উৎপল দত্তের নাটক - 'ঘুম
নেই’
(প্রযোজনা
- ঠাকুরপুকুর ইচ্ছেমতো)
বাংলা তথা ভারতবর্ষের অন্যতম প্রণম্য নাট্যপ্রতিভা উৎপল দত্তের লেখা নাটক 'ঘুম নেই' দেখলাম আকাদেমিতে। গিয়েছিলাম উৎপল দত্তের নাটক দেখব বলে। ‘ঘুম নেই’ কয়েকবার পড়েছি। তাঁর কিছু প্রযোজনা দেখার সৌভাগ্য হয়েছে, কিন্তু এই নাটকটা দেখা হয়নি। একটা আবেগ ছিলই।
মঞ্চস্থাপত্য হতবাক করেছে। জ্বলন্ত কুপি, হেরিকেন ইত্যাদি ব্যবহার করা হয়েছে মঞ্চে। সবার জন্য বিপজ্জনক, মঞ্চে আগুনের ব্যবহার তাই নিষিদ্ধ। এ ধরনের মঞ্চস্থাপত্যে কল্পনার কোন অবকাশ নেই। আকর্ষণহীন। দোকানে একসারে বাল্ব জ্বলছে। আবার হ্যারিকেন, কুপিও জ্বলছে। আলোর উৎস কোনটা? এলাকা ব্যবহার ও আবহ – দক্ষতার পরিচায়ক। এইসব আয়োজন তো নাট্যক্রিয়াটিকে এগিয়ে নেবার জন্য? যার ভিত্তি কিছু মানুষ এবং তাদের ক্রিয়াকলাপ ও সংলাপ। বিশ্লেষণ, পারস্পরিক সম্পর্ক নির্ধারণ এসব আনেকটা নির্ভর করে পরিচালকের চিন্তাভাবনা, তাঁর শ্রেণীসচেনতার ওপর। উৎপল দত্ত শ্রমিক শ্রেণীর শুধু সমর্থক ছিলেন না তাঁর লেখায়, নাটকের সংলাপে ফুটে ওঠে তিনি তাদের প্রতি কতটা শ্রদ্ধাশীল ছিলেন।
ট্রাক ড্রাইভারদের জীবনকথন এই নাটকের উপজীব্য। খেটে খাওয়া মানুষদের আনন্দ, কষ্ট ইত্যেকার অনুভূতিগুলো ছিটকে ছিটকে সামনে আসে নাটকে। তার জন্য এই মানুষদের মুখে অক্ছার স্ল্যাঙ বসাতে হয়নি নাটককারকে। লিখতে হয়নি যৌন অঙ্গভঙ্গির নির্দেশ। আসলে উৎপল দত্ত এঁদের আপন ভাবতেন, শ্রদ্ধা করতেন। প্রযোজনায় দেখলাম খোলামেলা যৌন অঙ্গভঙ্গির আর খিস্তি খেউড়ের ছড়াছড়ি। হাত এবং কোমরের দোলনে রতিক্রিয়া দেখানো। যৌনাঙ্গ প্রদর্শন শুধু বাকি ছিল। এই কারণেই বোধহয় আয়োজক সংস্থা প্রযোজনাটিকে ‘প্রাপ্তবয়স্কদের’ বলে দাগিয়ে দিয়েছেন। একই পরিবারের প্রাপ্তবয়স্ক সবাই একসাথে বসে বোধহয় প্রযোজনাটি দেখতে পারবেন না, রুচিতে বাধবে। আর ভুল এখানেই, নাটকটি কিন্তু প্রাপ্তমনস্কদের।
নাটকের শেষ দিকে যখন মঞ্চ জুড়ে উত্তেজনা, সেই সময় হঠাৎ দেখা গে্ল, একজনের হাতে হাতুড়ি অন্য একজনের হাতে কাস্তে। দুটি হাত ডাউন স্টেজে এগিয়ে এসে কাস্তে-হাতুড়ি প্রতীক তৈরী করল আর আপ স্টেজে জেগে উঠল লাল পতাকা। লালের কোনরকম উপস্থিতি মঞ্চে ছিল না এতক্ষণ, ড্রাইভারের হাতে কাস্তে কোথা থেকে এলো বোঝা গেল না। প্রক্ষিপ্ত মনে হ'ল। সত্তরের শেষ থেকে আশির মধ্যভাগ পর্যন্ত এইরকম আঙ্গিকের ব্যবহার অনেক দেখেছি। পোস্টার ড্রামার চল তখন। লাল পতাকা আর ঐ প্রতীকের যথেচ্ছ ব্যবহার অত্যন্ত ক্লিশে কৌশল। এক শ্রেণীর দর্শক টানতে সমর্থ হতে পারে হয়ত। শ্রদ্ধেয় উৎপল দত্তের নামে এই সব বিকৃতি মোটেই কাম্য নয়। তাঁকে অপমান করার এবং উৎপল সৃষ্ট চরিত্রের বিকৃতি ঘটানোর অধিকার পরিচালকের নেই।
একসময় ট্রেনে এমনকি চলন্ত বাসে ধুমপান নিত্য কর্তব্যের মত ছিল। এখন বিদ্যাহীনরাও এই কাজ করেন না। সিনেমা, থিয়েটার এমনকি রাস্তায় ধুমপান হয় না। আর বিপরীতে শিক্ষিত লোকজন আকছার ধুমপান করে গেলেন মঞ্চে। মঞ্চ কি প্রেক্ষাগৃহের অংশ নয়? বেআইনি কাজটি না করলে নাট্যক্রিয়াটি দুর্বল হত না, হলেও কিছু করার নেই।
অভিনেতারা আপ্রাণ চেষ্টা করেছেন এবং বোঝা যায় নির্দেশ অনুসারে কাজ করেছেন। তবে সবচেয়ে সিনিয়র অভিনেতার সংলাপ জড়িয়ে যাওয়া ভালো লাগল না। চরিত্রের বয়স বা ম্যানারিজম যাই হোক না কেন, সংলাপ তো বোঝাতেই হবে!
প্রেক্ষাগৃহের উল্লাসে বোঝা যায় উৎপল তাঁদের কাছে একটি নাম মাত্র। স্বাভাবিকভাবে আজকের প্রজন্ম তাঁর প্রযোজনা দেখার সূযোগ পাননি, এই ইঁদুর দৌড়ের সময়টাতে নাটক পাঠের অবকাশও খুব কম তাঁদের। আমরা তো পূর্বসূরীদের চিনে নিতে তাঁদের সাহায্য করতে পারি!
#
# #
# #
সনির্বন্ধ
অনুরোধ –
• দর্শক তৈরির দায় যেন থিয়েটার ভুলে না যায়।
• প্রেক্ষাগৃহে
ধূমপান আইনবিরুদ্ধ কাজ। মঞ্চ প্রেক্ষাগৃহের অংশ।
• মঞ্চে আগুনের
ব্যবহার বিপজ্জনক, তাই নিষিদ্ধ। আকাদেমি কর্তৃপক্ষ সজাগ হন!
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন