ধর্ষণ সংস্কৃতি ও ধর্ষকের
মনস্তত্ব
যাপনচিত্র দুইয়ে আমরা দেখব যে ঘটনাটা সেটা এই রকম। একজন মহিলা জানিয়েছেন তাঁর অভিজ্ঞতা। তিনি বলছেন, বিশেষ কারণবশত তাঁদের পৈতৃক বাড়ি বিক্রি করে দেন তাঁর বাবা। এর প্রতিক্রিয়ায় সমাজের অন্যান্যদের সঙ্গে সঙ্গে তাঁর বন্ধুর মা তাকে বারবার এই বলে খোঁচাতে থাকেন যে বাড়ির একটা মাত্র ছেলে সন্তান হওয়া স্বত্বেও তাঁর বাবা কেন বাড়িটা তাকে অর্থাৎ ছেলেকে না দিয়ে বিক্রি করে দেন (যদিও ভদ্রমহিলার বক্তব্য অনুসারে বাড়ি বিক্রি করে তাঁর বাবা অন্যত্র আবার একটা বাড়ি বা ফ্ল্যাট কেনেন তাদের সুবিধের জন্য)। এই ঘটনাটা উল্লেখের মধ্যে দিয়ে আমি এটা বোঝাতে চাইছি যে এখনও সমাজে মানুষ এই ধ্যানধারণা মজ্জায় নিয়ে চলে যে যদি পুত্রসন্তান কারো থাকে, যোগ্য হোক বা অযোগ্য হোক, পৈত্রিক সম্পত্তি একমাত্র তারই অবশ্য প্রাপ্য। এই যে ছেলে সন্তান সম্পর্কে লিঙ্গ নির্বিশেষে সকলেরই এমন ধারণা, এমন একটা আবেগ, বৃহত্তরভাবে যা আসলে লিঙ্গ অসাম্যেরই একটা উদাহরণ – এই মানসিকতা কিন্তু আসলে ধর্ষণ সংস্কৃতিকেই উজ্জীবিত করে। ধর্ষণ বিষয়টা যেহেতু একজন নারীর ওপর বেশিরভাগ ক্ষেত্রে সংঘটিত হয়, তাই সমাজের প্রতিটা নারীর ব্যাক্তিগত ও সম্মিলিত চেষ্টা ছাড়া এই পরিস্থিতি থেকে পরিত্রাণ পাওয়া খুব মুশকিল। আর এই বিষয়টাই অপরপক্ষ কাজে লাগাচ্ছে তাদের গোটা মৌলবাদী ব্যাপারটাকে বিছিয়ে রাখার স্ট্রাটেজি হিসেবে। চক্রান্তটা আসলে এইখানে। আবার ধর্ষণ করার কাজটা যেহেতু পুরুষরা করে থাকে সাধারণভাবে, যেহেতু ধর্ষণ সম্পর্কিত নানা গবেষণা ও সমীক্ষা থেকে এটা পাওয়া গেছে যে একজন পুরুষ তার শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণের জন্যই এই কাজটি করে থাকে, তাই মহিলাদের তাদের কর্তব্য নির্ধারণ করতে হবে বিজ্ঞানসম্মত জ্ঞানের পথ অনুসরণ করে। এর দ্বিতীয় কোনো উপায় আর নেই।
যাপনচিত্র তিনে আমি দেখাতে চাই যে ঘটনাটা সেটা এইরকম। একজন মা আমাকে অভিযোগ করেছেন যে এখনকার সব মায়েরা তাদের মেয়েদের কি সব বেহায়া অসভ্যের মতো জামাকাপড় পরায়। মেয়েরা সব প্যান্ট সার্ট পরে বেলেল্লাপনা করে বেড়ায়। আমার মেয়েকে কেউ শাড়ি আর চুড়িদার ছাড়া অন্য কিছু পড়তে দেখেছে! আমার মেয়েকে কেউ আমার সঙ্গে ছাড়া অন্য কোথাও বসতে, চলতে, দাঁড়াতে, হা হা হি হি করতে দেখেছে? বনেদি রক্ষণশীল পরিবারের এই মা তাঁর জ্ঞানে বা অজ্ঞানে এমন সংস্কৃতির ধারক বাহক হয়ে গেছেন যা আসলে ধর্ষক সংস্কৃতিকেই উজ্জীবিত করে। কেননা ধর্ষণ সম্পর্কিত নানা গবেষণা ও সমীক্ষায় ইতিমধ্যেই জানা গেছে যে ধর্ষকরা নারীর কাছ থেকে এমন ব্যবহার ও চলাফেরা আশা করে যা ঐতিহ্যগতভাবে শান্ত, কোনোভাবেই উত্তেজক নয়। ধর্ষকদের মধ্যে এরকম একটা মানসিকতা পাওয়া গেছে যে কোনো নারীর পোষাক আশাক, চলাফেরা, যদি তাদের উত্তেজিত করে তাহলে সেই নারীকে ধর্ষণ করার পূর্ণ অধিকার একজন পুরুষের আছে বলে তারা মনে করে। বলা বাহুল্য আলোচ্য এই মা জেনে হোক বা না জেনে হোক ধর্ষকদের এই মানসিকতাকে উজ্জীবিত করছেন, তোল্লাই দিচ্ছেন, প্রতিবাদ করার বদলে। সবচেয়ে বড় কথা যে কোনো নারীর যে কোনো পোশাক পরার, যে কোনো জায়গায় চলাফেরা করার অধিকার, জীবনের যে কোনো আনন্দে অংশগ্রহণ করার অধিকার যে জন্মগত অধিকার রয়েছে, উপরোক্ত এই মায়ের সংস্কৃতি নারীর সেই অধিকারকে খর্ব করছে। সামগ্রিকভাবে গোটা পৃথিবীর অর্ধেক সংখ্যক মানুষের অস্তিত্ব রক্ষার সংগ্রাম ও স্বাধীনতাকে লাঞ্ছিত করছে। এই লাঞ্ছনা মানবতাবিরোধী।
যাপনচিত্র চারে আমি দেখাতে চাইব যে ঘটনাটা সেটা এইরকম। সম্প্রতি একটি বিয়ে হল যে বিয়েতে পাত্রী জানিয়ে দিয়েছে তার হবু শাশুড়িকে বিয়ের আগেই যে সে তাকে ‘মা’ বলে ডাকতে পারবে না। ডাকবে আন্টি বলে। কেননা পাত্র মেয়েটির মাকে ওইভাবেই ডাকে। এই বিয়েটির বৈশিষ্ট পাত্রী পাত্রের চেয়ে ছ’মাসের বড়। স্কুল লেভেলের পর থেকে এরা পারস্পরিক প্রেমের আদানপ্রদানের মধ্যে দিয়ে বেড়ে উঠেছে। মানসিক এবং শারীরিক সঙ্গ বিয়ের আগেই এদের প্রেমকে ঋদ্ধ করেছে। ক্যারিয়ার তৈরীতে একে অপরের সাহায্য পেয়েছে। সর্বোপরি বিয়ের পর ‘ঘর করতে’ মেয়েটিকে শ্বশুরবাড়িতে উঠতে হয়নি। ওরা ‘ঘর করতে’ গেছে মেয়েটির কাজের জায়গায়। আর এই সম্পর্কের সূত্রপাত হয়েছিল মেয়েটির মায়ের ইচ্ছেতে। স্কুলের পরে মেয়েটির মা মেয়েটিকে জানিয়ে দেয় যে সে যেন তার পছন্দ মতো জীবনসঙ্গী খুঁজে নেওয়ার চেষ্টা শুরু করে দেয় এবং এ ব্যাপারে মেয়েটি মায়ের কাছ থেকে অনেক বুদ্ধি ও পরামর্শ পেয়েছে।
সমাজকে, মেয়েদের জীবনকে এগিয়ে
নিয়ে যাবার ব্যাপারে এর চাইতে ভালো প্রয়াস খুব কমই দেখা যায়। সবচেয়ে বড় কথা একজন মা সাহস করে উদ্যোগ
নিয়ে তার মেয়েকে ভবিষ্যতের পথে এগিয়ে দিচ্ছে, তাকে উপযুক্ত পরামর্শ
উপদেশ দিচ্ছে সমাজে এ ঘটনা খুব বিরল বললেও কম বলা হয়। তার একটাই কারণ এই সমাজে নিরানব্বুই
দশমিক নয় শতাংশ মায়েরাই আজও এত কিছুর পরও পিতৃতান্ত্রিক নিয়মের বেড়াজালে আবদ্ধ থাকতে
বেশি নিরাপদই শুধু মনে করে না, তারা এই ব্যবস্থাটা কে কায়েম রাখতে রীতিমতো আচরণও করে
থাকে। মায়েরা যদি মেয়েদের পাশে একটু একটু করে দাঁড়াত বা দাঁড়ায় তাহলেও মেয়েদের জীবনটা
খানিকটা এগিয়ে যেতে পারে। তবে এখানে একটা কথা আছে। সাধারণত মায়েদের ওপর পরিবারের পুরুষদের
একটা চাপ থাকে, মায়েরা যেন তাদের সন্তানদের যথাযথ পারিবারিক
ঐতিহ্য মেনে শিক্ষিত করে তোলে। এবং এই চাপটা একটা চরম চাপ। একজন
মা বাধ্য ক্রীতদাসের মতো এই চাপ মেনে কাজ করতে বাধ্য থাকে। নতুবা সামনে পড়ে থাকে তাঁর মৃত্যু অথবা
হত্যার হুমকি। যে কোনো মৌলবাদের ভেতরের চরিত্র বা ঘাঁতঘোত গুলো যেরকম হয় আর কি। এই সব কিছুকে পেরিয়েও যে উপরোক্ত মা
তাঁর কন্যাকে এভাবে এগিয়ে দিতে পেরেছেন তার কারণ অস্তিত্ববাদী মনস্তত্বের দৃষ্টিকোণ
থেকে দেখলে বোঝা যাবে যে এই মা চেয়েছিলেন তাঁর কন্যা সন্তানকে ভালো দেখতে ভবিষ্যতে। তাঁর লক্ষ্যটা ছিল তাঁর কাছে স্পষ্ট। এবং তাঁর লক্ষ্যে পৌঁছানোর জন্য তিনি
তাঁর সাহসের ওপর ভর করেছেন। সেই সঙ্গে তিনি তাঁর বিশ্বাস দ্বারা চালিত হয়েছেন। সামাজিক চাপের কাছে নতি স্বীকার করেন
নি। এই ফ্যাক্টর গুলোই তাঁকে শেষ পর্যন্ত তাঁর লক্ষ্যে পৌঁছে দিয়েছে। সমাজের অন্য বেশির ভাগ মায়েদের মধ্যে
এই ফ্যাক্টরগুলো অনুপস্থিত, হয়তো বা আংশিকভাবে। তাই অন্য মায়েরা এইরকম অকৃত্রিম জীবনযাপনের
তাগিদ পান না। তাঁরা বাধ্য হন সবসময় একটা কৃত্রিম জীবনযাপন ও আচরণ বেছে নিতে। অবশ্যই এ ব্যাপারে সবচেয়ে বড় চাপ আসে
তাঁর স্বামী ও সব ধরনের আত্মীয়স্বজনের থেকে প্রাথমিকভাবে এবং বৃহত্তরভাবে গোটা সমাজের
কাছ থেকে। ‘লোকে কী বলবে’র চাপ বড় সাংঘাতিক চাপ, একটা জাঁতাকল যা আসলে এক প্রতিক্রিয়াশীল
সংস্কৃতি। এখানে একটা কথা না বলে পারছি না, দেখা গেছে যেসব ক্ষেত্রে
পারিবারিক জীবনে বাবারা অনুপস্থিত, সেসব ক্ষেত্রে মায়েরা ভালো
ভাবে দায়িত্ব পালন করতে পারেন অনেকটাই, যদিও সব ক্ষেত্রে এ কথা
প্রযোজ্য একেবারেই নয়। এবং মেয়েদের মুক্ত ভবিষ্যৎ জীবন বেছে নেওয়ায় অনেকটাই সফলতা
দেখা যায়। বাবাদের নিয়ন্ত্রণ বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই পরাধীনতার পরাকাষ্ঠা হয়ে দাঁড়ালে পরিবারে
তাদের উপস্থিতির প্রয়োজনীয়তা হয়তো কখনো কোনো কোনো ক্ষেত্রে প্রশ্নচিন্থ হয়ে দাঁড়াবে। কেননা মানব প্রকৃতি সব সময় প্রগতি ও
স্বাধীনতার দিকেই এগোতে চাইবে এবং চায়, এ কথা
ঐতিহাসিকভাবে প্রমাণিত।
যাপনচিত্র পাঁচে আমি তুলে ধরতে চাই যে উদাহরণটা সে এইরকম। বাবা মার একমাত্র মেয়ে। পড়াশোনায় ভালো। ছোটবেলায় বাবা মারা গেছে। ভালো পড়াশোনা করে মেয়েটি চাকরি পেয়েছে। চাকরি সূত্রেই দেখা হয়েছে সেই ছেলেটির সঙ্গে যাকে সে পরবর্তী কালে বিয়ে করেছে। বিয়ের পর দুজনে চাকরির উপার্জন জমিয়ে তারা একটা বড় সড় বাসস্থান করেছে। সেই বাসস্থানে মেয়েটি তার মাকেও এনে রেখেছে। আবার ছেলেরবাবা মাও থাকছে। তাদের সঙ্গে তার সুন্দর সম্পর্ক। মেয়েটিকে ছাড়া তাদের শ্বশুর শাশুড়ির চলে না বললেই চলে। ঘরের কাজ, রান্না, এগুলো সে করে না বললেই চলে। এর জন্য রাখা আছে লোক। খুব শান্ত, স্নিগ্ধ মেয়েটি কিন্তু বেশ জেদি।
প্রখর আত্মসচেতন এই মেয়েটি ঠিক যেভাবে তার জীবনকে গুছিয়ে নিয়েছে তেমনটা এখনকার দিনে অনেক মেয়েই চাইছে। তার কারণ সম্ভবত এই যে মেয়েদের মধ্যে কমবেশি একটা সচেতনতা তৈরী হয়েছে, যেটা তারা হয়তো প্রকাশ্যে আলোচনা করে না। চারহাতপাওলা একটা জীব ও প্রায় কমবেশি সমমেধাসম্পন্ন মানবমস্তিস্ক নিয়ে জন্মাবার পরও সামাজিক ও পারিবারিক জীবনে কেন দ্বিতীয় লিঙ্গের সম্মান নিয়ে বাঁচতে হবে – এ যৌক্তিক বোধের উন্মেষ নারী মনে হচ্ছে। তাই এখনকার মেয়েরা সামাজিক চাপ, ‘লোকে কী বলবে’র তোয়াক্কা না করে সাহস করে নিজেদের পছন্দ মতো জীবন নির্বাহ করছে। এরা বুঝতে পেরেছে সামাজিক মৌলবাদ, ধর্ষণ, পৌরুষের ইগো ও কনসেপ্টকে যতই মাথায় চড়তে দেওয়া যাবে, ততই এগুলো আরও আরও চড়তেই থাকবে। তাই এরা একটু একটু করে ছোট ছোট পদক্ষেপে দায়িত্ব নিয়ে সাহস করে খানিকটা বা সামাজিক সামঞ্জস্য বজায় রেখে একটা অকৃত্রিম জীবন যাপন করবার চেষ্টা করছে। কোনোরকম ইমোশনাল ব্লাকমেকিংএর শিকার না হয়ে এই যাপন কিন্তু আসলে গোটা নারীসমাজকেই অনেকটা এগিয়ে দেবে শুধু নয়, মৌলবাদী ও ধর্ষণ সংস্কৃতিকেও অনেকটাই গুটিয়ে যেতে সাহায্য করবে।
মেয়েরা যদি ধর্ষণ না চায় বা তার আনুষঙ্গিক মৌলবাদী থাবা তাদের জীবনে না চায়, তাহলে তাদের সাহস করে নিজের জীবনের দায়িত্ব নিজেকে নিতে হবে, পারিবারিক ও সামাজিক ঘেরাটোপকে অমান্য ও অগ্রাহ্য করে ঐতিহ্যগত লিঙ্গবৈষম্যমূলক মূল্যবোধের শেকল থেকে বেরিয়ে আসতে একাই নিজের শিক্ষা ও পেশাকে সম্বল করে নতুন বন্ধুজগৎ গড়ে তুলতে হবে। কিয়র্কগার্ডের বক্তব্য মতো, নিজের বিশ্বাসের পথে চলতে শিখতে হবে। তবেই নারীরা একমাত্র তাদের অস্তিত্বের সংকট থেকে মুক্ত হতে পারবে একটু একটু করে। অস্ত্বিত্ববাদী মনস্ত্বত্বের দেখানো পথে অকৃত্রিম জীবনযাপনের মধ্যে দিয়েই একমাত্র নারীরা তাদের পূর্ণ অস্তিত্ব বিকাশের সুযোগ ও অধিকার পেতে পারবে। সমাধান এই একটাই।
(ক্রমশ)
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন