বৃহস্পতিবার, ১৪ নভেম্বর, ২০২৪

মৌসুমী মুখোপাধ্যায়

 

ধর্ষণ সংস্কৃতি ও ধর্ষকের মনস্ত্বত্ত্ব

 


মানুষের জীবনে তার অস্তিত্ত্বের মানে কী, এই মহাবিশ্বে তার অবস্থান কোথায় এবং অতীত বর্তমান ও ভবিষ্যতের মধ্যে সম্পর্ক কী – এই বিষয়গুলো নিয়ে চিন্তা ভাবনা করা এবং পরিস্কার স্পষ্ট ধারণা নিজের মধ্যে রাখা, অস্ত্বিত্ত্ববাদী মনোস্তত্ত্বের নিরিখে, এইগুলোই মানবমনকে ভালো রাখার গুরুত্বপূর্ণ কতগুলো পদক্ষেপ এবং ভালো থাকতে গেলে ও অর্থপূর্ণ জীবনযাপন করতে চাইলে অকৃত্তিম জীবনযাপনে অভ্যস্ত হওয়ার ক্ষেত্রে এই চিন্তাচেতনা জরুরী যে কোনো মানুষের ক্ষেত্রেই লিঙ্গপক্ষপাতহীনভাবে মনবিজ্ঞানের এই জ্ঞান যেহেতু লিঙ্গবৈষম্যহীনভাবেই নির্মিত হয়েছে তাই এই জ্ঞানের গ্রহণ ও চর্চায় আপত্তি থাকার কথা নয় নারীবাদী চিন্তাচেতনার চর্চায় অন্তত আমার তো নেই তো যে কথা বলার, শৈশব থেকেই নারী জীবনের নির্মাণটা যদি তেমন ভাবে হয়, যদি তাদের জীবনের একটা স্পষ্ট লক্ষ্য থাকে এবং একজন নারী হিসেবে এই মৌলবাদী সামাজিক পরিমন্ডলে সে ভবিষ্যতে কেমন জীবন ও মুক্তির আকাশ চাইছে এটা স্পষ্ট ভাবে জানে ও দৃঢ প্রত্যয়ে তার সেই বিশ্বাসের দিকে এগিয়ে যায় তাহলে ভালো থাকাটা তার হাতের মুঠোয় না হয়ে পারে না এ কথা বলার এখানে অন্য একটা কারণও আছে এটা দেখা যায় বাবা মায়েরা নিজের জীবনে যে কাজটা করতে পারেন না বা যে পরিবেশ তারা নিজেদের জীবনে পান না, সেটা তারা তাদের সন্তানের মধ্যে দিয়ে পেতে চান। এই ক্ষেত্রে বাবা-মারা যদি বিশেষ করে মায়েরা যদি শৈশবে একজন কন্যাসন্তানের মধ্যেও পুত্রসন্তানের পাশাপাশি তার ভবিষ্যৎ জীবনের জন্যও লক্ষ্য  নির্ধারণের জন্য পরিচালনা করেন, সামাজিক চাপকে উপেক্ষা করেন ও তা করার মূল্যবোধ যতটা সম্ভব পরিবারের মধ্যে চর্চা করেন তাহলে শুরুয়াতটা শক্তপোক্ত হয়। এমনটা যে এখন হচ্ছে না তা বলছি না তবে সেটা সার্বজনীন নয় সচেতন বাবা-মাই একমাত্র সচেতন সন্তান তৈরী করতে পারেন সচেতনতাই একমাত্র পথ নারীদের নতুন ভবিষ্যৎ নির্মাণের জন্য, ধর্ষণহীন দিগন্ত রনার জন্য বা মৌলবাদহীন একটা সামাজিক কাঠামো প্রতিষ্ঠার জন্য যে কোনোরকমের গ্রহণযোগ্যতার কাছে নতি স্বীকাকরলে, সামাজিক চাপে খুব সহজেই বিপর্যস্ত বিধ্বস্ত হয়ে পড়লে সেটা হবার নয় এই বেসিক শিক্ষাটাও সকলের কাছে ড়িয়ে পড়া চাই

যাপনচিত্র ছয়ে আমি তুলে ধরতে চাই যে ঘটনাটা সেটা এইরকম একজন প্রৌঢা, বিয়ে করেন নি বা হয়নি তুখোড় মেধাবী ছাত্রী বাবা মায়ের সংসারেই ভাইদের সঙ্গে থেকেছেন সংসারের যাবতীয় দায়িত্ব সারাজীবন একাই সামলেছেন কিন্তু আলাদা করে নিজের জন্য কিছুই করেন নি প্রৌঢাবস্থায় এসে হঠাকরেই তিনি ডিপ্রেশনের শিকার হন একদিন আবিস্কার করেন তার পাশে কেউ নেই আমি যখন এই ভদ্রমহিলাকে জিজ্ঞেস করি সারাজীবন সংসারের সমস্যা সমাধানের দায়িত্ব তিনি কেন নিতে গেলেন নিজের ভবিষ্যৎ না গুছিয়ে তখন তিনি অবাক হয়ে বললেন নিজের লোকেদের জন্য এটুকু করতে তার ভালো লাগত  

ওপরে যে ঘটনাটা বললাম সেখানে ভদ্রমহিলার জায়গায় ভদ্রলোকও কেউ একজন থাকতে পারতেন সমাজে এমন উদাহরণ প্রচুর আছে দুক্ষেত্রেই যেটা কাজ করেছে, সেটা হল সামাজিক অনুমোদন আর গ্রহণযোগ্যতার প্রতি ব্যক্তির এক অমোঘ ও চোরা আকর্ষণ যা তাদের তাদের কোথাও উন্নীত হতে দেয় নি সবসময় প্রায় সবক্ষেত্রেই সামাজিক বা পারিপার্শ্বিক অনুমোদন আর গ্রহণযোগ্যতা একটা ট্র্যাপ হিসেবে কাজ করে তার বিকাশের পরিপন্থী হয়ে আলোচ্য ভদ্রমহিলার ক্ষেত্রে অন্য যে ফ্যাক্টরগুলো কাজ করেছে সেগুলো হল আত্মসচেতনতার অভাব এবং সেই সঙ্গে গুড-গার্ল সিন্ড্রোম এই যাপনচিত্রে নেওয়া ঘটনাটা হয়ত সরাসরি আমার শিরোনামের বিষয়ের সঙ্গে যুক্ত নয়, তবে নারীর কৃত্রিম জীবনযাপনের এটি একটি প্রকৃষ্ট উদাহরণ তাই এই ঘটনাটিকে বেছে নেওয়া সমাজে যেহেতু একধরনের মৌলবাদী পরিমন্ডলের মধ্যে এমনিতেই একজন নারীকে অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার লড়াই চালিয়ে যেতে হয়, তাই আলোচ্য ভদ্রমহিলার মতো এই ভুলগুলো একেবারেই করা যাবে না অপরদিকে একজন পুরুষকে যেহেতু এই মৌলবাদী পরিমন্ডলের শিকার এইভাবে হতে হয় না, তাই তার ক্ষেত্রে পরিণামটাও বলা বাহুল্য অন্যরকম হয় যত বেশি নারী উন্নয়ন হবে তত বেশি ধর্ষণ সংস্কৃতি মাথা চাড়া দিয়ে উঠতে পারবে না আবার উল্টো দিক থেকে যত বেশি ধর্ষণ সংস্কৃতির চর্চা হতে পারে, এমন কাজ থেকে বিরত থাকা যাবে তত বেশি নারী উন্নয়ন ও বিকাশ সম্ভব হয়ে উঠবে ব্যাপারটা খুব সহজ তবে এই বিষয়টা সব মেয়েদের মনে ও মাথায় শুধু পৌঁছে দেওয়া দরকার তাইই নয়, যত বেশি সংখ্যক ছেলেদের মাথায়ও পৌঁছে যাওয়াও জরুরী তার জন্যে সমাজের সংশ্লিষ্ট সকলের উচিত হবে মেয়েদের বিশেষ করে শিশু কন্যাদের সেই অভিমুখে চালিত করা

যাপনচিত্র সাত এ আমি যে ঘটনা তুলে ধরতে চাই সেটা এইরকম মফঃস্বলের একটি পাড়ায় একজন ল্য ইয়ার ঘরে বউ ছেলেমেয়ে রেখে আবার অন্যত্র আরো একজনকে বিয়ে করে ঘর সংসার করেন তার বউ ছেলেমেয়েকে সাহায্য করার অপরাধে তিনি গোপনে প্রতিবেশী এক মহিলার মেয়ের নামে সর্বত্র খারাপ কথা রটনা করে দেন পাড়ার মহিলারা সেটাকেই সত্যি ভেবে তাদের একঘরে করে দেয় এভাবেই সর্বত্র প্রচার হয়ে যায় সদ্য কৈশোরে পা দেওয়া মেয়েটির নাকি একটি বাচ্চা হয়ে গেছে পর্যন্ত 

ধর্ষণ সংস্কৃতির এর থেকে বড় উদাহরণ আর খুব কমই পাওয়া যাবে একজন পুরুষ তার সামাজিক, পারিবারিক, আত্মিক দৈন্য ঢাকতে একজন কিশোরীকে যে অভিনব পদ্ধতিতে আক্রমণ করেছে সেটা কোনো অংশে ধর্ষণের চেয়ে কম কিছু নয় আর সেই কাজে পাড়ার মহিলারা সরাসরি কীভাবে সাহায্য করেছে তা জানলে আশ্চর্য হয়ে যেতে হয় অবাক হতে হয় মেয়েরাও কীভাবে একটা ধর্ষণে সাহায্যকারী ভূমিকা পালন করেছে

যে সচেতনতা বা আত্মসচেতনতা থাকলে মানুষ, সে নারীই হোক বা পুরুষ, কৃত্রিম জীবন থেকে দূরে থাকতে পারে, ওপরের আলোচ্য মহিলাদের তা নেই এটা স্পষ্ট শুধু সেটাই নয়, অন্যের কথার সত্যমিথ্যা যাচাই না করে একটি ফুটফুটে জীবনকে জীবনের শুরুতেই সমাজসংসারে এক ঘরে করে দেওয়ার মতো কাজ যে পাড়ার কিছু স্বল্প শিক্ষিত মহিলারা মিলে করে দেখিয়েছেন সেটা কাকে কান টেনে নিয়ে যাওয়ার যেমন সমান, তেমনি নারী সমাজের কোনো গুড-গার্ল সিন্ড্রোমে আক্রান্ত হওয়ার একটা নজির বটে আগেকার দিনে, এমনকি এখনকার দিনেও বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই নারী সমাজের বৃহত্তর অংশের কোনো লক্ষ্য ছিল না বা থাকে না জীবনের তারা ঘরের কাজ সামলে বাকি সময়টায় পাড়ায় কোথায় কী কে করল তার তদ্বির তদারকিতে অবসর ব্যয় করেন বা করতেন শুধু নয়, এর ভিত্তিতে তারা মেয়েদের গায়ে নানারকম লেবেল এঁটে দিয়ে থাকতেন এবং আজও দেন নিজেদের আত্মিক উন্নতির কোনোরকম চেষ্টা না করেই এভাবেই এক প্রজন্ম থেকে আর এক প্রজন্ম তৈরী হয়েছে এবং হচ্ছে একটা অর্থপূর্ণ জীবনযাপন নির্মাণের ব্যাপারে এদের কোনো আগ্রহ তৈরি না হওয়াটা অর্থপূর্ণ জীবনযাপনে আগ্রহী নারীদের পেছনে টেনে ধরার কাজ করে সমাজে যে একধরণের প্রতিকৃয়াশীলতার জন্ম দেয় সেটা আসলে ধর্ষণ সংস্কৃতিরই চর্চা ও উদযাপন মেয়েদের এই সাংস্কৃতিক পরিমন্ডল থেকে বেরিয়ে আসতে হবে যে করেই হোক, প্রতিবাদে সরব হতে হবে সেটা বয়োজ্যেষ্ঠদের বিরুদ্ধে হলেও হতে  হবে বং এটাই হবে বরং যেকোনো মেয়েজন্য একটা অকৃত্রিম, অর্থপূর্ণ জীবনযাপন যা তার ও অন্যদের উন্নত ভবিষ্যৎ নির্মাণে সহায়তা করবে অযথা গ্রহনযোগ্যতা, অনুমোদনের লোভে সমাজের এইসব কাকিমা জেঠিমাদের তাবেদারি করা কিন্তু আসলে নিজের এবং নিজের উত্তরসূরিদের জীবনকে আরো বেশি বেশি করে ধর্ষকদের হাতে তুলে দেওয়ার সামিল যাপনচিত্র সাতের মধ্যে দিয়ে আমি এও বোঝাবার চেষ্টা করলাম ধর্ষণ সংস্কৃতি ব্যাপারটা কত বিরাট, কত ব্যাপক এর পরিধি আমাদের সচেতন হওয়ার সময় এসেছে সময় এসেছে ধর্ষণ সংস্কৃতির এই চক্রাকার আবর্তনকে ভেঙে দিয়ে নতুন পথ নির্মাণের এখানে আরো একটা কথা যোগ করতে চাই যে লোকটি তার নিজের দৈন্য ঢাকতে আক্রোশে এক ফুটফুটে কিশোরীর জীবনে চরম নির্মম অন্ধকার ছুঁড়ে দেয়, সে যদি সুযোগ পেত, সে যদি তাকে হাতের নাগালের মধ্যে পেত, সে নির্ঘাত ধর্ষণ করেই তার প্রতিশোধের আগুন নেভাত সমাজের আনাচে কানাচে এমন ঘটনার কথা আমরা প্রায়শই খবরের কাগজে পড়ে থাকি তাই যে সব নারীরা এমনকি পুরুষরাও অকৃত্রিম, অর্থপূর্ণ জীবনযাপন নির্মাণ করতে চাইবে, তাদের অবশ্যই উচিত হবে এই ধরনের পুরুষদের অস্তিত্বকে বিপন্ন করে তোলা প্রতিবাদে সরব হবার মধ্য দিয়ে   

[ক্রমশ]                                      


কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন