বৃহস্পতিবার, ১৪ নভেম্বর, ২০২৪

অম্লান বোস

 

আত্মার আত্মীয়রা




বুকটা ছাঁত করে উঠলো ডক্টর বোসের। তপনের জড়ানো কথা শেষ হবার পর কয়েকটা মুহূর্ত মাত্র কেটেছে, ডক্টর বোস মাথা নিচু করে বেরিয়ে আসছেন অপারেশন থিয়েটার থেকে। চোখের জল অসহ্য তাপে বাস্প হয়ে চোখ ফেটে বেরিয়ে আসছে, ঠিক তখনই ও টি’র বাইরে অপেক্ষারতা সহকারিণী তাঁর আই-ফোনটা হাতে দিয়ে বললো “স্যার, আপনাকে বার বার কল করছে”। কানে নেবার সংগে সংগে শুনলেন … পাশের হাসপাতাল থেকে অপ্রীতিকর কিন্তু  প্রত্যাশিত দু:সংবাদ - “ড: বোস, দু:খের সংগে জানাচ্ছি, অনেক চেষ্টা করেও আমরা তরুণকে আর ধরে রাখতে পারলাম না - দু মিনিট আগেই ও চলে গেল”।

অবাক হলেন না ডক্টর বোস, শুধু হতাশ মুখ থেকে অস্ফুটে বেরিয়ে এলো - “সে কি - দুমিনিট আগে?  জানতাম, আমি জানতাম - এটাই হবে । “ঐ সময়েই তো তপন এখানে অপারেশন টেবিলে অজ্ঞান অবস্হায় শুয়ে মা আর ভাইয়ের ডাক শুনছে বলছিল। ওরা যে বেঁচে নেই তপনের সেটা জানা নেই কিন্তু সে ওদের হাসি খুশী উজ্জ্বল চেহারা দেখতে পাচ্ছে বলল।  তখনই অভিজ্ঞ  ড: বোস বুঝেছিলেন ওর ভাই তরুণও  মায়ের কাছে, ঐ চিরশান্তির জায়গায় চলে গেল। এন ডি ইর আর একটি জ্বলন্ত উদাহরণ।

হাতের সার্জিকাল গ্লাভস্ দুটোতে হতাশার আগুন-ঝাঁঝ, অসহিষ্ণু ডাক্তার তাঁর পরিশীলিত ধৈর্য হারিয়ে পাগলের মতই নিরুপায় হাত থেকে ও দুটোকে জোর করে টেনে খুলে নিয়ে গার্বেজ বিনের নির্বাক গহ্বরে ছুঁড়ে দিলেন!

নিয়ার ডেথ এক্সপিরিয়েন্স - এন ডি ই! ১৯৭৫ সালে মনস্তত্ববিদ রেমন্ড মুডি এই নামকরণটাই করেছিলেন। মৃতপ্রায়ের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা - প্রাণহীন দেহ আমাদের সামনে অথচ, কিছুক্ষণের জন্য তার আত্মাটি দেহ ছেড়ে জীবনের সীমা পার হয়ে মরণের পথ মাড়িয়ে আবার নিজের দেহে আশ্রয় নিল।

কথাটা কিছুদিন আগেই শুনেছিলাম। খবরকাগজে পড়েছিলাম গাড়ী চালাতে চালাতে এক ভদ্রলোক হঠাৎই হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে কিছুক্ষণ হাসপাতালে অপারেশন থিয়েটারে থাকার সময়েই মৃত্যুর চৌকাঠটা পার হয়ে আবার তাঁর নিজস্ব জীবনে ফিরে এসেছেন মরণোত্তর অনেক অদ্ভুত অজানা অভিজ্ঞতা নিয়ে, মনস্তাত্বিক জগতে আলোড়ন তুলেছিলেন তিনি। আশ্চর্য লেগেছিল আমার, কৌতুহলের বশে রেবেকা ও কোনরের সম্পাদনায় প্রকাশিত বইটা পড়ে ফেললাম। অজস্র চমকপ্রদ ঘটনার বিবরণ, অপার্থিব তো বটেই তবে অবিশ্বাস্য বলতে পারি না কারণ এসব ঘটনাপ্রবাহ নামকরা বিজ্ঞানীদের গবেষণার বিবরণ। ভালই লাগছিল ঐ জীবন মৃত্যুর দরজা দিয়ে যাওয়া আসার চমকপ্রদ ঘটনাপ্রবাহ, যদিও বৈজ্ঞানিক তত্ত্বজ্ঞান দিয়ে আমি এগুলোকে ঠিক মাপতে পারছিলাম না ।

জগদ্বিখ্যাত রিসার্চ স্কলার এবং সার্জন ডক্টর বোস নানা সমস্যাজনিত অসুস্হতার কারণে  বিশেষ করে দুর্ঘটনায় কবলিত মুমূর্ষু মানুষদের শেষ মূহুর্তগুলি নিয়ে বহুরকমের গবেষণা করেছেন। তাঁর সঙ্গে আমার যোগাযোগ দু তিন বছরের।

ড: বোসের কাছেই শোনা ওপরের ঐ ঘটনাটা - তপন একটি ৮ বছরের ছেলে, ভাই তরুণ ৬ বছরের। একদিন তাদের স্কুলে নিয়ে যাবার পথে এক দুর্ঘটনায় তাদের মা ঘটনাস্থলেই মারা যান আর ছোটছেলে তরুণকে ঘোর আশংকাজনক অবস্হায় স্হানীয় হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। আর, অজ্ঞান অর্ধমৃত বড়-ভাই তপনকে কাছের একটি হাসপাতালে নিয়ে  যাওয়া হয়েছিল ডঃ বোসের তত্ত্বাবধানে। তপন দুর্ঘটনাস্হলে মা’র মৃত্যুসংবাদ জানতে পারেনি এবং  তার ভাই তরুণকে যে দগ্ধ অর্ধমৃত অবস্হায় পাশেই অন্য আর একটি হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়েছে (এবং তারও মৃত্যু হয়েছে) এটাও তার জানার কথা নয়। কিন্তু অচেতন অবস্হায় জীবন মৃত্যুর দোলাচলে তপন তার মৃত মা আর ভাই তরুণকে মৃত্যুর আঙ্গিনাতে দেখেছিল, এবং তাদের ডাকও শুনেছিল - যদিও তাদের দুজনের কেউই সেই সময় জীবিত ছিল না। তপনকে ডঃ বোস অবশ্য জীবন ফিরিয়ে দিতে পেরেছিলেন এবং তার কাছ থেকে অনেক তথ্য জোগাড় করেছিলেন তিনি।

সেই অবোধ্য, অবিশ্বাস্য অথচ তথ্যনির্ভর এন ডি ই! যে সম্বন্ধে আমি আগ্রহ নিতে পড়াশোনা করছি।

ছুরি কাঁটার সঙ্গে পুলকের খুব একটা সখ্যতা নেই দেখলাম, দুটো ফিশ্ কাটলেট হাতে ধরেই শেষ করল, ভাল করে হট্ এ্যান্ড সুইট চিলি সস্ মাখিয়ে। পুলক আমার আর এক জীবন্ত সাক্ষী এবং এই আকর্ষণীয় সংবেদনে বর্ণিত ঘটনাটির সংগে প্রত্যক্ষভাবে জড়িত।

চায়ের কাপে একটা লম্বা চুমুক দিয়ে চোখদুটো আমেজে প্রায় বুঁজে চেয়ারে ঠেস দিয়ে আরাম করে বসল।

“স্যার চা-টা কিন্তু অসাধারণ, আমি সত্যিই…

অপরেশ আমার সব ব্যাপারেই সাহায্যের হাত বাড়ায়, এবারেও অন্যথা নেই। ঝাঁঝালো স্বরে ঝাঁপিয়ে পড়ল সে - “স্যারের নজর সবকিছুতেই উঁচু - তুই শুরু কর তো যে জন্যে আসলি…। ওর দৌলতেই আজ আমি পুলককে সামনে পেয়েছি। আমার কিন্তু মুস্কিল হচ্ছে। গন্ডগোলে কথার খেই হারিয়ে যাবে সেটা আমি হতে দিতে পারি না, স্টিয়ারিংটা তাই নিজের হাতে নিতেই হল।

“ঠিক আছে, ঠিক আছে অপরেশ, ওকে এবার বলতে দাও। বলো পুলক, ঐ এ্যাকসিডেন্টের পর তোমার ঠিক কি হয়েছিল বলো তো। জানো নিশ্চয়ই, আমি এসব নিয়ে একটু পড়াশোনা করছি আজকাল।”

“হ্যাঁ হ্যাঁ, জানি স্যার, তাহলে আমার ঐ দুর্ঘটনা থেকেই শুরু করি?

একটু থেমে পুলক শুরু করলো -

“পরের দিন ৩০শে মার্চ ফারটিলাইজার কারখানাটা হ্যান্ড ওভার করার কথা ক্লায়েন্টকে। যন্ত্রপাতি এবং পাইপলাইনে ফ্লো, প্রেসার, তাপমাত্রা, পরিশ্রুত জল, নানা রকম কেমিক্যাল এবং গ্যাসের প্রতিটা গেজ সিস্টেমের চাহিদা মতই সঠিক মাপ দেখাচ্ছে। ওপরে চিমনির তাপমাত্রাটা পরীক্ষা করে তরতরিয়ে সিঁড়ি দিয়ে নামছি উৎফুল্ল হয়ে একটা বলিউডি সুরে শীষ দিতে দিতে। কর্মক্ষেত্রের উপযুক্ত জুতোটাও এমার্জেন্সী কলের জন্যে পরা হয়নি - হঠাৎ বাতাস চিরে একটা একটানা তীক্ষ্ণ আর্তনাদে  চমকে উঠলাম, মানে একটা বড়রকমের গোলমাল কোথাও হয়েছে নিশ্চয়ই। দূরে প্রবেশ ফটকে এ্যাম্বুলেন্সটা লক্ষ্য করতে গিয়েই চূড়ান্ত অঘটন -  হড়কে গেল পা। মাধ্যাকর্ষণের অমোঘ আকর্ষণে আমি সিঁড়ি বেয়ে গড়াতে শুরু করলাম, মাথায় কাঁধে পিঠে পায়ে এলোপাথাড়ি আঘাত, মাথার খুলিতে পর পর লোহার হাতুড়ী। নাক মুখ দিয়ে  ঝলক ঝলক নোনতা স্রোত আমার চোখ মুখ ঢেকে দিল, মনে হোল ডানহাতটা নির্ভরতার খোঁজে আকাশকে আঁকড়াবার চেষ্টা করে নিরাশ হয়ে ঐ সিঁড়িতেই নেতিয়ে পড়ল।” 



একটু অন্যমনস্ক হয়ে, চোখের পাতা নামিয়ে নিল পুলক।

ওকে সামলাবার একটু সুযোগ দেবার জন্যেই বোধহয় অপরেশ ডান হাতটা তুলে বলল - “আমি এখানে ছোট্ট একটু কথা বলি সুজিতদা? পলু তখন দায়িত্বশীল ইন্জিনীয়ার ছিল, কিন্তু কোন অজানা কারণে মানসিক বিপর্যয়ে সে নিজের জীবনটা নষ্ট করে ফেলছিল। অসংযম, মাদকদ্রব্য, ড্রাগ। কয়েকবার অতিরিক্ত পরিমানে ঘুমের ওষুধ খেয়ে আত্মহত্যার চেষ্টাও করে সে। পরে অবশ্য নিজেকে মোটামুটি সামলে নিয়েছিল।

কোন গুরুত্ব না দিয়ে চোখ আধো বন্ধ অবস্হায় পলু শুরু করল -



“কি হল জানি না স্যার, নেতিয়ে মাটিতে পড়ে গিয়ে শুয়ে থাকা অবস্হায় আমি কিন্তু সামনে ঘটতে থাকা ঘটনাগুলো চোখের সামনে পরিস্কার দেখতে পাচ্ছিলাম ভাসমান অবস্হায়  - যেন মাটির কয়েক ফিট ওপর আমি ভাসছি। আমি দেখছি আমার থেঁৎলানো দেহটা রক্তে ভাসছে, চারদিকে ছোটাছুটি, নিরাপত্তা কর্মিদের ব্যস্ততা, গ্যাস নিষ্কাসনের কর্ণভেদী শব্দ, সহকর্মিদের আতঙ্ক, আমাকে স্ট্রেচারে ওঠানো - সব ছাপিয়ে স্যার, হঠাৎ আমি কেমন শান্ত বাতাবরণে ভেসে উঠলাম, মাটি থেকে চার পাঁচ ফিট ওপরে।

আমার অচেতন শরীর ঘিরে  উদ্বেগ, চাপা আশঙ্কাজড়িত কন্ঠে ম্যানেজারের নির্দেশ, জীপ, ক্রেন, বুলডোজারের আনাগোনা- সব, সব দেখতে আর শুনতে পাচ্ছি ঐ ভাসমান অবস্হায়। কোন কষ্ট, বেদনা বা ভয় নেই - এক নিস্তব্ধ শান্তিসাগরে দুলছি। দেখলাম , লাল নীল সবুজ আলো ছড়িয়ে এ্যাম্বুলেন্স এলো, আমার অচেতন দেহটা তোলা হল, তীরবেগে তীক্ষ্ণ সাইরেনে আশঙ্কা আর সন্ত্রাস ছড়িয়ে চলল স্হানীয় হাসপাতালের দিকে। আশ্চর্য, হাওয়ার সওয়ারী হয়ে আমিও তখন ঐ এ্যাম্বুলেন্সের সঙ্গে সঙ্গে উড়ে যাচ্ছি, অথচ আমার অচেতন শরীরটা তখনও এ্যাম্বুলেন্সের ভেতরে দেখতে পাচ্ছি। আমার নিজের অবস্হা নিয়ে আমার মনে কিন্তু তখন কোন চিন্তা বা আশঙ্কা নেই। আমার বাবা, মা, দাদু, কাকা, কাকিমা, বন্ধু শিরীষকে কেমন যেন বায়বীয় অবস্হার আমার আশেপাশে হাসি মুখে ঘুরতে দেখলাম, এরা কেউই জীবিত ছিলেন না। আমার কিন্তু অস্বাভাবিক কিছু মনে হয়নি।”

“হাসপাতালের সবুজ ইউনিফর্ম পরা কয়েকজন সহকারী দক্ষতার সঙ্গে আমার চোখের সামনেই আমার দেহটা নিয়ে গেল এমার্জেন্সী থেকে ও টি তে। সার্জন এ্যানাস্হেসিস্ট্, সহকর্মিদের নিয়ে প্রখর আলোর নীচে শুরু করলেন আমার অপারেশন - সবই কিন্তু আমি দেখতে পাচ্ছি সেই ভাসমান অবস্হায়।”

ডক্টর বোসের কাছেও পুলক বলেছিল, ঐ অবস্হাতেই সে তার পরিবারের মৃত আত্মীয়দের কয়েকজনকে দেখতে পাচ্ছিল চোখের সামনে - জীবন্ত, মূর্ত। পুলক তাদের দেখেছিল তারা খুব সুখী, নিশ্চিন্তে অসীম আনন্দের সাগরে ভেসে বেড়াচ্ছে। বারবার ইশারায় পুলককে ওদের কাছে ডাকছে। ওরা মুখে কোন কথা বলছে না, নিজেদের মধ্যেও না, কিন্তু মনের তরঙ্গের মাধ্যমে নিজেদের উষ্ণ আনন্দবার্তা পুল কের প্রাণের ভেতরে ঢেলে দিতে চাইছে। তাদের হাসি খুশী ভাব, স্বাভাবিক উচ্ছাস আর অশরীরি ইংগিত স্পষ্ট জানাচ্ছে

“তোমার মনের অবস্হা তখন কি পুলক - কি মনে হচ্ছিল তোমার তখন?” থাকতে না পেরে বললাম আমি।

“আমার মনে তখন কেবল কৌতুহল যাঁদের ভাসতে দেখছি, তাদের কোন দু:খ নেই, উদ্বেগ নেই, শরীরে কোন ব্যাথা যন্ত্রণা নেই। আশ্চর্য - নীল আকাশে মুক্ত পাখীর মত উড়ে বেড়াচ্ছি যেন, চারদিকে ঝকঝকে সোনালী রোদ, শান্তিপূর্ণ, স্হির, নিস্কম্প আবহাওয়া। মনেই আসেনি যে আমি হাসপাতালে আছি।”

“মাই গড্ - তারপর?" 



“ভাসছি ভাসছি . . . হঠাৎ একটা অজানা স্রোত আমাকে একটা অন্ধকার সুড়ঙ্গের ভেতরে টেনে নিয়ে গেল। লম্বা সুড়ঙ্গের শেষপ্রান্তে চোখধাঁধানো একটা নীলচে সাদা উজ্জ্বল আলো দেখতে পেলাম। অপার শান্তির মধ্যে সুড়ঙ্গপথে ভেসে যেতে যেতে কিছুক্ষণের মধ্যেই হঠাৎ একটা জমাট দেওয়াল সামনে এসে গেল, আর আলোটা গেল হারিয়ে। পেছনে ফেরা ছাড়া তখন আর কোন রাস্তা আমার নেই। ইচ্ছে না থাকলেও বাধ্য হয়েই ফিরতে হল আর ভাসতে ভাসতে, জনঅরণ্যের রোজকার স্বাভাবিক জীবনযাত্রা ছুঁয়েই বলতে পারেন, হাসপাতালের অপারেশন রুমে এসে পড়লাম এবং এক অপ্রতিহত আকর্ষণে আমাকে আমার  অচেতন  দেহেই আশ্রয় নিতে হল  - আমাকে কেউ যেন জোর করেই ওখানে ঢুকিয়ে দিল আমার অনিচ্ছাসত্ত্বেও। কেমন মনে হল এটাই আমার একমাত্র নিরাপদ আশ্রয়, আমার নিজস্ব জায়গা। আশ্চর্য, তখনও, অবচেতন চোখে পরিস্কার দেখছি ওদের ব্যস্ততা, তৎপরতা, ডাক্তারদের কর্মকান্ড, আনুষঙ্গিক সতর্কতার সঙ্গে সঙ্গে তাদের একমুখী শুশ্রূষা, নিরলস পরিচর্যা। এর মধ্যে শুনলাম এক সহকারী ফিস ফিস করে বললো - ছেলেটা বাঁচবে তো?”

এবার অপরেশ বললো - “ডাক্তাররা  কয়েক দিনের অক্লান্ত পরিশ্রমে, সুষ্ঠু সুশ্রূষায় পুলককে সুস্হ করে তুললেন। আশ্চর্যের কথা, যখন সে সুস্হ হয়ে ছাড়া পেলো তখন শরীরে মনে, আচার ব্যবহারে ওর বিগত বছরগুলির অসংযমী আচরণের কোন ছায়া নেই, নেই কোন ডিলিরিয়াম। যেন নতুন প্রাণ নিয়ে ফিরে এসেছে মৃত্যুর আঙ্গিনা থেকে।”

পুলক নিজের মনে বলে চললো - “ড: বোস কয়েকদিন পর আমাকে চেম্বারে ডাকলেন - নানারকম প্রশ্ন করে আমার সব কথা শুনে উনি খুবই উৎসাহী এবং সক্রিয় হয়ে উঠলেন। তাঁর বিশ্বাস, তাঁর গবেষণা, তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ এবং আমার প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতার যোগফল বিজ্ঞানিদের কাছে গ্রহণযোগ্যতার কাজে সহায়ক হবেই, এবং বিজ্ঞান  জগতে বিষ্ময়কর আলো ফোটাতে পারবে। তাই তিনি আমাকে একদিন নিজের ওয়ার্কশপে এনে জ্ঞানী বিজ্ঞানীদের সামনে এই অদ্ভুত ঘটনার সরাসরি বিবরণ দিতে চাইলেন।”

পুলক নিজের তাগিদেই গেল সেখানে আর, ঐ মঞ্চে অলৌকিক বা অশরীরি ঘটনার প্রত্যক্ষ বিবরণ দিয়ে অবিশ্বাসীদের অনেকের মধ্যেই কৌতূহল সৃষ্টি করল। আত্মবিশ্বাসী, অনাড়ম্বর উপস্হাপনার সময়ে পুলকের মুখের স্বাভাবিক ঔজ্জ্বল্, চোখের  অচঞ্চল ভাষা আর নিজের বক্তব্যের ওপর প্রচন্ড আত্মবিশ্বাস  উপস্হিত সকলের মনে গভীর ছাপ ফেলে দিয়েছন। সাধারণভাবে অবিশ্বাসী শ্রোতারাও প্রশ্নের তরঙ্গ তুলে, বিজ্ঞানের  কষ্টিপাথরে যাচাই করে, এই ঘটনাটিকে নেহাতই কল্পনাপ্রসূত গল্পকথা বলে উড়িয়ে দিতে পারলেন না। বিজ্ঞানী, মনস্তত্ববিদ, গুণীজনদের প্রতিটি কঠিন প্রশ্নের উত্তর  পুলক এমন দৃঢ় আত্মবিশ্বাসে ভর করে সরল করে দিয়েছিল যে সেদিন শ্রোতাদের স্বাভাবিক সন্দেহ আর অবিশ্বাস অনেকাংশেই দূর হয়েছিল। ডঃ বোসের এই গবেষণা আর অজানা পথের বিশদ অনুসন্ধান সেদিন সত্যিই গতি পেয়েছিল।

ডক্টর বোস ঠিক এইটাই চাইছিলেন, অবিশ্বাস আর সন্দেহের বরফে একটু ফাটল ধরাতে পারলে সেই সূক্ষ্ম রন্ধ্রপথে প্রবেশ করবে অজানা আনন্দময় জগতের সত্যের আলো, ঐ অহেতুক ভীতি, অনিশ্চয়তার অন্ধকার দূর হবে। জগত জুড়ে নতুন ভাবধারায় সুস্হ আলোচনা শুরু হবে।

ততদিনে পৃথিবী জুড়ে তথ্যপ্রমাণ সহ অক্লান্ত গবেষণার পর প্রমাণিত হয়েছে এন ডি ইর সংগে হ্যালুশিনেশনের কোনই সম্পর্ক নেই। উঁচু মাচা থেকে পড়ে যাওয়া শ্রমজীবি মজদুর, যুদ্ধফেরত মুমূর্ষু সৈনিক বা মর্মান্তিক দুর্ঘটনায় আহত মানুষদের নিয়ে এইবার এই গবেষণার পথ ধীরে ধীরে নির্ভুল নিশানায় এগোতে শুরু করল।

ড: বোস এবং অন্যান্য আগ্রহী বিজ্ঞানীরা তাঁদের গবেষণার মাধ্যমে, এই জাতীয় অসংখ্য ঘটনার প্রত্যক্ষ শ্রোতা ছিলেন এবং অধিকাংশ ক্ষেত্রেই একটি প্রায় অবশ্যম্ভাবী বর্ণনা তাঁরা পেয়েছেন, যেমন পুলকও নিজস্ব অভিজ্ঞতায় শুনিয়েছিল। এন ডি ই’র একান্ত অনুভূতির কথা বলতে গিয়ে কেউ কেউ জানিয়েছিলেন তাঁদের অশরীরি অবস্হার মধ্যে তাঁরা নিজের কানে শুনেছিলেন ডাক্তাররা তাকে “মৃত” বলেই হাত তুলে দিয়েছিলেন অথচ, অবিশ্বাস্যভাবে, রূগীরা নিজেদের দেহে ফিরে পুরনো জীবন আবার ফিরে পেয়েছেন। এই সময়ে আবার কেউ কেউ তার নিজের জীবনে ঘটে যাওয়া কিছু কিছু বিশেষ দৃশ্যাবলীও ঘটতে দেখেছে।

এন ডি ই - মানুষের এই দুর্বোধ্য অবস্হা নিয়ে আজ শাখা প্রশাখা বিস্তার করে সারা বিশ্বে বিজ্ঞানীদের তোলপাড় অনুসন্ধান চলছে, এবং অস্তিত্ববাদীদের প্রবল বিশ্বাস - তাঁরা এই নিশ্চয়তা অনিশ্চয়তার দোলার ওপর বিজ্ঞানের সন্ধানী আলোক সম্পাত করতে পারবেন।

 

 

 


কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন