশ কাটিয়ে সরে গেলেন, আবার কেউ কেউ তাঁকে আত্মস্থ করেই শক্তি পেলেন তাঁর মুখোমুখি দাঁড়াবার। ...এরপরে যাঁরা এসেছেন বা আরো পরে যাঁরা আসবেন, রবীন্দ্রনাথ থেকে আর কোনো ভয় থাকলো না তাঁদের। অবশ্য অন্যান্য দুটো একটা বিপদ ইতিমধ্যে দেখা দিয়েছে, যেমন জীবনানন্দ, বিষ্ণু দে বা অন্য কারো্র আবর্ত, যা থেকে বেরোতে পারছেন না আজকের দিনের নবাগতরা। অর্থাৎ জীবনানন্দ পূর্ণতর ভাবে আবিষ্কৃত হবার অনেক আগেই পরবর্তী প্রজন্মের কবিদের ওপর তাঁর অনিবার্য প্রভাবের ইংগিত দিয়েছিলেন বুদ্ধদেব বসু। বাংলা কবিতায় রাবীন্দ্রিকতার অবসান ঘটিয়ে নতুন বীজ বপন করলেন জীবনানন্দই। নিশ্চিত ভাবে তিনিই বাংলা কবিতায় সেকাল ও একালের যোগসূত্র।
১৯৫৩তে প্রকাশিত হলো ‘কৃত্তিবাস’। উঠে এলেন সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, শরৎকুমার মুখোপাধ্যায়, বিনয় মজুমদার, নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী, অলোকরঞ্জন দাশগুপ্ত, তারাপদ রায়, শঙ্খ ঘোষ, পূর্ণেন্দু পত্রী প্রমুখ। মধ্য তিরিশের দিনেশ দাস, চল্লিশের সুভাষ মুখোপাধ্যায়, বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, প্রমুখ তখন পূর্ণ দীপ্তিতে। বস্তুত বাংলা কবিতায় পঞ্চাশ ও ষাটের দশক ছিল সৃজনের স্বর্ণসময়। নবলব্ধ স্বাধীনতার ফলশ্রুতিতে একদিকে সঞ্জীবনী স্বপ্ন দেখা, আবার স্বপ্ন ভঙ্গের সময়কালও বটে। মধ্যপঞ্চাশেই স্লোগান উঠলো, “ইয়ে আজাদি ঝুটা হ্যায়, ভুলো মত্, ভুলো মত্”। এক পয়সার ট্রাম ভাড়া বৃদ্ধির আন্দোলন, ঊনপঞ্চাশের শিক্ষক ধর্মধট, কাকদ্বীপ আন্দোলন, ৫৯এর খাদ্য আন্দোলনে কলকাতার রাস্তায় তাজা রক্তের স্রোত। প্রতিষ্ঠান বিরোধীতার তীব্র সুর স্থান পেল পঞ্চাশ-ষাটের কবিতায়। শঙ্খ ঘোষ লিখলেন, “নিভন্ত এই চুল্লি তবে / একটু আগুন দে / হাড়ের শিরায় শিখার মাতন / মরার আনন্দে”।
উত্তাল সময়েই সৃষ্টির প্রাচুর্য সর্বকালে সর্বদেশে। আমাদের সেই সময়টা কেমন ছিল? পঞ্চাশের কবি প্রয়াত পূর্ণেন্দু পত্রীর পংক্তিতে –
সত্তরের দশক আমাদের সমাজ জীবনের আর এক উত্তাল, অস্থির সময়। নকশালবাড়ির কৃষক আন্দোলনের আকর্ষণে ঝাঁপিয়ে পড়লেন হাজার হাজার তরুণ অপরাজেয় রাষ্ট্রশক্তির বন্দুক-বেয়োনেটের সামনে। কাশীপুর, বরানগরের ট্রাক ভর্তি লাশ উধাও হয়ে গেল গঙ্গাগর্ভে, বস্তাবন্দি লাশ বারাসাতের রাস্তায়, মৃতদেহ মাড়িয়ে বাড়ি ফিরছে মানুষ, কয়েদখানায় হত্যা – সে এক মৃত্যুর দশক! বিমলচন্দ্র ঘোষের পংক্তিতে – “কিনু গোয়ালার গলি / সোনার টুকরো ছেলেরা সব অশ্বমেধের বলি / বারুদ গন্ধ বুকে নিয়ে আকাশে ফোটে জ্যোৎস্না / ময়লা হাতে ওকে তোরা ছুঁস না ।/ ওরে মন পৃথিবীর গভীর / গভীরতর অসুখ এখন”। সেই গভীরতর অসুখের সমকালে, সত্তরের দশক সৃজনের দশকও হয়ে উঠেছিল। এই দশকে সৃষ্টি হয়েছে অনেক রাজনৈতিক কবিতা সব্যসাচী দেব, মণিভূষণ ভট্টাচার্য, কমলেশ সেন, সমীর রায় প্রমুখের কলমে। এবং বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, যিনি ছিলেন চল্লিশ ও সত্তরের যোগসূত্র।
সমকালীন সময়ের অনুষঙ্গে রবীন্দ্রোত্তর বাংলা কবিতার বিষয় ভাবনার কয়েকটি ঝোঁক ছুঁয়ে গেলাম মাত্র এক কবিতা পাঠকের দৃষ্টিকোণ থেকে। সত্তরে এসেই থামলাম। কেননা, আশি পরবর্তী সময়কে আমার মনে হয় শূন্যতা বোধের সময়কাল। বিশ্বায়ন নামক দানবের গ্রাসে বিপন্ন এখন আমাদের অনেক কিছুই। – বিপন্ন মূল্যবোধ, বিপর্যস্ত আমার মাতৃভাষার অহংকার। তবুও কবিতা থাকে, কবিতা আছে। জীবন পবিত্র, এই পবিত্রতার বোধকে আঁকড়ে থাকুক একালের কবিতা, পীড়িত মানুষের বেদনার কেন্দ্রে হাত রাখুক আজকের কবিতা। দেশজ জীবন আর মানুষের বেদনার বার্তা সংবেদনশীল চরণে ঠাঁই পাক আজকের কবিতার শরীরে, এই-ই তো দাবি! হয়তো আশি পরবর্তী চল্লিশ বছরের কিংবা রবীন্দ্রোত্তর একশ বছরের কবিতার কথা লিখবেন আর কেউ। আমি তার কিছু সূত্র রেখে গেলাম মাত্র।
“সময়-স্বদেশ–মনুষ্যত্ব–কবি–কবিতা–কবিতার পাঠক কোথাও যদি একসূত্রে বাঁধা যেত! হয়তো একদিন সব প্রশ্নের উত্তর পাওয়া যাবে; আমরা সবাই মিলে পরিশুদ্ধ হব”। (বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের শ্রেষ্ঠ কবিতার ভূমিকা। এই সূত্র বন্ধন করুক একালের কবিতা, অপেক্ষায় থাকি।
বাংলা কবিতার সেকাল-একাল বিষয়ে কলম চালানোর আগে একটা খুচরো গৌরচন্দ্রিকা করে নেওয়া দরকার। তা হলো এ বিষয়ে কিছু বলার এক্তিয়ার আমার আছে কি না, সে বিষয়েই আমি সন্দিহান, কারণ আমি কবি নই, তাত্বিকও নই। নির্ভেজাল পাঠকের দৃষ্টিকোণ থেকে সেকাল ও একালের কবিতার বিষয় ভাবনাকে বুঝতে চেয়েছি এবং সমকালীন সময়ের অনুষঙ্গে বাংলা কবিতার কয়েকটি ঝোঁক বুঝতে চেষ্টা করেছি।
রবীন্দ্রোত্তর বাংলা কবিতাকে আধুনিক, অতি আধুনিক, উত্তর আধুনিক ইত্যাদি নানান অভিধায় দাগিয়ে দেবার প্রবণতা চলে আসছে বরাবরই। এখন আবার একালের কবিকুলের একাংশ বলছেন, শূন্য দশকের কবিতা, যেন একুশ শতকে সমাজ ভাবনায় কোনো মৌলিক পরিবর্তন ঘটে গেছে! আমরাই বাংলা কবিতার আসল আগমার্কা প্রতিনিধি, আমরাই আধুনিক, আধুনিকের চেয়েও আধুনিক, এমন শূন্যগর্ভ দাবি সেকাল একাল সবকালের কবিকুলই করে থাকেন। গত শতাব্দীর তিরিশের দশকে ‘পথ ছাড়ো রবীন্দ্রনাথ’ বলে ‘কল্লোল’ গোষ্ঠীর কবিরা নিজেদের জানান দিয়েছিলেন যে, ভাবের দিক দিয়ে রবীন্দ্রপ্রভাব মুক্ত তাদের কবিতাই ‘আধুনিক কবিতা’। বললেন বটে, কিন্তু আধুনিক বাংলা কবিতার যে সংকলনগুলি তাঁরা প্রকাশ করলেন, তার কোনোটি থেকেই রবীন্দ্রনাথকে বাইরে রাখতে পারলেন না। ১৯৫৪তে প্রকাশিত বুদ্ধদেব বসু সম্পাদিত ‘আধুনিক বাংলা কবিতা’ সংকলনে রবীন্দ্রনাথের ১৬টি কবিতা স্থান পেয়েছিল এবং সংকলনটির ভূমিকায় তিনি স্বীকার করেছিলেন, “রবীন্দ্রনাথের পর নতুন তো রবীন্দ্রনাথ নিজেই”। বাংলা কবিতার অনুরাগী পাঠক হিসাবে আমার মনে হয়, বাংলা কবিতার ক্ষেত্রে আধুনিক, অতি আধুনিক, উত্তর আধুনিক এইসব অভিধাগুলি সাময়িক বাগাড়ম্বর মাত্র, আমি বলতে চাই ‘বাংলা কবিতা’।
বাংলা কবিতার সেকাল-একাল কথাটির মধ্যে একটা বৃহত্তর ক্ষেত্রের ইঙ্গিত থেকে যায়। রবীন্দ্র পরবর্তী পর্বে নানান ধারায় বিবর্তিত হয়ে সে শক্তি সঞ্চয় করেছে – তার বিন্যাস ও নির্মাণ কৌশল বিবর্তিত বয়েছে নানান ধারায়, কোনো একটি ধারা দিয়ে বাংলা কবিতাকে চিহ্নিত করা যায় না।
এই একুশ শতকের আমরা, যারা স্বাধীনতার আগে চল্লিশের দশকে জন্মেছি, তাদের সকলেরই কবিতার কাছে আসার শুরু পঞ্চাশের দশকে – রবীন্দ্রোত্তর পর্বে। তার আগেই তিরিশের দশকে বাংলা কবিতার দিক পরিবর্তনের সূচনা হয়েছিল রবীন্দ্রনাথের জীবদ্দশাতেই। দেশকাল, সমাজ পারিপার্শ্বিক, জীবন সম্পর্কে সচেতন আগ্রহের প্রকাশ, সংকট, অবসাদ, আত্মানুসন্ধান ইত্যাদি যে ভাবনাসমূহকে আধুনিকতার লক্ষণ ধরা হয়, সেগুলি তো ছিল রবীন্দ্রনাথের শেষ পর্বের কবিতাতেও। সুতরাং বলা যায়, বাংলা কবিতার আধুনিক হয়ে ওঠার সূচনা রবীন্দ্রনাথের হাতেই।
বাংলা কবিতার রবীন্দ্রপ্রভাব বলয়ের চৌকাঠ পেরনো শুরু হলো তিরিশের দশকে ‘কল্লোল’, ‘কালিকলম’, ‘পরিচয়’ পত্রিকার হাত ধরে, প্রবল উপস্থিতি জানালেন বুদ্ধদেব বসু, বিষ্ণু দে, সুধীন্দ্রনাথ দত্ত, অমিয় চক্রবর্তী, প্রেমেন্দ্র মিত্র, জীবনানন্দ দাশ প্রমুখ। আধুনিক নগর জীবনের সংশয়, ক্লান্তি, বিতৃষ্ণা, মূল্যবোধের বিপর্যয় নিঃসঙ্গতা বোধ ও বিশ্বাসের সংকট - এসবই ছিল তাঁদের কাব্যসৌন্দর্য সাধনার উপকরণ। তাঁদের কবিতার বিরুদ্ধে দুর্বোধ্যতার প্রবল অভিযোগও উঠেছিল।
মধ্যতিরিশ থেকে চল্লিশের দশক জুড়ে বাংলা কবিতার বিষয় ভাবনায় আর একটি ধারা স্পষ্ট রূপ পেল – যার প্রভাব বাংলা কবিতার ক্ষেত্রে হলো সুদূর প্রসারি, এই ধারাটিকে কেউ কেউ বলেন ‘বিপ্লবী আধুনিকতার ধারা’। আমার মতো যাঁদের বাংলা কবিতার কাছে আসা শুরু পঞ্চাশের দশকে, তাঁদের কাছে এই ধারাটি চিহ্নিত ছিল প্রগতিবাদী বা জীবনবাদী ধারা রূপে। স্বল্পায়ু সুকান্ত ভট্টাচার্য লিখলেন, “প্রয়োজন নেই কবিতার স্নিগ্ধতা - / কবিতা, তোমায় দিলেম আজকে ছুটি /ক্ষুধার রাজ্যে পৃথিবী গদ্যময়; / পূর্ণিমা চাঁদ যেন ঝলসানো রুটি”। ১৯৩৭এ দীনেশ দাশ লিখলেন, “চাদের শতক আজ নহে তো / এযুগের চাঁদ হ’ল কাস্তে”।
১৯৩০এ জার্মানীতে হিটলারের উথ্বান, ফ্যাসিবাদর মানবতা বিরোধী আগ্রাসন, ২য় বিশ্বযুদ্ধের দামামা বেজে ওঠা এই সংকটময় বিশ্ব পরিস্থিতিতে ভারতেও গঠিত হয়েছিল ফ্যাসিবিরোধী লেখক সঙ্ঘ। ১৯৩৬এ কলকাতায় প্রগতি লেখক সঙ্ঘের প্রথম সম্মেলনে পৌরোহিত্য করলেন স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ। এ দেশে তখন এক তোলপাড় করা সময় বিয়াল্লিশের আগস্ট বিপ্লব, তেতাল্লিশে মানুষের তৈরি করা মন্বন্তরে কলকাতার রাস্তায় মৃত্যুর মিছিল, গণনাট্য সঙ্ঘের প্রবল আবির্ভাব, ডাক ও তার ধর্মঘট, ছেচল্লিশের নৌ বিদ্রোহ, দাঙ্গা, সাতচল্লিশে দেশভাগ ও ছিন্নমূল উদ্বাস্তু স্রোত। এই উত্তাল সময়ের আবহে বাংলা কবিতা আর শুধু ‘কলা কৈবল্যবাদী’ থাকে কি করে? থাকলো না, বিষয় ভাবনায় এলো আমূল পরিবর্তন। এই কাব্যধারার মূল কথা ছিল এই যে, কবিতা শোনাবে সময়ের শব্দ, তার শরীরে থাকবে গণ মানুষের জীবন। কবিতা হবে সহজ, আবেদন প্রত্যক্ষ, সমাজ বাস্তবতা ও সদর্থক আশাবাদের চিত্রকল্প, কবিতার দায় নতুনতর এক বন্দোবস্তের স্বপ্ন দেখানো। পঞ্চাশের দশকের মাঝামাঝি পর্যন্ত এই ধারাটি প্রবলতর ছিল। এমনকি দুর্বোধ্যতার দায়ে অভিযুক্ত বুদ্ধদেব বসু, বিষ্ণু দে প্রমুখদেরও যেন জন্মান্তর ঘটে গেল এই জীবনবাদী ধারার ছোঁয়ায়। আপনভোলা নির্জনতায় আত্মমগ্ন জীবনানন্দ দাস মুখোমুখি হলেন ‘মহাপৃথিবী’র, লিখলেন, “তবুও নগরে, যুদ্ধে, বাজারে, বন্দরে / জেনে গেছি কারা ধন্য / কারা স্বর্ণ প্রাধান্যের সূত্রপাত করে”। বুদ্ধদেব বসু লিখলেন, “... শুধু জেগে আছে তাই নয়, কাজ করে যাচ্ছে গোপনে- গোপনে, / সৃষ্টি করে যাচ্ছে মৃত্যুর বুকে নতুন জন্ম, কবর ফেটে অবুঝ / অদ্ভুত উৎসারণ, পাথর ভেঙে স্রোত, বরফের নিথর আস্তরণে” (‘স্পন্দন’), – “যখন ঘোমটা ছিঁড়ে উঁকি দেবে ক্ষীণ, প্রবল, উজ্বল আশ্চর্য সবুজ / বসন্তের প্রথম চুম্বনে ...” (‘শীত রাত্রির প্রার্থনা’)। চল্লিশের দশকে এলেন সুভাষ মুখোপাধ্যায়, মঙ্গলাচরণ চট্টোপাধ্যায়, জ্যোতিরিন্দ্র মৈত্র, সমর সেন, সুকান্ত ভট্টাচার্য, বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায় প্রমুখ – যাঁদের কবিতার শব্দে গভীরতর জীবনবোধ ও সামাজিক চৈতন্যের অঙ্গীকার। সমর সেন লিখলেন, “তবু জানি কালের গলিত গর্ভ থেকে বিপ্লবের ধাত্রী / যুগে যুগে নতুন জন্ম আনে, / তবু জানি জটিল অন্ধকার একদিন জীর্ণ হবে, চূর্ণ হবে, ভষ্ম হবে / আকাশ গঙ্গা আবার পৃথিবীতে নামবে... / ততদিন নারী ধর্ষণের ইতিহাস / পেস্তাচেরা চোখ মেলে শেষহীন পড়া / অন্ধকূপে স্তব্ধ ইঁদুরের মতো, / ততদিন গর্ভের ঘুমন্ত তপোবনে / বণিকের মানদন্ডের পিঙ্গল প্রহার”।
পঞ্চাশের কবিতায় বিপ্লবী আধুনিকতার প্রভাব স্তিমিত হলো বটে কিন্তু জীবনবাদী আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রকাশ আরো বিচিত্র বিন্যাসে সমৃদ্ধ হয়ে উঠলো। আর এই পঞ্চাশের দশকেই যেন তিরিশের জীবনানন্দ নতুন ভাবে আবিষ্কৃত হতে থাকলেন। ১৯৫৪য় মাত্র পঞ্চান্ন বছর বয়সে প্রয়াত হবার আগে নির্জনতা প্রিয় জীবনানন্দ সমকালীন অন্যান্যদের মতো আলোচিত ছিলেন না। কিন্তু এই উচ্চারণে সংশয়ের জায়গা নেই যে, পঞ্চাশ ও ষাট দশকের কবিদের ঋণ প্রধানত জীবনানন্দের কাছেই, তিনিই সেকাল- একালের সার্থক যোগসূত্র। জীবনানন্দের পরের প্রজন্মের কবি প্রয়াত সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় তো বলেছিলেন, “তিনি কবিদের কবি”। সেই কবে ১৯৫২তে ‘নতুন সাহিত্য’ পত্রিকায় লেখা একটি নিবন্ধে বুদ্ধদেব বসু লিখেছিলেন, “বাঙালি কবির পক্ষে বিশ শতকের তৃতীয় ও চতুর্থ দশকে প্রধানতম সমস্যা ছিলেন রবীন্দ্রনাথ। কোনো কবি জীবনানন্দের মতো রবীন্দ্রনাথকে পাশ কাটিয়ে সরে গেলেন, আবার কেউ কেউ তাঁকে আত্মস্থ করেই শক্তি পেলেন তাঁর মুখোমুখি দাঁড়াবার। ...এরপরে যাঁরা এসেছেন বা আরো পরে যাঁরা আসবেন, রবীন্দ্রনাথ থেকে আর কোনো ভয় থাকলো না তাঁদের। অবশ্য অন্যান্য দুটো একটা বিপদ ইতিমধ্যে দেখা দিয়েছে, যেমন জীবনানন্দ, বিষ্ণু দে বা অন্য কারো্র আবর্ত, যা থেকে বেরোতে পারছেন না আজকের দিনের নবাগতরা। অর্থাৎ জীবনানন্দ পূর্ণতর ভাবে আবিষ্কৃত হবার অনেক আগেই পরবর্তী প্রজন্মের কবিদের ওপর তাঁর অনিবার্য প্রভাবের ইংগিত দিয়েছিলেন বুদ্ধদেব বসু। বাংলা কবিতায় রাবীন্দ্রিকতার অবসান ঘটিয়ে নতুন বীজ বপন করলেন জীবনানন্দই। নিশ্চিত ভাবে তিনিই বাংলা কবিতায় সেকাল ও একালের যোগসূত্র।
১৯৫৩তে প্রকাশিত হলো ‘কৃত্তিবাস’। উঠে এলেন সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, শরৎকুমার মুখোপাধ্যায়, বিনয় মজুমদার, নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী, অলোকরঞ্জন দাশগুপ্ত, তারাপদ রায়, শঙ্খ ঘোষ, পূর্ণেন্দু পত্রী প্রমুখ। মধ্য তিরিশের দিনেশ দাস, চল্লিশের সুভাষ মুখোপাধ্যায়, বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, প্রমুখ তখন পূর্ণ দীপ্তিতে। বস্তুত বাংলা কবিতায় পঞ্চাশ ও ষাটের দশক ছিল সৃজনের স্বর্ণসময়। নবলব্ধ স্বাধীনতার ফলশ্রুতিতে একদিকে সঞ্জীবনী স্বপ্ন দেখা, আবার স্বপ্ন ভঙ্গের সময়কালও বটে। মধ্যপঞ্চাশেই স্লোগান উঠলো, “ইয়ে আজাদি ঝুটা হ্যায়, ভুলো মত্, ভুলো মত্”। এক পয়সার ট্রাম ভাড়া বৃদ্ধির আন্দোলন, ঊনপঞ্চাশের শিক্ষক ধর্মধট, কাকদ্বীপ আন্দোলন, ৫৯এর খাদ্য আন্দোলনে কলকাতার রাস্তায় তাজা রক্তের স্রোত। প্রতিষ্ঠান বিরোধীতার তীব্র সুর স্থান পেল পঞ্চাশ-ষাটের কবিতায়। শঙ্খ ঘোষ লিখলেন, “নিভন্ত এই চুল্লি তবে / একটু আগুন দে / হাড়ের শিরায় শিখার মাতন / মরার আনন্দে”।
উত্তাল সময়েই সৃষ্টির প্রাচুর্য সর্বকালে সর্বদেশে। আমাদের সেই সময়টা কেমন ছিল? পঞ্চাশের কবি প্রয়াত পূর্ণেন্দু পত্রীর পংক্তিতে –
এই সমকালেই সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের কলমে নারী, নিসর্গ আর কবিতা একাকার হয়ে যায় অপাপবিদ্ধ পবিত্রতার অন্বেষণে, শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের কবিতায় প্রকৃতি প্রেম আর জীবন সম্পর্কে শ্রদ্ধাবোধ। বাংলা কবিতার স্বর্ণ সময়ই বটে!“সে এক কলকাতা ছিল আমাদের
শ্যামবাজার ছুঁয়ে ব্রহ্মপুত্র
সেন্ট্রাল অ্যাভিনিউ জুড়ে গারো পর্বতমালা
আর হ্যারিসন রোডে চিতোরের সারসার দূর্গ।
বিরাট সামিয়ানার নীচে
সারারাত নাচের গানের আর
কবিতার উৎসব।
যেখানে পা রাখছি
আগুনের আলপনা।
যেখানে হাত সেখানেই রক্তরাখী।
তখন সূর্য সেন বলে হাঁক দিলেই
খুলে যেত এক লাখ দরজা।
সে এক কলকাতা ছিল আমাদের।
কলেজ স্ট্রীটের গায়ে কাকদ্বীপ
ডালহৌসির গায়ে তেলেঙ্গানা
আর রাজভবনের সামনে চট্টগ্রাম”।
সত্তরের দশক আমাদের সমাজ জীবনের আর এক উত্তাল, অস্থির সময়। নকশালবাড়ির কৃষক আন্দোলনের আকর্ষণে ঝাঁপিয়ে পড়লেন হাজার হাজার তরুণ অপরাজেয় রাষ্ট্রশক্তির বন্দুক-বেয়োনেটের সামনে। কাশীপুর, বরানগরের ট্রাক ভর্তি লাশ উধাও হয়ে গেল গঙ্গাগর্ভে, বস্তাবন্দি লাশ বারাসাতের রাস্তায়, মৃতদেহ মাড়িয়ে বাড়ি ফিরছে মানুষ, কয়েদখানায় হত্যা – সে এক মৃত্যুর দশক! বিমলচন্দ্র ঘোষের পংক্তিতে – “কিনু গোয়ালার গলি / সোনার টুকরো ছেলেরা সব অশ্বমেধের বলি / বারুদ গন্ধ বুকে নিয়ে আকাশে ফোটে জ্যোৎস্না / ময়লা হাতে ওকে তোরা ছুঁস না ।/ ওরে মন পৃথিবীর গভীর / গভীরতর অসুখ এখন”। সেই গভীরতর অসুখের সমকালে, সত্তরের দশক সৃজনের দশকও হয়ে উঠেছিল। এই দশকে সৃষ্টি হয়েছে অনেক রাজনৈতিক কবিতা সব্যসাচী দেব, মণিভূষণ ভট্টাচার্য, কমলেশ সেন, সমীর রায় প্রমুখের কলমে। এবং বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, যিনি ছিলেন চল্লিশ ও সত্তরের যোগসূত্র।
সমকালীন সময়ের অনুষঙ্গে রবীন্দ্রোত্তর বাংলা কবিতার বিষয় ভাবনার কয়েকটি ঝোঁক ছুঁয়ে গেলাম মাত্র এক কবিতা পাঠকের দৃষ্টিকোণ থেকে। সত্তরে এসেই থামলাম। কেননা, আশি পরবর্তী সময়কে আমার মনে হয় শূন্যতা বোধের সময়কাল। বিশ্বায়ন নামক দানবের গ্রাসে বিপন্ন এখন আমাদের অনেক কিছুই। – বিপন্ন মূল্যবোধ, বিপর্যস্ত আমার মাতৃভাষার অহংকার। তবুও কবিতা থাকে, কবিতা আছে। জীবন পবিত্র, এই পবিত্রতার বোধকে আঁকড়ে থাকুক একালের কবিতা, পীড়িত মানুষের বেদনার কেন্দ্রে হাত রাখুক আজকের কবিতা। দেশজ জীবন আর মানুষের বেদনার বার্তা সংবেদনশীল চরণে ঠাঁই পাক আজকের কবিতার শরীরে, এই-ই তো দাবি! হয়তো আশি পরবর্তী চল্লিশ বছরের কিংবা রবীন্দ্রোত্তর একশ বছরের কবিতার কথা লিখবেন আর কেউ। আমি তার কিছু সূত্র রেখে গেলাম মাত্র।
“সময়-স্বদেশ–মনুষ্যত্ব–কবি–কবিতা–কবিতার পাঠক কোথাও যদি একসূত্রে বাঁধা যেত! হয়তো একদিন সব প্রশ্নের উত্তর পাওয়া যাবে; আমরা সবাই মিলে পরিশুদ্ধ হব”। (বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের শ্রেষ্ঠ কবিতার ভূমিকা। এই সূত্র বন্ধন করুক একালের কবিতা, অপেক্ষায় থাকি।
আশির দশকের পরেরটা ছুঁয়ে যাওয়া উচিত ছিল ফাল্গুনীদা, আগেকার ব্যাপারগুলোতো আমরা পুরোনো যারা বহুভাবে পড়েছি।
উত্তরমুছুনঠিক বলেছেন সুশান্ত । 'আশিতে আসিও না' এই রকম একটা বাঁধা নিজের মধ্যেই ছিল । সত্যি বলতে কি সাহস হয় নি ! বিশ্বায়ন নামক পাঁচ অক্ষরের দানব তো আমদের অনেক কিছুই গিলে ফেলেছে - লিখনশৈলী , মননও তো তাঁর আওতার বাইরে নয় । তবে হ্যা , পরের চল্লিশ বছরের কবিতাকেও ছোঁয়ার ইচ্ছা আছে । দেখা যাক । জানা বিষয় আবার পড়েছেন বলে ধন্যবাদ ।
মুছুন:) অপেক্ষাতে থাকব।
উত্তরমুছুন