সিনেমার মনন ও মানসিকতায় নব্য বস্তুবাদ
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়কাল।
বিপর্যস্ত, বিধ্বস্ত চারপাশ। বোমায় নিশ্চিহ্ন স্টুডিও সিস্টেম। সিনেমার কারিগররা ভাবতে
শুরু করেছেন কীভাবে নয়া পদ্ধতিতে ছবি তৈরি করা যায়! অনেকেই জীবিকার সন্ধানে হলিউড
পাড়ি দিয়েছেন। জাঁ রেনোয়ার সঙ্গে একসময় কাজ করেছিলেন রসোলিনি। তিনি দুমড়ে মুচড়ে
যাওয়া ক্যানভাসে ছবি আঁকবার চেষ্টা করলেন। অনামী, বিশেষত গ্রুপ থিয়েটারের কুশীলবদের
নিয়ে তিনি কাজ করলেন। শুটিং হল শহরের বিভিন্ন রাস্তায়। তৈরি হল নতুন ধারার ছবি। রোম
: ওপেন সিটি। বিষয়বস্তু, ক্যামেরার নব ভাষা, আঙ্গিক, প্রেক্ষাপট, বোলচালের জিন্দেগী,
আটপৌরে মেদুরতায় ছবি স্পর্শ করল বাস্তবতার সীমা। ক্যামেরা স্টুডিওর সীমানা ছাড়িয়ে
ঘুরে বেড়াল আনাচকানাচ। মেকি নয়, জীবন তখন real. অশ্রুবিন্দু হাতের মুঠোয় ধরা পড়ল।
neo realism মিশে গেল জীবনের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে।
Hemingwayর Old man and the sea র উক্তি... "মানুষ ধ্বংস হতে পারে। কিন্ত পরাজিত হবে না কোনদিন।" neo realism এর উচ্চারণ এই উক্তিকে সমর্থন করল। স্বপ্নবহুল জগত ছেড়ে ক্যামেরা প্যান করল রাস্তায়, শ্রমিক-বস্তিতে, গরিব মানুষের দিকে।
Tilt up, tilt down করে দেখাল মধ্যবিত্ত ও ভুখা মানুষের যাপন। ক্যামেরা কাঁপল, ক্যামেরা কাঁদল... মুহূর্ত বন্দি হল হৃদয়ে। শু সাইন, বাইসাইকেল থিভস-এর নির্মাতা ডি সিকার ছবি চলচ্চিত্র দুনিয়ায় যে বিপ্লব সংঘটিত করেছিল তার ফলশ্রুতি হল মিরাকল ইন মিলান, ফেলিনির eight and half, আন্তোনিয়নির ইল গ্রিদো, সত্যজিত রায়ের পথের পাঁচালি সহ নানাবিধ বাস্তববোধসম্পন্ন ছবি। প্রতিটি ছবি সময়ের দলিল।
ডিটেইলস-এর যেসব বিষয় আমরা এখন বিশ্ব চলচ্চিত্রে দেখি তার উদ্ভব নব্য বস্তুবাদের ভারসাম্যযুক্ত পরিকাঠামোয়। সেই সময় সাদা কালোতে ছবি তোলার আগ্রহ ক্যামেরার নৈর্ব্যক্তিক গতি চরিত্রকে প্রতিভাত করেছে। এই নব্য বস্তুবাদের পথ ধরে এল নব তরঙ্গ। ত্রুফো, গদার নব তরঙ্গের প্রতিভূ। ত্রুফোর 400 blows কান চলচ্চিত্র উৎসবে শিরোপা অর্জন করে বুঝিয়ে দেয় অতি বাস্তবতা সিনেমার ভিতকে মজবুত করে। Hand held camera, কাঁধে ঝোলানো টেপ রেকর্ডার, ultra sensitive negetive ব্যবহার করে নব তরঙ্গের পরিচালকরা সিনেমার ভাষাকে সম্পূর্ণ বদলে দিয়েছিলেন। অল্প আলোয় ছবি গভীরতম অনুভূতির কথা ব্যক্ত করেছিল। যে অনুভূতির স্রোত আজও বহমান। বিখ্যাত ছবি হিরোসিমা মুন আমুর, আলা রেনেঁর পরিচালনায় যুদ্ধবিরোধী মানবতাপ্রমী মনোভাবকে স্পষ্ট করেছে। মৃণাল সেনের একদিন প্রতিদিন ছবিতে অস্তিত্ববাদের রূপ ধরা পড়ে। বাস্তব থেকে অতি বাস্তব, কঠিন বস্তুতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থা আধুনিক সিনেমার মানদণ্ডকে নির্মাণ করে বুঝিয়ে দিয়েছে ছবির ভাষা, ক্যামেরার চলন আসলে জীবনের রোজনামচা, অথবা তারও বেশি কিছু।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন