প্রকৃতির গান, গানের প্রকৃতি
‘স্বর্ণযুগের গান’ সম্পর্কে
অনেক অতি আধুনিক পণ্ডিতের মত, আকাশ-বাতাস-চাঁদ-তারা-ফুল-পাখি-নদী আর আমি আর তুমির বাইরে নাকি তা বেরোতে পারে
নি। কথাটা মিথ্যে নয়। পঞ্চকবির
মধ্যে সর্বকনিষ্ঠ যিনি, যাঁর হাতে ১৯৩০-এর দশকে গ্রামোফোন কোম্পানির সৌজন্যে ‘আধুনিক’
বাংলা গানের প্রস্তুতিপর্বের আরম্ভ, তাঁর কাব্যগীতি,
বাংলা ঠুংরি-গজল এমনকি নিজের তৈরি নবরাগপ্রধান
গানেও ফুল-পাখি-লতাপাতার ছড়াছড়ি। তাঁর অনুজপ্রতিম যে-সব গীতিকার-সুরকার মোটামুটি তিরিশের মাঝামাঝি থেকে চল্লিশের প্রায় শেষ অবধি রাজ্যপাট চালিয়েছেন,
তাঁরাও সে পথেই হেঁটেছেন; আর যে গানটিকে
‘স্বর্ণযুগের উদ্বোধনী সঙ্গীত’-এর মর্যাদা অনেকেই
দিয়ে থাকেন, তার ভাবনা বা বার্তায় কিছুটা গণমুখী চেতনার প্রতিফলন
থাকলেও, তার মূল কাঠামোতে কিন্তু ‘নীল শালুকে
দোলন দিয়ে রঙ ফানুসে ভেসে’ বেড়ায় গ্রাম্য প্রকৃতির অকৃত্রিম বাতাস,
আর সে বাতাসে ছড়িয়ে যায় ‘পাকা ধানের বাসে বাসে
সবার নিমন্ত্রণ’। এর পর একই সুরকার-শিল্পীর যুগলবন্দিতে যখন আসে ‘রানার’,
‘পাল্কির গান’ বা ‘মনের জানালা
ধরে’ বা ‘আমায় প্রশ্ন করে’র মত গান, সেখানেও কিন্তু ‘অবাক
রাতের তারারা আকাশে মিটিমিটি করে চায়’ বা ‘হৃদয়ের শাখা ধরে নাড়া দিয়ে গেছে’-র মত শব্দগুচ্ছ ব্রাত্য
নয়, বর্জনীয় নয় প্রকৃতির অন্যান্য চিত্রকল্পও, শুধু ভাষা প্রয়োগের ধরনটুকু আলাদা।
ভাষার ব্যবহার বদলেছে বারে বারেই, এক গীতিকার থেকে অন্য গীতিকারের কলমে। কিন্তু প্রকৃতির অনুষঙ্গে আশ্রয় নিতে দ্বিধা করেননি কেউই। কেনই বা করতে হবে? যা স্বাভাবিক,
তাই তো প্রকৃতির স্বরূপ। মানুষের
চোখ-কান-ইন্দ্রিয়-মন-প্রাণ যদি শত বিপত্তি, শত জীবনসঙ্কটের
মাঝেও প্রকৃতির আশ্রয়েই শান্তি খুঁজতে চায়, এক ঝলক টাটকা বাতাস,
নদীর কলধ্বনি বা ঝরাপাতাদের মর্মরের মাঝে খুঁজে পেতে চায় জীবনের মানে,
তাহলে জোর করে সেই স্বাভাবিক প্রবণতাকে অস্বীকার করতে চাওয়ার মধ্যে কী
এমন বাহাদুরি আছে, সাধারণ মানুষের মাথায় তো ঢোকে না। বরং মানুষের মন-অনুভূতি-আনন্দ-বেদনার বিচিত্র আবেদনকে কেন্দ্রে রেখে প্রেম আর
প্রকৃতি পরস্পরকে চায় অনাদিকাল ধরে, এটাই সত্যি আর স্বাভাবিক
-- ঠিক যেমন কথা চায় সুরকে, রূপ চায় ভাবকে,
ঝরাপাতা ডাকে ঝড়কে, অলির কথা শুনে বকুল হাসে,
আর অসীম আকাশ না ডাকলে বলাকারা সুদূরে পাড়ি দিত কিনা—সে প্রশ্নও জাগে গানেরই কথায়, সুরে, গায়নে।
এ গান প্রথম যখন শুনেছি, এত কিছু মনে আসেনি। শুধু তেরো-চোদ্দ বছরের মনে দোলা দিয়েছিল কথা আর সুরের মিল, আর অনির্বচনীয় এক কণ্ঠে তার একাকার হয়ে যাওয়া অভিব্যক্তি। পরে নেশা চেপেছে খুঁজে দেখার, কথা,
সুর, গায়ন ধরে ধরে খুঁজে দেখা—না না, ব্যবচ্ছেদ নয়। ছিঁড়ে-কেটে না ফেলেও তো আঙুল বুলিয়ে, চোখের কাছে
এনে পরখ করে দেখা যেত পাতার শিরা-উপশিরা, বৃন্তের গড়ন, পাপড়ির ভেতরের দিকের রঙ—ছোটবেলায় তাই তো করেছি। ছিঁড়ে খাতায় লাগিয়ে ফেলার হুকুম
ভালো লাগত না কোনদিন, কিন্তু ছুঁয়ে দেখা,
কাছ থেকে চোখে দেখা ভালো লাগত। এখানেও
ওইটুকুই— গানের প্রকৃতিটুকু ছুঁয়ে দেখতে চাওয়া। তাতে মনে হয়েছে, এ গানের মধ্যে ছন্দের যে আবর্তন, তাতে বিশ্বপ্রকৃতির স্পন্দনের আভাস। লয় দ্রুত, স্বরক্ষেপণ সোজা, যাকে বিদেশে বলে ‘staccato’। কিন্তু পশ্চিমি ‘staccato’ এত নরম,
এত মেদুর হয় না, এখানে হয়েছে তার কারণ এদেশের প্রকৃতি,
জলহাওয়া, আর স্রষ্টার নিজের প্রকৃতিও। ‘Staccato ’ শেষ
পর্যন্ত এসে মিলছে হালকা আন্দোলনে, আবর্তনে, গানের ভাব সেটাই চাইছে। একদিকে বলাকা, অন্যদিকে আকাশ, একদিকে বাঁশি অন্যদিকে নূপুর,
একদিকে ফুলের গন্ধ, অন্যদিকে হাওয়ার পরশ—
এরাও পরস্পরকে চায়, আর সেই মিলের সুর ধরিয়ে দিচ্ছেন
শিল্পী, কোন এক ‘তুমি’র জন্য। কিন্তু পুরোপুরি মিল শেষ পর্যন্ত হয়ে গেলে তো খেলা যাবে ভেঙে, তখন কেই বা আমি, কেই বা তুমি! গানটা গাইবে কে আর শুনবেই বা কে? তাই প্রকৃতির ইচ্ছে
খেলাটা চলুক, মানুষও সায় দেয়, আর শ্রোতার
যদি ইচ্ছে হয়, ‘ওই আকাশ না ডাকলে’র অনির্দেশ্য
প্রশ্নের সুরেলা আমেজ তেহাই-এর মেজাজে (হায় ভগবান, আধুনিক গানে তেহাই!) শেষ হবার পরও গানটা আর একবার শুনি, তাকেও দোষ দেওয়া যায়
কি?
লিখতে লিখতে মনে পড়ল আর একখানা গান, ‘কত দিন পরে এলে—একটু বোসো’। এ গানের জন্ম নাকি গীতিকার আর সুরকার-শিল্পীর মধ্যে অনেকদিন পর দেখা হওয়ার মুহূর্তে ঘরোয়া অভ্যর্থনার সূত্রে। স্বাভাবিক কথনভঙ্গিতে শুরু হওয়া গানটা অন্তরায় হঠাৎই বাঁক নেয় ঘরের কোণ ছেড়ে বাইরের
উদার, মুক্ত প্রকৃতির অভিমুখে। ‘আকাশে বৃষ্টি আসুক,
গাছেরা উঠুক কেঁপে ঝড়ে’। বৃষ্টি
এল কিনা জানি না, কিন্তু গলার
‘ক্রুনিং’-এ, সুরে সুরে ছবিটা
পরিষ্কার ফুটল—আকাশের কোণে মেঘ জমেছে, বাতাসের
ঝাপটায় গাছের পাতাগুলো দুলছে—এই বৃষ্টির কামনাটুকু চিরকালের—আর তার পেছনে লুকিয়ে আছে গ্রীষ্মের দাহে শুকিয়ে যাওয়া মাটির শান্তির আশা,
চাষিভাইদের ফসলের কামনা, মানুষ ও পরিবেশের নিবিড়
সম্পর্কের চেতনা। পরের স্তবকে আবার-- জীবনের পথের কিছুটা অন্তত সবুজ ঘাসে ঢাকা থাকুক, এই মানবিক ভালোবাসার চাওয়াটুকু প্রকৃতিচেতনায় মিলে যায় অনায়াসেই। কবিতায় যাকে ‘ইকোপোয়েটিক্স’ নাম দিয়ে তার মধ্যেকার উচ্চাঙ্গ সাহিত্যগুণ
ব্যাখ্যা করা চলে, গানে তাকে ‘আকাশ-বাতাস-মেঘ-বৃষ্টি’ বলে হেয় করার বোধহয় এটাই কারণ-- এগুলো তো ‘হালকা’ আধুনিক গান, হাজার হাজার
লাখ লাখ সাধারণ মানুষ ভালোবেসে তা শোনে, আমাদের অফিস-করণিক দাদা ‘বড়বাবু’র বিদায়সংবর্ধনা
সভায় এই গানটাই গেয়ে ওঠেন স্বতঃস্ফূর্ত আবেগে—কেন যে,
তার জবাব অতি-বুদ্ধিবাদী তত্ত্ব-প্রকরণচারী মস্তিষ্কে সহজে ধরা দেয় না।
এসব প্রশ্নের আসলে জবাব হয় না। তাই কোন এক অতি-আধুনিক বিজ্ঞ সমালোচক
বলেছিলেন, ‘টিনটার্ন অ্যাবে’র কয়েক
মাইল ওপরে দাঁড়িয়ে কবির মনে পড়ল তাঁর ছেলেবেলার কথা, প্রকৃতির স্পন্দন তিনি নতুন করে অনুভব করলেন পরিণত
বয়সের ব্যক্তিগত দার্শনিক অনুভবের নিরিখে। তা করলেন তো ভালো,
তাতে জগতের কী এল গেল? এখন সেইটা বুঝতে গেলে তো
অনুভূতি লাগে, আর লাগে হৃদয়—আকাশের মত বিশাল,
নদীর মত বাঁধনহীন। এই দেখুন, বলতে বলতেই ঢেউয়ের মত মনের কথা
ভাসিয়ে নিতে চাইছে আর একখানা গান, ‘ও নদী রে একটি কথা শুধাই শুধু
তোমারে’। কোনও চরিত্রের মুখে গাওয়া না হলেও, গান কিভাবে নিজেই প্রকৃতির
মতই এক প্রাণময় পরম সত্তা
হয়ে উঠতে পারে, এবং একটি সাহিত্যধর্মী, সমাজসচেতন, মানবিক আবেদনে ভরা চলচ্চিত্রের হৃদয় এবং মস্তিষ্ক
হিসেবে কাজ করতে পারে একইসাথে, তার অন্যতম সেরা উদাহরণ ‘নীল আকাশের নীচে’(১৯৫৯)
ছায়াছবির এই গান। গানটি আন্তর্জাতিক হয়ে উঠেছিল ইংরেজি ছবি ‘সিদ্ধার্থ’(১৯৭২)-তে
আবার ব্যবহার করার সূত্রে। ছবির কাহিনি অনুযায়ী এ নদীর
নাম হতে পারে ভারতের গঙ্গা বা চীনের ইয়াংসিকিয়াং, কিন্তু যদি সমগ্র
মানবসভ্যতার কথা ভাবি, তাহলে এ নদী অনেক বড় অর্থে জীবনের প্রবাহের
সঙ্গে একাকার। সেই নদীকে ডাক দিচ্ছে মানবতা, সেই ডাক মিশে যাচ্ছে তার প্রবাহের সঙ্গে, এমন এক প্রবাহ যার চলার শেষ নেই। এই কথাগুলো
বলার জন্য যেন এই সুর ছাড়া আর কোন অভিব্যক্তি হতে পারত না।
নদীর সঙ্গে কথা বলছেন যে শিল্পীমানুষ, শুধু একজন ব্যক্তি তিনি নন, তিনি মানবতার মুখ। প্রকৃতির চিরন্তন প্রবাহের সঙ্গে মনের
কথা আদানপ্রদানের বাহক হয়ে উঠছে একটি বিহ্বল প্রশ্ন—“বল কোথায় তোমার দেশ, তোমার নাই কি চলার শেষ…”
অন্তরায় সেই বাধাবন্ধহীন নদীর চলার তাৎপর্য ফুটে উঠল শুদ্ধ নিখাদের
প্রয়োগে—“তোমার কোন বাঁধন নাই তুমি ঘরছাড়া কি তাই/ এই আছ ভাটায় আবার এই তো দেখি জোয়ারে।” মধ্য সপ্তকের নি-তে শুরু হয়ে আবার মন্দ্র সপ্তকের নি-তে ফিরে আসা। সপ্তকের শুরু বা শেষ সা-তে,
তার ঠিক আগের স্বর শুদ্ধ নি। সংগীতের
ভাষায় নিখাদ যেন এক কিনারা, এক প্রতীক্ষা, এক অভাববোধের দ্যোতনা আনে—কিনারা নেই, তাই সে নদী ঘরছাড়া।
সঞ্চারীতে মধ্যমকে সা করে গানটা ফিরে এল স গ
প কর্ডে। এ শুধু নদীর গতিপথের ধর্ম
নয়, জীবনের ধর্ম-- “এ কূল ভেঙে ও কূল
তুমি গড়ো, যার এ কূল ও কূল দু কূল গেল তার লাগি কী করো।” ভাঙ্গা-গড়া বোঝাতে এইভাবে মধ্যমে দাঁড়িয়ে পড়া এক সূক্ষ্ম অথচ অভিনব প্রয়োগ,
যা কথার সাথে সামঞ্জস্য রেখে এক অপূর্ব আবেদন সৃষ্টি করে। শেষ স্তবকে এসে, জোয়ার ভাঁটা ভাঙা
গড়া সবকিছুর ঊর্ধ্বে উঠতে পারে যে মানবতার বিবেক, সে নদীর বিশালতার
সঙ্গে একাকার হয়ে গিয়ে বলতে পারে—“আমায় ভাবছ মিছেই পর... সুখ
দুঃখের কথা কিছু কইলে না হয় আমারে।” এত গভীর কথা, এত সহজ করে বলা—এবং সেটা সাড়ে
তিন মিনিটের একটা গানের মাধ্যমে—এর পরও যদি কেউ আকাশ-বাতাস-মেঘ-নদীর নামে গালমন্দ
করতে চান তো করুন, সে তাঁর ব্যক্তিগত অধিকার।
ব্যক্তিগত মতামতের কথাই যখন উঠল, তখন খুব
পরিচিত একজনের কথা বলেই শেষ করি। এই অধমের অকিঞ্চিৎকর ভালোলাগাকে তিনি প্রায়ই
‘আকাশ-বাতাস-চাঁদ-তারা-ফুল-ছবি-গান’ নিয়ে পাগলামি বলে ব্যঙ্গ করেন। বাইরের জীবনে
তিনি উচ্চপদস্থ, উচ্চশিক্ষিত, সমাজসচেতন, সংবিধান-আইন-অধিকারসচেতন এক মানুষ। কিন্তু
অত্যন্ত ব্যক্তিগত যন্ত্রণার মুহূর্তে তিনিও আশ্রয় নেন একান্তে, ‘শ্যামলা গাঁয়ের
কাজলা মেয়ে’, ‘মেঘ কালো আঁধার কালো’র মত গানে, হারিয়ে যাওয়া ছোটবেলার জন্য আড়ালে
কাঁদেন ‘ফুল পাখি বন্ধু আমার ছিল’ বা ‘আমাদের ছুটি ছুটি চল নেব লুটি’র মত গান শুনে। ‘ফিল্ডওয়ার্ক’-এর ব্যস্ততায় গ্রামেগঞ্জে ছুটতে
ছুটতে দু-দণ্ডের জন্য থমকে দাঁড়িয়ে ছবি তুলে নেন নদীর ওপারে অস্তগামী
সূর্যের, শেয়ার করেন ক্যাপশন দিয়েঃ ‘সূর্য
ডোবার পালা আসে যদি…’ জানি, এ সবই
ব্যক্তিগত, কিন্তু ব্যক্তি ছাড়া তো সমাজ হয় না,
তার দেখার চোখ, অনুভবের মন আর শোনার কান ছাড়া আকাশ-বাতাস-প্রকৃতি-গান কিছুই হয় না। ‘অশথের ছায়ে মাঠের প্রান্তে দূরে, রাখালি বাঁশির
বেজে বেজে ওঠা সুরে’ তাই থেকেই যাবে এই সব গান, আর তা শুনতে শুনতে লুকিয়ে চোখের জলটুকু মুছে নেবার মত, ধরা যাক এই
অধমের মত-- কিছু মানুষও থাকবে— আবার ঘুরে
তাকাবে, কেউ দেখে ফেলে নি তো? আজও এমন মানুষের
সংখ্যা নিতান্ত কম নয় বোধহয়, না হলে ইউটিউব-এ এসব গানের ‘ভিউ’ এত হয় কেমন করে,
কে জানে!