সোমবার, ১৯ জুন, ২০২৩

পঙ্কজকুমার চ্যাটার্জি

 

রশোমন




১৯৮০ সাল। তখন আমি ইউকো ব্যাংকের ইন্ডিয়া এক্সচেঞ্জ প্লেস শাখায় চাকরি করছি। সিনেমা দেখাটা আমার নেশাই ছিল প্রায়, বিশেষ করে ভালো ছবি হলেই সাধারণত দেখতাম। কলকাতা সিনে ক্লাব মাঝে মাঝেই দিকপাল পরিচালকদের সিনেমা প্রদর্শন করতো। সাধারণত, পি জি হাসপাতালের বিপরীতে সরলা মেমোরিয়াল হলে সেইসব ছবি দেখানো হতো। এক শনিবারে আকিরা কুরোসাওয়ার দুটো বিখ্যাত ছবি দেখার টিকিট পেলাম। প্রথমটি সন্ধ্যা সাড়ে পাঁচটায়, ‘সেভেন সামুরাই’ এবং রাত সাড়ে আটটায় ‘রশোমন’। শনিবার অফিস ছুটি দুপুর দুটোয়। ঠিক সেই সময় হৃষিকেশ মুখার্জি পরিচালিত ছবি ‘খুব সুরত’ রিলিজ করেছে। অভিনয়ে ছিলেন রেখা, রাকেশ রোশন, অশোককুমার ইত্যাদি। চলে গেলাম রক্সি সিনেমায় তিনটের শো দেখতে। হালকা মেজাজের সামাজিক ছবি। খুব ভালো লেগেছিল। কেষ্ট মুখার্জি এই ছবিতে কমিক চরিত্রাভিনয়ের জন্য ফিল্মফেয়ার এওয়ার্ড পেয়েছিলেন।

পাঁচটায় শো শেষ হলে বাসে করে চলে এলাম সরলা মেমোরিয়াল হলে। কুরোসাওয়া বলে কথা! দর্শক গিজ গিজ করছে। ‘সেভেন সামুরাই’ ছিল জাপানের গ্রামের পটভূমিকার লেখা ষোড়শ শতকের এক  কাহিনী। দস্যুরা গ্রামের ক্ষেতে ফসল ফলার সময় হানা দিয়ে সেই ফসল চুরি করে নিয়ে যায়। দস্যুদের প্রতিরোধ করতে গ্রামের লোকেরা সাত সামুরাইকে নিয়োগ করেন। সামুরাই হলো জাপানের বংশপরম্পরাগত যোদ্ধা। প্রথম ছয়জন ছিল সামুরাই বংশের। কিন্তু, শেষ সামুরাই হলো এক কৃষক পরিবারের ছেলে ‘কিকুচাই’। যেখানে সামুরাইরা পেশাগত ভাবে সংযত চরিত্রের, সেখানে কিকুচাই ছিল  সম্পূর্ণ আলাদা। দুর্দম, বেপরোয়া, আত্মম্ভরী। ছয়জন সামুরাই-এর সঙ্গে কিকুচাই-এর সংঘাত চলে। পরে এই কিকুচাই-এর দক্ষতার জন্যই সামুরাইরা সফল হয়। এই চরিত্রকে জীবন্ত করে তুলেছিলেন কিংবদন্তী  জাপানী অভিনেতা তোশিরো মিফুনে। এখনও মনে আছে তোশিরো মিফুনের অনবদ্য অভিনয়। ‘সেভেন  সামুরাই’-এর অনুপ্রেরণায় ২০০৩ সালে টম ক্রুজের অভিনয় এবং সহ-প্রযোজনায় জনপ্রিয় ছবি ‘দি লাস্ট সামুরাই’ তৈরি হয়। পাক্কা তিন ঘন্টার ছবি দেখে যখন বেরোলাম তখন মনে হচ্ছিল পরের শো’টা আর  দেখবো না। মাথা ঝিমঝিম করছিল। কিন্তু, এই সুযোগ হারাতে মন চাইছিল না।

‘রশোমন’ও এক গল্পভিত্তিক ছবি। এই ছবিতে এক সামুরাই-এর হত্যারহস্যের চারটি কাহিনী দেখানো  হয়েছে। প্রতিটিই মনে হবে সত্যি। হত্যাকারী দস্যু ‘তাজোমারো’ (অভিনেতা তোশিরো মিফু্নে) বিবরণে সে জানায় যে সামুরাই-এর স্ত্রীর কথামতো সে সামুরাই-এর সঙ্গে দ্বৈত যুদ্ধ করে তাকে হারায় এবং হত্যা করে। সামুরাই-এর স্ত্রী এর মধ্যে পালিয়ে যায়। কিন্তু, স্ত্রীর মূল্যবান ছোরা কোথায় সে বলতে পারে না।  সামুরাই-এর স্ত্রী জানায় যে দস্যু সামুরাইকে গাছের সঙ্গে বেঁধে রেখে তাকে ধর্ষণ করে পালিয়ে যায়। তখন  সে স্বামীর কাছে প্রার্থনা করে তাকে ক্ষমা করে দেওয়ার জন্য। কিন্তু, সামুরাই শুধু তাকিয়ে থাকে। স্ত্রী তখন স্বামীকে বন্ধনমুক্ত করে তাকে হত্যা করতে বলে। কিন্তু, স্বামীর স্থির, রোষিত দৃষ্টি দেখে স্ত্রী মূর্ছা যায়। মূর্ছা ভাঙার পর স্ত্রী দেখে বুকে ছোরাবিদ্ধ অবস্থায় স্বামীর মৃতদেহ। অনেক চেষ্টা করেও স্ত্রী আত্মহত্যা করতে পারে না।

এবার মৃত সামুরাই-এর কাহিনী শোনা হয় এক মাধ্যমের মুখে। সামুরাই জানায় দস্যু তার স্ত্রীকে ধর্ষণের  পরে তাকে তার সঙ্গে পালিয়ে যেতে বলে। তখন স্ত্রী দস্যুকে বলে স্বামীকে খুন করার জন্য। এতে দস্যু আশ্চর্য হয়ে সামুরাইকে দুটো বিকল্প দেয় - হয় সে স্ত্রীকে ছেড়ে দেবে অথবা তাকে খুন করবে। সামুরাই বলে যে সে এই অপরাধ ক্ষমা করতে প্রস্তুত। তখন স্ত্রী পালিয়ে যায় এবং দস্যু তাকে অনেক চেষ্টা করেও ধরতে পারে না। ফিরে এসে দস্যু সামুরাইকে ছেড়ে দেয়। সামুরাই নিজে বুকে ছোরা বিদ্ধ করে আত্মহত্যা করে। পরে কেউ ছোরাটি সরিয়ে দেয়।

উপরের তিন কাহিনী শোনা যায় আদালতে। গল্পের শুরুতে এক কাঠুরে এবং এক ধর্মযাজক এই ঘটনা নিয়ে আলোচনা করছিল। স্থান হলো আদালতের বাইরে প্রাচীন কিয়োটো শহরের প্রবেশ-তোরণ, যার নাম রশোমন। তখন এক সাধারণ পথিকও তাতে যোগ দেয়। কাঠুরে পথিককে বলে যে সে পুরো ঘটনা নিজের চোখে দেখেছে। কিন্তু, সে এই ঘটনার সঙ্গে জড়িত হতে চায় না বলে আদালতে সাক্ষ্য দেয়নি। সে বলে যে আদালতে বলা তিনটি কাহিনীই ঠিক নয়।

কাঠুরের কাহিনি অনুযায়ী দস্যু সামুরাই-এর স্ত্রীকে ধর্ষণের পরে তাকে বিবাহের প্রস্তাব দেয়। কিন্তু, রাজী  না হয়ে স্ত্রী সামুরাইএর দড়ি খুলে দেয়। সামুরাই নষ্ট স্ত্রীর জন্য দস্যুর সাথে লড়াই করতে চায় না। তখন স্ত্রী দস্যু এবং সামুরাইকে সমালোচনা করে বলে যে দুজনই আসল মরদ নয়, হলে তারা এক নারীর ভালোবাসার জন্য যুদ্ধ করতো। স্ত্রীর প্ররোচনায় দুই জনের মধ্যে যুদ্ধ হয়। দীর্ঘ লড়াই-এর পর, দস্যু সুযোগ পায় এবং ইতস্ততার পরে সামুরাইকে হত্যা করে। এর মধ্যে স্ত্রী পালিয়ে যায় এবং স্ত্রীকে না ধরতে পেরে সামুরাই-এর তরবারি নিয়ে চলে যায়। কাঠুরের কাহিনী স্তব্দ করে দেয় পাশে রাখা এক ঝুড়িতে রাখা  এক পরিত্যক্ত শিশুর কান্নায়। সাধারণ পথিক শিশুর গায়ের কিমোনো এবং হাতের বাজু নিয়ে চলে যায়। কাঠুরে বাধা দিলে সে বলে যে কাঠুরে নিজেই দস্যুর স্ত্রীর মূল্যবান ছোরা চুরি করেছে এবং সেই কারণেই সে সাক্ষ্য দেয়নি। সে আরো বলে কাঠুরে নিজে একজন দস্যুর মতো আচরণ করেছে এবং এই পৃথিবীতে সবাই নিজের স্বার্থের কথাই চিন্তা করে।

এই সব তঞ্চকতা দেখে ধর্মযাজকের মানবতার উপর বিশ্বাস ধাক্কা খায়। কাঠুরে শিশুটিকে তুলে নিয়ে ধর্মযাজকের হাতে দেয়। ধর্মযাজকের প্রথমে সন্দেহ হয়। কিন্তু, কাঠুরে বলে যে সে তার ছয় সন্তানের সাথে এই শিশুকে লালন-পালন করবে। এতে ধর্মযাজকের মানবতার উপর বিশ্বাস ফিরে আসে। কাঠুরের কাহিনী এবং মূল্যবান ছোরা অপহরণের বিষয় ধর্মযাজক এক নতুন আলোকে গ্রহণ করে।

এই প্রজন্মের অনেকেই এই বিশ্ববিখ্যাত ছবিটি দেখেননি। তাই আমি সংক্ষেপে কাহিনীটা বিবৃত করলাম। এই ছবির জনপ্রিয়তা ফলশ্রুতিস্বরূপ আদালতে এই রকম পরস্পর-বিরোধী সাক্ষ্য দেওয়া হলে তাকে ‘রশোমন এফেক্ট’ বলা হয়।

 


1 টি মন্তব্য: