সোমবার, ১৪ অক্টোবর, ২০২৪

শান্তিরঞ্জন চক্রবর্তী

 

সমকালীন ছোটগল্প




পুনর্জীবন

মন চাইলেই সব হয়ে যায় নাকি! পরিবেশ পরিস্থিতি আমূল পাল্টে দিতে পারে মনের গতিবিধি এমনও হতে পারে, বাইরে থেকে যাকে মনে হবে উচ্ছল আনন্দময়, ভেতরে ভেতরে সে ভীষণ একা রহস্যটা এখানেই যে আমরা খুব কাছের মানুষ হয়েও মনের অতলে লুকানো সে একাকীত্বের বিন্দুমাত্র খবর রাখতে পারি না

সমুদ্রকে দেখে কে আন্দাজ করতে পেরেছিল সে এমন একটা কাজ করার সংকল্প করছে মনে মনে! বাইরের লোকের কথা ছেড়েই দিলাম কিন্তু তার মা, যে তার প্রতিটি নিঃশ্বাস প্রশ্বাসের সঙ্গে পরিচিত সে পর্যন্ত তার মনের হদিশ পেল না মায়ের পরেই জীবনে যার স্থান, সে স্ত্রী পর্যন্ত বুঝে উঠতে পারল না কি ভীষণ তোলপাড় চলছে তার মনের অভ্যন্তরে! না, কেউ না, কেউ  পারেনি ওর মনের বদ্ধ দরজার আগল খুলে ভীতরে প্রবেশ করতেনা, উঁকি দিয়ে দেখার ফাঁকটুকু পর্যন্ত রাখেনি সমুদ্র ও যে সকলের আপন ওর কথা, ওর আপন করা মিষ্টি হাসি, সব চাইতে বড়কথা, সমাজের প্রত্যেকটি মানুষের জন্য ওর সমান দরদ, সমাজের উন্নতির জন্য আত্মনিবেদন ওকে করে তুলেছিল সকলের আত্মার আত্মীয় সকলের মনে স্মিতহাসি মাখা মুখখানিই জ্বলজ্বল করত কারও যেকোন রকম সমস্যায় আগেই যার কথাটি মনে আসত সে সমুদ্র চাকরির জায়গাতেও মধ্যমণি সমুদ্র আর্থিক  কায়িক যেকোন রকম সমস্যার মুশকিল আসান সমুদ্রওর মনটাকে দেখার কথা মনেই হয়নি কারো সমুদ্র মানেই হল মুশকিল আসান এর থেকে বেশী জানার বা বোঝার সুযোগই দেয়নি সমুদ্র কারোকে কোনদিন

বিয়ের আগে পর্যন্ত ছিল মা ছেলের সংসার বিয়ের পর অনেক কিছুই পালটে যায়.  সমুদ্রর ক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম হল না বিয়ের আগে একই ঘরে মা ছেলের দুটি খাটে বিছানা এখন  মা একা সেই ঘরে পাশের ঘরে একটিই খাট, একটিই বিছানা কিন্তু বিছানার ভাগীদার এখন দুজন মা একা হয়ে যাম এখন বেশী কথা সমুদ্রর স্ত্রীর সাথে এটাই তো স্বাভাবিক সদ্যবিবাহিত দম্পতি চাইবেই তো একে অন্যের  সঙ্গে পরিচিত হবার জন্য পর্যাপ্ত অবসর মায়ের মধ্যে সমুদ্র যেন  সংকোচ সন্দেহের ছায়া দেখতে পায় ইদানিং আগে খাবার টেবিলে  মায়ের সঙ্গে ছিল যত কথা সমুদ্রর এখন  কেবল খাওয়ার সময় আর দুটি ভাত নে সমু, বা আর এক টুকরো মাছএর মধ্যেই মা ছেলের কথাবার্তা সীমাবদ্ধ বৌ ছেলে একসঙ্গেই খেতে বসেমা পরিবেশন করেন রান্না ঘরের অধিকার  তিনি এত  সহজে ছেড়ে দেবেন না বৌকে ছেলের কোন পদটি পছন্দ কোন মাছের কেমন রান্নাটি সে  বেশী পছন্দ করে বৌ তা জানবে কি করে? কেমন একটা ভয় পেয়ে বসেছে মাকে, এই বুঝি কোনদিন  ছেলে বলে বসলো, ‘মা আমার কোম্পানি কোয়ার্টার দিচ্ছে, ওখান থেকেই অফিস যেতে সুবিধে হবে,  আমরা ঠিক করেছি কোয়ার্টার নিয়ে নেব, তোমার ইচ্ছে হলে যেতে পার আমাদের সাথেনা তেমন  কিছু হয়নি, হওয়া সম্ভবও নয়মা অন্ত প্রাণ সমুদ্রর, তার পক্ষে মাকে ছেড়ে যাওয়ার ভাবনা কল্পনায়ও আসবেনা কখনোতা ছাড়া তার অঞ্চলের উন্নতির মূলে যে তারই তৎপরতা সবচাইতে বেশীসে ঘর ছেড়ে চলে গেলে সকলে চোখে অন্ধকার দেখবে যে!

সমুদ্রর স্ত্রী কিন্তু ধরে ফেলেছে মায়ের দুর্বল জায়গাটিরান্নাঘরের সাতপ্যাঁচে জড়াতে চায় না সেওতার দিনের বেশীর ভাগ সময় কাটে টিভির সামনে বসে আর মোবাইলে কথা বলেশুরু থেকেই কেমন একটা দূরত্ব তৈরী হয়ে যায় শ্বাশুড়ি আর বৌয়ের মধ্যেমা একদিন জনান্তিকেই বলে উঠলেন, ‘খাটতে খাটতে জীবন শেষ হয়ে গেল, আমার জীবনে আর সুখ লেখা নেইকথাগুলো মা  এম আওয়াজে বললেন, যেন ছেলে বৌ দুজনের কানেই পৌঁছায়সমুদ্র ছাড়া আর কে জানবে মায়ের লড়াইয়ের কথা তাই মায়ের এই অভিমানটুকু ধরে ফেলল সমুদ্রসত্যি তো পৃথ্বী পারে তো মাকে কাজে সাহায্য করতে, সব্জি কেটে দেওয়া, কড়াই থেকে ডাল তরকারিটা পাত্রে ঢেলে দেওয়া,  বাসন কোসন এগিয়ে দেওয়া এসব! রাতে শুতে এসে সমুদ্র বলল বৌকে কথাগুলো থমথমে হয়ে গেল পরিবেশটা বলল, কতখানি ত্যাগ স্বীকার করেছে মা তাকে আজকের সমুদ্র করে গড়ে তোলার জন্য কিছুক্ষণ চুপ করে থাকার পর পৃথ্বী নিজেই ভাঙ্গলো নীরবতা সমুদ্রকে সোজাসুজি প্রশ্ন তার, ‘মা বুঝি আমার নামে অভিযোগ করেছে তোমার কাছে’? সমুদ্র কিন্তু একেবারেই প্রস্তুত ছিল না এমন একটি  প্রশ্নের মুখোমুখি হবে বলে অতি মাত্রায় সপ্রতিভ সনুদ্র বলল জবাবে, ‘এটাকে অভিযোগ বলে না পৃথ্বী, এ বয়সে মা পেরে উঠছেন না রান্নাঘরটা পুরো সামাল দিতে পৃথ্বীর হাতে বল, সপাটে পাঠালো সমুদ্রর কোর্টে, ‘জানি তো, মার বয়স হয়েছে, কেনইবা খাটবেন তিনি, আমি তো বলেছি, রান্না ঘরটা আমি পুরো সামলে নেবো, বল না মাকে’! ঠিকই তো বলেছে পৃথ্বী, ভাবল সমুদ্র সংসারের হাল তো দীর্ঘকাল বেয়ে এসেছেন মা ক্লান্তি তো স্বাভাবিক মাকে বুঝিয়ে বলবে কাল

মা অনেককাল সংসারের ঘানি টেনেছ তুমি, এখন তোমার ছেলের বৌ এসেছে, এখনও খেটে মরবে? এখন  তোমার আরাম করার সময় হেঁসেলের পুরো ভারটাই ওর ওপর ছেড়ে দাও খোলা মনেই কথাগুলো বলল সমুদ্র যত সহজে সমুদ্র বলল কথাগুলো মা কিন্তু নিতে পারলেন না তত সহজেছেলের মুখের দিকে তকালেন একবার না, কোন ভাবান্তর নেইমা ভেবে বসলেন, ছেলে  বৌতে যুক্তি করেই এই সিদ্ধান্তে পৌচেছেনীরবে মেনে নিলেন তিনি ছেলের কথাবললেন, ‘ঠিক আছে, তোদের সংসার, তোরা যেমন চাইবি তেমনই হবেসমুদ্র মায়ের মন বুঝে উঠতে পারে না এখন মায়ের কথার ভাবে যেন একটু শ্লেষ, একটু অসন্তুষ্টি মা কি আঘাত পেয়েছেন তবে? সমুদ্র মানুষের দুঃখ বোঝে, সে দুঃখ নিরসনের চেষ্টাও করে সাধ্যমত কিন্তু মানুষের মনের গভীরে যে একটি অনাবিষ্কৃত জগত তা নিয়ে ভাবনার প্রয়োজন বোধ করেনি কখনো বিয়ের পর এক অজানা জগতের সামনে এসে দাঁড়িয়েছে সে পরিস্থিতি ভাবতে বাধ্য করছে তাকে সমুদ্রর মনে হয়  ট্রায়াঙ্গেলের তিনটি বিন্দুতে যেন অবস্থান করছে তারা তিনজন তিনটি রেখায় যুক্ত তিনটি বিন্দু কিন্তু দূরত্ব তৈরী হয়ে গেছে এমন যে কখনই তাদের পাশাপাশি বসা সম্ভব হয়ে উঠবে না আর

এ এক অদ্ভূত অভিজ্ঞতা এতে না আছে আনন্দ না শান্তি প্রতিদিন মায়ের দূরে সরে যাওয়া, এক বিছানায় শুয়েও পৃথ্বী ও তার মধ্যে এক দুস্তর ব্যবধান অস্থির করে তুলছে সমুদ্রকে ওদিকে ভোর হতেই দরজায় সারি দিয়ে দাঁড়াবে চেনা অচেনা কত প্রার্থী কি করবে সমুদ্র? যে মানুষটি সকলের মুশকিল আসান সে নিজেই যে আজ দিশাহারা না মন না শরীর, কোনটিই যে স্বস্তি  দিচ্ছে না তাকে কার কাছে নামাবে সমুদ্র মনের এই দুর্বহ ভার যার কাছে বসে একে একে সমস্ত সমস্যার কথা সবিস্তারে বলে ভারমুক্ত হত সমুদ্র সে তো মা যে মা বন্ধুর মত আশ্বাসে ভরে তুলত তার মন,  নতুন উদ্যমে কাজে লেগে পড়ার প্রেরণা যোগাতো, সে মায়েরই যে অবিশ্বাসের পাত্র হয়ে  উঠেছে সে দিনে দিনে  বেশ তো ছিল মা ছেলেতে , মা কেন বাধ্য করল তাকে বিয়ের পিঁড়িতে বসতে?

এর মধ্যেই একদিন মায়ের নৈর্ব্যক্তিক ঘোষণা, ‘মানুষের মুখে আমি লাগাম পড়াবো কি করে? আমাকে যখন শুনতে হয়, বছর তো গড়িয়ে গেল, নাতীর মুখ দেখবে কবে, তখন মুখে তালা মেরে রাখা ছাড়া আর উপায় কি!’ শিহরণ জাগে সমুদ্রর মনে মা চান তার ছেলের কোন বংশধর আসুক তিনি নাতী বা নাতনীর মুখ দেখতে চান, এটাই হল মোদ্দা কথা চোখাচোখী হল সমুদ্র আর পৃথ্বীর মধ্যে সমুদ্রর চোখে ইঙ্গিত, পৃথ্বীর গালে লজ্জার রক্তিম আভা

দিন মাস কেটে যায় একইধারায় মায়ের অনুযোগ আর একদিন ভাষা পেলো, ‘আমি যে  একা হয়ে গেছি এ খেয়াল নেই কারও আমার হাত ধরে নিয়ে যাওয়ার জন্য একটা কেউ থাকতে নেই’? কথাগুলো যে পৃথ্বীকে উদ্দেশ্য করেই বলা একথা বুঝিয়ে দেবার দরকার নেইজবাবে বলল পৃথ্বী,  কে বলল নেই? আসছে তো!’ সেদিন থেকে মায়ের অন্যরূপ দেখতে অভ্যস্ত হয়ে গেল সমুদ্র আর পৃথ্বী বউমার প্রতি তার সম্ভাষণ আচরণ সব কিছুতেই যেন বাৎসল্যের ছোঁয়া

সমুদ্র নিশ্চিন্ত এখন মা আর পৃথ্বীর মধ্যে যে কোনদিন বিরূপতা ছিল মনেই হয় না এখন সমুদ্র ফুরফুরে মনে সমস্ত দায়িত্ব কর্তব্য সামলাচ্ছে ঘর বাইরের ডাক্তার যেদিন জানিয়ে দিলেন ডেলিভারির ডেট সেদিন থেকে কি উৎকণ্ঠা মায়ের পৃথ্বীর খাওয়া চলাফেরা বিশ্রাম সব কিছুতেই মায়ের সজাগ দৃষ্টি

পৃথ্বী যেদিন নার্সিংহোমে ভর্তি হল সেদিন একটা অদ্ভূত কথা শোনালো মা সমুদ্রকে সে নাকি স্বপ্ন দেখেছে তাঁর মৃত স্বামী, সমুদ্রর বাবা, যার অকালমৃত্যু ঘটেছিল কোন দুর্ঘটনায়, সে-ই ফিরে আসছে সমুদ্রর ছেলের রূপে চমকে উঠল সমুদ্র এই মাকে সে কি করে বোঝাবে, স্বপ্ন সত্য হয় না কখনও, তা ছাড়া পৃথ্বী কন্যা না পুত্র সন্তানের জন্ম দেবে সে ব্যাপারেও নিশ্চিত করে বলা সম্ভব নাকি  আর ভাবতে পারছে না সমুদ্র সন্তানসম্ভবা পৃথ্বীর প্রতি মায়ের ব্যবহারের যে পরিবর্তন লক্ষ্য করেছিল সমুদ্র তার মূলে যে মায়ের অমূলক স্বপ্ন ও কামনা এ কথা ভেবে  শঙ্কিত বোধ করে সমুদ্র পৃথ্বী যদি কন্যা সন্তানের জন্ম দেয় তবে যে মা সেই আগের জায়গাতেই ফিরে যাবে তাতে কোন সন্দেহ নেই হলও তাই সমুদ্র মেয়ের মুখ দেখে ফিরেছে ঘরে কিছুতেই পারছে না মায়ের মুখোমুখি হতে এক বুক আশা  নিয়ে যে প্রতীক্ষা করছে ,কখন সেই আকাঙ্ক্ষিত সংবাদটি নিয়ে ফিরবে ছেলে, বলবে, তাই হয়েছে মা, যেমন ভেবেছ তুমি, বাবা এসেছেন আমার ছেলে হয়ে সমুদ্র ফিরেছে দেখে প্রায় ছুটেই এলেন ছেলের কাছে ,জানতে চাইলেন পৃথ্বী পুত্র সন্তান জন্ম দিয়েছে কিনা সমুদ্রকে দেখে আন্দাজ করলেন, পূর্ণ হয়নি তার আশা দুপা পিছিয়ে গেলেন তিনি তারপর আবার সেই বিষোদ্গার, ‘আমি জানতাম, এই বৌ কোন আশা পূরণ করতে পারবে না আমার, কি কুক্ষণে যে এই বৌকে ঘরে এনেছিলাম! ‘সমুদ্র ভাবল, একবার বোঝাবার চেষ্টা করবে নাকি মাকে পুরো ব্যাপারটা সত্যি তো কন্যা সন্তান জন্ম দেবার ব্যাপারে পৃথ্বীর তো দায় ছিল না কোন! এটা সম্পূর্নতঃ জৈবিক ব্যাপার যা সমুদ্রর পক্ষেও জানা সম্ভব নয় সংযত হল সমুদ্র একটু আশাবাদী হল এই ভেবে যে, নাতনীর মুখখানি দেখলে মা নিশ্চিত ভালবেসে ফেলবে তাকে আর পৃথ্বীর প্রতি তার কঠোরতারও অবসান ঘটবে

পৃথ্বীকে নিয়ে ঘরে ফিরল সমুদ্র সমুদ্রর পরামর্শমত পৃথ্বী শিশু কন্যাকে নিয়ে এগিয়ে গেল শাশুড়ির দিকে, বললএই নিন মা, কোলে নিন আপনার নাতনীকে অবাক হল পৃথ্বী,  উচ্ছ্বাস তো দূরের কথা, একবার তাকিয়েও দেখলেন না শাশুড়ীমা তাদের দিকে নিরাসক্ত গলায় সমুদ্রকে বললেন, তার ঘরের আলমারিতে রাখা সোনার চেনটি মেয়ের গলায় পরিয়ে দিতে সমুদ্র আশাবাদী, এমন করেই একদিন মা কোলে তুলে নেবেন তার নাতনীকে মায়ের কথামত চেইনটি এনে মেয়ের গলায় পরাতে যাবে সমুদ্র, এমন সময় তীব্র দৃষ্টিতে তাকালো পৃথ্বী সমুদ্রর দিকে, বললো, ‘না সমুদ্র, যেখানে স্নেহ নেই, মমতা নেই, কেবলমাত্র ফর্মালিটির জন্য একছড়া হার পরিয়ে দেওয়া, সে দয়ার দান নেবে না আমার মেয়ে কথাগুলো বলেই সে শোয়ার ঘরের দিকে পা বাড়ালো  সমুদ্র, যে স্থানীয় হাজার সমস্যা সমাধানের ঠিকে নিয়ে বসে আছে , এমনকি পারিবারিক সমস্যা মেটানোর দায় থেকেও  মুক্তি নেই যার, সেই সমুদ্র বাক্যহারা

দিন কেটে যায় একটি একটি করে এর মধ্যে একবারের জন্যও মা কোলে তুলে নেনেনি নাতনীকে রাগে ফুঁসছে পৃথ্বী দাই একজন আছে অবশ্য মেয়ের দেখাশোনার জন্য কিন্তু নিজের ঠাম্মির স্নেহ-পরিচর্যা থেকে সে বঞ্চিত থাকবে কেন? মা পৃথ্বীর সঙ্গে তো নয়ই, এমন কি্ তার নিজের ছেলের সঙ্গেও কথা বলা বন্ধ করে দিয়েছেন পৃথীর দিক থেকে চাপ আসছে কোয়ার্টারে চলে যাবার জন্য তার যুক্তি, মা যখন সহ্য করতে পারছেন না তাদের তখন কেন তার চক্ষুশূল হয়ে ঘরে থাকা ওদিকে সাহায্যপ্রার্থী লোকজনের আসার বিরাম নেই ক্লান্ত, ভীষণ ভাবে ক্লান্ত হয়ে পড়ছে সমুদ্র মনের দিক থেকে উদভ্রান্তের মত ভেবে চলেছে কি উপায়ে সামাল দিতে পারে সব দিক পথ খুঁজে পাচ্ছে না সমুদ্র পৃথ্বীর যুক্তি খন্ডন করতে পারেনি সে মাকে একা ফেলে চলে যাওয়া! না , এতবড় কৃতঘ্নতা সম্ভব নয় তার পক্ষে তবে? সব কিছু তুচ্ছ মনে  হল সমুদ্রর কত সমস্যার মিমাংসা কত সহজে করে দিয়েছে সমুদ্র অথচ আজ নিজের জীবনের এই জটিল সমস্যার কোন সমাধান সূত্রই যে খুঁজে পাচ্ছে না সে! মনের কোথায় যেন একটা জ্বলা নেভা আলোর সংকেত এ সংকেত যেন দুর্বিসহ জীবন থেকে মুক্তির কথা বলে প্রতিদিন মা আর পৃথ্বীর মন জোগাতে জোগাতে ব্যক্তিত্ব হারাচ্ছে সমুদ্র সন্তানের মুখের দিকে চেয়ে বাঁচার শক্তির সন্ধান করে কিন্তু সে কয়েক মুহূর্তের জন্য মাত্র পারছে না, পারছে  না সমুদ্র এ লড়াইয়ে টিকে থাকতে ওর সর্বাঙ্গে ছেয়ে গেছে পরাজয়ের কালিমা না পৃথ্বী, না মা ,  কারও চোখে পড়ছে না ওর নিস্প্রভ মুখখানি নিজ নিজ অবস্থান রক্ষায় এতই ব্যস্ত দুজন যে সমুদ্রর শরীর মনের খবর রাখার এক চিলতে অবসরও খুঁজে পায় না ওরা আলো নয়, অন্ধকার বিষম আকর্ষণে ওকে এক অতলান্ত খাদের দিকে নিয়ে চলেছে ক্রমাগত মায়া মমতা, বাৎসল্য, স্নে্,দায়িত্ব কর্তব্য সব অর্থহীন মনে হয় এমন কি যে প্রাণ মানুষের কাছে সবচেয়ে প্রিয় তাও যেন গুরুত্ব হারিয়েছে আজ

ছুটির দিন যথারীতি বাজার করে এনেছে সমুদ্র মা ও পৃথ্বীরর পছন্দের যা কিছু সব এনেছে মনে করে কারো মুখে কোন কথা নেই যেন যন্ত্রচালিত রোবোট তিনটি একটা জরুরী মিটিং  আছে বলে বেরিয়ে গেল সমুদ্র পৃথ্বী ব্যস্ত তার মেয়েকে নিয়ে মা আছেন রান্না ঘরে বাড়িতে ভাড়াটে আছে দুতিন ঘর তারা নিজ নিজ সংসার নিয়ে ব্যস্ত পুরো বাড়িটা জুড়েই যেন একটা বিষাদের ছায়া সমুদ্র ফিরল বেশ দেরীতেই মা বললেন, ‘সকালে খাবার খেলি না, দুপুরেও এত দেরী করে ফিরলি, খিদে পায়নি?’ সমুদ্র জানালো, সে খেয়ে এসেছে এক বন্ধুর বাড়ি থেকে মা আগের মত করে আর জানতে চাইলেন না, কোন বন্ধুর বাড়ি, কি খেলো সেখানে পৃথ্বী ফর্মালিটির ধার ধারে না বাইরে কোথাও খেয়ে এসেছে, হতেই পারে, তাতে আবার জিজ্ঞাসাবাদের কি আছেসদ্য মা হয়েছে পৃথ্বী তার অনিয়ম বাচ্চার উপর প্রভাব ফেলতে পারে, এই বিবেচনায় সে তার সময়মত খাওয়া সেরে নিয়েছেমা পারেনিসমুদ্র খেয়ে এসেছে শোনার পর সে বসেছে এখন ভাতের থালা নিয়ে

এখন মধ্যদিনদিবানিদ্রার অভ্যাস নেই মায়েরসে তার ঘরে হয় সেলাই নয় তো গল্পের বই নিয়ে ব্যস্তপৃথ্বী ঘুমন্ত কন্যার পাশে রাত জাগার ধকল পুষিয়ে নিচ্ছেসমুদ্র তার অফিস কাম ষ্টাডিতে যেন একটা শ্মশান নীরবতা পুরো বাড়িটাকে গ্রাস করে নিয়েছে সমুদ্র সন্তর্পনে বেরিয়ে এল ঘর থেকে ঘুমন্ত কন্যার দিকে চেয়ে রইল কয়েক মুহূর্ত তারপর যেমন এসেছিল তেমনি নিশ্চুপে ফিরে গিয়ে দরজা বন্ধ করে দিল

মা বেরিয়ে বাথরুমের দিকে যাচ্ছিলেন নজরে পড়ল সমুদ্রর অফিস ঘরের দরজা এটা তো রাত ছাড়া বন্ধ থাকেনা কখনো! সমুদ্র ও ঘরে থাকুক না থাকুক সব সময় খোলাই তো থাকে দরজা একবার সমুদ্র পৃথ্বীর শোবার ঘরের দিকে এগিয়ে গিয়ে দেখলেন না, সেখানেও তো নেই সমুদ্র ভাবলেন, তবে কি পৃথ্বীর সঙ্গে  মনের অমিল? কি জানি কি ব্যাপার আচ্ছা, দরজাটা তো ঠিক মত বন্ধ হতে চায় না, গরমের দিনে সিটকিনি লাগাতেও কষ্ট হয় খুব, ফাঁক তো একটু থেকেই যায় দেখবে  নাকি একবার দরজার ফাঁক দিয়ে, কি করছে সমুদ্র! উৎকণ্ঠা আর কৌতূহল যুগপৎ টেনে নিয়ে গেল মাকে দরজার সামনে আঁতকে উঠলেন তিনি এক আকাশ ফাটা চিৎকারসমু---…’ খান খান করে দিল বাড়িটার উপর ঘন কালো মেঘের মত ছেয়ে থাকা নিস্তন্ধতার ঘেরাটোপ পৃথ্বী দৌড়ে বেরিয়ে এলো ঘর থেকে ভাড়াটেরা ছুটে এলো কোন অঘটনের আশংকায় সবার মুখে একই প্রশ্ন, কি হল, এই মর্মান্তিক চিৎকারের কারণটা কি? মা হাঁপাতে হাঁপাতে কোন রকমে বলতে পারলেন, ‘শিগগীর দরজাটা ভাঙো আগে তৎপর কয়েকজন ভাড়াটে পুরুষ ভেঙে ফেলল দরজাটা দেখল সকলে, সব হারানোর দৃষ্টি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে সমুদ্র, সিলিং ফ্যানের সাথে বাঁধা একটি নায়লন রশি ঝুলছে ওর মৃত্যুমুখীনতার সাক্ষী হয়ে পৃথ্বী দৌড়ে গিয়ে জড়িয়ে ধরল সমুদ্রকে বুকে মাথা গুঁজে কেঁদে উঠল ফুঁপিয়ে সদ্য ঘুমভাঙা সমুদ্রকন্যা একা বিছানায় তার করুণ কান্না স্পর্শ করে গেল কি মায়ের হৃদয়? একবার তাকালেন সমুদ্রর বুকে ঠাঁই নেওয়া পৃথ্বীর দিকে যাক , সমুদ্র আর পৃথ্বী মেটাক  তাদের হিসাব নিকাশ তার সঙ্গে পরে কথা হবে ওদিকে তীব্রতর হল কান্নার রব। ছুটে গেলেন তিনি কোলে তুলে নিয়ে আদরে আদরে ভরিয়ে দিলেন পৌত্রীকে শিশু মমতা বোঝে কান্না থেমে গেছে তার ঠাম্মীর কাঁধে মাথা রেখে নিশ্চিন্তে চোখ বুজেছে আবার পৃথ্বীর মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে তার হাত ধরে বেরিয়ে এল সমুদ্র মা তখন পৌঁছে গেছেন সমুদ্রর কাছে মেয়েকে দেখিয়ে বললেন তিনি, ‘এ তুই কি করতে  যাচ্ছিলি বাবা, আমার কথা নয় ছেড়েই দে, আমার এই নাতনীটাকে মনে পড়েনি একবার?

আবেগে কেঁপে উঠল সমুদ্র কারো বিরুদ্ধে কোন অভিযোগ নয়, পুরো ব্যাপারটির দায় নিজের উপর নিয়ে ধরা গলায় বলল সমুদ্র, ‘এ ছাড়া আর কোন পথ আমি খুঁজে পাই নি মা, তবে দেখো, আজ থেকে খুব ভাল করে বাঁচবো আমরা  আলোচনারত ভাড়াটেদের উদ্দেশে বলল সমুদ্র, ‘আপনাদের সঙ্গে আমি পরে কথা বলবো কেমন’! এ কথার পর আর কোন প্রশ্ন থাকতে পারে না তাই একে একে নিষ্ক্রান্ত হয়ে গেল  সকলে

এদিকে পুরো ঘুমটি ঘুমিয়ে নিয়েছেন পুচকু রানি বড় বড় চোখে তাকিয়ে কি বুঝল পুচকু কে জানে! পৃথ্বী হাত বাড়ালো কিন্তু  না, কারো কাছে নয়, পরম এক আশ্রয় যেন সে খুঁজে পেয়েছে এতদিনে পৃথ্বী আর সমুদ্রর চোখে বিস্ময় জাগিয়ে সে সজোরে জড়িয়ে ধরল ঠাম্মিকে

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 


কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন