সোমবার, ১৪ অক্টোবর, ২০২৪

মধুবন চক্রবর্তী

 

বাংলাসাহিত্যে প্রথম মহিলা ঔপন্যাসিক হানা ক্যাথরিন মুলেন্স এবংন প্রথম বাঙালি মহিলা ঔপন্যাসিক স্বর্ণকুমারী দেবী

 


বাংলা উপন্যাস লেখা শুরু হয়েছিল উনবিংশ শতকের মধ্যভাগে। ধীরে ধীরে বাংলা সাহিত্যের একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়ে পরিণত হয়েছিল। একটি বিশেষ ধারা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হতে শুরু করে বাংলা উপন্যাস।  ১৮৫২ খ্রিস্টাব্দে প্রকাশিত হলো ‘ফুলমণি ও করুণার বিবরণ’ নামক গ্রন্থ, যা বাংলা ভাষার প্রথম উপন্যাস হিসেবেই গণ্য হয়। ‌কেউ কেউ বলেন, প্রথম বাঙালি মহিলা ঔপন্যাসিক ছিলেন স্বর্ণকুমারী দেবী।

মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের চতুর্থ কন্যা স্বর্ণকুমারী দেবী। রবীন্দ্রনাথের থেকে পাঁচ বছরের বড় ছিলেন স্বর্ণকুমারী দেবী। সাহিত্যে যখন পুরুষদের দাপট, সেই সময় স্বর্ণকুমারী দেবী পুরুষ মহলে নিবিড় এক সাহিত্যচর্চার পরিবেশ তৈরি করেছিলেন। সেই সাহিত্যচর্চার প্রতিবেশ প্রবেশ করেছিল অন্দরমহলে যা স্বর্ণকুমারীকে স্পর্শ করেছিল প্রগাঢ়তার সঙ্গে। অনুপ্রেরণা দিয়েছিল সাহিত্য চর্চায়। তাঁর রচিত প্রথম উপন্যাস হলো দ্বীপনির্বাণ’ যা প্রকাশিত হয়েছিল ১৮৭৬ খ্রিস্টাব্দে। পরিসংখ্যান বলছে, ইতিপূর্বে ১৮৫২ সালে হানা  ক্যাথরিন ম্যলেন্স তাঁর প্রথম উপন্যাসটি রচনা করেছিলেন। যার নাম ‘ফুলমণি ও করুণার বিবরণ’। উপন্যাসটি প্রকাশ করে বাংলা ভাষার প্রথম ঔপন্যাসিকের মর্যাদা লাভ করেছিলেন তিনি। কিন্তু স্বর্ণকুমারী দেবী ছিলেন প্রথম বাঙালি মহিলা ঔপন্যাসিক, যিনি কবিতা নাটক সহ সাহিত্যের বিভিন্ন আঙিনায় রচনার ক্ষেত্রেও সাবলীল ছিলেন। ‌এদিকে হানা ক্যাথরিন মুলেন্ সম্পর্কে বলতে গেলে সত্যি বড় অবাক হতে হয়।  এখানে অবাক আর মুগ্ধতা কোনটা বলবো? দুটোই প্রকারান্তরে একই অর্থ বহন করে, কিন্তু মুগ্ধতার মধ্যে রয়েছে বিস্ময়, এক অসম্ভবকে সম্ভব করার মধ্যে যে আনন্দ থাকে উচ্ছ্বাস থাকে। সেই বিষয়টাই প্রতিষ্ঠিত হয় মুগ্ধতার মধ্যে। একজন অবাঙালি হয়ে বাংলাসাহিত্যে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করা তাও আবার বাংলা সাহিত্যের মূলধারা উপন্যাসে, যা আমাদের মুগ্ধ করে। সর্বোপরি একজন মহিলা হয়ে সেই সময়ের প্রেক্ষাপটে সব প্রতিকূলতা অতিক্রম করে। তবে বাংলাভাষার প্রতি তাঁর এই অমোঘ টান বাংলা ভাষাকে কি যথার্থ সম্মান দিতে পেরেছে? এই প্রশ্নের মুখে দাঁড় করিয়ে দেয় আপামর বাঙালিকে? ক'জন মনে রেখেছেন এই নারীকে? হানা ক্যাথরিন মুলেন্স ছিলেন সুইস নারী। বাবা ফ্রাসোঁয়া ল্যক্রোইকস একজন সুইস পাদ্রী ছিলেন, যিনি ১৮২১ খ্রিস্টাব্দে লন্ডন মিশনারি সোসাইটির তরফে খ্রিস্টধর্ম প্রচারের উদ্দেশ্যে ভারতের চুঁচুড়া যাত্রা করেছিলেন। তিনি ছিলেন একজন শিক্ষাবিদ, অনুবাদক ও নানা মিশনের নেত্রী ছিলেন। সেইসঙ্গে মেয়েদের জন্য স্কুল স্থাপন করেছিলেন। নারী শিক্ষার অগ্রগতিকে ত্বরান্বিত করেছিলেন। নারী জাগরণ, নারীর শিক্ষা, নারী স্বাধীনতায় বিশ্বাসী হানা ক্যাথরিন ম্যলেন্স বেশিরভাগ সময় কাটিয়েছিলেন কলকাতায়। মেয়েদের একটি বোডিং স্কুলের প্রধান ছিলেন তিনি। বাইবেলের ক্লাস নিতেন। তাঁর উপন্যাস ‘ফুলমণি ও করুণার বিবরণ’  গড়ে উঠেছিল খ্রিস্টান মহিলাদের জীবন যাপনের খুঁটিনাটি বিষয় নিয়ে। উপন্যাসটিতে বাঙালি খ্রিস্টান পরিবারের নিখুঁত বিবরণ তুলে ধরা হয়। ভারতের একটি অঞ্চলের বাঙালি খ্রিস্টান নারীদের জীবন কথা, উপন্যাসের মূল উপজীব্য। বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে উপন্যাসটির গুরুত্ব অবশ্যই রয়েছে, বিশেষ করে সাহিত্য অনুরাগী পাঠকের কাছে বিশেষ মর্যাদারও দাবি রাখে।



যদিও ‘ফুলমণি ও করুণার বিবরণ’ গ্রন্থটি  মূলত ইংরেজি গল্পের ছায়া অবলম্বনে রচিত, কিন্তু বইটির উল্লেখ বাংলা রচনার বিভিন্ন তালিকাগ্রন্থে পাওয়া যায়। কিন্তু মূল রচনাটি দুষ্প্রাপ্য। ১৯৫৮ সালে বিশিষ্ট গ্রন্থাগারিক  এবং প্রাবন্ধিক চিত্তরঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়ের সম্পাদনায় বইটি প্রকাশিত হলে বাংলা ভাষার প্রথম উপন্যাস হিসেবে এর দাবি সুপ্রতিষ্ঠিত হয়। জানা যায়, লন্ডন মিশনারি  সোসাইটির সুইস সদস্য রেফারেন্ড ফ্রঁসোয়া লাক্রোয়া খ্রিস্টধর্ম প্রচার করতে ১৮২১ সালে চুঁচুড়ায় আসেন, তার পাঁচবছর পর কন্যা ক্যাথরিনের জন্ম হয়। দীর্ঘদিন বাংলায় বসবাসের সুবাদে, ধীরে ধীরে হানা ক্যাথরিন বাংলাভাষায় অভ্যস্ত হতে থাকেন। বাংলা ভাষা তাঁর কাছে হয়ে ওঠে আপনজন। বাংলা বাঙালিকে ভালোবেসে কলকাতায় থাকতে শুরু করেন। পরে ভবানীপুর মিশনের স্কুলে দেশি ক্রিস্টান ছেলেমেয়েদের বাংলা পড়াতেন। পরবর্তী ক্ষেত্রে মিশনের অপর কর্মী  যে মুলেন্সের সঙ্গে তাঁর বিয়ে হয়।

১৮৫২ খ্রিস্টাব্দে বাঙালি খ্রিস্টান মহিলাদের জীবন নিয়ে লেখা ‘ফুলমণি ও করুণার বিবরণ’ ক্যালকাটা ক্রিশ্চিয়ান ট্রাস্ট এন্ড বুক সোসাইটি থেকে প্রকাশিত হয়েছিল। উপন্যাসটি প্রায় বারোটি ভারতীয় প্রাদেশিক ভাষায় অনূদিত হয় এবং বিভিন্ন অঞ্চলের খ্রিস্টানদের বিদ্যালয়ে পাঠ্য হয়। তাঁর এই উপন্যাস মূলত ইংরেজি  গল্পের ছায়া অবলম্বনে রচিত হয়েছিল। তবে গ্রন্থটি মৌলিক রচনা না অনুবাদ মূলক, সেই নিয়ে কিন্তু পরবর্তীক্ষেত্রে বিতর্ক তৈরি হয়। ক্যাথরিন কি নিজে এই বইটি লিখেছিলেন? না অন্য কেউ তার নামে লিখেছিলেন? ১৯৫৯ সালে বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ গ্রন্থাগারের একটি তাক থেকে একই লেখিকার 'বিশ্বাস বিজয়' নামে একটি পুঁথি খুঁজে পাওয়া যায়। কিন্তু দেখা যাচ্ছে সেটি ‘ফুলমণি ও করুণার বিবরণে’র ইংরেজি রচনার বঙ্গানুবাদ।

১৮৪৫ সালের ১৯শে জুন মিশনের কর্মী মি .জে মুলেন্সের সঙ্গে তাঁর বিবাহ হয়। বিবাহের পর থেকে তাঁর নামের শেষে মুলেন্স সংযুক্ত হয়। এই সময় তিনি মহিলাদের স্কুল পরিচালনায় নিয়োজিত ছিলেন। মিশন  স্কুলের শিক্ষায়ত্রী হয়েও  বাঙালি মেয়েদের দেশীয় সংস্কৃতি ও প্রথায় জীবনযাপনে উৎসাহ দিয়েছেন। ১৮৫৪ তে তাঁরই উৎসাহে কলকাতায় জেনানা মিশন স্থাপিত হয়। এই মিশনের কাজ ছিল কলকাতার উচ্চবর্ণের হিন্দু পরিবারের অন্দরমহলে গিয়ে মহিলাদের লেখাপড়ায় উৎসাহ দেওয়া। কলকাতার নারীশিক্ষার কেন্দ্রগুলির দায়িত্বভার গ্রহণ করেছিলেন তিনি। এছাড়া ১৮৫১ এবং ১৮৫৬ সালে 'TRAVELS OF A BIBLE' and

‘DAY BREAK IN BRITAIN' তাঁর আরও দুটি বই বাংলায় অনুবাদ করেন। পাশাপশি তাঁর আর একটি বই

‘বিশ্বাস বিজয়’ অর্থাৎ বঙ্গদেশে খ্রীষ্টধর্মের গতির রীতি প্রকশার্থ উপাখ্যান, সেটিও প্রকাশিত হয়। বাংলা ভাষার প্রতি তাঁর একাগ্রতা অগাধ ভালোবাসা তাঁকে বাংলা ভাষার প্রতি শ্রদ্ধাশীল করে তোলে। তাঁর প্রথম  উপন্যাস নিয়ে বিভিন্ন মহলে বিতর্ক থাকলেও, তাঁর কৃতিত্ব অস্বীকার করা যায় না। একসময় সুকুমার সেন বলেছিলেন, "বইটি আকারে প্রকারে উপন্যাসের মত। বাংলায় উপন্যাসোপম প্রথম আখ্যান রূপে তাই  ‘ফুলমণি ও করুণার বিবরণ’ বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে স্মরণীয় হয়ে থাকবে।

হানা ক্যাথরিন মুলেন্সকে বাংলা ভাষার প্রথম ঔপন্যাসিক হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হলেও, স্বর্ণকুমারী দেবীকে আধুনিক বাংলা সাহিত্যের প্রথম উল্লেখযোগ্য বাঙালি মহিলা সাহিত্যিক হিসেবে পরিগণিত করা হয়।

১৮৭৬ সালে তাঁর প্রথম উপন্যাস ‘দ্বীপনির্বাণ’ প্রকাশিত হয়, যা স্বর্ণকুমারী দেবীর অল্প বয়সের রচনা। ‘দ্বীপনির্বাণ’ ছিল জাতীয়তাবাদী ভাবে অনুপ্রাণিত এক উপন্যাস। স্বর্ণকুমারী দেবীর সাহিত্য প্রতিভা ছিল  বিচিত্রমুখী। উপন্যাস, কবিতা নাটক, গল্প সাহিত্যের বিচিত্র প্রকরণেই তাঁর পারদর্শিতা প্রমাণিত হয়। সাময়িক পত্র সম্পাদনাতে ও কৃতিত্বের স্বাক্ষর রাখেন তিনি। পাশাপাশি তাঁর সম্পাদিত 'ভারতী’ পত্রিকাও সমকালে বেশ গুরুত্ব লাভ করে। সব মিলিয়ে বলা যেতে পারে নবজাগরণ যুগের নারী চেতনার প্রতিমূর্তি ছিলেন স্বর্ণকুমারী দেবী।

এই দুই মহীয়সী নারীকে জানাই আমাদের শ্রদ্ধা ও প্রণাম

 


কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন