ফ্ল্যাশব্যাকে থিয়েটার পাঁচালি-তে
প্রতিবাদী মাসের থিয়েটার
প্রতি,
এই প্রতিবাদী মাসে থিয়েটারের কথা লিখতে বললেন সম্পাদক কাজল সেন। তিনি সবসময়ই থিয়েটারের ফ্ল্যাশব্যাকে যাওয়া রীতিটিকে সমর্থন করে চলেছেন। তাই এইসময়ে এক নজরে একজন প্রতিবাদী শিল্পীর কথা তুলে ধরা যাক।
তাঁর
সঙ্গে একদিন দেখা হয়। তখন অতিমারি চলছে। চারদিকে মরণের ভয় নিয়ে
মেলামেশা বন্ধ। এদিকে থিয়েটারেও তখন দুরবস্থা। বিশেষ গবেষণার কাজে তাঁর কাছে যেতে হবে।
ভাবলাম বর্ষীয়ান শিল্পী আমাকে সময় দেবেন কেন? এমনিতে তিনি এতটাই ব্যস্ত থাকেন। সিনেমা,
টেলিভশনের কাজ অল্পস্বল্প চলছে। কিন্তু আগের মতো দুরন্ত নয় সেই গতি। তারই মধ্যে তাঁকে
পেলাম, তাঁর কাজের ফাঁকে। তাঁর সঙ্গে আলোচনা করা হবে থিয়েটারের কথা নিয়েই। তিনি কেন
এতগুলো বছর ধরে থিয়েটারে যুক্ত? ওতপ্রোতভাবে যুক্ত। এটা তো ভাবাচ্ছিল তাঁর কাছে যেতে
যেতে …।
থিয়েটারে
টিকে থাকা মানে আর্থিকভাবে সংগ্রাম করা। অন্তত বিশশতকের
গ্রুপ-থিয়েটারে যখন অভিনেত্রীদের দেখা গেল। একটা লড়াই সামাজিক। প্রশ্ন, কেন থিয়েটারে? কেন আর কোনও চাকরিতে নয়? একটা লড়াই আর্থিক। কেন থিয়েটারে? কেন অন্য কোনও
চাকরিতে নয়?
এই
দুই লড়াইয়ের একটাই উত্তর। তা দিতেই থিয়েটারে থাকা।
একটি এর কারণ নির্ণয়ের জন্যে থিয়েটার কর্মীদের মধ্যে ততদিনে কাজ করছেন
রেবা রায়চৌধুরী, শোভা সেন, তৃপ্তি মিত্র এবং আরও অনেকে। এখানের
আলোচনা চিত্রা সেন সম্পর্কে। জন্ম ৫ মে ১৯৩৪।
পারিবারিকভাবে নৃত্য শিক্ষা চলে মণিপুরী, ভরতনাট্যম।
মূলত নৃত্যগুরু বালকৃষ্ণ মেনন, শক্তি নাগ।
গণনাট্যে চিত্রা।
নৃত্যশিল্পী হিসেবে শুরু। তখন তিনি চিত্রা মণ্ডল। ভারতীয় গণনাট্য
সংঘ-এ যোগদান। নৃত্যশিল্পীরূপে ভারত ও বিশ্বের বিভিন্ন দেশ ভ্রমণ। গণনাট্য
সংঘের পর, গ্রুপ থিয়েটার পর্ব। যেখানে ছিল আদর্শ, গড়ে ওঠার প্রবচন ছিল। ভাল নাটক করব, ভাল করে করব'।
গ্রুপ থিয়েটারের চিত্রা।
থিয়েটার গিল্ড, বিবেক নাট্যসমাজ, চলাচল
প্রভৃতি নাট্যদলে।
অভিনয়ে প্রথম আত্মপ্রকাশ ঘটে 'নীলদর্পণ' নাটকের
ক্ষেত্রমণি বা ছোট বউ। সাড়া ফেলে দেন অলকানন্দা চরিত্রটি রূপদান করে। নাটক 'অলকানন্দার পুত্রকন্যা' বিখ্যাত
অনেক কারণেই। এক্ষেত্রে অভিনেত্রী চিত্রা নাটকে অলকানন্দা-চরিত্রের জন্যে সম্মান
পান রাজ্যের শ্রেষ্ঠ অভিনেত্রীর। পশ্চিমবঙ্গ নাট্য আকাডেমি, শ্রেষ্ঠ
অভিনেত্রী সম্মান, সাল ১৯৯০। নাটকের দুনিয়ায় তিনি বেশ কয়েকটি
উল্লেখ্যযোগ্য চরিত্রে বিখ্যাত।
অতসী,
হেমাঙ্গিনী, নয়না, সেনতে
সুইতা, অচলা, বনলতা সেন এবং কুন্তী। তাঁর
অভিনীত নাটকের নাম যথাক্রমে 'শোভাযাত্রা', 'অলীকবাবু', 'যদুবংশ', 'ভালো
মানুষের মেয়ে', 'গৃহদাহ', 'আঁখিপল্লব',
'প্রথম পার্থ'। আবার তিনি পুরস্কৃত হন শ্রেষ্ঠ
অভিনেত্রীর পুরস্কার, পশ্চিমবঙ্গ নাট্য আকাডেমি ২০১০ সালে। নাটক 'জলছবি'।
প্রশ্নঃ থিয়েটার মানে তো রিহার্সাল এবং রিহার্সাল। লাইভ অভিনয় বলে কথা। এজন্যে তৈরি হওয়াটা বেশ কঠিন, সময়সাপেক্ষের এবং একটানা করে যাওয়াটাও তো থাকে। খুব শক্ত।
কথা শুনে হেসে বললেন বর্ষীয়ান চিত্রা, দেখো,
অভিনয় মানে তো থিয়েটার। মঞ্চ। সেটাই শিখে
এসেছি। আমরা তো গণনাটো কাজ করে এসেছি। নৃত্যশিল্পী থেকে একদিন পাঠ পেলাম। অনেক
স্ট্রাগল করে অভিনয় চালিয়েছি।
গ্রুপ থিয়েটার চালাতে গিয়ে অফিস ক্লাবে অভিনয় করেছি। আর ক্যামেরায়
কাজে অনেক পরে এসেছে দূরদর্শন, সিনেমার পর্দা। এবং যে মাধ্যমে যতটুকু আজ অভিনয়ের
কথা বলছি সবটাই তো মঞ্চে শেষ। কথা বলা, মেপে কথা বলা,
স্বরক্ষেপণ। শরীর সুস্থ রাখা। সবটাই তো থিয়েটার শিখিয়েছে। ফলে,
এটি প্রথম পছন্দের। রক্তে
মিশে গেছে। বোধে মিশে গেছে। আলাদা করে উল্লেখের দরকার নেই যে
থিয়েটার আমার সত্তায় মিশে গেছে।
প্রশ্নঃ
গ্রুপ থিয়েটারের চিত্রা থেকে চিত্রা-র থিয়েটার?
নাট্য-বিশ্লেষক এবং রঙরূপ দলের প্রধান অভিনেত্রী, নাট্যকার
ও নির্দেশক সীমা মুখোপাধ্যায়-এর কথায়,
“চিত্রাদি, একজন কমপ্লিট আর্টিস্ট। নিয়মানুবর্তিতা
যেমন, তেমনই হলেন বড় মাপের চিন্তক। কেমন, উদাহরণ, চিত্রাদি রিহার্সালে আগে পৌঁছে গিয়ে ঘর ঝাঁট
দিয়ে সাফ করেন। এবং হাসিমুখে সবার জন্যে অপেক্ষা করেন। ১৯৩৪ সাল থেকে ২০২১ সাল।
কত বছর? অভিনয় করতে থাকাটাই একটা লড়াই। নয়?”
প্রশ্নঃ
গ্রুপ থিয়েটারের চিত্রা থেকে চিত্রা-র থিয়েটার?
নাট্য-বিশ্লেষক এবং সংলাপ কলকাতা দলের প্রধান অভিনেতা, নির্দেশক
কুন্তল মুখোপাধ্যায়-এর কথায়, “রবীন্দ্র- উত্তরকালে গ্রুপ
থিয়েটারে অভিনেত্রীদের এক বিশেষ স্থান গ্রহণ করতে দেখা যায়। থিয়েটারে টিকে থাকার
জন্যে চিত্রাদি অন্য মাধ্যমে কাজ করেননি। উনি দল, মানে
শ্যামল সেন এর গ্রুপ থিয়েটার দল স্বপ্নসন্ধানী’র জন্যেই উপার্জন
করেছেন। সে খুব কঠিন সময় পার করেছেন। এবং তাঁর ভূমিকা একারণেই স্মরণীয় যে, তিনি চলচ্চিত্র, ছোট পর্দা, বেতার
মাধ্যমে কাজ করলেও, বেশি গুরুত্ব দিয়েছেন গ্রুপ থিয়েটারকেই।
তাই ২০২১ শে উনি 'জলছবি' অভিনয় করেন।
মানে করতে পারেন সাবলীলভাবেই। ওঁর অভিনয় দেখে তো বোঝার উপায় নেই, ওঁর বয়স কত।”
থিয়েটার মানে সময়ের হাতে অভিনেতা। এবং অভিনেত্রীও। সেটাই
এক লড়াই এবং লড়াইয়ের ব্যাটন রইল দর্শকের
হাতেই।
এই কিস্তির লেখা যখন শুরু করেছিলাম, তখন মাননীয় লেখক-সম্পাদক কাজল সেনের ‘কালিমাটি অনলাইন’এর পাতায় প্রথম কিস্তিতে ছিল দর্শক। আমাদের যা কিছু লড়াই সব ধরা থাকে সময়ে যেমন, তেমনই দর্শকের কাছেও। তাই ফিরে দেখার এই ইতিহাস দর্শকের কাছের।
_ ইতি
একুশ শতকের ফ্ল্যাশব্যাক সত্তাধিকারী…
(ছবি সৌজন্যঃ চিত্রা সেন ও সীমা মুখোপাধ্যায়)
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন