সোমবার, ১৯ জুন, ২০২৩

<<<< সম্পাদকীয় >>>>

 


কালিমাটি অনলাইন / ১১৪ / একাদশ বর্ষ : চতুর্থ সংখ্যা




বিশ্বে দীর্ঘকাল ধরে ঋতুর যে বিন্যাস প্রচলিত আছে, তাতে ভারত এবং তার প্রতিবেশী দেশগুলিতে সারা বছরে ছ’টি ঋতুর কথা উল্লেখ করা হয়ে থাকে। প্রতিটি ঋতুর জন্য দুটি মাস বরাদ্দ করা হয়েছে। এবং যতদিন পর্যন্ত মানুষ প্রকৃতির যাবতীয় নিয়মকে যথাযথ মর্যাদা দিয়েছে, তাকে উত্যক্ত করেনি, ততদিন প্রকৃতিও তার ভারসাম্য বজায় রাখতে পেরেছে। কিন্তু যখন থেকে শিল্প ও প্রযুক্তি ক্রমশ উন্নততর হয়েছে, মানুষের বসবাস ও জীবনধারণ অনেক অনায়াস ও জটিলতামুক্ত হয়েছে, তখন থেকে মানুষের লোভ ও লালসাও ক্রমবর্ধিত হয়েছে। আর সেই লোভ ও লালসার শিকার হয়েছে প্রকৃতি। ইস্কুলে পড়াকালীন ষান্মাসিক ও বার্ষিক পরীক্ষায় প্রশ্নপত্রে রচনা লেখার জন্য কিছু নম্বর নির্ধারিত থাকত এবং কয়েকটি বিষয়ের মধ্যে কোনো একটি বিষয়কে বেছে নেবার ‘অপশন’ থাকত। আমরা সবাই জানি, সেই বিষয়গুলির মধ্যে একটি বিষয় থাকত, বিজ্ঞান আশীর্বাদ না অভিশাপ? বলা বাহুল্য, এই বিষয়টি নিয়ে আমরা পরীক্ষার খাতায় কয়েক পাতা রচনা লিখেছি। তবে এখন এই পরিণত বয়সে পৌঁছে মনে হয়, বিষয়টির গোড়াতেই ভুল ছিল। বিজ্ঞানের আবার আশীর্বাদ বা অভিশাপ হয় নাকি? তার ভালো বা খারাপ কিছু হতে পারে না। বিজ্ঞান তো আর অন্য কিছু নয়, বরং যে প্রকৃতির অন্তর্গত এই বিশ্ব থেকে ব্রম্ভান্ড, সেই প্রকৃতির নিয়ম বা প্রাকৃতিক নিয়মই হচ্ছে বিজ্ঞান। বিজ্ঞান অর্থে বিশেষ অর্জিত জ্ঞান। এবং বিজ্ঞানচর্চা অর্থে প্রকৃতিচর্চা। সুতরাং বলা যেতে পারে, বিজ্ঞান আশীর্বাদ না অভিশাপ, এই বিষয়টিকে বর্জন করে প্রশ্ন রাখা যেতে পারে, প্রযুক্তি আশীর্বাদ না অভিশাপ? এর উত্তরে বলা যেতে পারে, একদিকে যেমন প্রযুক্তি মানুষের জীবনে ও ধারণে আশীর্বাদের বন্যা বইয়ে দিয়েছে, অন্যদিকে তা হয়ে দাঁড়িয়েছে ভয়ংকর অভিশাপ। আর এই দুটি ব্যাপারই ঘটেছে মানুষের ইচ্ছায় অথবা হিংসায়। কেননা, প্রযুক্তি নির্মাণ ও নিয়ন্ত্রণ মানুষেরই হাতে। কল্যাণকামী মানুষের কল্যাণ কামনায় যদি প্রযুক্তিকে ব্যবহার করে, তবে তা আশীর্বাদ, আর যদি লোভ ও লালসায় উন্মত্ত হয়ে ব্যবহার করে, তবে তা অভিশাপ। এসব কথা আমরা সবাই জানি, উদাহরণ হিসেবে অনেক প্রসঙ্গই আমাদের জানা আছে। এবং প্রকৃতির নিয়মের বিরুদ্ধতা করলে, প্রকৃতি যে তার শোধ তুলবে, একথাও আমাদের অজানা নয়।

আর তাই, ভারতীয় উপমহাদেশে বছরের ঋতুবিন্যাস যে নিয়ম মেনে করা হয়েছিল, আজ মানুষের প্রকৃতির বিরুদ্ধাচরণে তা বিঘ্নিত হচ্ছে। মূলত তিনটি নির্দিষ্ট সময়কালে নির্দ্ধারিত ঋতুর ওপর দাদাগিরি করছে অপর তিনটি ঋতু। শরত, হেমন্ত ও বসন্ত প্রায় চাপা পড়ে যাচ্ছে গ্রীষ্ম, বর্ষা ও শীতের দাপটে। এরমধ্যে শীত হচ্ছে তুলনামূলকভাবে দুর্বল। এই উপমহাদেশের অধিকাংশ স্থানে তার আয়ুসীমা বড়ই স্বল্প। এসেই যাই যাই তাড়া। সেক্ষেত্রে বর্ষা কিছুটা সবল হলেও তার আসা ও যাওয়া বড়ই অনিশ্চিত, বোহেমিয়ান চরিত্র তার। অনেকসময় তার জন্য বরাদ্দ সময়ে তার দেখা পাওয়া যায় না, আবার অন্যের বরাদ্দ সময়ে তার অনুপ্রবেশ ঘটে। তবে মানতেই হবে, প্রবল ও প্রচন্ড গ্রীষ্ম দাদাগিরিতে প্রথম। শুধু নিজের জন্য নির্দিষ্ট সময়কালেই নয়, বাকী পাঁচটি ঋতুর সময়কালেও সে দাদাগিরি করতে চায় এবং করেও। আর গ্রীষ্মকে এই দাদাগিরির সুযোগ করে দিয়েছে এই বিশ্বের লোভী ও স্বার্থপর কিছু মানুষ। মানুষেরই লালসায় প্রকৃতির ভারসাম্য আজ টালমাটাল। প্রতিটি মুহূর্তে এই পৃথিবীর উষ্ণায়ণ সংঘটিত হচ্ছে। তাপমাত্রা যাচ্ছে বেড়ে। আমরা প্রচন্ড গরমে কাহিল হয়ে পড়ছি। কত প্রাণ অকালে শেষ হয়ে যাচ্ছে এই গরম সহ্য করতে না পেরে। যাদের সাধ্য আছে, সামর্থ আছে, তারা প্রযুক্তির সাহায্যে শৈত্যকে আহ্বান করতে পারছেন; কিন্তু এই বিশ্বে বসবাসকারী অধিকাংশ মানুষেরই সেই সাধ্য ও সামর্থ নেই। তাদের জীবন হয়ে দাঁড়াচ্ছে সব থেকে অসহনীয়। এবং এভাবেই যদি প্রকৃতি যদি ক্রমশই বিমুখ হয়ে উঠতে থাকে, আশঙ্কা হয়, আমরা আমাদের অস্তিত্ব আর কতদিন টিকিয়ে রাখতে পারব!

আমরা জানি, এই দু;সহ গরমে কেউ ভালো নেই। তবু কামনা করি, সবাই ভালো থাকার চেষ্টা করুন, সুস্থ থাকার চেষ্টা করুন।

 

আমাদের সঙ্গে যোগাযোগের ই-মেল ঠিকানা :

kajalsen1952@gmail.com / kalimationline100@gmail.com

দূরভাষ যোগাযোগ : 9835544675

অথবা সরাসরি ডাকযোগে যোগাযোগ : Kajal Sen, Flat 301, Phase 2, Parvati Condominium, 50 Pramathanagar Main Road, Pramathanagar, Jamshedpur 831002, Jharkhand, India.

 

 

 

 


অভিজিৎ মিত্র

 

সিনেমার পৃথিবী – ৩১          




আগের পর্বে আমরা ইউরোপের মাঝামাঝি চারটে দেশের ছবি নিয়ে আলোচনা করেছিলাম। আজ বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে থাকা আরো তিনটে দেশ। কিন্তু এদের নিয়ে কিছু না লিখলে ইউরোপের সিনেমা নিয়ে আলোচনা অসম্পূর্ণ থেকে যাবে। উত্তরদিকে উত্তর সাগরের দক্ষিণপ্রান্তে নেদারল্যান্ড বা হল্যান্ড। দক্ষিণদিকে আড্রিয়াটিক সাগরের ধারে  যুগোস্লাভিয়া থেকে আলাদা হয়ে যাওয়া বসনিয়া-হার্জেগোভিনা এবং আরো দক্ষিণে ভূমধ্যসাগরের তীরে ছড়িয়ে থাকা ছবির মত সুন্দর দেশ গ্রীস।

হল্যান্ড দেশটা তৈরি হয়েছিল মোটামুটি দ্বাদশ শতকে। ছোট দেশ। প্রথম ছবি তৈরি হয়েছিল সেই ১৮৯৬ সালে। কিন্তু দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ওখানকার ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রি প্রায় বন্ধ হয়ে গেছিল। আবার সেই ইন্ডাস্ট্রি শুরু হয় ষাটের দশকে এবং সত্তরের দশক থেকে সরকারি সাহায্যে ডাচ সিনেমার জয়জয়কার শুরু হয়। পল ভারহুভেনের হাত ধরে। ডাচ সিনেমা বললে এখনো অব্ধি মোটামুটি যে যে ছবির কথা মাথায় আসবেই - ভিলেজ অন দ্য রিভার (১৯৫৯), তুর্কিশ ডিলাইট (১৯৭৩), সোলজার অব অরেঞ্জ (১৯৭৭), দ্য অ্যাসল্ট (১৯৮৬), অ্যান্তোনিয়া’জ লাইন (১৯৯৫), ক্যারেকটার (১৯৯৭), জুস অ্যান্ড জো (২০০২), টুইন সিস্টার্স (২০০৩), দ্য ব্ল্যাক বুক (২০০৬), উইন্টার ইন দ্য ওয়ার টাইম (২০০৯), অ্যাকিউজড (২০১৪), ক্লোজ টু ভারমিয়ার (২০২৩)।

এখানে আমরা বেছে নেব এক ফেমিনিন সিনেমা, যাকে ফেমিনিন রূপকথা বললেও কম বলা হবে। সাহসী রূপকথা। অ্যান্তোনিয়া’জ লাইন। মার্লিন গোরিসের একঘন্টা চল্লিশ মিনিটের সিনেমা। এক মাতৃতান্ত্রিক সমাজের কথা। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর বিধবা অ্যান্তোনিয়া তার মেয়েকে নিয়ে নিজের মায়ের গ্রামে ফিরে আসে। এসে একে একে পুরনো বন্ধুদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে। তারপর প্ল্যান করে শুধু মেয়েদের দিয়ে এক পরিবার তৈরি করার। একে একে পুরুষদের সেই গ্রাম থেকে তাড়িয়ে দেয়। নিজের মেয়েকে শহরে নিয়ে গিয়ে এক ব্যক্তির সঙ্গে সঙ্গম করিয়ে এনে গর্ভবতী করায়। সেই বাচ্চার জন্মের পর সেও মহিলাদের মাঝেই বড় হয়ে ওঠে। এবং একসময় সেও তার এক বাল্যবন্ধুর সাহায্যে গর্ভবতী হয়। বহুবছর পর অ্যান্তোনিয়া যখন মারা যাচ্ছে, তার আশেপাশে তার পরিবারের মেয়েরা ভিড় করে দাঁড়িয়ে।

এই গল্পে পরিবার আছে, ভালবাসা আছে, আশা আছে, রাগ আছে, ভবিষ্যতের কথা আছে কিন্তু সেই সবই মাতৃতান্ত্রিক ধাঁচে। এটাই জানিয়ে দেওয়ার জন্য যে মহিলারাও সব নিজে হাতে করতে পারে, চাষবাস থেকে শুরু করে পরিবার গড়ে তোলা অব্ধি। এই গল্পের সূত্রধর, অ্যান্তোনিয়ার প্রপৌত্রী, জীবনের এই ছন্দের সূত্র ধরেই এগিয়ে যেতে ভালবাসে। গল্প প্রায় পঞ্চাশ বছর এগিয়ে যায়, অ্যান্তোনিয়া-র পরিবার বেড়ে চলে – কিন্তু মূলসুর যেন সেই ছন্দেই বাঁধা থাকে। একের পর এক ঋতু আসে, যায়, আর সেই মেয়েদের পরিবারের সময় ধীর লয়ে কেটে যায়। গল্পটা সুন্দর, সাহসী এবং খানিক পাগলাটেও বটে। তবে এটা ঠিক, এই গল্প কখনোই বোর করে না। আসলে এখানে অনেকগুলো ব্যাপার একসঙ্গে মিশে আছে। সেক্স, আনন্দ,‌ গড়ে তোলা, স্বাধীনতা, পরিবারতন্ত্র এবং মৃত্যু। এই সূতোটাই ছবি ধরে রাখে। তবে হ্যাঁ, ডাচ সিনেমা নিয়ে কথা শেষ করার আগে পাঠকদের অনুরোধ করব একবার সাড়ে আট মিনিটের ছোট্ট অ্যানিমেশন ছবি ‘ফাদার অ্যান্ড ডটার’ (২০০০) দেখতে। মনোযোগ দিয়ে। 

বসনিয়া-হার্জেগোভিনা নবীন দেশ। উনিশ শতক থেকে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ অব্ধি অস্ট্রো-হাঙ্গেরি রাজত্বের অংশ ছিল। তারপর যুগোস্লাভিয়ার অংশ হয়েছিল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর যুগোস্লাভিয়ার অন্তর্গত এই দেশকে রিপাবলিক হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছিল। তারপর ১৯৯২ সালে যুগোস্লাভিয়া টুকরো হয়ে যাবার পর এই দেশ স্বাধীন হয়। ১৯৯৫ সাল  অব্ধি বসনিয়ার গৃহযুদ্ধ চলেছিল যা পাঠক পাঠিকা জানেন। অবশেষে এই দেশ থিতু হয়। তাহলে বুঝলেন, খুবই নবীন দেশ। বসনিয়ার ছবি নিয়ে বলতে গেলে তাহলে প্রথমেই যুগোস্লাভিয়াকে একবার ফিরে দেখতে হয়। অবশ্য সেটা আমি মাত্র একটা ছবির রেফারেন্সেই বলব। এমির কুস্তুরিকার আন্ডারগ্রাউন্ড (১৯৯৫)। আমার দেখা গত শতকের অন্যতম সেরা সুররিয়েল আর্ট ফিল্ম যা যুদ্ধের যন্ত্রণা ছত্রে ছত্রে ফুটিয়ে তুলেছিল। এই ছবি বাদে বসনিয়া- হার্জেগোভিনার উল্লেখযোগ্য অন্য ছবিগুলো হল - ওয়েলকাম টু সারাজাভো (১৯৯৭), দ্য পারফেক্ট সার্কল (১৯৯৭), নো ম্যান’স ল্যান্ড (২০০১), ডেজ অ্যান্ড আওয়ারস (২০০৪), দ্য ল্যান্ড অব মাই ড্রিমস (২০০৬), হালিমা’জ পাথ (২০১২), হোয়ার আর ইউ গোইং, আইডা? (২০২০)। হ্যাঁ, বসনিয়ার ছবির অন্যতম প্রধান দিক যদি বলতে হয়, আমার মতে, তা হল সিনেমাটোগ্রাফি।

আমি এখানে ‘নো ম্যান’স ল্যান্ড’ নিয়ে আলোচনা করব। ডেনিস ট্যানোভিচের এক উল্লেখযোগ্য ছবি। বসনিয়া যুদ্ধের সময় বসনিয়ার এক সৈন্য চিকি এবং সার্বিয়ান এক সেনা নিনো এক জনশূন্য জায়গায় আটকে পড়ে। তারা দুজনে প্রথমে দুজনের বিরুদ্ধে যুদ্ধং দেহি মনোভাব থাকলেও পরে নিজেদের ভেতর সমঝোতা করে নেয়। এবং দেখতে পায় কিছুদূরে আরেক বসনিক সেনা এক ল্যান্ডমাইনের ওপর অজ্ঞান হয়ে পড়ে আছে। তাকে তুলতে গেলেই মাইন ফেটে সবার মৃত্যু হবে। এক সময় চিকি ও নিনোকে ইউ-এন থেকে উদ্ধার করা হয়, কিন্তু বাইরে বেরিয়ে চিকি নিনোকে গুলি করে, শান্তি বজায় রাখতে ইউ-এন সৈন্য নিনোকেও গুলি করে। দিনের শেষে দেখা যায় মাইনের ওপর পড়ে থাকা সেই সেনাকে কেউ উদ্ধার করতে এগিয়ে আসেনি।

যুদ্ধের ভয়াবহতা, ব্ল্যাক কমেডি, যুদ্ধের সারশূন্যতা – যেভাবেই দেখা হোক, এই ছবি এক মাইলস্টোন। আউটডোর শুটিং হবার জন্য এই ছবির সিনেমাটোগ্রাফি বেশ ভাল - ক্যামেরার অ্যাঙ্গল, ক্লোজ শট, লং শট, এডিটিং। কিন্তু আমার মতে এই ছবির আসল ক্রেডিট হল যুদ্ধের ফাঁপা দর্শন এবং যুদ্ধের কমেডি দুটোর ব্যালান্স রেখে এগিয়ে যাওয়া। আমি হয়ত ঠিক বোঝাতে পারলাম না। স্পিরিচুয়ালিটি অ্যান্ড প্র্যাকটিস পত্রিকায় এই ছবি নিয়ে রিভিউ লেখা হয়েছিল – ‘a vivid film about the insanity of war and the dreadful things it can do to those who drench themselves in hate’। যথার্থ।  

গ্রীস নিয়ে প্রথম যে কথা বলতেই হয়, তা হল, এই দেশ ইউরোপ, এশিয়া ও আফ্রিকার ঠিক মাঝামাঝি পয়েন্টে দাঁড়িয়ে। প্রাচীন গ্রীক সভ্যতা, বাইজান্টাইন সভ্যতা ও অটোমান সাম্রাজ্য – সবকিছুর ধারক ও বাহক এই গ্রীস। পাশ্চাত্য দর্শন, সাহিত্য ও কলার উৎসভূমি এই দেশ। অলিম্পিক গেমসের সূচনায় এই দেশ। অ্যাক্রোপোলিস বা ডেলফি-র ছবি আজো যেন গায়ে কাঁটা দেওয়ায়। গ্রীক সিনেমা বললে আমার জ্ঞান অনুযায়ী অ্যাস্টেরো (১৯২৯) হল প্রথম গ্রীক ছবি। এরপর মাইকেল ক্যাকোয়ান্নিসের হাত ধরে গ্রীক ছবির উত্থান। সত্তরের দশকের পর থিও অ্যাঞ্জেলোপাউলোস।  

গ্রীসের ছবির প্রধান কিছু হল - ইলেক্ট্রা (১৯৬২), জোরবা দ্য গ্রীক (১৯৬৪), ব্লাড অন দ্য ল্যান্ড (১৯৬৬), দ্য ট্রোজান উওমেন (১৯৭১), ইফিজেনিয়া (১৯৭৭), মিসিং (১৯৮২), দ্য বি-কিপার (১৯৮৬), ল্যান্ডস্কেপ ইন দ্য মিস্ট (১৯৮৮), ইউলিসিস’ গেজ (১৯৯৫), ইটার্নিটি অ্যান্ড আ ডে (১৯৯৮), ডগটুথ (২০০৯), ডিগার (২০২০)। 

একটা ব্যাপার লক্ষ্য করুন, এই যত গ্রীক সিনেমার কথা ওপরে লিখলাম, তার মধ্যে সিংহভাগ ছবির পরিচালক ক্যাকোয়ান্নিস ও অ্যাঞ্জেলোপাউলোস। ক্যাকোয়ান্নিস নির্বাক চলচিত্র জমানার সেই পরিচালক, যিনি অবলীলায় থিয়েটারকে সিনেমায় তুলে এনেছেন। কিন্তু যার সিনেমায় সূক্ষ্ম চলাফেরা, সূক্ষ্ম বদলে যাওয়া, সূক্ষ্ম সময়ের হেরফের, রাজনৈতিক অস্থিরতা, সবই অবলীলায় ধরা পড়ে - তিনি হলেন অ্যাঞ্জেলোপাউলোস। লং শট এবং যৌগিক দৃশ্যের জাদুকর। দেখতে বসলে মনে হয় হিপনোটিক এফেক্ট ধরা পড়ছে। ওনার সাইলেন্ট ট্রিলজি (ভয়েজ টু সিথেরা, দ্য বি-কিপার এবং ল্যান্ডস্কেপ ইন দ্য মিস্ট) পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে সিনেমার সিলেবাসে পড়ানো হয়। আমরা গ্রীসের ছবি শুরু করব ওনার বিখ্যাত ছবি ‘ইটার্নিটি অ্যান্ড আ ডে’ দিয়ে।

আলেক্সান্ড্রোস মাঝবয়েসি এক লেখক। সালোনিকি শহরের সমুদ্রতীরে তার বাড়ি। একদিন হঠাৎ সে জানতে পারে তার এক দুরারোগ্য রোগ হয়েছে যার জন্য কাল তাকে হসপিটালে ভর্তি হতেই হবে। এবং সে নিজেও জানে না সে ছাড়া পেয়ে আবার বাড়ি ফিরবে কিনা। তার আক্ষেপ, সে এক বিখ্যাত কবিতার বই শেষ করতে হয়ত পারবে না। সে তার মেয়ে জামাইয়ের কাছে যায় তার পোষ্য কুকুরটার খেয়াল রাখার জন্য কিন্তু মেয়ে অস্বীকার করে। সে ফিরে আসে। এবং রাস্তার ধারে এক আলবানিয়ান উদ্বাস্তু ছেলেকে কি করে উদ্ধার করে বাড়ি পৌঁছে দেওয়া যায়, সেই চিন্তায় মগ্ন হয়। অতীতের অনেক স্মৃতি তাকে ঘিরে ধরে। তার মৃতা স্ত্রীকে সে দেখতে পায়, তার সঙ্গে কথা বলতে শুরু করে। সে কি পারবে এই এক দিনের জন্য অমরত্ব পেতে?

এই থিম নিয়ে বিষাদে ভারাক্রান্ত ছবি ‘ইটার্নিটি অ্যান্ড আ ডে’। থিও-র দু’ঘন্টা সতেরো মিনিটের ছবি। যেন একজন কবির জ্যামিতি, টপোলজি। কবি জানে সে আর একদিন পর পৃথিবীতে নেই, তবুও সে ফেয়ারওয়েলের কোন আয়োজন করছে না, বরং নীরবে অতীতের স্মৃতি নিয়ে চলে যাচ্ছে। শুনলে অবাক হতে হয়, এই সিনেমার শরীরি ভাষা একটাই শক্ত যে ছবির মুখ্য চরিত্র ব্রুনো যে প্রত্যেক সংলাপ জার্মানে বলেছেন, তারপর সেটা গ্রীক ভাষায় ডাব করা হয়েছে, তা বোঝা যায় না। শুধু একটাই কথা ছবির পর দর্শকের মনে রয়ে যায় – ‘Tell me, how long does tomorrow last?’।    

শেষ করার আগে ক্যাকোয়ান্নিসের ‘জোরবা দ্য গ্রীক’ নিয়ে কিছু কথা। অস্কার পাওয়া ছবি। এক তরুণ লেখক ক্রিটি দ্বীপে বেড়াতে গিয়ে জোরবা নামক এক বৃদ্ধের সাহচর্যে আসেন। এবং আস্তে আস্তে তার জীবনদর্শন বদলে যায়। জোরবা-র ভূমিকায় অ্যান্থনি কুইন অনবদ্য। গোটা সিনেমা মনে হবে যেন এক বন্য ঘোড়া, ছুটেই চলেছে, ক্লান্ত হবার লক্ষন নেই। আজো এই ছবি দেখলে সতেজ লাগে। জীবনে বাধা সত্তেও এগিয়ে যেতে ইচ্ছে করে। জোরবার মুখে – ‘Life is trouble. Only death is not. To be alive is to undo your belt and look for trouble’, ভোলা যায় না।   

গ্রীক সৌন্দর্য, গ্রীক সিনেমা দেখলে মাথার মধ্যে বিষ্ণু দে-র উর্বশী ও আর্টেমিস খেলে যায় – ‘আজো তাই লাবণ্যের  ঘরে/ আমার চেতনা ছেয়ে মায়া জাগে লাবন্যের নিঃশ্বাসের স্বরে/ নিঃশ্বাসের গন্ধে তার চুলের কালোয়/ উর্বশীর মায়া লাগে...’। গ্রীস নিয়ে আমার কিছু স্বপ্ন আছে। ইচ্ছে আছে মনের মানবীকে সঙ্গে নিয়ে জীবনে অন্তত একবার গ্রীসে বেড়াতে যাব, এথেন্সের অ্যাক্রোপোলিসে বা ডেলফি-র থিয়েটারের ধ্বংসস্তূপে ইতিহাসের রোমাঞ্চ অনুভব করব, ভূমধ্যসাগরের তীরে সান্টোরিনি দ্বীপে ছবির মত সাজানো সাদা বাড়িঘরের মাঝে হাতে হাত রেখে অলিতে গলিতে পাগলের মত ঘুরে বেড়াব, দূষনহীন গাড়িহীন রোডস্‌ শহরে পায়ে পায়ে মনুমেন্টগুলো দেখব, একবার তুর্কিতে ঢুঁ মেরে আসব আর পারোস দ্বীপের নীল জলরাশির মধ্যে দুজনে বসে সাগরের পাড়ে দাঁড়িয়ে থাকা সাদা শহরটায় দুচোখ মেলে সময় কাটাব।

ব্যস্‌, ইউরোপ নিয়ে সিনেমা ভ্রমণ এবার সাঙ্গ হল। সামনের বার অন্য মহাদেশ।  

(ক্রমশ)


প্রদোষ ভট্টাচার্য

 

কলকাতায় বাংলা ছবির ‘মুক্তি-শৃঙ্খল’ ৫ম পর্ব (রাধা - পূর্ণ) 

 


পূর্ণ

অধুনালুপ্ত ভবানীপুরের পূর্ণ সিনেমায় যত না বাংলা ছবি দেখেছি, বোধহয় তাঁর সমান বা বেশী দেখেছি ইংরেজী ছবি! বাস্তবে, পূর্ণর প্রথম স্মৃতি হলো খুব ছোটবেলায়, সম্ভবত রবিবার সকালে এখানে Son of Robin Hood  দেখতে যাওয়া, যে ছবির চমক ছিল যে আদতে গল্পের কেন্দ্রে যে চরিত্র, সে রবিন হুডের ছেলে নয়, মেয়ে ডিয়ারিং হুড! জীবনে প্রথম Tarzan-কে নিয়ে ছবিও এই পূর্ণতে রবিবার সকালে দেখা!

যাইহোক, এখন বাংলা ছবির প্রসঙ্গে আসি।

দুর্বোধ্য ও ক্লান্তিকর লেগেছিল ১২ই নভেম্বর ১৯৬৫-তে মুক্তি পাওয়া সুপার হিট ‘মুখুজ্যে পরিবার’। শুধু মনে আছে, অনুপকুমার হাতে একটি বল নিয়ে (সম্ভবত মান্না দের গলায়) সারা বাড়ি ঘুরছেন আর গাইছেন, “দাদরা-কাহারবায়-চৌতালে-ঝম্পকে, পাতায়-পাতায়, ডালে-ডালে / দুনিয়ায় সবাই ঘুরছে ভাই তালে!” গান তিনি থামাতে বাধ্য হচ্ছেন যখন রান্নাঘর থেকে কোমরে কাপড় গুঁজে বেরিয়ে এসে কোন এক গুরুজন-স্থানীয়া মহিলা (ছায়া দেবী?) অনুপকুমারকে সমানে চপেটাঘাত করতে শুরু করছেন! অন্যান্যদের মধ্যে অভিনয়ে ছিলেন জহর গাঙ্গুলী।

১৯৬৬তে আমার জেদের বশবর্তী হয়ে বাবা আমায় নিয়ে যান পূর্ণতে ‘মায়াবিনী লেন’ দেখতে, কারণ ছবির পোস্টার দেখে ভেবেছিলাম এটি ভূতের গল্প! দাদা বারবার সাবধান করেছিলেন যে গল্প একটি বস্তিকে নিয়ে, ভূতের ‘ভ’ও ছবিতে নেই। মনে করুন ছবির প্রথম দৃশ্য, কুয়াশায় ঢাকা আবহাওয়ার মধ্যে দিয়ে কাঁধে বস্তার মতো কী একটা নিয়ে এগিয়ে চলেছেন বিকাশ রায় – দেখে খুব আশা করলাম ভূত আসবে! কিন্তু দাদাই ঠিক, বস্তিবাসীদের জীবন সংগ্রামের গল্প, যে বস্তিকে ভেঙে গড়ে উঠতে চলেছে প্রাসাদ! শুধু চমক লেগেছিল চেনা মেট্রো সিনেমাকে দেখে, যার কাছে রাস্তায় নেচে-নেচে গান করছেন একজন পুরুষ ও এক মহিলা, “দুনিয়াটা সব ভিতরে কালো, বাইরেতে চুনকাম” (পুরুষকণ্ঠ সম্ভবত সতীনাথ মুখোপাধ্যায়ের)। আর নায়কের (নির্মলকুমার?) মুখে অপ্রত্যাশিতভাবে খুব চেনা কণ্ঠে গান, “ওগো মায়াবিনী লেন”! বলে দিতে হবে কি, কার কণ্ঠ? বাবা অবশ্য ছবিটি দেখে খুবই বিরক্ত  হয়ে আমাকে ভর্ৎসনা করেছিলেন।

১৯৬৭ সালে অক্টোবর মাসে (মুক্তির তারিখ ২৯শে সেপ্টেম্বর) ৬০ সালে ‘সখের চোর’ আর ৬৫ সালে ‘কাপুরুষ ও মহাপুরুষ’-এর পর সত্যজিৎ ও উত্তম একসঙ্গে আমার সিনেমা-দেখার ভুবনে আবির্ভূত হন ‘চিড়িয়াখানা’তে (পূর্ণ)! বুঝতেই পারছেন কেন এই ছবি দেখার অনুমতি মিলেছিলঃ গোয়েন্দা কাহিনী যে! আর প্রথম দর্শনেই উত্তমকুমার আমাকে অভিভূত করেছিলেন! অথচ, তাঁর বা সত্যজিতের অতি বড় ভক্তও দাবী করবেননা যে দু’জনের শ্রেষ্ঠ ছবিগুলির মধ্যে ‘চিড়িয়াখানা’ পড়ে!

সম্ভবত ১৯৬৮ বা ৬৯-এ পূর্ণতে মা আমার ইচ্ছাতেই নিয়ে গিয়ে দেখিয়েছেন পুনর্মুক্তিপ্রাপ্ত ১৯৪৯ সালের দেশাত্মবোধক ছবি ‘চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুণ্ঠন’, যার অন্যতম সম্পদ একাধিক রবীন্দ্রসঙ্গীত ও নজরুলগীতি।

১৯৭২-এর শেষে এরপর দেখি আমার প্রথম (আংশিক) রঙিন বাংলা ছবি, অরুন্ধতী দেবী পরিচালিত ‘পদিপিসীর বর্মিবাক্স’, পূর্ণতে। (এর আগে বাংলা ছবিতে রং দেখেছি প্রথম বোধহয় ‘গুপী গাইন ও বাঘা বাইন’-এর শেষ দৃশ্যে)। এখনকার সিনেমায় বা ধারাবাহিকে অতীতকে সাধারণত দেখানো হয় সাদা-কালোয় বা সেপিয়ায়, বর্তমান থাকে ‘স্বাভাবিক’ভাবে রঙিন। আর ৭২ সালে বর্তমানের ঘটনা দেখানো হয়েছিল তখন বাংলা ছবির রীতি মেনে প্রত্যাশিত  সাদা-কালোয়। আর যে মুহূর্তে পাঁচুমামা (চিন্ময় রায়) পদিপিসীর সম্বন্ধে স্মৃতিচারণ আরম্ভ করলেন, ছবি হয়ে উঠল রঙিন! অন্যদের অতীতকথনের সময়ও রঙিন চিত্রগ্রহণ ব্যবহৃত হয়েছে। পদিপিসীরূপী ছায়া দেবী দক্ষ অভিনেত্রী, কিন্তু বর্তমানের পদ্মা দেবীর অভিনয়ের পাশে তাঁর কাজ একটু মোটা দাগের লেগেছিল। আর অতীতের চরিত্রে দ্বিজু ভাওয়াল (?) এবং তাঁর সাঙ্গোপাঙ্গোদের কীর্তিকলাপও অত্যধিক স্থূলরুচির মনে হয়েছে। দুই ক্ষেত্রেই পরিচালিকা আরেকটু সংযত অভিনয় দাবি করতে পারতেন।

সত্তরের দশকেই পূর্ণতে দেখে মুগ্ধ হয়েছিলাম শ্রীমতী পিকচার্স-এর পুনর্মুক্তি প্রাপ্ত, শরৎচন্দ্রের কাহিনি অবলম্বনে কানন দেবী, কমল মিত্র, জহর গাঙ্গুলী, ধনঞ্জয় ভট্টাচার্য প্রমুখ অভিনীত ‘নব বিধান’। ‘অগ্নীশ্বর’ দেখেছি অনেক পরে, ৮০-র দশকের গোড়ায়, যখন পূর্ণতেই ছবিটি (পুন)র্মুক্তি পায়, যেমন ৭৫-এ প্রথম পেয়েছিল। অনেকদিক দিয়েই প্রশংসনীয় ছবি, কিন্তু প্রথমার্ধে উত্তমকুমার খানিকটা অতি-অভিনয় করেননি কি? ঐ চশমার ওপর দিয়ে তাকিয়ে থাকা! পরে শুনেছি উত্তম সজ্ঞানেই এ কাজ করেছিলেন, বাস্তব জীবনে তাঁর দেখা কোন একজনের অনুকরণে। তুলনায় দ্বিতীয়ার্ধে উত্তমের অভিনয় অনেক বেশী স্বাভাবিক। আমার কাছে বিশেষ আকর্ষণ অবশ্যই ছিল হেমন্তকন্ঠে “পুরানো সেই দিনের কথা” আর তাঁর গাওয়া দুটি দ্বিজেন্দ্রগীতির মধ্যে একটিঃ “ধনধান্যে পুষ্পে ভরা”। ছবিটি মার সঙ্গে দেখেছিলাম ‘ডবল শো’-এ। এর আগের প্রদর্শনীতে পাশেই ভারতীতে দেখেছিলাম ‘সপ্তপদী’।

কোন এক সময় পূর্ণতে দেখি পুনর্মুক্তিপ্রাপ্ত ১৯৫৪ সালের ছবি ঢুলি। ১৯৭৪/৭৫-এ দেবী চৌধুরাণী-রূপে মহানায়িকা মন কাড়েননি একেবারেই। কিন্তু এবার অনুভব করি সুচিত্রা সেনের মুগ্ধ-করা সৌন্দর্য এবং তাঁর অভিনয় ক্ষমতা। এটিই সম্ভবত একমাত্র ছবি  যা’তে সুচিত্রা সেন এবং মালা সিনহা একসঙ্গে অভিনয় করেছেন। ছবির নাম জানা  ছিল ধনঞ্জয় ভট্টাচার্যের কণ্ঠে ‘ত্রিনয়নী দুর্গা’ গানটির জন্যে। দেখতে গিয়ে টাইটেল কার্ডে উপরি পাওনাঃ নেপথ্য  শিল্পীদের তালিকায় ‘ধনঞ্জয়’-এর পরেই সেই ‘হেমন্ত’! মেরুদণ্ডহীন নায়কের পাশে মহানায়িকা অপাত্রের প্রতি নীরব ভালোবাসায় দীপ্ত! এমনকি উচ্ছল কিশোরী ছাত্রীর ভূমিকায় মালাও মন কেড়েছেন।

পূর্ণতে শেষবার গেছি আশির দশকের গোড়ায়। আগেই বলেছি যে এখানে বাংলা ছবির পাশাপাশি দেখতাম ইংরেজী ছবি। কিন্তু এই শেষবার শ্যামাপ্রসাদ কলেজের দুই বয়োজ্যেষ্ঠ সহকর্মীকে নিয়ে দেখতে যাই একটি পুনর্মুক্তিপ্রাপ্ত ষাটের দশকের হিন্দী ছবিঃ আগাথা ক্রিস্টির উপন্যাস ও নাটক And Then There Were None অনুপ্রাণিত ‘গুমনাম’।

কালিঘাট-ভবানীপুর অঞ্চল ছিল বাংলা ছবির জায়গা। সবার আগে হিন্দী ছবির কাছে আত্মসমর্পণ করে যদুবাবুর বাজারের লাগোয়া রূপালী। এখানে কোনদিন বাংলা ছবি চলতেই দেখিনি, যদিও শুনেছি যে এককালে এখানে বাংলা ছবিই আসত। এরপর বাংলা ছবির ফাঁকে ফাঁকে হিন্দী ছবি দেখানো শুরু করে বসুশ্রী, ঊজ্জ্বলা, ইন্দিরা, ভারতী। হিন্দী ছবি না দেখানোর ব্যাপারে দৃঢ় ছিল পূর্ণ এবং মিনার-বিজলী-ছবিঘর ‘চেন’। আশির দশকে এই প্রতিরোধ শেষ হয়ে যায়। আগেই বলেছি, বিজলীতে দুপুরের শো-তে এই সময় দেখেছি হেমন্ত মুখোপাধ্যায় প্রযোজিত এবং সুরারোপিত ‘কোহরা’। আর এবার পূর্ণ আনলো আদ্যোপান্ত বোম্বাই ঘরানার ছবি ‘গুমনাম’। লক্ষ্যণীয় যে ‘কোহরা’ এবং ‘গুমনাম’ দুটিই বিদেশী কাহিনি-অনুপ্রাণিত।

রাধা

১২ই জুন ১৯৬৪ তারিখে মা লিখছেন যে আমাকে ‘বীরেশ্বর বিবেকানন্দ’ দেখাতে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। বয়স তখন সাত। বাবা ভারতীয় সৈন্যদলে থাকার সুবাদে আমরা তখন থাকতাম ১ নং বালিগঞ্জ ময়দান ক্যাম্পে। সেখান থেকে বাংলা ছবি দেখার এলাকা ছিল দক্ষিণ কলকাতার ভবানীপুর আর কালিঘাট এলাকার হলগুলো। কিন্তু এক্ষেত্রে ব্যতিক্রম ঘটলো। যে আত্মীয়া ছবিটি দেখার ব্যবস্থা করেছিলেন তিনি উত্তর কলকাতার একটি ইস্কুলে শিক্ষকতা করতেন। তিনি টিকিট কাটলেন হাতিবাগানের রাধায় (এটিও আর নেই!)। মা লিখছেন যে আমার সেই কাকা (‘দেড়শো খকার কাণ্ডে’-র খলনায়ক জটাধর বক্সী যাঁর মতো দেখতে) বলছেন, “দূর। দূর, কী ওসব দেখবি?” আমার উত্তরঃ “এত মহান্ পুরুষ ছিলেন – অমন করে বলছ? বললে পাপ হয় জানো?” যাবার আগে আমাকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না! আমি তো দরজার পেছনে লুকিয়ে! মা ক্ষেপে গিয়ে আমাকে ‘ইডিয়ট’ বলায় যে মাসীমা সমস্ত ব্যবস্থা করেছিলেন তাঁর কাছে ভর্ৎসিতা হন! মনে আছে, রাধায় বেশ ঠাণ্ডা-ঠাণ্ডা হাওয়া গায়ে লাগছিল, মানে এটা  সেই সময় যখন অল্প কিছু দিনের জন্যে বাংলা ছবির হলগুলো দর্শক-স্বাচ্ছন্দের কথা ভেবে নিজেদের শীততাপ নিয়ন্ত্রিত করে! কিছু উত্তর ও দক্ষিণ কলকাতার বাংলা ছবির হলে অনেকদিন অবধি রবিবার সকালে বাঙালি  দর্শকদের জন্যে ইংরেজী ছবি দেখানো হতো। রাধাতেও এই নিয়ম মেনে মূল ছবির আগে দেখানো হলো David and Goliath-এর ট্রেলর। মূল ছবিটি, মা লিখছেন, বিরতি পর্যন্ত বেশ উপভোগ করেছিলাম। জীবনী-পুস্তকে পড়া  নরেনের দামাল শৈশবের ঘটনা মনে আছে, যেভাবে তাঁকে শান্ত করতে মাথায় জল ঢালতে হতো, তা দেখলাম। ঠাকুর রামকৃষ্ণরূপী গুরুদাস বন্দ্যোপাধ্যায়কে তখন কিছুটা বিদঘুটে আর হাস্যকরই মনে হয়েছিল, কারণ জীবনী-বইগুলিতে তাঁর বাণীই থাকতো, তাঁর তথাকথিত ক্ষ্যাপামির বর্ণনা নয়। অভিনেতার গলায় একটি শ্যামাসংগীতও ছিল মনে পড়ে, গেয়েছিলেন বোধহয় ধনঞ্জয় ভট্টাচার্য। আরও মজা পেয়েছিলাম একটি অজানা ঘটনা দেখে। ঠাকুর মা’র নাম করতে-করতে শয্যায় বসেই “ওরে বাবারে, জ্বলে গেলুম, পুড়ে গেলুম” বলে উঠে পড়লেন। সম্ভবত নরেনই তাঁকে যাচাই করার জন্যে খাটে টাকা রেখেছিলেন! তবে ছবির শেষটা একটু বিভ্রান্ত করেছিল। মা আমার মন্তব্য উদ্ধৃত করেছেনঃ “ ‘তোর অনেক কাজ আছে!’ তারপর পাথরের উপর একটা ওঁ লেখা – কী মানে হয়?”

১৯৬৫ সালে বাবা ভারতীয় সৈন্যদল থেকে অবসর নিয়ে Voltas কোম্পানীতে যোগ দিয়েছিলেন। সেই সুবাদে ১৯৬৬ থেকে ১৯৭৬-এর জুন মাস অবধি আমাদের ঠিকানা ছিল মধ্য কলকাতার রাসেল স্ট্রীটে, কোম্পানীর ফ্ল্যাট। Voltasথেকে বাবা অবসর নেন ঐ ৭৬-এর ফেব্রুয়ারীতেই, কিন্তু কোম্পানীর কর্তৃপক্ষ, অতি সৌজন্য-সহকারে আমাদের ১৫ই জুলাই অবধি ফ্ল্যাটে থাকার অনুমতি দেন, যাতে আমি Part 1 পরীক্ষা নির্বিঘ্নে শেষ করতে পারি। এর মধ্যে ধীরে-ধীরে আমাদের জিনিসপত্র সরতে থাকে বাবার তৈরি আমাদের নিজস্ব ‘সল্ট লেক’ (বিধান নগর)-এর বাড়িতে। 

এর পরেই আস্তে-আস্তে উত্তর কলকাতার সিনেমা-হলগুলোতে যাওয়া শুরু করেছিলাম। ওপরে বলেছি যে ষাটের দশকে রাধায় ‘বীরেশ্বর বিবেকানন্দ’ দেখা ছিল স্থানের দিক দিয়ে ব্যতিক্রমী, কারণ তখন বাংলা ছবি দেখা হতো  দক্ষিণের ভবানীপুর-কালিঘাট অঞ্চলে। এতদিনে শ্যামবাজারের মিনারে দেখেছি সেই ১৯৬৪ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত সত্যজিৎ রায়ের ‘চারুলতা’, আর আবার রাধায় ১৯৬৩ সালের ‘পলাতক’, যাতে ‘যাত্রিক’ নামের আড়ালে হেমন্তর সঙ্গে প্রথম জুটি বেঁধেছিলেন তরুণ মজুমদার। গান পাগল করেছিল, তৃপ্ত করেছিল, কিন্তু অনুপকুমার-অভিনীত মূল চরিত্রটির প্রতি খুব-একটা সহানুভূতি বোধ করিনি। তার ক্ষ্যাপামির জন্যে মানসিকভাবে ক্ষত-বিক্ষত হয়েছে একের পর এক চরিত্র, ‘হরেরূপিনী সন্ধ্যা রায় থেকে যাত্রাদলের গোলাপ (অনুভা গুপ্ত) আর বসন্তের স্নেহময় দাদা-বৌদি (অসিতবরণ-ভারতী দেবী) অবধি! তবে “জীবনপুরের পথিক রে ভাই” আমার গলায় ধ্বনিত হয়েছে প্রেসিডেন্সী কলেজে প্রমোদদা’র ক্যান্টিনে, তার হিন্দি রূপান্তরটি – “জনম সে বনজারা হুঁ বন্ধু” – লক্ষ্নৌ-এর ‘মোতি মহল’ ক্যাম্পাসে, এবং সবশেষে আবার বাংলা গানটি সাগরপারের অক্সফোর্ড শহরে এক ‘পাব’-এ!

১৯৯৩ সালে আমার বিয়ে হয়। সে বছর ১লা বৈশাখ উপলক্ষে আমরা স্থির করি সিনেমায় ‘ডবল শো’ দেখব! দুপুর বা ম্যাটিনির শোতে যাই হাতিবাগানের রাধায় – আমার জীবনে এই তৃতীয় ও শেষবার! ছবির নাম রক্তের স্বাদ। অভিনয়ে দেবশ্রী রায়, প্রসেনজিৎ, সুপ্রিয়া দেবী, দিলীপ রায়, জর্জ বেকার, অনামিকা সাহা, চিত্রা সেন প্রমুখ। কলকাতার বাইরে কোন এক মফস্বল শহরে একের পর এক মৃতদেহ পাওয়া যাচ্ছে। দেহগুলি সব রক্তশূন্য। আর প্রায় প্রত্যেকটির ধারে-কাছে দেখা গেছে শহরের হাসপাতাল/নার্সিং হোমের ডাক্তার-দম্পতির (সুপ্রিয়া দেবী-দিলীপ রায়) অনাথা আত্মীয়া দেবশ্রী রায়কে! অবস্থা এমন পর্যায় পৌঁছোয় যে মানসিক-ভাবে বিপর্যস্ত দেবশ্রী মনে করতে  থাকে যে সে সত্যিই ‘ড্রাকুলা’ হয়ে গেছে! নবাগত যুবক প্রসেনজিৎ অবশেষে রহস্যের বেশ চমকে দেওয়া কিনারা  করে, যদিও সমাধানের ব্যাখ্যায় খানিকটা গোঁজামিল আছে! ব্রিটিশ বন্ধু এবং ভ্যাম্পায়ার-বিশেষজ্ঞ Andy Boylan ছবিটির একটি মনোজ্ঞ সমালোচনা লিখেছেন। চাইলে পড়ে দেখতে পারেন।

https://taliesinttlg.blogspot.com/2018/08/rakter-swad-review.html

শেষপর্বে লিখব কিছু একক প্রেক্ষাগৃহ নিয়ে।

(ক্রমশ)

 

 

 

 

 

 


পঙ্কজকুমার চ্যাটার্জি

 

রশোমন




১৯৮০ সাল। তখন আমি ইউকো ব্যাংকের ইন্ডিয়া এক্সচেঞ্জ প্লেস শাখায় চাকরি করছি। সিনেমা দেখাটা আমার নেশাই ছিল প্রায়, বিশেষ করে ভালো ছবি হলেই সাধারণত দেখতাম। কলকাতা সিনে ক্লাব মাঝে মাঝেই দিকপাল পরিচালকদের সিনেমা প্রদর্শন করতো। সাধারণত, পি জি হাসপাতালের বিপরীতে সরলা মেমোরিয়াল হলে সেইসব ছবি দেখানো হতো। এক শনিবারে আকিরা কুরোসাওয়ার দুটো বিখ্যাত ছবি দেখার টিকিট পেলাম। প্রথমটি সন্ধ্যা সাড়ে পাঁচটায়, ‘সেভেন সামুরাই’ এবং রাত সাড়ে আটটায় ‘রশোমন’। শনিবার অফিস ছুটি দুপুর দুটোয়। ঠিক সেই সময় হৃষিকেশ মুখার্জি পরিচালিত ছবি ‘খুব সুরত’ রিলিজ করেছে। অভিনয়ে ছিলেন রেখা, রাকেশ রোশন, অশোককুমার ইত্যাদি। চলে গেলাম রক্সি সিনেমায় তিনটের শো দেখতে। হালকা মেজাজের সামাজিক ছবি। খুব ভালো লেগেছিল। কেষ্ট মুখার্জি এই ছবিতে কমিক চরিত্রাভিনয়ের জন্য ফিল্মফেয়ার এওয়ার্ড পেয়েছিলেন।

পাঁচটায় শো শেষ হলে বাসে করে চলে এলাম সরলা মেমোরিয়াল হলে। কুরোসাওয়া বলে কথা! দর্শক গিজ গিজ করছে। ‘সেভেন সামুরাই’ ছিল জাপানের গ্রামের পটভূমিকার লেখা ষোড়শ শতকের এক  কাহিনী। দস্যুরা গ্রামের ক্ষেতে ফসল ফলার সময় হানা দিয়ে সেই ফসল চুরি করে নিয়ে যায়। দস্যুদের প্রতিরোধ করতে গ্রামের লোকেরা সাত সামুরাইকে নিয়োগ করেন। সামুরাই হলো জাপানের বংশপরম্পরাগত যোদ্ধা। প্রথম ছয়জন ছিল সামুরাই বংশের। কিন্তু, শেষ সামুরাই হলো এক কৃষক পরিবারের ছেলে ‘কিকুচাই’। যেখানে সামুরাইরা পেশাগত ভাবে সংযত চরিত্রের, সেখানে কিকুচাই ছিল  সম্পূর্ণ আলাদা। দুর্দম, বেপরোয়া, আত্মম্ভরী। ছয়জন সামুরাই-এর সঙ্গে কিকুচাই-এর সংঘাত চলে। পরে এই কিকুচাই-এর দক্ষতার জন্যই সামুরাইরা সফল হয়। এই চরিত্রকে জীবন্ত করে তুলেছিলেন কিংবদন্তী  জাপানী অভিনেতা তোশিরো মিফুনে। এখনও মনে আছে তোশিরো মিফুনের অনবদ্য অভিনয়। ‘সেভেন  সামুরাই’-এর অনুপ্রেরণায় ২০০৩ সালে টম ক্রুজের অভিনয় এবং সহ-প্রযোজনায় জনপ্রিয় ছবি ‘দি লাস্ট সামুরাই’ তৈরি হয়। পাক্কা তিন ঘন্টার ছবি দেখে যখন বেরোলাম তখন মনে হচ্ছিল পরের শো’টা আর  দেখবো না। মাথা ঝিমঝিম করছিল। কিন্তু, এই সুযোগ হারাতে মন চাইছিল না।

‘রশোমন’ও এক গল্পভিত্তিক ছবি। এই ছবিতে এক সামুরাই-এর হত্যারহস্যের চারটি কাহিনী দেখানো  হয়েছে। প্রতিটিই মনে হবে সত্যি। হত্যাকারী দস্যু ‘তাজোমারো’ (অভিনেতা তোশিরো মিফু্নে) বিবরণে সে জানায় যে সামুরাই-এর স্ত্রীর কথামতো সে সামুরাই-এর সঙ্গে দ্বৈত যুদ্ধ করে তাকে হারায় এবং হত্যা করে। সামুরাই-এর স্ত্রী এর মধ্যে পালিয়ে যায়। কিন্তু, স্ত্রীর মূল্যবান ছোরা কোথায় সে বলতে পারে না।  সামুরাই-এর স্ত্রী জানায় যে দস্যু সামুরাইকে গাছের সঙ্গে বেঁধে রেখে তাকে ধর্ষণ করে পালিয়ে যায়। তখন  সে স্বামীর কাছে প্রার্থনা করে তাকে ক্ষমা করে দেওয়ার জন্য। কিন্তু, সামুরাই শুধু তাকিয়ে থাকে। স্ত্রী তখন স্বামীকে বন্ধনমুক্ত করে তাকে হত্যা করতে বলে। কিন্তু, স্বামীর স্থির, রোষিত দৃষ্টি দেখে স্ত্রী মূর্ছা যায়। মূর্ছা ভাঙার পর স্ত্রী দেখে বুকে ছোরাবিদ্ধ অবস্থায় স্বামীর মৃতদেহ। অনেক চেষ্টা করেও স্ত্রী আত্মহত্যা করতে পারে না।

এবার মৃত সামুরাই-এর কাহিনী শোনা হয় এক মাধ্যমের মুখে। সামুরাই জানায় দস্যু তার স্ত্রীকে ধর্ষণের  পরে তাকে তার সঙ্গে পালিয়ে যেতে বলে। তখন স্ত্রী দস্যুকে বলে স্বামীকে খুন করার জন্য। এতে দস্যু আশ্চর্য হয়ে সামুরাইকে দুটো বিকল্প দেয় - হয় সে স্ত্রীকে ছেড়ে দেবে অথবা তাকে খুন করবে। সামুরাই বলে যে সে এই অপরাধ ক্ষমা করতে প্রস্তুত। তখন স্ত্রী পালিয়ে যায় এবং দস্যু তাকে অনেক চেষ্টা করেও ধরতে পারে না। ফিরে এসে দস্যু সামুরাইকে ছেড়ে দেয়। সামুরাই নিজে বুকে ছোরা বিদ্ধ করে আত্মহত্যা করে। পরে কেউ ছোরাটি সরিয়ে দেয়।

উপরের তিন কাহিনী শোনা যায় আদালতে। গল্পের শুরুতে এক কাঠুরে এবং এক ধর্মযাজক এই ঘটনা নিয়ে আলোচনা করছিল। স্থান হলো আদালতের বাইরে প্রাচীন কিয়োটো শহরের প্রবেশ-তোরণ, যার নাম রশোমন। তখন এক সাধারণ পথিকও তাতে যোগ দেয়। কাঠুরে পথিককে বলে যে সে পুরো ঘটনা নিজের চোখে দেখেছে। কিন্তু, সে এই ঘটনার সঙ্গে জড়িত হতে চায় না বলে আদালতে সাক্ষ্য দেয়নি। সে বলে যে আদালতে বলা তিনটি কাহিনীই ঠিক নয়।

কাঠুরের কাহিনি অনুযায়ী দস্যু সামুরাই-এর স্ত্রীকে ধর্ষণের পরে তাকে বিবাহের প্রস্তাব দেয়। কিন্তু, রাজী  না হয়ে স্ত্রী সামুরাইএর দড়ি খুলে দেয়। সামুরাই নষ্ট স্ত্রীর জন্য দস্যুর সাথে লড়াই করতে চায় না। তখন স্ত্রী দস্যু এবং সামুরাইকে সমালোচনা করে বলে যে দুজনই আসল মরদ নয়, হলে তারা এক নারীর ভালোবাসার জন্য যুদ্ধ করতো। স্ত্রীর প্ররোচনায় দুই জনের মধ্যে যুদ্ধ হয়। দীর্ঘ লড়াই-এর পর, দস্যু সুযোগ পায় এবং ইতস্ততার পরে সামুরাইকে হত্যা করে। এর মধ্যে স্ত্রী পালিয়ে যায় এবং স্ত্রীকে না ধরতে পেরে সামুরাই-এর তরবারি নিয়ে চলে যায়। কাঠুরের কাহিনী স্তব্দ করে দেয় পাশে রাখা এক ঝুড়িতে রাখা  এক পরিত্যক্ত শিশুর কান্নায়। সাধারণ পথিক শিশুর গায়ের কিমোনো এবং হাতের বাজু নিয়ে চলে যায়। কাঠুরে বাধা দিলে সে বলে যে কাঠুরে নিজেই দস্যুর স্ত্রীর মূল্যবান ছোরা চুরি করেছে এবং সেই কারণেই সে সাক্ষ্য দেয়নি। সে আরো বলে কাঠুরে নিজে একজন দস্যুর মতো আচরণ করেছে এবং এই পৃথিবীতে সবাই নিজের স্বার্থের কথাই চিন্তা করে।

এই সব তঞ্চকতা দেখে ধর্মযাজকের মানবতার উপর বিশ্বাস ধাক্কা খায়। কাঠুরে শিশুটিকে তুলে নিয়ে ধর্মযাজকের হাতে দেয়। ধর্মযাজকের প্রথমে সন্দেহ হয়। কিন্তু, কাঠুরে বলে যে সে তার ছয় সন্তানের সাথে এই শিশুকে লালন-পালন করবে। এতে ধর্মযাজকের মানবতার উপর বিশ্বাস ফিরে আসে। কাঠুরের কাহিনী এবং মূল্যবান ছোরা অপহরণের বিষয় ধর্মযাজক এক নতুন আলোকে গ্রহণ করে।

এই প্রজন্মের অনেকেই এই বিশ্ববিখ্যাত ছবিটি দেখেননি। তাই আমি সংক্ষেপে কাহিনীটা বিবৃত করলাম। এই ছবির জনপ্রিয়তা ফলশ্রুতিস্বরূপ আদালতে এই রকম পরস্পর-বিরোধী সাক্ষ্য দেওয়া হলে তাকে ‘রশোমন এফেক্ট’ বলা হয়।

 


অমর চট্টোপাধ্যায়

 

উৎপল দত্তের নাটক - 'ঘুম নেই’




 

(প্রযোজনা - ঠাকুরপুকুর ইচ্ছেমতো)

বাংলা তথা ভারতবর্ষের অন‍্যতম প্রণম‍্য নাট‍্যপ্রতিভা উৎপল দত্তের লেখা নাটক 'ঘুম নেই' দেখলাম আকাদেমিতে।  গিয়েছিলাম উৎপল দত্তের নাটক দেখব বলে। ‘ঘুম নেই’ কয়েকবার পড়েছি। তাঁর কিছু প্রযোজনা দেখার সৌভাগ্য হয়েছে, কিন্তু এই নাটকটা দেখা হয়নি। একটা আবেগ ছিল‌ই।

মঞ্চস্থাপত‍্য হতবাক করেছে। জ্বলন্ত কুপি, হেরিকেন ইত‍্যাদি ব‍্যবহার করা হয়েছে মঞ্চে। সবার জন‍্য বিপজ্জনক, মঞ্চে আগুনের ব‍্যবহার তাই নিষিদ্ধ। এ ধরনের মঞ্চস্থাপত‍্যে কল্পনার কোন অবকাশ নেই। আকর্ষণহীন। দোকানে একসারে বাল্ব জ্বলছে। আবার হ‍্যারিকেন, কুপিও জ্বলছে। আলোর উৎস কোনটা? এলাকা ব‍্যবহার ও আবহ – দক্ষতার পরিচায়ক। এইসব আয়োজন তো নাট‍্যক্রিয়াটিকে এগিয়ে নেবার জন‍্য? যার ভিত্তি কিছু মানুষ এবং তাদের ক্রিয়াকলাপ ও সংলাপ। বিশ্লেষণ, পারস্পরিক সম্পর্ক নির্ধারণ এসব আনেকটা নির্ভর করে পরিচালকের চিন্তাভাবনা, তাঁর শ্রেণীসচেনতার ওপর। উৎপল দত্ত শ্রমিক শ্রেণীর শুধু সমর্থক ছিলেন না তাঁর লেখায়, নাটকের সংলাপে ফুটে ওঠে তিনি তাদের প্রতি কতটা শ্রদ্ধাশীল ছিলেন।

ট্রাক ড্রাইভারদের জীবনকথন এই নাটকের উপজীব্য। খেটে খাওয়া মানুষদের আনন্দ, কষ্ট ইত‍্যেকার অনুভূতিগুলো ছিটকে ছিটকে সামনে আসে নাটকে। তার জন‍্য এই মানুষদের মুখে অক্ছার স্ল‍্যাঙ বসাতে হয়নি নাটককারকে।  লিখতে হয়নি যৌন অঙ্গভঙ্গির নির্দেশ। আসলে উৎপল দত্ত এঁদের আপন ভাবতেন, শ্রদ্ধা করতেন। প্রযোজনায় দেখলাম খোলামেলা যৌন অঙ্গভঙ্গির আর খিস্তি খেউড়ের ছড়াছড়ি। হাত এবং কোমরের দোলনে রতিক্রিয়া দেখানো। যৌনাঙ্গ প্রদর্শন শুধু বাকি ছিল। এই কারণেই বোধহয় আয়োজক সংস্থা প্রযোজনাটিকে ‘প্রাপ্তবয়স্কদের’ বলে দাগিয়ে দিয়েছেন। এক‌ই পরিবারের প্রাপ্তবয়স্ক সবাই একসাথে বসে বোধহয় প্রযোজনাটি দেখতে পারবেন না, রুচিতে বাধবে। আর ভুল এখানেই, নাটকটি কিন্তু প্রাপ্তমনস্কদের।

নাটকের শেষ দিকে যখন মঞ্চ জুড়ে উত্তেজনা, সেই সময় হঠাৎ দেখা গে্‌ল, একজনের হাতে হাতুড়ি অন‍্য একজনের হাতে কাস্তে। দুটি হাত ডাউন স্টেজে এগিয়ে এসে কাস্তে-হাতুড়ি প্রতীক তৈরী করল আর আপ স্টেজে জেগে উঠল লাল পতাকা। লালের কোনরকম উপস্থিতি মঞ্চে ছিল না এতক্ষণ, ড্রাইভারের হাতে কাস্তে কোথা থেকে এলো বোঝা গেল না। প্রক্ষিপ্ত মনে হ'ল। সত্তরের শেষ থেকে আশির মধ‍্যভাগ পর্যন্ত এইরকম আঙ্গিকের ব‍্যবহার অনেক দেখেছি। পোস্টার ড্রামার চল তখন। লাল পতাকা আর ঐ প্রতীকের যথেচ্ছ ব‍্যবহার অত্যন্ত ক্লিশে কৌশল। এক শ্রেণীর দর্শক টানতে সমর্থ হতে পারে হয়ত। শ্রদ্ধেয় উৎপল দত্তের নামে এই সব বিকৃতি মোটেই কাম‍্য নয়। তাঁকে অপমান করার এবং উৎপল সৃষ্ট চরিত্রের বিকৃতি ঘটানোর অধিকার পরিচালকের নেই।

একসময় ট্রেনে এমনকি চলন্ত বাসে ধুমপান নিত‍্য কর্তব‍্যের মত ছিল। এখন বিদ‍্যাহীনরাও এই কাজ করেন না।  সিনেমা, থিয়েটার এমনকি রাস্তায় ধুমপান হয় না। আর বিপরীতে শিক্ষিত লোকজন আকছার ধুমপান করে গেলেন মঞ্চে। মঞ্চ কি প্রেক্ষাগৃহের অংশ নয়? বেআইনি কাজটি না করলে নাট‍্যক্রিয়াটি দুর্বল হত না, হলেও কিছু করার নেই।

অভিনেতারা আপ্রাণ চেষ্টা করেছেন এবং বোঝা যায় নির্দেশ অনুসারে কাজ করেছেন। তবে সবচেয়ে সিনিয়র অভিনেতার সংলাপ জড়িয়ে যাওয়া ভালো লাগল না। চরিত্রের বয়স বা ম‍্যানারিজম যাই হোক না কেন, সংলাপ তো বোঝাতেই হবে!

প্রেক্ষাগৃহের উল্লাসে বোঝা যায় উৎপল তাঁদের কাছে একটি নাম মাত্র। স্বাভাবিকভাবে আজকের প্রজন্ম তাঁর প্রযোজনা দেখার সূযোগ পাননি, এই ইঁদুর দৌড়ের সময়টাতে নাটক পাঠের অবকাশও খুব কম তাঁদের। আমরা তো পূর্বসূরীদের চিনে নিতে তাঁদের সাহায্য করতে পারি!

 

#       #       #       #       #

 

সনির্বন্ধ অনুরোধ –

দর্শক তৈরির দায় যেন থিয়েটার ভুলে না যায়।

প্রেক্ষাগৃহে ধূমপান আইনবিরুদ্ধ কাজ। মঞ্চ প্রেক্ষাগৃহের অংশ।

মঞ্চে আগুনের ব‍্যবহার বিপজ্জনক, তাই নিষিদ্ধ। আকাদেমি কর্তৃপক্ষ সজাগ হন!

 


পৃথা কুণ্ডু

 

প্রকৃতির গান, গানের প্রকৃতি





স্বর্ণযুগের গানসম্পর্কে অনেক অতি আধুনিক পণ্ডিতের মত, আকাশ-বাতাস-চাঁদ-তারা-ফুল-পাখি-নদী আর আমি আর তুমির বাইরে নাকি তা বেরোতে পারে নি কথাটা মিথ্যে নয় পঞ্চকবির মধ্যে সর্বকনিষ্ঠ যিনি, যাঁর হাতে ১৯৩০-এর দশকে গ্রামোফোন কোম্পানির সৌজন্যেআধুনিকবাংলা গানের প্রস্তুতিপর্বের আরম্ভ, তাঁর কাব্যগীতি, বাংলা ঠুংরি-গজল এমনকি নিজের তৈরি নবরাগপ্রধান গানেও ফুল-পাখি-লতাপাতার ছড়াছড়ি তাঁর অনুজপ্রতিম যে-সব গীতিকার-সুরকার মোটামুটি তিরিশের মাঝামাঝি থেকে চল্লিশের প্রায় শেষ অবধি রাজ্যপাট চালিয়েছেন, তাঁরাও সে পথেই হেঁটেছেন; আর যে গানটিকেস্বর্ণযুগের উদ্বোধনী সঙ্গীত’-এর মর্যাদা অনেকেই দিয়ে থাকেন, তার ভাবনা বা বার্তায় কিছুটা গণমুখী চেতনার প্রতিফলন থাকলেও, তার মূল কাঠামোতে কিন্তুনীল শালুকে দোলন দিয়ে রঙ ফানুসে ভেসেবেড়ায় গ্রাম্য প্রকৃতির অকৃত্রিম বাতাস, আর সে বাতাসে ছড়িয়ে যায়পাকা ধানের বাসে বাসে সবার নিমন্ত্রণ এর পর একই সুরকার-শিল্পীর যুগলবন্দিতে যখন আসেরানার’, ‘পাল্কির গানবামনের জানালা ধরেবাআমায় প্রশ্ন করের মত গান, সেখানেও কিন্তুঅবাক রাতের তারারা আকাশে মিটিমিটি করে চায়বাহৃদয়ের শাখা ধরে নাড়া দিয়ে গেছে’-র মত শব্দগুচ্ছ ব্রাত্য নয়, বর্জনীয় নয় প্রকৃতির অন্যান্য চিত্রকল্পও, শুধু ভাষা প্রয়োগের ধরনটুকু আলাদা

ভাষার ব্যবহার বদলেছে বারে বারেই, এক গীতিকার থেকে অন্য গীতিকারের কলমে কিন্তু প্রকৃতির অনুষঙ্গে  আশ্রয় নিতে দ্বিধা করেননি কেউই কেনই বা করতে হবে? যা স্বাভাবিক, তাই তো প্রকৃতির স্বরূপ মানুষের চোখ-কান-ইন্দ্রিয়-মন-প্রাণ যদি শত বিপত্তি, শত জীবনসঙ্কটের মাঝেও প্রকৃতির আশ্রয়েই শান্তি খুঁজতে চায়, এক ঝলক টাটকা বাতাস, নদীর কলধ্বনি বা ঝরাপাতাদের মর্মরের মাঝে খুঁজে পেতে চায় জীবনের মানে, তাহলে জোর করে সেই স্বাভাবিক প্রবণতাকে অস্বীকার করতে চাওয়ার মধ্যে কী এমন বাহাদুরি আছে, সাধারণ মানুষের মাথায় তো ঢোকে না বরং মানুষের মন-অনুভূতি-আনন্দ-বেদনার বিচিত্র আবেদনকে কেন্দ্রে রেখে প্রেম আর প্রকৃতি পরস্পরকে চায় অনাদিকাল ধরে, এটাই সত্যি আর স্বাভাবিক -- ঠিক যেমন কথা চায় সুরকে, রূপ চায় ভাবকে, ঝরাপাতা ডাকে ঝড়কে, অলির কথা শুনে বকুল হাসে, আর অসীম আকাশ না ডাকলে বলাকারা সুদূরে পাড়ি দিত কিনাসে প্রশ্নও জাগে গানেরই কথায়, সুরে, গায়নে

এ গান প্রথম যখন শুনেছি, এত কিছু মনে আসেনি শুধু তেরো-চোদ্দ বছরের মনে দোলা দিয়েছিল কথা আর সুরের মিল, আর অনির্বচনীয় এক কণ্ঠে তার একাকার হয়ে যাওয়া অভিব্যক্তি পরে নেশা চেপেছে খুঁজে দেখার, কথা, সুর, গায়ন ধরে ধরে খুঁজে দেখানা না, ব্যবচ্ছেদ নয় ছিঁড়ে-কেটে না ফেলেও তো আঙুল বুলিয়ে, চোখের কাছে এনে পরখ করে দেখা যেত পাতার শিরা-উপশিরা, বৃন্তের গড়ন, পাপড়ির ভেতরের দিকের রঙছোটবেলায় তাই তো করেছি ছিঁড়ে খাতায় লাগিয়ে ফেলার হুকুম ভালো লাগত না কোনদিন, কিন্তু ছুঁয়ে দেখা, কাছ থেকে চোখে দেখা ভালো লাগত এখানেও ওইটুকুইগানের প্রকৃতিটুকু ছুঁয়ে দেখতে চাওয়া তাতে মনে হয়েছে, এ  গানের মধ্যে ছন্দের যে আবর্তন, তাতে বিশ্বপ্রকৃতির স্পন্দনের আভাস লয় দ্রুত, স্বরক্ষেপণ সোজা, যাকে বিদেশে  বলে ‘staccato’ কিন্তু পশ্চিমি ‘staccato’ এত নরম, এত মেদুর হয় না, এখানে হয়েছে তার কারণ এদেশের প্রকৃতি, জলহাওয়া, আর স্রষ্টার নিজের প্রকৃতিও ‘Staccato ’ শেষ পর্যন্ত এসে মিলছে হালকা আন্দোলনে, আবর্তনে, গানের ভাব সেটাই চাইছে একদিকে বলাকা, অন্যদিকে আকাশ, একদিকে বাঁশি অন্যদিকে নূপুর, একদিকে ফুলের গন্ধ, অন্যদিকে হাওয়ার পরশএরাও পরস্পরকে চায়, আর সেই মিলের সুর ধরিয়ে দিচ্ছেন শিল্পী, কোন একতুমির জন্য  কিন্তু পুরোপুরি মিল শেষ পর্যন্ত হয়ে গেলে তো খেলা যাবে ভেঙে, তখন কেই বা আমি, কেই বা তুমি! গানটা গাইবে কে আর শুনবেই বা কে? তাই প্রকৃতির ইচ্ছে খেলাটা চলুক, মানুষও সায় দেয়, আর শ্রোতার যদি ইচ্ছে হয়, ‘ওই আকাশ না ডাকলের অনির্দেশ্য প্রশ্নের সুরেলা আমেজ তেহাই-এর মেজাজে (হায় ভগবান, আধুনিক গানে তেহাই!) শেষ হবার পরও গানটা আর একবার শুনি, তাকেও দোষ দেওয়া যায় কি?




লিখতে লিখতে মনে পড়ল আর একখানা গান, ‘কত দিন পরে এলেএকটু বোসো এ গানের জন্ম নাকি গীতিকার আর সুরকার-শিল্পীর মধ্যে অনেকদিন পর দেখা হওয়ার মুহূর্তে ঘরোয়া অভ্যর্থনার সূত্রে স্বাভাবিক কথনভঙ্গিতে শুরু হওয়া গানটা অন্তরায় হঠাৎই বাঁক নেয় ঘরের কোণ ছেড়ে বাইরের উদার, মুক্ত প্রকৃতির অভিমুখেআকাশে বৃষ্টি আসুক, গাছেরা উঠুক কেঁপে ঝড়ে বৃষ্টি এল কিনা জানি না, কিন্তু গলারক্রুনিং’-, সুরে সুরে ছবিটা পরিষ্কার ফুটলআকাশের কোণে মেঘ জমেছে, বাতাসের ঝাপটায় গাছের পাতাগুলো দুলছেএই বৃষ্টির কামনাটুকু চিরকালেরআর তার পেছনে লুকিয়ে আছে গ্রীষ্মের দাহে শুকিয়ে যাওয়া মাটির শান্তির আশা, চাষিভাইদের ফসলের কামনা, মানুষ ও পরিবেশের নিবিড় সম্পর্কের চেতনা পরের স্তবকে আবার-- জীবনের পথের কিছুটা অন্তত সবুজ ঘাসে ঢাকা থাকুক, এই মানবিক ভালোবাসার চাওয়াটুকু প্রকৃতিচেতনায় মিলে যায় অনায়াসেই  কবিতায় যাকেইকোপোয়েটিক্সনাম দিয়ে তার মধ্যেকার উচ্চাঙ্গ সাহিত্যগুণ ব্যাখ্যা করা চলে, গানে তাকেআকাশ-বাতাস-মেঘ-বৃষ্টিবলে হেয় করার বোধহয় এটাই কারণ-- এগুলো তোহালকাআধুনিক গান, হাজার হাজার লাখ লাখ সাধারণ মানুষ ভালোবেসে তা শোনে, আমাদের অফিস-করণিক দাদাবড়বাবুর বিদায়সংবর্ধনা সভায় এই গানটাই গেয়ে ওঠেন স্বতঃস্ফূর্ত আবেগেকেন যে, তার জবাব অতি-বুদ্ধিবাদী তত্ত্ব-প্রকরণচারী মস্তিষ্কে সহজে ধরা দেয় না

এসব প্রশ্নের আসলে জবাব হয় না তাই কোন এক অতি-আধুনিক বিজ্ঞ সমালোচক বলেছিলেন, ‘টিনটার্ন অ্যাবের কয়েক মাইল ওপরে দাঁড়িয়ে কবির মনে পড়ল তাঁর ছেলেবেলার কথা, প্রকৃতির স্পন্দন তিনি নতুন করে অনুভব   করলেন পরিণত বয়সের ব্যক্তিগত দার্শনিক অনুভবের নিরিখেতা করলেন তো ভালো, তাতে জগতের কী এল গেল? এখন সেইটা বুঝতে গেলে তো অনুভূতি লাগে, আর লাগে হৃদয়আকাশের মত বিশাল, নদীর মত বাঁধনহীনএই দেখুন, বলতে বলতেই ঢেউয়ের মত মনের কথা ভাসিয়ে নিতে চাইছে আর একখানা গান, ‘ও নদী রে একটি কথা শুধাই শুধু তোমারে কোনচরিত্রের মুখে গাওয়া না হলেও, গান কিভাবে নিজেই প্রকৃতির মতই এক প্রাণময়  পরম সত্তা হয়ে উঠতে পারে, এবং একটি সাহিত্যধর্মী, সমাজসচেতন, মানবিক আবেদনে ভরা চলচ্চিত্রের হৃদয় এবং মস্তিষ্ক হিসেবে কাজ করতে পারে একইসাথে, তার অন্যতম সেরা উদাহরণ ‘নীল আকাশের নীচে’(১৯৫৯) ছায়াছবির এই গান গানটি আন্তর্জাতিক হয়ে উঠেছিল ইংরেজি ছবিসিদ্ধার্থ’(১৯৭২)-তে আবার ব্যবহার করার সূত্রে ছবির কাহিনি অনুযায়ী এ নদীর নাম হতে পারে  ভারতের গঙ্গা বা চীনের ইয়াংসিকিয়াং, কিন্তু যদি সমগ্র মানবসভ্যতার কথা ভাবি, তাহলে এ নদী অনেক বড় অর্থে জীবনের প্রবাহের সঙ্গে একাকার সেই নদীকে ডাক দিচ্ছে মানবতা, সেই ডাক মিশে যাচ্ছে তার প্রবাহের সঙ্গে, এমন এক প্রবাহ যার চলার শেষ নেই এই কথাগুলো বলার জন্য যেন এই সুর ছাড়া আর কোন অভিব্যক্তি হতে পারত না

নদীর সঙ্গে কথা বলছেন যে শিল্পীমানুষ, শুধু একজন ব্যক্তি তিনি নন, তিনি মানবতার মুখ প্রকৃতির চিরন্তন  প্রবাহের সঙ্গে মনের কথা আদানপ্রদানের বাহক হয়ে উঠছে একটি বিহ্বল প্রশ্ন—“বল কোথায় তোমার দেশ, তোমার নাই কি চলার শেষ…” অন্তরায় সেই বাধাবন্ধহীন নদীর চলার তাৎপর্য ফুটে উঠল শুদ্ধ নিখাদের প্রয়োগে—“তোমার কোন বাঁধন নাই তুমি ঘরছাড়া কি তাই/ এই আছ ভাটায় আবার এই তো দেখি জোয়ারেমধ্য সপ্তকের  নি-তে শুরু হয়ে আবার মন্দ্র সপ্তকের নি-তে ফিরে আসা সপ্তকের শুরু বা শেষ সা-তে, তার ঠিক আগের স্বর শুদ্ধ নি  সংগীতের ভাষায় নিখাদ যেন এক কিনারা, এক প্রতীক্ষা, এক অভাববোধের দ্যোতনা আনেকিনারা নেই, তাই সে নদী ঘরছাড়া

সঞ্চারীতে মধ্যমকে সা করে গানটা ফিরে এল স গ প কর্ডে এ শুধু নদীর গতিপথের ধর্ম নয়, জীবনের ধর্ম--এ কূল ভেঙে ও কূল তুমি গড়ো, যার এ কূল ও কূল দু কূল গেল তার লাগি কী করোভাঙ্গা-গড়া বোঝাতে এইভাবে মধ্যমে দাঁড়িয়ে পড়া এক সূক্ষ্ম অথচ অভিনব প্রয়োগ, যা কথার সাথে সামঞ্জস্য রেখে এক অপূর্ব আবেদন সৃষ্টি করে শেষ স্তবকে এসে, জোয়ার ভাঁটা ভাঙা গড়া সবকিছুর ঊর্ধ্বে উঠতে পারে যে মানবতার বিবেক, সে নদীর বিশালতার সঙ্গে একাকার হয়ে গিয়ে বলতে পারে—“আমায় ভাবছ মিছেই পর... সুখ দুঃখের কথা কিছু কইলে না হয় আমারে।” এত গভীর কথা, এত সহজ করে বলা—এবং সেটা সাড়ে তিন মিনিটের একটা গানের মাধ্যমে—এর পরও যদি কেউ আকাশ-বাতাস-মেঘ-নদীর নামে গালমন্দ করতে চান তো করুন, সে তাঁর ব্যক্তিগত অধিকার।

ব্যক্তিগত মতামতের কথাই যখন উঠল, তখন খুব পরিচিত একজনের কথা বলেই শেষ করি। এই অধমের অকিঞ্চিৎকর ভালোলাগাকে তিনি প্রায়ই ‘আকাশ-বাতাস-চাঁদ-তারা-ফুল-ছবি-গান’ নিয়ে পাগলামি বলে ব্যঙ্গ করেন। বাইরের জীবনে তিনি উচ্চপদস্থ, উচ্চশিক্ষিত, সমাজসচেতন, সংবিধান-আইন-অধিকারসচেতন এক মানুষকিন্তু অত্যন্ত ব্যক্তিগত যন্ত্রণার মুহূর্তে তিনিও আশ্রয় নেন একান্তে, ‘শ্যামলা গাঁয়ের কাজলা মেয়ে’, ‘মেঘ কালো আঁধার কালো’র মত গানে, হারিয়ে যাওয়া ছোটবেলার জন্য আড়ালে কাঁদেন ফুল পাখি বন্ধু আমার ছিলবাআমাদের ছুটি ছুটি চল নেব লুটির মত গান শুনেফিল্ডওয়ার্ক’-এর ব্যস্ততায় গ্রামেগঞ্জে ছুটতে ছুটতে দু-দণ্ডের জন্য থমকে দাঁড়িয়ে ছবি তুলে নেন নদীর ওপারে অস্তগামী সূর্যের, শেয়ার করেন ক্যাপশন দিয়েঃসূর্য ডোবার পালা আসে যদি…’ জানি, এ সবব্যক্তিগত, কিন্তু ব্যক্তি ছাড়া তো সমাজ হয় না, তার দেখার চোখ, অনুভবের মন আর শোনার কান ছাড়া আকাশ-বাতাস-প্রকৃতি-গান কিছুই হয় না অশথের ছায়ে মাঠের প্রান্তে দূরে, রাখালি বাঁশির বেজে বেজে ওঠা সুরেতাই থেকেই যাবে এই সব গান, আর তা শুনতে শুনতে লুকিয়ে চোখের জলটুকু  মুছে নেবার মত, ধরা যাক এই অধমের মত-- কিছু মানুষও থাকবেআবার ঘুরে তাকাবে, কেউ দেখে ফেলে নি তো? আজও এমন মানুষের সংখ্যা নিতান্ত কম নয় বোধহয়, না হলে ইউটিউব-এ এসব গানেরভিউএত হয় কেমন করে, কে জানে!