বৃহস্পতিবার, ১৪ নভেম্বর, ২০২৪

<<<< সম্পাদকীয় >>>>

 


কালিমাটি অনলাইন / ১২৫ / দ্বাদশ বর্ষ : পঞ্চম সংখ্যা  


আমরা প্রায়ই আলোচনা করে থাকি, মানুষের জন্মের আদিম যুগ থেকে অগ্রসর হয়ে আমরা সভ্যতার আলোকে আজ আলোকিত এবং তাই নিজেদের সভ্য বলে মনে করি। আর সেইসঙ্গে ঘটেছে সংস্কৃতির বিকাশ, তাই আমরা সংস্কৃতিবান। এই ভাবনার মধ্যে খুব একটা ভুল কিছু নেই, কিন্তু আছে অনেক ফাঁক, যা আমাদের সভ্য ও সংস্কৃতিবান হওয়াতে ব্যাঘাত ঘটায়। এবং তখন সভ্য ও সংস্কৃতিবান নিজেদের মেকী বলে মনে হয়। প্রশ্ন জাগে, বহিরঙ্গে আমরা সভ্য ও সংস্কৃতিবান হলেও অন্তরঙ্গে কতটুকু সভ্য ও সংস্কৃতিবান হতে পেরেছি! আদৌ কি কিছু হতে পেরেছি! আমাদের চারপাশের ঘটমান বিষয়গুলোর ওপর দৃষ্টিপাত করলেই উপলব্ধি করি, এসব তো আদৌ প্রচলিত সভ্য সমাজব্যবস্থায় ঘটার কথা নয়, বরং এসবই সভ্যতাবিরোধী! বস্তুতপক্ষে, একটা সুস্থ সমাজব্যবস্থার জন্য অত্যন্ত জরুরি পারস্পরিক সম্মানবোধ, কর্তব্যবোধ, সহযোগিতাবোধ এবং সততাবোধ। প্রয়োজন ব্যষ্টিস্বার্থ থেকে সমষ্টিস্বার্থে উত্তোরিত হবার জন্য নিবিড় অনুশীলন। ভাবতে আশ্চর্য লাগে, একদিকে যখন সারা বিশ্ব জুড়ে চলছে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির ব্যাপক চর্চা, অন্যদিকে তখন চলছে মনুষ্যত্ব হারানোর অলিখিত প্রতিযোগিতা। সাধারণভাবে বিচার করলে, মনুষ্যত্বের পক্ষে যা কিছু বিরোধী কাজ বা গুণ, সভ্যতার প্রথম পর্বে যা বজায় ছিল, সভ্যতা বিকাশের সঙ্গে সঙ্গে তা আরও বেড়ে চলেছে। মানুষের লোভ, ঈর্ষা, পরশ্রীকাতরতা, দম্ভ, অহংকার ইত্যাদি যেসব দোষ আছে, তা তাকে প্ররোচিত করে চুরি, ডাকাতি, হত্যা, দাঙ্গা, ক্ষমতা প্রদর্শন, ধর্ষণ এরকম বিভিন্ন অপকর্মে। মানুষ তখন আর মানুষের পর্যায়ে থাকে না, অমানুষের ঘৃণ্য ভূমিকায় উপনীত হয়। 

ইতিমধ্যে আর জি কর কলেজ ও হাসপাতালে কর্মরত অবস্থায় মহিলা চিকিৎসককে নৃশংসভাবে হত্যা ও ধর্ষণকান্ডের পর তিনমাস অতিক্রান্ত হয়েছে। কলকাতা পুলিশের হাত থেকে অপরাধ অনুসন্ধানের কাজ  কেন্দ্রীয়সংস্থা সিবিআইয়ের হাতে গেছে। কিন্তু এখনও পর্যন্ত মূল অভিযুক্ত রূপে মাত্র একজনকে সনাক্ত করা হয়েছে, যাকে ইতিপূর্বে কলকাতা পুলিশও সনাক্ত করেছিল। যদিও সবাই সন্দেহ প্রকাশ করছ্র যে, এই হত্যাকান্ড ও ধর্ষণ একজনের কাজ নয়, বরং সম্মিলিতভাবে এই দুষ্কর্ম করা হয়েছে। বিশেষত অপরাধকর্মের যাবতীয় তথ্য ও প্রমাণ লোপ করার জন্য যে আরও বেশ কয়েকজন জড়িত, তাতেও কোনো সন্দেহ নেই। একথা স্পষ্ট যে, এই ধর্ষণ ও হত্যাকান্ড পূর্বপরিকল্পিত এবং এর পেছনে আছে কায়েমিস্বার্থের কিছু মানুষ। সুতরাং আমাদের জানা নেই যে, অপরাধীদের শাস্তি কী নির্নিত হবে আদালতে। বিশেষত এই ঘৃণ্য অপরাধের পেছনে যে প্রভাবশালী ও ক্ষমতাশালী গোষ্ঠির মদদ আছে, তাদের কি আদৌ আদালতে পেশ করে শাস্তিদান করা হবে, তারও কোনো সঠিক উত্তর জানা নেই। তবু আমরা সুবিচারের আশায় আছি। অন্যায়ের বিরুদ্ধে ন্যায়ের জয়ের প্রতীক্ষায় আছি। নির্যাতিতা তিলোত্তমাদের পাশে সর্বদা আছি।  

‘কালিমাটি অনলাইন’ ব্লগজিনের প্রিয় পাঠক-পাঠিকাদের জানাই আমাদের আন্তরিক শুভেচ্ছা ও ভালোবাসা।

মাদের সঙ্গে যোগাযোগের ই-মেল ঠিকানা :

kajalsen1952@gmail.com / kalimationline100@gmail.com

দূরভাষ যোগাযোগ : 9835544675

 

 

 


অভিজিৎ মিত্র

 

সিনেমার পৃথিবী – ৪০



আজ বাকি সিনেমাটোগ্রাফারদের নিয়ে আমাদের ক্যানভাস। তবে তারা ক’জন, ৬জন না আরো বেশি, এই মুহূর্তে বলা সম্ভব নয়। আলোচনা এগোলে সেটা নিজের গতিবেগেই উঠে আসবে। একটা কথা বলে রাখি,  দেখুন, পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন সময় পরিচালকরা নিজেরাই ক্যামেরার পেছনে চোখ লাগিয়েছেন, কারণ  একজন পরিচালক সিনেমাটোগ্রাফি না বুঝলে ছবি হয় না। ফলে রেনোয়াঁ থেকে ত্রুফো বার্গম্যান গোদার অ্যান্তনিয়নি কিউব্রিক তারকোভস্কি সত্যজিৎ – সবাই এক অর্থে পরিচালক, আরেক অর্থে সিনেমাটোগ্রাফার। কিন্তু আমি এদের আলোচনায় আনব না। এমনকি শ্যাং ইমো-র (চিন) মত ফটোগ্রাফার থেকে পরিচালক হয়ে ওঠা কাউকে নিয়েও কলম ছোঁয়াব না। আগের পর্বে যেভাবে শুধুমাত্র ফটোগ্রাফারদের নিয়েই কাটাছেঁড়া করেছি, এবারেও তাই। এবং এবার গোটা পৃথিবী থেকে কয়েকজন ক্যামেরাম্যানকে বাছব। আগু-পেছু করে। ভৌগলিক জায়গা ধরে। ইউরোপ দিয়ে শুরু করব, আমেরিকা হয়ে এশিয়ার এসে থামব। ইউরোপের মাত্র ৩ জন। জার্মান এক্সপ্রেসনিস্ট ক্যামেরাম্যান ফ্রিজ আর্নো ওয়েগনার (১৮৮৯-১৯৫৮), এবং দুজন এই মুহূর্তের লিভিং লিজেন্ড - ইতালির ভিত্তোরিও স্টোরারো (১৯৪০-) ও ব্রিটেনের রজার ডিকিন্স (১৯৪৯-)।

জার্মান এক্সপ্রেসনিজম নিয়ে আমি আগেই আলোচনা করেছি। মুর্নাউ এবং ফ্রিজ ল্যাং-এর ছবি নিয়েও। ২০ এবং ৩০-এর দশকের বেশিরভাগ জার্মান এক্সপ্রেসনিস্ট ছবির ক্যামেরাম্যান ছিলেন ফ্রিজ আর্নো ওয়েগনার। বিশেষ করে আলো-আঁধারির খেলা ও দেওয়ালে ছায়ার কাজ (শ্যাডোগাফি), যা দিয়ে সাসপেন্স ফুটিয়ে তুলতে হয়, সেইসব কাজ ওয়েগনার গোটা পৃথিবীকে দেখিয়ে গেছেন। ধরুন মুর্নাউ-এর বিখ্যাত ছবি নসফেরাতু (১৯২২)। সেই ছবির আবহে শ্যাডোগ্রাফি বা স্টপ-শট ফুটিয়ে সেই সিনেমাকে ক্লাসিক পর্যায়ে নিয়ে যাওয়া, আবার ধরুন ল্যাং-এর বিখ্যাত ছবি এম (১৯৩১), তার মধ্যে শুধু সাসপেন্স নয়, ট্র্যাকিং শটের মাধ্যমে লং শট এবং তাও সেই ৯০ বছর আগে – এগুলোর জন্যই আজো গোটা সিনেমা জগৎ ওয়েগনারের কাছে শ্রদ্ধায় মাথা নত করে। দুর্ভাগ্য, ১৯৩৩-এ নাৎসীরা জার্মানি দখল করার পর ওয়েগনারের মত প্রতিভাশালী লোকেদেরও চুপ হয়ে যেতে হয়েছিল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর উনি আবার কয়েকটা ডকু ফিল্মে ক্যামেরা ধরেছিলেন বটে, কিন্তু সেভাবে আর কোনদিন সিনেমাটোগ্রাফিতে ফিরে আসেননি।

ইতালির ক্যামেরাম্যান ভিত্তোরিও স্টোরারো তার ৭০ এবং ৮০-র দশকের কাজের জন্য বিখ্যাত। প্রায় পাঁচ দশকের কেরিয়ারে অনেক পরিচালকের সঙ্গে কাজ করেছেন, যার মধ্যে রোজি, বার্তোলুচি, ফ্রান্সিস ফোর্ড কোপালা, উডি অ্যালেন – এরা উল্লেখযোগ্য। ৩বার সেরা সিনেমাটোগ্রাফার হিসেবে অস্কার পেয়েছেন, অ্যাপোক্যালিপ্স নাউ (১৯৭৯), রেডস্‌ (১৯৮১) এবং দ্য লাস্ট এম্পারার (১৯৮৭) ছবির জন্য। স্টোরারো এই মুহূর্তে জীবিত ৩ লিভিং লিজেন্ড-এর একজন যারা ক্যামেরার পেছনে চোখ রেখে ৩বার করে অস্কার পেয়েছেন। উনি, আমেরিকার রবার্ট রিচার্ডসন এবং লাতিন আমেরিকার এমানুয়েল লুবেজস্কি। বাকি দুজনের ক্যামেরা নিয়েও একটু পরেই আলোচনায় আসব। যাইহোক, আমাকে স্টোরারোর সেরা কাজ বেছে নিতে বললে আমি কিন্তু দ্য কনফরমিস্ট (১৯৭০) বাছব। খুব কম ছবিতেই আলো-ছায়ার এত ভাল কাজ দেখা গেছে। বড় বড় হলঘর ব্যবহার করে তার আলো-ছায়ার স্পেস থেকে ফ্রেমে ভেঙে সিন ফুটিয়ে তোলা হয়েছে, বিভিন্ন আর্কিটেকচার ব্যবহার করে সিনের ভেতরেই একাধিক সিন বানানো হয়েছে। এবং ক্যামেরা রাখা হয়েছে এমন কিছু ডাচ অ্যাঙ্গলে যা কখনোই সাধারণভাবে ব্যবহার হয় না। এর সাথে আছে ডিপ কালার কনট্রাস্ট। অনবদ্য।

সারা পৃথিবীতে একজনও সিনেমাপ্রেমী মানুষ পাওয়া যাবে না, যিনি রজার ডিকিন্স-কে চেনেন না। কারণ শশাঙ্ক রিডেম্পশন (১৯৯৪) থেকে শুরু করে ফারগো (১৯৯৬) হয়ে জেমস বন্ডের স্কাইফল (২০১২) অবধি এমন কোন ক্যামেরা প্রধান ছবি নেই, যার পেছনে ডিকিন্স ছিলেন না। অস্কার পেয়েছেন দু’বার, কিন্তু তার থেকেও বড় কথা নমিনেটেড হয়েছেন ১৬বার। মনে হয় এরপর আর ডিকিন্স সম্বন্ধে বিশেষ কিছু বলার অপেক্ষা রাখে না। সবাই ফারগো সিনেমা মনে রাখে ফ্রান্সিস ম্যাকডরম্যান্ড-এর অভিনয়ের জন্য, কিন্তু ডিকিন্সের ক্যামেরাও সেই ছবির এক উল্লেখ্য ফ্যাক্টর ছিল। আবার ধরুন নো কান্ট্রি ফর ওল্ড মেন (২০০৭) ছবির মাঝে মাঝে থমকে যাওয়া ক্যামেরা, অনেকটা হান্টিং মোডে, যা সাবলীলভাবে জেভিয়ার বারডেমের নিষ্ঠুরতা ফুটিয়ে তুলেছে, সেটার কৃতিত্বও ডিকিন্সকেই দিতে হবে। তবে আমার পছন্দ ডিকিন্সের অনেক আগের এক ব্রিটিশ ছবি, অ্যানাদার টাইম অ্যানাদার প্লেস (১৯৮৩)।

এবার আসা যাক আমেরিকায়। দুই আমেরিকা মিলিয়েও মাত্র ৩জন। আমেরিকার জোসেফ রাটেনবার্গ (১৮৮৯-১৯৮৩), রবার্ট রিচার্ডসন (১৯৫৫-) এবং লাতিন আমেরিকার এমানুয়েল লুবেজস্কি (১৯৬৪-)।

আজ অবধি মাত্র একজন ক্যামেরাম্যান ৪বার অস্কার পেয়েছেন। তার নাম জোসেফ রাটেনবার্গ। ক্যামেরায় ওয়েগনারের সমসাময়িক, কিন্তু কেরিয়ার অনেক দীর্ঘ। এবং সৌভাগ্যবানও বটে কারণ ক্যামেরার সামনে  লুইসি রেনার, গ্রিয়ার গারসন, জোয়ান ক্রফোর্ড, ডেবোরা কার, ইনগ্রিড বার্গম্যান-এর মত স্বর্ণযুগের সুন্দরী নায়িকাদের পেয়েছেন, তাদের ক্লোজ ইন মুখের হাসি দিয়ে ক্যামেরার ফ্রেম ভরেছেন। যাইহোক, রাটেনবার্গকে বলা হত সাদা-কালো ছবির গুরুদেব, কারণ উনি সাদা-কালো ফ্রেমে শুট করার পর সেগুলো ছবিতে প্রায়  ত্রিমাত্রিক বলে মনে হত। আরো অদ্ভুত লাগত সিলুয়েটের খেলা। কম আলোয় কালো রং যে ভেলভেটের মত ফুটে উঠতে পারে, এই সহজ তথ্য উনি গোটা পৃথিবীকে দিয়ে গেছেন। তবে রাটেনবার্গের কালোর মসৃণতা দেখতে চাইলে আমার ব্যক্তিগত পছন্দ গ্যাসলাইট (১৯৪৪)। অবশ্য তার আরেক কারণ আমার রসিক পাঠকরা এতদিন পর নিশ্চয়ই জানেন – ইনগ্রিড বার্গম্যান – যে নায়িকা আমার অল টাইম ড্রিম গার্ল।

রবার্ট রিচার্ডসনের নাম একটু আগেই উল্লেখ করেছি। ওনার প্রায় সমসাময়িক ডিকিন্সের মত উনিও সেই আটের দশকে থেকে ক্যামেরার পেছনে সক্রিয়। নব্বইয়ের দশক থেকে ওনার কাজ সামনে আসতে শুরু করে। কোয়েন্টিন টারান্টিনো এবং মার্টিন স্করসেসির পছন্দের ক্যামেরাম্যান মানেই কিন্তু রিচার্ডসন। প্লাটুন (১৯৮৬), জেএফকে (১৯৯১), দ্য অ্যাভিয়েটর (২০০৪), হুগো (২০১১), দ্য হেটফুল এইট (১৯১৫) ওনার  উল্লেখযোগ্য কিছু কাজ। উজ্জ্বল আলোর কাজে ওনাকে পথিকৃৎ মানা হয়। দ্য অ্যাভিয়েটর এবং দ্য হেটফুল এইট দেখলে সেটা খানিকটা বোঝা যায়। তবে একজন সমালোচক হিসেবে আমার মনে হয়েছে স্নো ফলিং অন সিডারস (১৯৯৯) ছবি ওনার ক্যামেরার কাজ যত ভালভাবে ফুটিয়ে তুলেছে, তোলার সুযোগ রেখেছে, বিশেষ করে আউটডোর শটে, সেটা অন্য ছবিগুলোতে হয়ত ততটা নেই।

লাতিন আমেরিকার এমানুয়েল লুবেজস্কি বয়সে এদের তুলনায় নবীন, কিন্তু এরমধ্যেই এমন কিছু কাজ করেছেন যে ইতিমধ্যেই ঐ ৩জন লিভিং লিজেন্ডে তার নাম উঠে এসেছে এবং কোয়ারনের পছন্দসই ক্যামেরাম্যান হিসেবে শুধু তিনি। ওনার যে যে বৈশিষ্ট্যগুলো আমার চোখে পড়েছে - ন্যাচারাল লাইটিং-এ শুটিং পছন্দ করার জন্য আমার মনে হয়েছে উনি আর্নেস্ট হলারের সঠিক অনুসারী, একটানা লং-শট ব্যবহারের দিকে তিনি ভাদিম ইউসেভের সার্থক উত্তরসূরী এবং হাতে ধরা স্টেডিক্যাম নিয়ে শুটিং করার জন্য অ্যালকটের উত্তরসূরী হিসেবেও তার নামটাই উঠে আসবে। বয়স মাত্র ষাট, কিন্তু ইতিমধ্য্যেই উল্লেখযোগ্য কাজ প্রচুর। চিল্ড্রেন অব মেন (২০০৬), গ্রাভিটি (২০১৩), বার্ডম্যান (২০১৪), দত রেভেনান্ট (২০১৫), আমস্টার্ডাম (২০২২) ইত্যাদি। আমি যদি লুবেজস্কির অন্য সব কাজ ভুলেও যাই, শুধু বার্ডম্যান (২০১৪) ছবির জন্য ওনাকে মনে রাখতেই হবে। 

এবং সমস্ত উঠতি ক্যামেরাম্যানদের কাছে আমার অনুরোধ, এই ছবিটা খুব মনোযোগ দিয়ে দ্যাখো, প্রতি ফ্রেম, প্রতি শট। লং টেকগুলো এত সুন্দর যে মাঝে মাঝেই পুরো সেটের ৩৬০ ডিগ্রি ক্যামেরায় উঠে এসেছে, এবং কালার কনট্রাস্ট। আধুনিক সিনেমার ইতিহাসে এই ছবি ক্যামেরার কাজের জন্য একদিন সবার ওপরে থাকবে। নিউ ইয়র্ক ফিল্ম আকাডেমি এই ছবিকে ‘a visual symphony in film making’ বলে অভিহিত করেছে।

এবার এশিয়ায় আসি। এশিয়ার মাত্র দু’জন। জাপানের কাজুও মিয়াগাওয়া (১৯০৮-১৯৯৯) ও দক্ষিণ কোরিয়ার হং কিয়ুং-পো (১৯৬২-)। এবং আগেরবার যার কথা বলেছিলাম, সবশেষে সত্যজিতের ক্যামেরাম্যান সুব্রত মিত্র (১৯৩০-২০০১)।

জাপানের কাজুও মিয়াগাওয়া বোধহয় একমাত্র সিনেমাটোগ্রাফার যিনি কুরোশাওয়া, ওজু এবং মিজোগুচি, এই তিন বিখ্যাত পরিচালকের সঙ্গেই সুনামের সাথে কাজ করেছেন। বিশেষ করে রশোমন (১৯৫০)-এর ট্র্যাকিং শটের জন্য মিয়াগাওয়া বিখ্যাত হয়ে ওঠেন। মিয়াগাওয়া ক্যামেরাম্যান হিসেবে যেসব উল্লেখ্য ছবিতে কাজ করেছিলেন – রশোমন (১৯৫০), উগেৎসু (১৯৫৩), সানসো দ্য বেলিফ (১৯৫৪), ফ্লোটিং উইডস্‌ (১৯৫৯), হার ব্রাদার (১৯৬০), য়োজিম্বো (১৯৬১)। ১৯৬০ সালে হার ব্রাদার ছবিতে উনি এক অদ্ভুত পদ্ধতি ব্যবহার করেছিলেন, যা পরবর্তীকালে বিভিন্ন ছবিতে ব্যবহৃত হতে শুরু করে – ব্লিচ বাইপাস বা স্কিপ ব্লিচ। এটার মোদ্দা ব্যাপার হল, রঙিন ছবির ওপরেই সাদা-কালো ফ্রেম ধরে রাখা। এবার আসা যাক রশোমন ছবির কথায়। আমি আগেই বলেছি, কুরোশাওয়া ছিলেন অদ্ভুত রকমের পরিচালক। উনি নিজের সেটে তিনটে করে ক্যামেরা তৈরি রাখতেন। যে কোন শটে তিনটে আলাদা অ্যাঙ্গলে তিনটে ক্যামেরা মুভ করত এবং উনি পরে এর ভেতর থেকে সেরা শটটা বেছে নিতেন। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে ওনার এক নম্বর ক্যামেরার পেছনের থাকতেন তাকাও সাইতো (১৯২৯-২০১৪)। দু’নম্বরে থাকতেন মিয়াগাওয়া। কিন্তু রশোমন ছবিতে মিয়াগাওয়ার স্বপ্নময় ফিল্টারহীন ফ্রেম আর ট্র্যাকিং শটগুলো এমন ছিল যে কুরোশাওয়া বেশিরভাগ ক্ষেত্রে সেগুলোই ব্যবহার করেছিলেন। এবং আউটডোর শট, যেগুলো 3:4 অনুপাতে ওয়াইড স্ক্রিনে নেওয়া হয়েছিল, সেগুলো ছিল রশোমন ছবির প্রধান আকর্ষণ। এখান থেকেই মিয়াগাওয়া শুরু করেন। এবং আস্তে আস্তে  নিজের কৌশল এমন জায়গায় নিয়ে যান যে পরিচালকরা ক্যামেরার জটিল কাজ ওনাকে ছাড়া করতে চাইতেন না। আমার পছন্দ কাগি (১৯৫৯) নামক এক ছবি, যেটা দেখলে বোঝা যায় মিয়াগাওয়া কতটা খুঁতখুঁতে ছিলেন ক্যামেরার পেছনে।

আমার বানানো এই সিনেমাটোগ্রাফারদের লিস্টে কাউকে যদি পাক্কা একুশ শতকের ক্যামেরাম্যান হিসেবে রাখতে হয়, তিনি হলেন দক্ষিণ কোরিয়ার হং কিয়ুং-পো। কেরিয়ার শুরু করেছেন ২০০০ সালে। এবং তারপর  মাদার (২০০৯), দ্য ওয়েলিং (২০১৬), বার্নিং (২০১৮), প্যারাসাইট (২০১৯)-এর মত বেশ কিছু ভাল ভাল ছবির ক্যামেরার পেছনে দাঁড়িয়ে গোটা পৃথিবীর সম্ভ্রম আদায় করে নিয়েছেন। প্রথমত, ডায়নামিক আউটডোর ক্যামেরা এবং দ্বিতীয়ত, দুটো সিনকে একসাথে কম্পোজ করে টানটান রহস্য ধরে রাখা - ওনাকে ক্লাসিক ক্যামেরাম্যানদের দলে অনায়াসে দাঁড় করিয়েছে। এবং এই ধারাবাহিকের একদম শুরুতেই বলেছিলাম, মূলত কোরিয়ান ছবির রহস্যময়তা ও সিনেমাটোগ্রাফি আমাকে সেই দেশের ছবি নিয়ে এত আগ্রহী করে তুলেছিল।

মাত্র ২১ বছর বয়সে ক্যামেরার পেছনে দাঁড়িয়ে ‘পথের পাঁচালী’ (১৯৫৫) শুরু করেছিলেন। আস্তে আস্তে সত্যজিতের থেকে শিখেছেন, নিজেও শিখেছেন এবং একসময় ভারতীয় সিনেমার ক্যামেরাম্যান বললে ওনার মুখটাই বোঝাত। সুব্রত মিত্র। ওনাকে ছাড়া আমার এই ক্যামেরা নিয়ে কূট-কাচালি নেহাতই বেমানান। ভারতীয় সিনেমায় ওনার বেশ কিছু অবদান আছে, কিন্তু এখানে আমি যেটা বলার জন্য কলম ধরেছি, তা হল বাউন্স লাইটিং-এর অবদান। ব্যাপারটা একটু বোঝানো যাক। ধরুন মেঘলা আকাশ, লাইট কম, আপনাকে সেই লাইটে শুট করতে হবে, কিন্তু কিউব্রিকের মত স্পেশাল লেন্স নেই। তখন আপনি যদি ফোরগ্রাউন্ডে যে বস্তু (বা মানুষ) রয়েছে, তার ওপর সোজা লাইট ফেলেন, তাহলে পেছনে খুব বিশ্রী রকমের একটা শার্প ছায়া নজরে আসবে। কিন্তু আপনি যদি অন্য একটা আয়না বা দেওয়ালের ওপর আলো ফেলে সেটার প্রতিফলন ঐ বস্তুর ওপর নিয়ে যান, দেখবেন ছায়া কমে যাবে এবং আলোর কনট্রাস্ট একদম প্রাকৃতিক মনে হবে। এটাই বাউন্স লাইটিং। এবং পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে কিছু ক্যামেরাম্যান এই পদ্ধতি ব্যবহার করে সেটাকে নিজের টেকনিক বলে চালাতে চেষ্টা করেছিলেন।

কিন্তু এক সাক্ষাতকারে সত্যজিৎ রায় স্পষ্ট জানিয়েছিলেন, এই পদ্ধতি তারা ১৯৫৪ সাল থেকে ব্যবহার করেছেন পথের পাঁচালি-তে। সুতরাং এর সন্মান কাউকে যদি দিতে হয়, তার পাওনাদার একমাত্র সুব্রত মিত্র, আর কেউ নয়। সত্যজিতের বয়ানে – ‘You know, about seven or eight years after “Pather Panchali” was made, I read an article in American Cinematographer written by Sven Nykvist – at the time of Bergman’s “Through a Glass Darkly” I think – claiming the invention of bounced light. But we had been using it since 1954.’ এর পরেও কি আর কিছু বলার থাকে?

তাহলে দু’পর্বে সব মিলিয়ে মোট ১৫জন সিনেমাটোগ্রাফার আমাদের আলোচনায় এলেন। যদিও জ্যাক কার্ডিফের মত আরো অনেকেই বাইরে রয়ে গেলেন। তো বাকিদের বিষয়ে, অনুরোধ, আগ্রহ জাগলে নিজেরাই একটু জেনে নেবেন।

 

 


প্রদোষ ভট্টাচার্য

 

বড় পর্দায় ইংরজী ছবি

কলকাতায় কনিষ্ঠতম ৭০ মিমি প্রেক্ষাগৃহ


যমুনা 


(অষ্টম পর্ব) 

কলকাতায় চৌরঙ্গী-অঞ্চলে কনিষ্ঠতম – এবং এখন লুপ্ত – ৭০ মিমি পর্দাবিশিষ্ট হল ছিল মার্কী স্ট্রীটের ‘যমুনা। এখানে যে ছবি প্রথম দেখি তা যে শুধু ৩৫ মিমি ছিল তাই নয়, ছিল সাদা-কালো, এবং আদতে গতানুগতিক পূর্ণদৈর্ঘের কাহিনিচিত্রই নয়! এটি ১৯৪৩ সালে তৈরি, ১৫ পর্বের একটি ‘সিরিয়াল! নাম এবং কেন্দ্রীয় চরিত্র আমাদের ছোটবেলার, প্রথমে অরণ্যদেব, পরে বেতাল, The Phantom, নাম ভূমিকায় টম টাইলার। হারানো নগর Zoloz-এর খোঁজে অধ্যাপক ডেভিডসন, প্রতিপক্ষ ডক্টর ব্রেমার। ব্রেমার ফ্যান্টমকে হত্যা করে, ফলে ফ্যান্টমের ছেলে – কমিক স্ট্রিপে Kit Walker নামটি তখনও আসেনি – জিওফ্রে প্রেস্কট – বাবার স্থানে অভিষিক্ত হয়ে খল চরিত্রদের সঙ্গে লড়াই চালিয়ে যায়। গোরিলার সঙ্গে কুস্তি, চোরাবালিতে ফ্যান্টমের পড়ে যাওয়া, কুমিরের আক্রমণ, সবই ছিল ছবিটিতে। তবে, যতদূর মনে পড়ে, সিরিয়ালের পর্বগুলি ঠিকভাবে সাজানো ছিল না, তাই কাহিনির অগ্রগতি খানিকটা এলোমেলো লেগেছিল।

সত্তরের দশকে এই ছবি দেখা, মার সঙ্গে। নব্বইয়ের দ্বিতীয়ার্ধে, তখন বিয়ে হয়ে গেছে, স্ত্রীর সঙ্গে বাদানুবাদের ফলে তাঁকে বাদ দিয়ে, শ্যালককে নিয়ে আবার যমুনায় – ১৯৯৬ সালে তৈরি, রঙিন, ৭০ মিমি পর্দা জুড়ে Billy Zane-অভিনীত The Phantom দেখতে! উক্ত অভিনেতা ছাড়াও, অন্যান্য চরিত্রে বেশ কিছু পরিচিত নাম পাওয়া যাবে। ফ্যান্টমের প্রেমিকা ডায়ানা পামারের ভূমিকায় Kristy Swanson, প্রথমে femme fatale এবং মুখ্য খলনায়ক Xander Drax-এর সহকারিণী সালার চরিত্রে Catherine Zeta-Jones, কিট যেহেতু ২১তম ফ্যান্টম, তাকে উপদেশ দিতে মাঝে-মাঝেই আবির্ভূত হন তার বাবা, ২০তম ফ্যান্টম, অভিনয়ে Patrick McGoohan। পরে স্ত্রীকে নিয়ে ছবিটি যমুনায় দ্বিতীয়বারও দেখেছিলাম।

যমুনায় ৭০ মিমি প্রোজেকশানে দেখা প্রথম ছবি ১৯৭৬-এর পুনর্নির্মিত রঙিন King Kong। মন্দ লাগেনি (১৯৩৩ সালের অবিস্মরণীয় আদি ছবিটি দেখেছিলাম ১৯৬৮-তে, বেতের চেয়ারে বসে, মাথার ওপর পাখা-ঘোরা টাইগার-এ!), তবে ডাইনোসরদের অনুপস্থিতি মনে ক্ষোভের জন্ম দিয়েছিল!

১৯৮৮-তে বিদেশ থেকে ফিরে যমুনায় দেখি, ওদেশে ভিডিওতে দেখা মজার ভূতের ছবি Ghostbusters-এর দ্বিতীয় কিস্তি, Ghostbusters II। এটি বড় পর্দা জুড়ে ছিল। কিন্তু বিদেশে দেখা এবং যমুনায় দ্বিতীয়বার দেখতে যাওয়া জেমস ক্যামেরন পরিচালিত Aliens ৩৫ মিমিতেই দেখতে হয়েছে। দুটি ছবিতে দুটি ভিন্নধর্মী চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন Sigourney Weaver।

যমুনায় দেখা সবচেয়ে স্মরণীয় ছবি ১৯৯৩ সালে তৈরি স্টিভেন স্পিলবার্গ পরিচালিত মাইকেল ক্রাইখটনের উপন্যাসের চিত্ররূপ Jurassic Park! এটি কিন্তু ৩৫ মিমিতেই দেখতে হয়েছিল। দেখে সবাইয়ের এত ভাল লেগেছিল – স্ত্রী, শ্যালক, শ্যালিকা – যে টিকিট কেটে শ্বশুর-শাশুড়ীকে দেখতে পাঠাই!

বড় পর্দায় যমুনায় দেখেছি সস্ত্রীক, আবার জেমস ক্যামেরন পরিচালিত Terminator 2: Judgement Day। এই সিরিজের প্রথম ছবি The Terminator স্ত্রীকে নিয়েই দেখেছি ৩৫ মিমি প্রোজেকশানে, নিউ এম্পায়ারে। অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রীকে এই জাতীয় ছবি দেখানোর ব্যাপারে তাঁর ভাসুর – আমার দাদা – মৃদু আপত্তি তুলেছিলেন!

যমুনায় দেখা শেষ ছবি সম্ভবত আমার শ্যালকের সঙ্গে, ১৯৯৫ সালে তৈরি কল্পবিজ্ঞান-হরর Species। ৭০ মিমি প্রোজেকশানই ছিল।

(নবম পর্ব)    

আমার সবচেয়ে প্রিয় দুটি ছবি। প্রথমটি কলকাতায় মুক্তি পায় ১৯৬৬ সালে, গ্লোব সিনেমায়। মনে হয় এক বছরের মতো চলেছিল, যা ইংরেজী ছবির পক্ষে অপ্রত্যাশিত। পরে, সত্তরের দশকে রাজ কাপুরের ববি বছরখানেক চলবে, আর প্রায় এক বছর চলবে ইয়াদোঁ কী বারাত।

The Sound of Music চলচ্চিত্রায়িত হয় ১৯৬৫ সালে। উৎস ১৯৪৯ সালে প্রকাশিত Maria Von Trapp-এর আত্মজীবনীমূলক The Story of the Trapp Family Singers, যার থেকে ১৯৫৯ সালে এক মঞ্চসফল সঙ্গীতবহুল নাটক প্রযোজিত হয়। লেখক ছিলেন Richard Rogers এবং গীত রচয়িতা Oscar Hammerstein II। ১৯৬১-তে এইরকম সংগীতধর্মী নাটক West Side Story চিত্রায়িত করে সফল Robert Wise এবার The Sound of Music-এর দায়িত্ব নেন। মুক্তি পাবার পর মিশ্র, অনেক সময় নেতিবাচক, সমালোচনা সত্বেও ছবিটি অভূতপূর্ব দর্শকানুকুল্য পায়, যা ডলারের অঙ্কে ১৯৩৯ সালের Gone with the Wind-কেও ছাড়িয়ে যায়। আমেরিকার National Film Registry-তে ছবিটি সাংস্কৃতিক, ঐতিহাসিক বা শৈল্পিক দিক দিয়ে গুরুত্বপূর্ণ বলে সুরক্ষিত হয়েছে।

আমাদের বাবা ১৯৬৫ থেকে সিনেমা দেখার ব্যাপারে এক নির্মম-সদয় রীতি চালু করেন। বছরের নির্দিষ্ট সময় জ্বর-উৎপাদক এবং অত্যন্ত যন্ত্রণাদায়ক T. A. B. C. ইনজেকশন নিতে হবে, এবং তার কষ্ট ভোলার জন্য সিনেমা দেখা যেতে পারে! The Sound of Music প্রথমবার দেখা এই পীড়াদায়ক প্রতিষেধক নেওয়ারই ফসল! ছবিটির ট্রেলার দেখে (১৯৬৬ সালে) তেমন কিছু লাগেনি। দেখার আগ্রহও ছিল না। জ্বর আর ব্যথা নিয়ে দেখে অনিচ্ছাসত্বেও স্বীকার করতে বাধ্য হলাম, ছবিটি “মন্দ নয়! সেটা ১৯৬৭ সাল। তারপর ঠিক মনে নেই কিভাবে, ছবিটি অভূতপূর্বভাবে ভালো লেগে গেল। সেই গ্লোবেই দেখেছি ১৯৬৭ থেকে ১৯৭৫-এর মধ্যে চারবার! প্রায় প্রতি বছরেই ছবিটি পুনর্মুক্তি পেত। তারপর, সত্তরের শেষের দিকে, টাইগার প্রেক্ষাগৃহে পঞ্চমবার দেখি। বড় পর্দায় যে চারটি ছবি – বাংলা-হিন্দী-ইংরেজী মিলিয়ে – সবচেয়ে বেশীবার দেখেছি, তার মধ্যে একটি এই Sound of Music।

ভালো লাগার অন্যতম কারণ ইংরেজী গানের সম্বন্ধে বোধহয় আপামর মধ্যবিত্ত বাঙালী ছেলেমেয়ের ধারণা পালটে দেওয়া। ছোটবেলা থেকে রেকর্ডে বা রেডিওতে যৎসামান্য ইংরেজী গান যা শুনেছি, সে সবই অপেরাধর্মী – সেই হু-উউউউ আর হাআআআআআআ। কথাগুলো ইংরেজী, হিব্রু, গ্রীক না লাতিন – বোঝা অসম্ভব! এর আগে, বোধহয় ১৯৬৫-তে, My Fair Lady এসেছিল, কিন্তু সেটা ঠিক ছোটদের জন্য নয় বলেই আমাদের দেখানো হয়নি। The Sound of Music মুগ্ধ করলো গানের সুরে শুধু নয়, গানের কথায় – যেমন সরল শব্দ, তেমনই মর্মস্পর্শী। দুটি উদাহরণ দেব। নাৎজি জার্মানির আগ্রাসনের মুখে দাঁড়িয়ে আল্পস পর্বতে ফোটা Edelweiss ফুলকে স্বদেশ অস্ট্রিয়ার প্রতি দেশপ্রেমের প্রতীক হিসেবে ব্যবহার করে ছবির মুখ্য পুরুষ চরিত্র ক্যাপ্টেন ভন ট্র্যাপ গেয়ে ওঠেনঃ

Edelweiss, Edelweiss – every morning you greet me.

Small and white, clean and bright, you look happy to meet me.

Blossom of snow, may you bloom and grow, bloom and grow forever!

Edelweiss, Edelweiss – bless my homeland forever!

অথবা, যে শীর্ষগান থেকে ছবির নামকরণ, গায়িকা-নায়িকা মারিয়ারূপিনী জুলি অ্যান্ড্রুজের উদাত্ত মধুপ্রদ কণ্ঠেঃ

The hills are alive with the sound of music –

With songs they have sung for a thousand years!

The hills fill my heart with the sound of music –

My heart wants to sing every song it hears!

My heart wants to beat like the wings of the birds

That rise from the lake to the trees;

My heart wants to sigh like a chime that flies

From a church on a breeze;

To laugh like a brook when it trips and falls

Over stones on its way,

To sing through the night like a lark who is learning to pray!

I go to the hills when my heart is lonely.

I know I will hear what I've heard before –

My heart will be blessed with the sound of music,

And I'll sing once more!

কি নেই ছবিটিতে! প্রতিটি চরিত্রে অভিনেতা-অভিনেত্রীর নিখুঁত অভিনয়, এমনকি ক্যাপ্টেন ভন ট্র্যাপের সাত-সাতটি মাতৃহীন সন্তানদের – যাদের বয়স ষোল থেকে পাঁচ! ছোট্ট গ্রেটেলের চরিত্রে পাগল করা মিষ্টি শিশু কিম ক্যারাথ অবধি অবিস্মরণীয়। ষোল বছরের লিসেল চরিত্রে একুশ বছরের Charmian Carr যেমন সুশ্রী তেমনই নিপুণ। আর দুই কেন্দ্রীয় চরিত্রে মারিয়ারূপিনী জুলি তো সবার প্রিয় গভরনেস-অবশেষে শিশুদের নতুন মা হিসেবে একেবারে মন কেড়েছিলেন। পত্নীবিরহে আপাত-কঠোর কিন্তু মারিয়ার প্রভাবে স্নেহের ফল্গুধারা নির্গত হওয়া ক্যাপ্টেনের ভূমিকায় ক্রিস্টোফার প্লামার একদম যথাযথ।

এছাড়া ইতিহাসের অমোঘ নির্দেশে সুখী পরিবারের জীবনে শত্রুর অন্ধকার উপস্থিতি, তাদের গ্রাস থেকে রূদ্ধশ্বাস দৃশ্যে কোনক্রমে মুক্তিলাভ – প্রতিটি জিনিস স্মৃতিতে অত্যুজ্জ্বল আজও! আর প্রায় প্রতিটি গান কণ্ঠস্থ হয়ে গিয়েছিল সেই দশ-এগারো বছর বয়সে!

এবার আসি আমার প্রিয়তম ছবির প্রসঙ্গে। এর উল্লেখ আগে করেছি, যখন বলেছিলাম যে ১৯৬৪-তে আমি প্রথম ওয়াল্ট ডিজনীর ছবি দেখি। ঐ ১৯৬৪-তেই তৈরি কিন্তু এদেশে ১৯৬৮-তে মুক্তিপ্রাপ্ত ছবি হলো প্যামেলা ট্র্যাভার্সের চারখানা (ছবির পর তিনি আরও ২/৩ টি লিখেছিলেন) বই অনুপ্রাণিত Mary Poppins। নাম ভূমিকায় সেই The Sound of Music-এর জুলি অ্যান্ড্রুজ। এটিই তাঁর অভিনীত প্রথম ছবি, এবং প্রথম আবির্ভাবেই তিনি শ্রেষ্ঠ অভিনেত্রীর ‘অস্কার জিতে নেন! ছবিটি ১৯৬৪-তে আমেরিকায় প্রথম মুক্তি পেলেও – অর্থাৎ The Sound of Music-এর আগে – এই দ্বিতীয়োক্ত ছবি যে মঞ্চনাটকের ওপর আধারিত সেটি তো ১৯৫৯-এর। অতএব, Mary Poppins-এর চিত্র্যনাট্যে তখন এখানকার দর্শক The Sound of Music-এর আখ্যানের যে প্রভাব লক্ষ করেছিলেন, তা যথার্থই মনে হয়। এবং এও ঘটনা যে দ্বিতীয়োক্ত ছবির পরিচালক রবার্ট ওয়াইজ ৩০শে অক্টোবর ১৯৬৩-তে ডিজনী স্টুডিওতে গিয়ে তখনো অমুক্তিপ্রাপ্ত Mary Poppins-এর কিছু ফুটেজ দেখেই গ্রেস কেলি, অ্যান ব্যাঙ্ক্রফট প্রমুখদের কথা বাতিল করে জুলিকেই নির্বাচন করেন।

ব্যাঙ্কস পরিবারের কর্তা জর্জ (ক্যাপ্টেন ভন ট্র্যাপ- এর নাম ছিল Georg!) ব্যাঙ্কের উচ্চপদস্থ কর্মচারী। তাঁর স্ত্রী উইনিফ্রেড স্বামীর অজান্তে সেই ১৯১০ সালে মেয়েদের ভোটাধিকার-আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত। তাঁদের দুই শিশু, বড় মেয়ে জেন আর ছোট ছেলে মাইকেলের জন্য বাবা-মার সময় কোথায়? তারা মানুষ হয় গভরনেসের হাতে। এবং ভন ট্র্যাপ ছেলেমেয়েদের মতোই জেন-মাইকেলের দস্যিপনায় এক গভরনেস যায়, আরেকজন আসে! এ ঘটনা অবশ্য ১৯৩৪ সালে প্রকাশিত প্রথম উপন্যাস Mary Poppins-এই আছে! শেষ গভরনেস কেটি ন্যানা বিদায় নেবার পর বাবা তাদের মাকে দিয়ে খবরের কাগজের জন্য বিজ্ঞাপন লেখান এক কড়া, কঠোরভাবে নিয়মানুবর্তী গভরনেসের আবেদন করে। তার মাঝখানে দুই ভাইবোন এসে তাদের পছন্দের গভরনেস কিরকম হবে লিখে এনে তা বাবা-মাকে গেয়ে শুনিয়ে নার্সারিতে ফিরে যায়। চরম তাচ্ছিল্যের সঙ্গে জর্জ ব্যাঙ্কস তাদের লেখা কাগজটি ছিঁড়ে কুচিকুচি করে ফায়ারপ্লেসে নিক্ষেপ করেন। কিন্তু আমরা দেখি, সকলের অজান্তে কুচোনো কাগজগুলোকে আপনা থেকে উঠে চিমনি দিয়ে আকাশে উড়ে যেতে! (এর আগে, ছবির শুরুতেই দেখেছি লন্ডনের আকাশে মেঘের ওপর বসা অতি মিষ্টি দেখতে এক মহিলাকে!)

পরের দিন ১৬ নম্বর চেরি ট্রি লেনের (ব্যাঙ্কসদের বাড়ী) বাইরে গোমড়ামুখো প্রৌঢ়া গভরনেসদের লম্বা লাইন। হঠাৎ এক দমকা হাওয়ায় তারা সবাই উড়ে যায়! মাথায় ছাতা দিয়ে বাড়ীর সামনে উড়ে এসে নামেন শিশুরা ঠিক যেমনটি চেয়েছিল, তেমনি মিষ্টি, গোলাপি গাল, সেই মেঘের ওপর বসে থাকা মহিলা! জর্জ তাঁর মূল্যায়ন করবেন কী, তিনিই ঢুকে শিশুদ্বয়ের লেখা (কোন জাদুবিদ্যায় কাগজের টুকরোগুলো সব জুড়ে গেছে!) চিঠি গৃহকর্তাকে গড়গড় করে পড়ে বলেন তাঁর পূর্ণ যোগ্যতা রয়েছে, তিনি নার্সারিতে চললেন! এরপর সকলের অলক্ষ্যে সিঁড়ির ব্যানিস্টারে বসে ওপরদিকে দিব্যি উঠে যান, মাধ্যাকর্ষণ শক্তিকে উপেক্ষা করে – ইনিই মেরি পপিন্স!

সাউন্ড অব মিউজিক’-এ মারিয়ার স্নেহের প্রভাবে ছেলেমেয়েরা এবং তাদের বাবা ক্যাপ্টেন পালটে  যান। মেরি পপিন্স একই রকমের পরিবর্তন আনেন ব্যাঙ্কসবাড়ীতে – তবে আক্ষরিক অর্থে ম্যাজিকের মধ্য দিয়ে! আত্মসর্বস্ব জর্জ স্নেহের দৃষ্টিতে দেখতে শেখেন দুই সন্তানকে, তাদের সহজ-সরল শখ-আহ্লাদের মূল্য দেন নিজের হাতে তাদের খেলার ঘুড়ি মেরামত করে তাদের এবং স্ত্রীকে নিয়ে জীবনে প্রথম পার্কে সেই ঘুড়ি ওড়াতে নিয়ে গিয়ে। আর তাঁর অব্যক্ত ইচ্ছা – ছেলেমেয়েরা তাঁর সঙ্গে ব্যাঙ্কে গিয়ে টাকার মূল্য কী তা শিখুক, অর্থনীতি, লাভ-ক্ষতির হিসেব করুক – কাজে লাগিয়ে ব্যাঙ্কে হুলুস্থুল ফেলে দিয়ে নিজের যে আপাত সর্বনাশ – চাকরী থেকে বরখাস্ত হওয়া – ডেকে এনেছিলেন, তাও উল্টে যায়, মেরি পপিন্সের সহযোগীদের বলা একটি মজার গল্পের কল্যাণে! ব্যাঙ্কস সসম্মানে ব্যাঙ্কে ফিরে আসেন কর্মচারী হিসেবে নয়, পার্টনার রূপে!

এর মাঝখানে এসেছে একের পর এক ম্যাজিকের ঘটনা। মেরির হাতের তুড়িতে নার্সারির যাবতীয় ছড়িয়ে থাকা জিনিস, খেলনা ইত্যাদি নিজেদের গুছিয়ে ফেলে, মেরির বন্ধু বার্টের রঙিন খড়ি দিয়ে ফুটপাথে আঁকা ছবির মধ্যে মেরি, বার্ট, জেন আর মাইকেলের ঢুকে গিয়ে জ্যান্ত কার্টুন চরিত্রদের সঙ্গে খেলা করে, মেরির আত্মীয় আংকল অ্যালবার্টের ঘরে সবাই সিলিং-এ বসে চা খায়, আরও কত কী!

সাউন্ড অব মিউজিক-এর মতো ‘মেরি পপিন্স-এর প্রতিটি গান সেই থেকে আজও কণ্ঠস্থ!

মেট্রোতে ছ সপ্তাহ চলাকালীন ছবিটি দেখি তিনবার, প্রথমে সপরিবারে, দ্বিতীয়বার মাসীমাকে নিয়ে দাদা আর আমি, তৃতীয়বার বাবার সঙ্গে। এর কয়েক বছর পর, ঐ মেট্রোতেই রবিবার সকালে চতুর্থবার আর আরও পরে আরেক রবিবার সকালে এলিট সিনেমায়, এই দুবারেও বাবার সঙ্গে।

Mary Poppins আজও আমার কাছে আমার সারা জীবনে দেখা শ্রেষ্ঠ ছবি – ইংরেজী, বাংলা, হিন্দী মিশিয়ে । দ্বিতীয় স্থানে আছে The Sound of Music।

 

 

 


তপজা মিত্র

 

সিনেমার মনন ও মানসিকতায় নব্য বস্তুবাদ

 


দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়কাল। বিপর্যস্ত, বিধ্বস্ত চারপাশ। বোমায় নিশ্চিহ্ন স্টুডিও সিস্টেম। সিনেমার কারিগররা ভাবতে শুরু করেছেন কীভাবে নয়া পদ্ধতিতে ছবি তৈরি করা যায়! অনেকেই জীবিকার সন্ধানে হলিউড পাড়ি দিয়েছেন। জাঁ রেনোয়ার সঙ্গে একসময় কাজ করেছিলেন রসোলিনি। তিনি দুমড়ে মুচড়ে যাওয়া ক্যানভাসে ছবি আঁকবার চেষ্টা করলেন। অনামী, বিশেষত গ্রুপ থিয়েটারের কুশীলবদের নিয়ে তিনি কাজ করলেন। শুটিং হল শহরের বিভিন্ন রাস্তায়। তৈরি হল নতুন ধারার ছবি। রোম : ওপেন সিটি। বিষয়বস্তু, ক্যামেরার নব ভাষা, আঙ্গিক, প্রেক্ষাপট, বোলচালের জিন্দেগী, আটপৌরে মেদুরতায় ছবি স্পর্শ করল বাস্তবতার সীমা। ক্যামেরা স্টুডিওর সীমানা ছাড়িয়ে ঘুরে বেড়াল আনাচকানাচ। মেকি নয়, জীবন তখন real. অশ্রুবিন্দু হাতের মুঠোয় ধরা পড়ল। neo realism মিশে গেল জীবনের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে।

Hemingwayর Old man and the sea র উক্তি... "মানুষ ধ্বংস হতে পারে। কিন্ত পরাজিত হবে না কোনদিন।" neo realism এর উচ্চারণ এই উক্তিকে সমর্থন করল। স্বপ্নবহুল জগত ছেড়ে ক্যামেরা প্যান করল রাস্তায়, শ্রমিক-বস্তিতে, গরিব মানুষের দিকে।

Tilt up, tilt down করে দেখাল মধ্যবিত্ত ও ভুখা মানুষের যাপন।  ক্যামেরা কাঁপল, ক্যামেরা কাঁদল... মুহূর্ত বন্দি হল হৃদয়ে। শু সাইন, বাইসাইকেল থিভস-এর নির্মাতা ডি সিকার ছবি চলচ্চিত্র দুনিয়ায় যে বিপ্লব সংঘটিত করেছিল তার ফলশ্রুতি হল মিরাকল ইন মিলান, ফেলিনির eight and half, আন্তোনিয়নির ইল গ্রিদো, সত্যজিত রায়ের পথের পাঁচালি সহ নানাবিধ বাস্তববোধসম্পন্ন ছবি। প্রতিটি ছবি সময়ের দলিল।

ডিটেইলস-এর যেসব বিষয় আমরা এখন বিশ্ব চলচ্চিত্রে দেখি তার উদ্ভব নব্য বস্তুবাদের ভারসাম্যযুক্ত পরিকাঠামোয়। সেই সময় সাদা কালোতে ছবি তোলার আগ্রহ ক্যামেরার নৈর্ব্যক্তিক গতি চরিত্রকে প্রতিভাত করেছে। এই নব্য বস্তুবাদের পথ ধরে এল নব তরঙ্গ। ত্রুফো, গদার নব তরঙ্গের  প্রতিভূ। ত্রুফোর 400 blows কান চলচ্চিত্র উৎসবে শিরোপা অর্জন করে বুঝিয়ে দেয় অতি বাস্তবতা সিনেমার ভিতকে মজবুত করে। Hand held camera, কাঁধে ঝোলানো টেপ রেকর্ডার, ultra sensitive negetive ব্যবহার করে নব তরঙ্গের পরিচালকরা সিনেমার ভাষাকে সম্পূর্ণ বদলে দিয়েছিলেন। অল্প আলোয় ছবি গভীরতম অনুভূতির কথা ব্যক্ত করেছিল। যে অনুভূতির স্রোত আজও বহমান। বিখ্যাত ছবি হিরোসিমা মুন আমুর, আলা রেনেঁর পরিচালনায় যুদ্ধবিরোধী মানবতাপ্রমী মনোভাবকে স্পষ্ট করেছে। মৃণাল সেনের একদিন প্রতিদিন ছবিতে অস্তিত্ববাদের রূপ ধরা পড়ে। বাস্তব থেকে অতি বাস্তব, কঠিন বস্তুতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থা আধুনিক সিনেমার মানদণ্ডকে নির্মাণ করে বুঝিয়ে দিয়েছে ছবির ভাষা, ক্যামেরার চলন আসলে জীবনের রোজনামচা, অথবা তারও বেশি কিছু।


অমিতাভ চৌধুরী

 

যতনে রতন চিনি

 


সেই নিষ্ঠা, সেই যত্ন

যতন অর্থাৎ যত্ন কথাটার মানে কেয়ার বা তত্ত্বাবধান। তবে আরেকটা মানেও আছে। সেটা হল প্রচেষ্টা কিংবা উদ্যম। রতন টাটার মহাপ্রয়াণের পর whatsapp, facebook, youtube, instagramএ এত খবর প্রকাশ পাচ্ছে যে মানুষের আর কিছু অজানা নেই। সুতরাং এই মহা-চরিত্রের উপরে কিছু লিখতে যাওয়া মানে সেটা নির্ঘাত পুনরাবৃত্তি হবে। লোকে বলবে, ও হরি, এ তো আমি কবেই পড়ে ফেলেছি, তুমি নতুনটা আর কি শোনালে? তাই আমি আমার কিছু একান্ত ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা এখানে লিখছি, জীবনের এক গর্বিত কৃতিত্ব বা proud accomplishment— যে কৃতিত্ব হাসিল করতে গিয়ে আমাকে এবং আমার মত আরও কয়েকজনকে প্রচণ্ড পরিমাণ প্রচেষ্টা, পরিশ্রম আর উদ্যমের মধ্যে দিয়ে যেতে হয়েছিল। অবশেষে সেই ‘পেশাদারী যতন’ আমাদের এক বিশাল রতনের কাছাকাছি এনে দিল। একটা বিরাট প্রাপ্তি – রতন টাটার নিমন্ত্রণ। হ্যাঁ, ঠিকই পড়লেন, রতন টাটা নিমন্ত্রণ, যেখানে উনি হোস্ট, এবং আমরা গেস্ট!

আন্তর্জাতিক পটভূমি

খানিকটা International Background বলে নি, তাহলে ব্যাপারটা বোঝাতে সুবিধা হবে। ৭০ দশকের মাঝামাঝি থেকে 80 দশকের গোড়ায় জাপান আক্রমণ করল আমেরিকাকে! অবশ্য সেই আক্রমণে কোন সৈন্য সামন্ত দরকার হল না। তারা আক্রমণ করল আমেরিকার ব্যবসাকে, এবং কম্পিটিশন বা প্রতিযোগিতায় এতটাই সাফল্য লাভ করল যে আমেরিকার অবস্থা নাজেহাল। তিন Automobile giants— Ford, General Motors and Chrysler অন্তর্জলি যাত্রায় চলে গেল। জাপানি গাড়ি ছাড়া অন্য গাড়ি আর বিক্রিই হয় না আমেরিকানদের নিজের দেশে। গাড়ি এক্সপোর্ট করা তো অতীতের স্বপ্ন! Nicon, Canon, Fuji, Pentax, Olympus এইসব ক্যামেরার ব্রান্ডগুলো রাতারাতি বাকি সব ক্যামেরা কোম্পানিকে কবরে পাঠিয়ে দিল, শুধু আমেরিকাতে নয়, সারা বিশ্বে। চারটি মোটরাইক কোম্পানি, Honda, Kawashaki, Suzuki আর Yamaha-র ঠেলায় পৃথিবীর বাকি সব মোটরসাইকেল কোম্পানিকে বন্ধ। পৃথিবীর চারভাগের তিন ভাগ Photocopier এর মার্কেট ছিল Xerox কোম্পানির সাথে। Photocopier মেশিনের ডাকনামই হয়ে গেছিল জেরক্স মেশিন। হঠাৎ দেখা গেল, যে সব ‘জেরক্স’ মেশিন বাজারে বিক্রি হচ্ছে সেগুলো Japanese Canon Photocopier!  আমেরিকার নিজস্ব ব্যবসা-বাণিজ্য ঠেকল একেবারে তলানিতে গিয়ে।

দিগগজ মার্কিন ইকোনোমিস্টরা বুঝতেই পারছিলেন না এই আক্রমণ কি করে ঠেকানো যায়। এদিকে দেশের অর্থনীতিতে ধ্বস নেমেই চলেছে। আমেরিকার এই কান্নাকাটির সময় আবির্ভূত হলেন একজন মহাপুরুষ, যার নাম Malcolm Baldrige, তৎকালীন US Secretary of Commerce. জাপানি আক্রমণকে ঠেকাতে তিনি দেশব্যাপী  কোয়ালিটি উন্নয়ন কর্মসূচি শুরু করলেন। তাঁর পলিসিকে অনুসরণ করে পরপর কোম্পানিরা আবার একটু একটু করে ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করলো। অন্তত তারা বুঝতে পারল কিভাবে জাপানি কোম্পানিকে টক্কর দেওয়া যায়। কিন্তু হঠাৎ ইন্দ্রপতন হল। অত্যন্ত দুঃখজনক-ভাবে Malcolm Baldrige একটি সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যান। তার নামে ইউ.এস. গভর্নমেন্ট Malcolm Baldrige National Quality Award ঘোষণা করে, যাতে কিছু বিশেষ মানদণ্ডের নিরিখে প্রতিবছর পুরস্কৃত করা হত ৫টি শ্রেষ্ঠ আমেরিকান কোম্পানিকে (ইদানিং কালে বেড়ে ১৮টি হয়েছে)।

রতন টাটার চিন্তাধারা এবং বানেশ্বরনের আবির্ভাব

JRD Tata এক অসাধারণ নৈতিক মানদণ্ড বা ethical standard তৈরি করে গেছিলেন।  কিন্তু তিনি বিশ্বাস রাখতেন প্রত্যেক টাটা কোম্পানির স্বতন্ত্র উৎকর্ষতা অথবা individual excellence এ। সেই সময় টাটা কোম্পানিগুলোর নিজস্ব আলাদা আলাদা লোগো ছিল, নিজের ব্যবসা নিজের মতো চালানোর অধিকার ছিল প্রত্যেকের। এমনকি গ্রুপ-এর নৈতিক মানদণ্ডকে, অত্যন্ত শ্রদ্ধার সঙ্গে হলেও, নিজের নিজের মতো করে ব্যাখ্যা করতো বিভিন্ন কোম্পানি।  ৯০ দশকের গোড়ার দিকে টাটা সাম্রাজ্যের দায়িত্ব নিজের হাতে তুলে নিয়ে রতন টাটা প্রথমেই চাইলেন ৮০টি টাটা কোম্পানিকে এক ছাতার তলায় নিয়ে আসতে। এই উদ্দেশ্য নিয়ে পরপর নানা ধরনের কাজ করা হল। পুরো গ্রুপ উপহার পেল নতুন একটা লোগো। টাটার নৈতিক মানদণ্ডকে নথিবদ্ধ করা হল, জন্ম নিলো ‘টাটা কোড অফ কন্ডাক্ট’ (Tata Code of Conduct)। এমনকি ব্যবসায় নিজেদের বাজারে সব প্রতিষ্ঠিত করার জন্য কিছু কিছু লক্ষ্য স্থির করা হল। কিন্তু এত কিছুতেও রতন টাটার মনের মধ্যে অপূর্ণতা থেকেই যাচ্ছিল।

সেই সময় তাঁর বন্ধু Mr. S. A. Vaneswaran আমেরিকার থেকে ভারতবর্ষে চলে আসতে রাজি হলেন। তিনি ছিলেন যুক্তরাষ্ট্র আমেরিকার Malcolm Baldrige Award Committee-র একজন মান্যতা-প্রাপ্ত মূল্যায়নকারী (certified assessor), যিনি শ্রেষ্ঠ আমেরিকান কোম্পানিগুলোকে মূল্যায়ন করে তাদেরকে পুরস্কৃত করতেন। বানেশ্বরন আইডিয়া দিলেন যে Malcolm Baldridge-এর অনুসারে টাটা গ্রুপের মধ্যে একটা প্রতিযোগিতা শুরু করতে এবং শ্রেষ্ঠ কোম্পানিগুলোকে পুরস্কৃত করতে। রতন টাটা বুঝতে পারলেন যে এই পদ্ধতিতে সবকটা টাটা কোম্পানির একটা মূল্যায়ন হয়ে যাবে এবং তাদেরকে “আন্ডার ওয়ান আমব্রেলা” নিয়ে আসা যেতে পারে। ব্যাস! শুরু হল বানেশ্বরনের তত্ত্বাবধানে TBEM (Tata Business Excellence Model) এবং সেটা হল হুবহু Malcolm Baldrige এর মানদণ্ড অক্ষুণ্ণ রেখে। টাটা কোম্পানিদের মূল্যায়নের পরে প্রত্যেক বছর যে পুরস্কার দেওয়া হবে তার নাম রাখা হল JRD QV Award (QV মানে Quality Value).





(রতন টাটার সঙ্গে বানেশ্বরনের একটা 30 বছর পুরনো একটা ছবি, TBEM লোগো, আর রতন টাটার মহাপ্রয়াণের কিছুদিন পরে বানেশ্বরন তাঁর সম্বন্ধে যা বলেছিলেন সেগুলো উপরে দেওয়া হল উৎসাহী পাঠকদের জন্যে}

এদিকে আমরা, পাতি ভারতীয়রা, নাকানিচোবানি খাচ্ছিলাম আমেরিকার সর্বশ্রেষ্ঠ standard এর পরিপ্রেক্ষিতে নিজেদেরকে খাপ খাইয়ে নিতে— সত্যি বলতে কি এই 1000-point স্কেলের নির্ণায়ক গোড়ার দিকে আমাদের মাথাতেই ঢুকছিল না। অন্যদিকে, রতন টাটার দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে, এতগুলো টাটা কোম্পানিকে মূল্যায়ন করবে কে? ভারতবর্ষে Baldrige assessor তো কেউ নেই। আমেরিকা থেকে assessor আনতে হচ্ছিল, যারা প্রতিদিন দুই থেকে তিন লাখ টাকা নিতো সেই সময় (আজ থেকে তিরিশ বছর আগে)। অর্থাৎ একটা কোম্পানির জন্য অন্তত কুড়ি তিরিশ লাখ টাকা!! এইভাবে আশিটা কোম্পানিকে মূল্যায়ন করতে হলে তার পেছনে পেছনে কি বিশাল পরিমাণ অর্থ ব্যয় করতে হবে, সেটা সহজেই অনুমেয়। সুতরাং বানেশ্বরন শুরু করলেন স্বদেশী TBEM Assessor তৈরি করা। আমেরিকা থেকে Baldrige এর মান্যতাপ্রাপ্ত ট্রেনর নিয়ে এসে টাটা গ্রুপের উৎসাহী executive-দের তালিম দেয়া শুরু হল। একেই তো সেরকম উৎসাহী লোক গ্রুপে খুঁজে পাওয়া মুশকিল। তার ওপরে যারা এগিয়ে এলো, Baldrige criteria হৃদয়ঙ্গম করতে তাদের প্রাণ যায় যায় অবস্থা। সত্যিকারের কারণটা ছিল একটা বিশাল সাংস্কৃতিক ব্যবধান বা cultural gap. একের পর এক তিনটে স্টেজে ট্রেনিং এবং পরীক্ষা হতো। প্রথম স্তরেই, ৬০/৭০ ভাগ উৎসাহী অফিসার অসফল হয়ে বিদায় নিত। বাকিদের দ্বিতীয় স্টেজ দিয়ে এগোতে হতো, সেখান থেকে অর্ধেক এগোতে পারত তৃতীয় স্তরে! তৃতীয় স্টেজে যারা পৌঁছল, তাদের মধ্যে প্রায় অনেকেই ফাইনাল পরীক্ষায় পাশ করে Certified TBEM Assessor খেতাব পেত, a proud recognition!

এত পড়াশুনা করলে জীবনে কি হতে পারতাম সেসব চিন্তা করে লাভ নেই। তবে তিনটে স্তর পেরিয়ে এই সার্টিফিকেট হাসিল করার জন্য অপরিসীম মেধা এবং পরিশ্রম দরকার হয়েছে। তাই এই খেতাব পেয়ে আমাদের গর্বে বুক ফুলে উঠলো। স্বাভাবিক কারণেই। কিন্তু এখানেই তো শেষ নয়, এরপর শুরু হল সত্যিকারের TBEM Assessment। দুনিয়াদারির নানা পর্যায় পেরিয়ে এসে আজ আমি নির্দ্বিধায় বলতে পারি, TBEM-এর assessments-গুলোই আজ পর্যন্ত আমার পেশাদারী জীবনের সবচেয়ে সুকঠিন এসাইনমেন্ট। প্রত্যেক টাটা কোম্পানিকে সার্বিকভাবে মূল্যায়ন বা assess করার জন্য আট থেকে দশজনের একটা গ্রুপ একটা গ্রুপ তৈরি করা হতো, যার সঙ্গে থাকতো একজন করে সার্টিফাইড্ আমেরিকান Baldrige Assessor. অতঃপর দিবারাত্রির কাব্য! প্রত্যেককেই পনেরো দিনের বিনিদ্র রজনী কাটিয়ে এই দুরহ কর্ম সঠিকভাবে এবং সুচারুরূপে সম্পন্ন করার চ্যালেঞ্জ।

একজন অসাধারণ ভদ্রলোক

আগেই বলেছি, TBEM Assessor হিসেবে আমাদের মানসিক ও কায়িক পরিশ্রমের এবং আমাদের পেশাদারী যত্নের ফল যা পেয়েছিলাম তা সত্যিই অভাবনীয়। সেই যতন আমাদের রতনকে চিনিয়ে ছিল একদম কাছাকাছি থেকে। প্রত্যেক বছর ফাইনাল TBEM Assessors পরীক্ষার শেষ হবার এবং allotted টাটা কোম্পানিদের assessment শেষ করার পরে, ২৯ জুলাই (JRD-র জন্মদিনে) রতন টাটার ‘পার্সোনাল ইনভিটেশনে’আমরা যেতাম প্রথমে বোম্বেতে এবং তারপর গোয়াতে। সেখানে আমরা সম্মানীয় অতিথি আর  রতন টাটা নিজে হোস্ট। উনি বারবার একটাই কথা বলতেন, তোমরা হচ্ছ Tata group এর intellectual assets. তোমরা না থাকলে আমরা কোটি কোটি টাকা আমেরিকান Assessor-দের দিতে বাধ্য হতাম। ওই দিনই আমাদের পরীক্ষা পাশের সার্টিফিকেট দিতেন রতন টাটা নিজের হাতে। (এখানে বলে রাখা ভালো, ইঞ্জিনিয়ারিং, ওকালতি, ডাক্তারির মত একবার পাস করলেই সারা জীবনের মতো সার্টিফিকেট পায় না TBEM-এর মূল্যায়নকারী বা Assessors-রা। এখানে প্রত্যেক বছর পরীক্ষা দিয়ে পাস করতে হয়, সার্টিফিকেট মাত্র এক বছরের জন্য বৈধ। তার কারণ, Baldrige criteria বছরে বছরে চেঞ্জ হতে থাকে)। সান্ধ্য Boozing sesson এর পর ডিনারে উনি ততক্ষণ নিজের প্লেট তুলতেন না যতক্ষণ না আমরা প্রত্যেকে খাওয়া শুরু করেছি। তাছাড়াও  ব্যক্তিগতভাবে প্রত্যেকে টেবিলের কাছে গিয়ে খানিকক্ষণ আড্ডা মারতেন একদম ব্যক্তিগতভাবে। রতন টাটার professionalism, vision, philanthropy এইসব নিয়ে প্রচুর তথ্য বাজারে ঘুরে বেড়াচ্ছে। কিন্তু আমরা নিজের চোখে যাকে দেখেছি তিনি একজন নিখাদ ভদ্রলোক। পর্বতের খুব কাছে দাঁড়িয়ে থাকলে তার বিশালতাটা বোঝা যায় না, কিন্তু প্রত্যেকটা পাথর, সবুজিমা, ছোট ছোট বাঁক আর মাটির গন্ধ হৃদয়ে লেগে থাকে। সেই রকম ভাবেই আমরা এই বিশাল চরিত্রের মানুষটিকে দেখেছি কয়েকবার। এত কাছে থেকে।

আজও স্মৃতিতে সেই দিনগুলো জ্বলজ্বল করছে … কোনদিন ম্লান হবে না।

প্রথম পংক্তিতে (উপবিষ্ট): Mr. Ratan Tata, Dr. J J Irani এবং Tata Sonsএর গণ্যমান্যরা।

 দ্বিতীয় পংক্তিতে অন্যান্য Assessor-দের সঙ্গে আমি, second from the left



Tata Refractories এর সহকর্মীদের
 
সাথে JRD QV ট্রফি গ্রহণ মিরতন টাটার থেকে    I am on the extreme left



 




শ্রেষ্ঠা সিনহা

 

জীবনানন্দ দাশের সাহিত্য সম্ভার  : সমকালীনতার স্বর ও স্বরান্তর 

 


রবীন্দ্র-পরবর্তী বাংলা কাব্য-কবিতা তথা বাংলা সাহিত্যের অন্যতম উজ্জ্বল একজন নক্ষত্র জীবনানন্দ দাশ (১৮৯৯-১৯৫৪)মূলত কাব্য-কবিতার কারণে পাঠকের কাছে তিনি সমাদৃত হলেও একাধারে তিনি ছিলেন গল্পকার, ঔপন্যাসিক, প্রাবন্ধিক। সব্যসাচীর ন্যায়ই জীবনানন্দ দাশ বাংলা সাহিত্যের ভাণ্ডার পরিপূর্ণ করেছেন স্বভঙ্গিমায়। তাঁর সমকালীন কিংবা পূর্ববর্তী সাহিত্যকারদের সঙ্গে তুল্যমূল্য বিচার বিশ্লেষণ করলেই শ্রীদাশের অন্যোন্যতা চোখে পড়ে। কবির জীবদ্দশা মাত্র পঞ্চান্নটি বসন্তে সীমায়িতইতিহাসের পাতায় চোখ রাখলে দেখা যায় বঙ্গভঙ্গের প্রতিরোধে সংঘটিত প্রতিবাদ, ঔপনিবেশিক শাসনতন্ত্রের শোষণ, দুই বিশ্বযুদ্ধ ও বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক মন্দা,  মন্বন্তর, সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা এবং শেষে ধর্মকেন্দ্রিক রাষ্ট্রবিভাজন ভারতীয় জনসমাজকে এক তীব্র সঙ্কটের সম্মুখীন করে তোলে। কবির ‘মহাপৃথিবী’ ও ‘বেলা অবেলা কালবেলা’ কাব্যগ্রন্থে এই সময়পট যথার্থভাবে চিত্রিত হয়েছে  জীবনানন্দ দাশের বিবরণী অনুসারে, ‘মহাপৃথিবী’র  “...কবিতাগুলো ১৩৩৬ থেকে ১৩৪৫-৪৮ এর ভিতর রচিত। বিভিন্ন সাময়িকপত্রে বেরিয়েছে ১৩৪২ থেকে ১৩৫০-এ।’’

আবার ১৯৪৮ খ্রিস্টাব্দে প্রকাশিত ‘সাতটি তারার তিমির’ কাব্যে ধ্বংসের ভগ্নস্তূপ থেকে ঘুরে দাঁড়ানোর পথান্বেষণে নিয়োজিত হয়েছেন কবি। যুদ্ধের অন্ধকার তাঁর চেতনায় প্রসারিত হয়েছে এমনভাবে যে তিনি বারংবার পথ-ভ্রমের আশঙ্কা প্রকাশ করেছেনআসলে এই কাব্যের কবিতাগুলির রচনাকাল ১৩৩৫ থেকে ১৩৫০ বঙ্গাব্দের মধ্যে। ফলত সেই মেঘাচ্ছন্নকালে দৃঢ় প্রত্যয়ের বদলে দ্বিধাগ্রস্ত সুরটিই প্রধান হয়ে উঠেছে। এই প্রসঙ্গে ‘তিমিরহননের গান’ কবিতা উল্লেখযোগ্য—

“কোনো হ্রদে

কোথাও নদীর ঢেউয়ে

কোনো এক সমুদ্রের জলে

পরস্পরের সাথে দু-দন্ড জলের মতো মিশে

সেই এক ভোরবেলা শতাব্দীর সূর্যের নিকটে

আমাদের জীবনের আলোড়নে—

হয়তো বা জীবনকে শিখে নিতে চেয়েছিলো।

অন্য এক আকাশের মতো চোখ নিয়ে

আমরা হেসেছি,

আমরা খেলেছি;

স্মরণীয় উওরাধিকারে কোনো গ্লানি নেই ভেবে

একদিন ভালোবেসে গেছি।

সেইসব রীতি আজ মৃতের চোখের মতো তবু—

তারার আলোর দিকে চেয়ে নিরালোক।’’

মানবমনের আশা-প্রত্যাশার সমান্তরালে থাকা যাওয়া দ্বিধা কবির কলমে তাই অর্থবহ হয়ে ওঠে। বর্হিবিশ্বের দুর্বিপাক মানুষের জীবন-যাপনের স্বাভাবিক নিয়ম-কানুনগুলিকে ব্যঙ্গ করেছে আরো একবার। জীবনের সব দীপ্তি যেন কুয়াশাচ্ছন্ন হয়ে প্রত্যাবর্তন করেছে। সমালোচক মহল তাই বলেছেন, “ ‘বনলতা সেন’ জীবনানন্দের ভূগোল ও ইতিহাসচেতনার শ্রেষ্ঠ কাব্য, ‘সাতটি তারার তিমির’ সমকালচেতনার শ্রেষ্ঠ কাব্য। ‘সাতটি তারার তিমির’ দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পটভূমিতে লেখাস্বপ্নক্লান্ত, কল্পনাক্লান্ত কবি সময়ের অন্ধাকারে পথ খুঁজছেন। শেষ পর্যন্ত বিশ্বাস রেখেছেন মৃত্যুত্তর মানবত্বে।’’

‘স্বভাবভীরু’ এই কবি সমকালীন প্রগাঢ় বিষণ্ণতার বেড়াজাল কাটিয়ে সময়ের থেকে দূরবর্তী বিশ্বকে নিরীক্ষণ করেছেন তিনিপ্রসঙ্গত ব্যক্তিগত জীবনে সম্পর্কের টানাপোড়েনও প্রতিবিম্বিত হয়েছে জীবনানন্দ দাশের সাহিত্যে। বর্তমান সময়ের নিরীখে এই বিষণ্ণতা, বিচ্ছিন্নতা কিংবা একাকীত্বের বোধ সামাজিক জীবনের একটি অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ হয়ে উঠেছে। সমাজের সকল স্তরেই যার প্রতিফলন প্রায়শই দেখা যায়। আসলে এই বিচ্ছিন্নতা হল আত্মসংযোগ বিনাশের একটি বোধ, যার সূত্রে ধীরে ধীরে বিষণ্ণতা এবং একাকীত্বের উদ্রেক হয়। ‘বোধ’ কবিতায় কবির কলমে তাই প্রতিধ্বনিত হয়েছে;

“সব কাছ তুচ্ছ হয়, -পণ্ড মনে হয়,

সব চিন্তা-প্রার্থনার সকল সময়

শূন্য মনে হয়।’’

আসলে একজন মানুষ তার জীবদ্দশায় কখনো নির্জন দ্বীপান্তরে নির্বাসিত হয়ে একাকী হয় অথবা সকলের মধ্যে বিরাজমান থেকেও একাকীত্ব অনুভব করে। পরিবার কিংবা প্রিয় মানুষদের সান্নিধ্যে থেকেও একজন ব্যক্তি একাকী জগতে ক্রমশ অবগাহন করে চলে; অথচ তার আশে-পাশে থাকা কেউই তার খবর রাখে না। উল্লেখ্য রবীন্দ্রনাথের ‘মৃণাল’ চরিত্রটি, সংসারের মধ্যে থেকে একাকী যাপনের চিত্র যেন ভবিষ্যতের সময়ের পদার্পণকেই যেন সূচিত করেছিলকল্লোল-কালের সাহিত্যিক মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘পুতুল নাচের ইতিকথা’ উপন্যাসে ‘শশী’ চরিত্রটির মধ্যেও এই বিষন্নতা বা একাকীত্বের স্বর শোনা যায়। আসলে রবীন্দ্র পরবর্তী সাহিত্যে এই একাকী মনের যাপনচিত্র ক্রমশ দীর্ঘায়িত হয়েছে। জীবনানন্দ দাশের ‘বোধ’ কবিতায় সেই দিকটি আরো প্রকটিত হয়ে ওঠে;

“সকল লোকের মাঝে বসে

আমার নিজের মুদ্রাদোষে

আমি একা হতেছি আলাদা?

আমার চোখেই শুধু ধাঁধা?

আমার পথেই শুধু বাঁধা?’’

অধ্যাপক সুমিতা চক্রবর্তী এই সমাজ প্রতীয়মানতা সম্পর্কে মন্তব্য করেছেন; “সত্যিই ১৯৪০ থেকে ১৯৫০ এর মধ্যবর্তী যে দলিত ও বিপন্ন, জটিল ও নিষ্ঠুর দশক—তার ভেতর দিয়ে এতখানি আর কোনো কবি হেঁটে গিয়েছিলেন কিনা জানি না’’ শুধু কবিতায় নয় উপন্যাসের প্রেক্ষাপটেও এই রক্তাক্ত সময়ের উপাখ্যান উঠে এসেছে। কবি যেন তাঁর সমকালীন রক্তক্ষয়ী ইতিহাসের ক্ষতচিহ্ন সহ সময়ের দোদুল্যমানতাকে পাঠকের সামনে উপস্থাপন করলেন। রক্তপাতের এই  কালো ইতিহাস স্মরণ করিয়ে দেয় কবির ‘বাসমতীর উপাখ্যান’ উপন্যাসের কথা। জাহাজের বাটলার ও প্রভাসবাবুর কথা-বার্তায় উঠে এসেছে দেশভাগের সুর। সাম্প্রদায়িকতার উস্কাকানিতে গগন, শশীরা নিজেদের মিথ্যা পরিচয়ে ভর করে ইয়াসিন, হানিফদের সঙ্গে লড়াইয়ে মেতে উঠেছে। আবার দেখা যায় বাসমতীর সমাজে একটি গরুর নিখোঁজ হওয়াকে ঘিরে হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে চাপা উত্তেজনাও।

আবার, পারিপার্শ্বিকতার সঙ্গে একদিকে বেকারত্ব অন্যদিকে দাম্পত্যের মায়াজালের নানান প্রতিকূলতার সন্নিবেশ দেখা যায় ছোটোগল্প সহ কথাসাহিত্যের পরিসরে। সেই সঙ্গে এম এ পাশ রুজি-রোজগারহীন বেকার জীবনের ধারাপাতও তাঁর সৃষ্ট চরিত্রগুলির অন্যতম উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য। কবির ব্যক্তিজীবনের প্রতিফলন এই ঘটনার সামিল একথা বলার অপেক্ষা রাখে না। বিশ্বব্যাপী মন্দা, নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসের ক্রমবর্ধমান মূল্যবৃদ্ধি ফলে সারা দেশে চাকরি দুর্লভ হয়ে ওঠে। উচ্চ শিক্ষিত এম এ পাশ করা বাঙালি যুবক চাকরির জন্য হন্যে হয়ে রাস্তায় ঘুরে বেড়ায়। গ্রাম ছেড়ে এসে তারা আশ্রয় নেয় মেসবাড়ির অন্দরে। এই সূত্রেই জীবনানন্দ শহর কলকাতার প্রসঙ্গ এনেছেন। ঔপনিবেশিক ভারতের রাজধানী হওয়ায় নগর কলকাতা উপার্জনের একামাত্র ঠিকানা হয়ে ওঠে।

ফলত “বাংলার লক্ষ্যগ্রাম নিরাশারা আলোহীনতায় ডুবে নিস্তদ্ধ, নিস্তেল’’হয়েই পড়ে রইল আর কলকাতার অলিগলি, ফুটপাত থেকে স্টেশনে স্রোতের শ্যাওলার মত ভেসে বেড়ালো শিক্ষিত বেকার যুবকের দল। উদাহরণ প্রসঙ্গে বলা যায়, ‘লোভ’ শীর্ষক গল্পের কথা। নায়ক নৃপেনের মনোজগতের দিকটি পরিস্ফুট করে ‘রূপসী বাংলা’-র কবি বলেছেন; “মস্তবড় সংসারের এক কিনারে সে পড়ে থাকে। কেউ বা কেরানিগিরি করে ত্রিশ টাকা পায়, সাতাশ-আটাশ বছরের বেকার যুবকটি পড়ে থাকে।...তার কোলাহল এখন অনেক দূরে। প্রতিধ্বনির মত, এই ক্ষীণ শব্দটুকুও যেন শিগ্‌গিরই মিলিয়ে যাবার মুখে স্রোত তাকে বড় প্রবঞ্চিত করে চলে যাচ্ছে।’’

আবার ‘মৃগয়া’ গল্পে শিকারী চরিত্রটির মধ্যে একাধারে একাকীত্ব যাপনের সঙ্গে নায়কের প্রকৃতি প্রতি বিমুগ্ধতাও লক্ষ্য করা যায়। ‘বেশি বয়সের ভালোবাসা’ গল্পের ঘটনাক্রমে দেখা যায় আভা পেশায় স্কুল শিক্ষিকা হলেও তার শিল্পীসত্ত্বা বা কবিসত্ত্বা বারংবার প্রকটিত হয়ে ওঠে। আভার কাছে ‘ভালোবাসার কাজ’ লেখা-লিখি। গল্পকারের কলমে, “যে মুহূর্তে আবেগ আসে, ঠিক তখনই কাজ করতে হয়, আবেগ উৎরে  গেলে আর্টিস্টের পক্ষে লিখতে বসা যেমন ভুল কারু পক্ষে কোনো সঙ্কল্প খাটাতে যাওয়াও তেমনি নিরর্থক।’’ কবিতা লিখে আভার আর্থিক স্বচ্ছলতা ফিরে  আসেনি বরং বিহ্বলতার সমুদ্রে অবগাহন করেছে সে। এখানেই জীবনানন্দ দাশের ব্যক্তিজীবনের প্রতিফলন লক্ষ্য করা যায়। ‘কারুবাসনা’ উপন্যাসে হেম চরিত্রটির মধ্যে এই দ্বিধা বিভক্ত মনোভাবটি বারংবার প্রতিবিম্বিত হয়েছেসে তাই বলেছে, “কারুবাসনা আমাকে নষ্ট করে দিয়েছে। আমার সংসারকে ভরে দিয়েছে ছাই-কালি-শূন্যতায়।’’১০ ‘কারুবাসনা’-র হেম-কল্যাণী কিংবা ‘মাল্যবান’-এর মাল্যবান-উৎপলার দাম্পত্য-শিথিলতা চিত্রণ জীবনানন্দ কৃত গদ্যের বহুল  পরিচিত দিক। এই প্রসঙ্গে লাবণ্য দাশের ‘মানুষ জীবনানন্দ’ উল্লেখ্য। সেখানে তিনি একটি নিটোল দাম্পত্যের ছবি তুলে ধরেছেন। সাংসারিক জীবনের প্রেক্ষিতে কবির উক্তি লাবণ্য দেবীর বক্তব্যের বিপরীত সাক্ষ্য দেয়। তাঁর লেখা অনুসারে, “তোমার কেবল সংসার আর সংসার। তুমি কি কিছুতেই তার ওপরে উঠতে পার না ? কোনোদিন দেখলাম না যে তুমি কবিতার আলোচনায়, মুহুর্তের জন্য যোগ দিয়েছ।’’১১

অথচ ‘হাতের তাস’ ছোটগল্পে এই ধরনের দাম্পত্য-শৈত্যের চিত্র লক্ষ্য করা যায়। সেখানে বছর পঁয়ত্রিশের প্রমথ বেকার। তিনবছর আগে তার বিয়ে হয় সুমিত্রা সঙ্গে। এম এ পাশ করে কলকাতার একটি কলেজে টেম্পোরারি হিসাবে কর্মরত থাকাকালীন সে জার্মান ভাষা আয়ত্ত করে। লেখালিখিতে সে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে অথচ ব্যক্তিগত জীবনে অস্বচ্ছলতার ছবিই উঠে আসে। প্রমথ ওকালতি পাশ করলেও পসার তার নেই। ব্যক্তিজীবনের এই দূরত্ব কথকের জবানীতে—

“নিজের জীবনকে প্রমথর স্ত্রী অত্যন্ত অসাড় মনে করে। একটা বেকার উকিলের বউ, একটা উচ্ছন্নে যাওয়া কেরানির একটা দজ্জাল শাশুড়ির পুত্রবধূ— নিজের জীবনটাকে সুমিত্রা একটা পোড়ো ভিটের মরা ধুধুলে লতার মত পণ্ড মনে করে’’১২

আবার কবির জন্মশতবর্ষে ‘বিভাব’ পত্রিকায় প্রকাশিত (ভূমেন্দ্র গুহ সম্পাদিত) ১৯৩১ সালের জুলাই ও সেপ্টেম্বর মাসে লেখা তাঁর ডায়েরির অংশে কবি লিখেছেন—

“— I wish I would be 1 bachelor again—aghast when i think of the

Future domestic life—’’

“—Re : Wife : the bleak future…No way wriggling out.’’১৩

এছাড়া ১৯৩১ সালের ১৪ সেপ্টেম্বর জীবনানন্দ লিখছেন—

…By my having a wife & child (apology for things) I have forfeited my claims to romance, love even sympathy.’’১৪

জীবনানন্দ দাশের সাহিত্যকথা আসলে ব্যর্থ প্রেমের বা ‘নষ্ট দাম্পত্যের’ প্রতিবিম্বন। ‘কারুবাসনা’র সম্মোহনে তাঁর কেন্দ্রীয় চরিত্ররা মন্ত্রমুগ্ধের ন্যায় তাড়িত। বস্তুনিষ্ঠ জগতের মাঝে তাদের মনের চিলেকোঠায় প্রছন্ন শিল্পীসত্তা থেকে যায়। তারা যেন যুগান্তরের পথ নির্দেশক।

প্রখ্যাত সাহিত্যিক মহাশ্বেতা দেবী তাঁর ‘শ্রেষ্ঠ গল্প’ সংকলনে জানিয়েছেন, “সাহিত্যকে শুধু ভাষা, শৈলি, আঙ্গিক নিরিখে বিচার করার মানদণ্ডটি ভুল। সাহিত্যের বিচারে ইতিহাস প্রেক্ষিত হওয়া দরকার। লেখকের লেখার সময় ও ইতিহাসের প্রেক্ষিত মাথায় না রাখলে কোনো লেখকেরই মূল্যায়ন করা যায় না।’’১৫ শ্রী দাশের সাহিত্যসম্ভার তার ব্যতিক্রমী ঘটনা নয়। বরং তাঁর ‘উত্তর রৈবিক বাংলা কাব্য’ প্রবন্ধাংশে কবি তাই বলেছেন, “কবির পক্ষে সমাজকে বোঝা দরকার, কবিতায় অস্থি-র ভিতরে থাকবে ইতিহাসচেতনা ও মর্মে থাকবে পরিচ্ছন্ন কালজ্ঞান। কাল বা সময় বৈনাশিক; কিন্তু সে সেই সমস্ত কুয়াশাগুলিকে কেটে-কেটে চলেছে যা পরিপ্রেক্ষিতের ব্যাপ্তি বাড়াবার পক্ষে অন্তরায়।’’১৬

কবিতাকে তিনি শিক্ষিত মানুষের বৈঠকখানার আসর থেকে সরিয়ে খেটে খাওয়া জনগোষ্ঠীর আঙিনায় পৌঁছে দিতে চেয়েছেন। ‘কবিতার কথা’য় তিনি এ প্রসঙ্গে বলেন, ‘আমি বলতে চাই না যে কাব্যের সঙ্গে জীবনের কোনো সম্পর্ক নেই; সম্বন্ধ রয়েছে কিন্তু প্রসিদ্ধ প্রকটভাবে নেই। কবিতা ও জীবন একই জিনিসের দুই রকম উৎসারণ।’’১৭ জীবনানন্দ দাশ আদ্যোপান্ত কবি। পূর্বসূরী রবীন্দ্রনাথের মতোই তিনিও কবিতার পাশাপাশি উপন্যাস-প্রবন্ধ-ছোটোগল্পে স্বচ্ছন্দে বিচরণ  করেছেন। তাঁর প্রায় সকল সাহিত্য সম্ভার বিশেষত কবিতাগুলি মৃত্যুর পরে প্রকাশিত হয়। তাই উত্তরকালের সাহিত্যিক রূপে তাঁকে বিবেচনা করা অসঙ্গত হবে না। তাঁর রচনার প্রেক্ষাপটে ছিল কালের এক জটিল আবর্ত। অথচ অনাগত অবশ্যম্ভাবীকালের আভাষ গল্পে লক্ষ করা যায়। দুই বিশ্বযুদ্ধের ভয়াবহতা বর্তমান সময়ে নেই; কিন্তু তার বিষবৃক্ষ এই সময়েও বিদ্যমান। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় জাপানের দুটো শহর প্রযুক্তির করালগ্রাসে বিলীন হয়ে যায়। সেই ধ্বংসের বীজ-রোপিত হয়ে প্রযুক্তির অগ্রগতিকে তরান্বিত করেছে। মানব সভ্যতা ক্রমশ কৃত্রিমতায় পরিবেষ্টিত হয়ে উঠেছে। ঘনীভূত হয়েছে প্রাণ ও প্রকৃতির সঙ্কট

জীবনানন্দ দাশের সাহিত্যবিশ্ব নতুন জীবনবোধের পরিচায়ক। ছেলেবেলার পাঠ্যক্রমে জীবনানন্দের কবিতার সঙ্গে প্রথম পরিচয় হয়অপরিণত বুদ্ধি-বিবেচনার মারফত বোঝা ও না বোঝার ইন্দ্রজালে তাঁর কবিতার সঙ্গে সখ্যতা বাড়েপরবর্তীতে কবির গদ্যরচনার সুবিন্যস্ত ভুবন আমায় মোহিত করে। সময়ের পর্বান্তর থেকে সমাজ-পরিবর্তিতকালে মানুষের ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যে কোন্‌ কোন্‌ সঙ্কটের সম্মুখীন হয় এবং কীভাবে মানুষের অস্তিত্বে তা মিশে যায়; সেই যুগচিহ্ন কবির কথাসাহিত্যে অন্যতম অনুসন্ধানী বিষয় হয়ে উঠেছে। তাঁর গল্প কিংবা উপন্যাস অথবা কবিতা বারংবার জানান দেয় কালপ্রবাহের কথা; সেই সঙ্গেই মানবমনের অন্তরালে জমে থাকা যন্ত্রণা- ক্ষতের ইতিবৃত্ত প্রতিবিম্বিত হয়ে সাধারণের সম্মুখে। আজ ‘মহাপৃথিবী’-র কবির ১২৬ তম জন্মবার্ষিকীতে তাঁর অতুলনীয় সৃষ্টি আমাদের বারংবার স্মরণ করায় মানবজীবন সুখদুঃখের সমন্বয়ে অতিবাহিত হয়। অথচ মানুষ কেবলমাত্র হৃদয়ের আলোকে সকল প্রতিকূলতা অতিক্রম করতে সম্ভবপর হয়তাই পরিশেষে বলা যায়, জীবনানন্দ দাশের সাহিত্যকীর্তি কেবলমাত্র বাংলা সাহিত্যের জ্বাজল্যমান সৃজন শুধু তাই নয়; তা মানবজীবনের নিগূঢ় দলিল।

 

তথ্যসূত্র

1.    দাশ, জীবনানন্দ, ‘মহাপৃথিবী’,  নবপর্যায় সিগনেট, কলকাতা, পৃ ৭

2.    দাশ, জীবনানন্দ, (সৈয়দ আবদুল মান্নান সং ও সম্পা.), ‘জীবনানন্দ দাশ : প্রকাশিত অপ্রকাশিত কবিতাসমগ্র’, অবসর, ঢাকা, পৃ ২৩১

3.    চক্রবর্তী, সুমিতা, ‘জীবনানন্দ : সমাজ ও সমকাল’, সাহিত্যলোক, কলকাতা, পৃ ৩২

4.    দাশ, জীবনানন্দ, ‘শ্রেষ্ঠ কবিতা’, নাভানা, কলকাতা, পৃ ৫

5.    তদেব, পৃ ৬

6.    চক্রবর্তী, সুমিতা, ‘জীবনানন্দ : সমাজ ও সমকাল’, সাহিত্যলোক, কলকাতা, পৃ ২৬

7.    দাশ, জীবনানন্দ, (সৈয়দআবদুল মান্নান  সং ও সম্পা.), ‘প্রকাশিত-অপ্রকাশিত কবিতাসমগ্র’, অবসর, ঢাকা, পৃ ৩১৮

8.    দাশ, জীবনানন্দ, ‘৩০টি গল্প’, (দেবেশ রায় সম্পা.), প্রতিক্ষণ, কলকাতা, পৃ ১৯৪

9.    তদেব পৃ ৩৫

10. দাশ, জীবনানন্দ, (দেবেশ রায় সম্পা.), ‘জীবনানন্দ সমগ্র জন্মশতবর্ষ সংস্করণ উপন্যাস ১’, প্রতিক্ষণ, কলকাতা, পৃ ২৩৫

11. দাশ, লাবণ্য, ‘মানুষ জীবনানন্দ’, ভাষাচিত্র, ঢাকা, পৃ ৪৩

12. দাশ, জীবনানন্দ, ‘জীবনানন্দ দাশ ৩০টি গল্প’, প্রতিক্ষণ, কলকাতা, পৃ ৪৬

13. গুহ, ভূমেন্দ্র (সম্পা.), ‘বিভাব : জীবনানন্দ দাশ স্মরণসংখ্যা’, কলকাতা, পৃ ৪০৫

14. তদেব, পৃ ৪০৮

15. দেবী, মহাশ্বেতা, ‘মহাশ্বেতা দেবীর ছোটোগল্প সংকলন’ (শমীক বন্দ্যোপাধ্যায় সম্পা.), ন্যাশানাল বুক ট্রাস্ট ইন্ডিয়া, নতুন দিল্লি, পৃ vii

16. দাশ, জীবনানন্দ, ‘জীবনানন্দ দাশ : প্রবন্ধ সমগ্র, (ভূমেন্দ্র গুহ সম্পা.), প্রতিক্ষণ, কলকাতা, পৃ ৩৮

17. দাশ, জীবনানন্দ, ‘ জীবনানন্দ দাশের শ্রেষ্ঠ কবিতা’, নাভানা, কলকাতা, পৃ ৫