সোমবার, ১৪ অক্টোবর, ২০২৪

রাশিদা সুলতানা

 

সমকালীন ছোটগল্প




বিধুহীন

কিয়োটো বিশ্ববিদ্যালয়ের বাঙালি গবেষক নিজাম আহমেদ-এর দাওয়াতে কিয়োটোর গিয়ন এলাকায় একটা ক্যাফেতে যাই। সকালে আমার ল্যাবে এসে একসাথে লাঞ্চ করার দাওয়াত দিয়েছেন। বাংলাদেশি চিত্রকর মাহবুব জামানের সাথে নিজাম সাহেব পরিচয় করিয়ে দেন। গাঢ় ফ্রেমের চশমা পরা মাহবুব জামান জানান কাছেই ইবারাকি শহরে তিনি থাকেন। আমি হেসে বলি কিয়োটোর অদূরে আরাশিয়ামায় থাকি। লাঞ্চ এবং আড্ডার দুই ঘণ্টার পুরো সময়ে আমার কথা বলা এই একবারই। জাপানি খাবার সুশি, সাশিমি, তাকিয়াকি খেতে খেতে নিজাম আর মাহবুব পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদ, তেলের জন্য বুশ ব্লেয়ারের ইরাক যুদ্ধ, চীন-জাপান সম্পর্ক, জাপানি সাহিত্যে চীনের প্রভাব, নানাকিছু। আমি তাঁদের কথার সমর্থনে মন্তব্যহীন মাথা নাড়াই। পুরো সময় ধরে আমি মনোযোগী শ্রোতা। যেকোনো অনিঃশেষ বাকোয়াজে ঘণ্টার পর ঘণ্টা মন্তব্যহীন শ্রোতা হয়ে কাটিয়ে দিতে পারি আমি। আমার মতের একশ’ভাগ বিরুদ্ধ কথাও দীর্ঘসময় প্রতিক্রিয়াহীন শুনে যেতে পারি। আমার নৈঃশব্দ্য আড্ডায় অস্বস্তিভাব তৈরি করে বলে দেশি-বিদেশি বন্ধুরা কালেভদ্রে আমাকে ডাকে। আর, কেউ ডাকলেও আমিও যে সবসময় সাড়া দেই তা নয়। আড্ডায় আমি নির্বাক থাকলেও ঘাড় উঁচু করে দু’কান সজাগ রেখে পুরো সময় মনোযোগী শ্রোতার ভঙ্গিতে বসে থাকি। এমনকি একশ’ভাগ আমার মতাদর্শবিরোধী এবং অপ্রিয় বিষয়ে আলাপ হলেও। তবে মাতাল হলে আমার মুখে কথার তুবড়ি ছোটে। তখন আমার শীতনিদ্রা তন্দ্রা টুটে-ফুটে আমি এক ভিন্নমূর্তি। কলকলিয়ে কথা বলি, ঘর ফাটিয়ে হাসি, আর মন খুলে লোকজনকে গালিও দেই, হারামজাদা, বাস্টার্ড। আর্টিস্ট মাহবুব আজকের আড্ডায় আমার নৈঃশব্দ্যে বিস্মিত দৃষ্টিতে আমাকে কয়েকবার দেখে। খাওয়া শেষে আমরা গিয়নের পথ ধরে হাঁটি। হাঁটতে হাঁটতে আমরা তিনজন মারুয়ামা পার্কে ঢুকি। পার্কে ঘাস, লতা, পাতা, ফুল, পাথরের সৌন্দর্যে আমরা তিনজন হাঁটি। বাতাসে সবার চুল উড়ছে। অদূরে এক বৃদ্ধ দম্পতি কবুতরের মতো একে অন্যের কাছে মুখ গুঁজে কিছু বলছে। বৃদ্ধার গলায় জড়ানো গোলাপী স্কার্ফ পতাকার মতো পতপত উড়ছে। বাংলাদেশের রাজনীতিবিদ আর সরকারি আমলাদের গালমন্দ করতে করতে নিজাম আচম্বিতে ঘোষণা দেয়, ভার্সিটিতে তার জরুরি একটা কাজ আছে, এই মুহূর্তে তার ছুটতে হবে। নিজাম বিদায় নিলে আর্টিস্ট মাহবুবও চলে যেতে উদ্যত হলে আমি তাকে বলি, ‘আজকের বিকালটা দারুণ। আমরা সন্ধ্যা পর্যন্ত কাটিয়ে দিতে পারি।’

লোকটার সাথে আমার কথা বলতে মন চাইছে।

মাহবুব হেসে বলেন, “চলুন বসি কোথাও।”

আমাদের দুই ঘণ্টার আড্ডায় আপনি তো প্রায় বোবার মতো নির্বাক ছিলেন। আমার কেন জানি মনে হচ্ছিল, আপনি বিষণ্ণতায় ডুবে থাকা একজন মানুষ।”

আমি বলি, না আপনাদের কথা মনোযোগে শুনছিলাম। আমার সমস্যা হচ্ছে খুউব মন না চাইলে আমি কথা বলি না। প্রায় সব সময়ই আমি নির্বাক থাকি। বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণার কাজে সুপারভাইজারের সাথে আলোচনাও বেশির ভাগ সময় ই-মেইলে চালাই। যেভাবে আপনার সাথে কথা বলতে শুরু করলাম, নিজাম সাহেবের সাথেও অত কথা বলি নাই। বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিচয়। আমাকে এ পর্যন্ত মাত্র দু’দিন দাওয়াত দিয়েছেন, অন্য সময়ও আজকের মতো নিঃশব্দ নির্বাক ছিলাম আগের দিনগুলিতে। পার্কে এসেই মনে হলো আপনার সাথে কথা বলব। আমার কথা বলা বলতে একটা প্রেমের গল্প বলা, কাউকে ভালো লাগলে তাকে শুধুমাত্র এই একটা গল্পই বলি। এই একটাই গল্প আমার। এর বাইরে অন্য কোনো গল্প বা রাজনীতি, সমাজনীতি কিংবা ইতিহাস কোনো কিছু নিয়েই কারো সাথে কথা বলি না। দীর্ঘ বহু বছর কারো সাথে কথা বলা মানেই আমার প্রণয় কাহিনি শোনানো। আমি সবাক হওয়া আর আমার প্রণয়কাহিনি বলা সমার্থক হয়ে উঠেছে। আপনি কি শুনবেন আমার প্রেম কাহিনি?”

প্রথম দিনে প্রথম পরিচয়ে আমাকে আপনার ভালোবাসার কথা বলবেন, আমি সম্মানিত বোধ করছি।”

বিষয়টা আসলে এমন, আমি জাস্ট আপনার সাথে কথা বলতে চাইছি। আমার এই প্রেমকাহিনিই আপনার শুনতে হবে। মন না চাইলেও শুনতে হবে, কেননা এই গল্পটা ছাড়া অন্য কিছু নিয়ে আমার কথা বলতে ভালো লাগে না। গত তিন সপ্তাহে কারো সাথে কথা বলি নাই। সপ্তাহতিনেক আগে একা ঘরে মাতাল হয়ে কথা বলেছিলাম। এমন হয়, যদি কখনো কথা বলতে মন চায়, নিজের ঘরে মাতাল হই। একা। তখন কত কথা বলি। মাতাল আমি একা ঘরের এ-প্রান্ত থেকে ও-প্রান্তে ছুটে বেড়াই। আবার ঝিম মেরে পড়ে থাকি। কোনো সময় হাসিতে বা কান্নায় ভেঙে পড়ি। প্রচুর কথা বলি।” মাহবুব বলেন, “আমাদের আড্ডায় যখন নির্বাক বসেছিলেন, আপনাকে চরম নিঃসঙ্গ এবং বিষণ্ণতায় ডুবে থাকা একজন মানুষ মনে হচ্ছিল। আপনার  সাথে হয়ত আমার বন্ধুত্ব জমবে, যেহেতু আমরা কাছেপিঠেই থাকি।”

আমি হাসি। মনে মনে বলি, হয়ত আর কোনোদিন আপনার সাথে দেখা হবে না।

শোনেন, এক উন্মাদ-প্রেমে পড়েছিলাম। একেবারে রোলার কোস্টার রাইড। হারুকি মুরাকমির এপ্রিলের এক চমৎকার সকালে একশ’ভাগ মানানসই মেয়েটিকে দেখে গল্পের মতো একশ’ভাগ মানানসই এক পুরুষ। তার কপালের ডান কোনার ভ্রƒর উপরে জন্মদাগ। দুর্দান্ত ভ্রু-কুঁচকানোর ভঙ্গি। কপালের ইলিবিলি রেখা।  ক্রূর চোখ, হাসলে যা দারুণ মোহনীয় দেখায়। হাতের আঙুল, নখ, সব মিলিয়ে প্রথম দর্শনেই সে আমাকে উড়িয়ে নিয়ে যায়।

সজীবের পোশাকে তেমন কোনো বিশেষত্ব নাই। তারপরও ঠিক যে ধরনের পুরুষ আমার শৈশব-কৈশোরের স্বপ্নে হানা দিত, সে যেন ঠিক তেমনই।

আমার বন্ধু ফয়সালের বন্ধু সে। একই বছরে জন্ম আমাদের। আমার জানুয়ারিতে, তার মার্চে। অথচ আমার স্বামী ইরফানকে আমি ভালোবাসি। সুখী সংসার আমাদের। সজীবের সাথে কথা বলার ফাঁকে আমি সিদ্ধান্ত নেই, তার কাছ থেকে দূরে থাকতে হবে। কোনোভাবে তার ফোন নাম্বার আমি নেব না। যে সব আড্ডায় সজীবের সাথে দেখা হতে পারে, আমি এড়িয়ে চলব। আড্ডার মাঝে জরুরি কাজ আছে বলে হঠাৎ উঠে যাই।

তিনদিন পর সজীব আমাকে টেলিফোন করে, ‘আমি ফয়সালের বন্ধু সজীব। সেদিন তো তাড়াহুড়ো করে চলে গেলেন। চলুন ঘণ্টাখানেকের জন্য কোথাও বসি।’ এক ঘণ্টার আড্ডা সেদিন আট ঘণ্টায় শেষ হয়। দুপুর গড়িয়ে বিকাল, ধানম-ির ক্যাফে থেকে রিকশায় ধানম-ির অলিগলি, লেকের পাড়, এভাবেই আমাদের শুরু। টানা পাঁচটা বছর, যখন তখন এভাবেই গোলাপী, ম্যাজেন্টা, ভারমিলিয়ান রেড, কত রঙেঢঙে-যে জীবন এসেছে আমাদের কাছে। কী যে উন্মাদনা! তবে আপনি বিশ্বাস করেন আর নাই করেন, একবিংশ শতাব্দীতেও আমার এই উথালপাথাল প্রেম ছিল প্লেটোনিক।

সজীব সত্যবাদী মানুষ। সে স্ত্রীকে ভালোবাসে। সে বলেছে তার পক্ষে অন্য নারীর সাথে শরীরী সম্পর্ক রেখে স্ত্রীকে মিথ্যা বলা সম্ভব না। তার স্ত্রীকে আমার কথা সে বলেছে। স্বামীর সত্যবাদিতায় আস্থাবান স্ত্রী এ নিয়ে বিশেষ কোনো ঝামেলা করে নাই।

অফিসের পর প্রায় প্রতিদিন অল্প সময়ের জন্য হলেও দেখা হতো। কোনো কোনো সময় কম্পমান আমরা দু’জন দু’জনকে জড়িয়ে ধরে রেখেছি। দু’-চারবার ফুঁপিয়ে কেঁদেছিও। এভাবেই কেটেছে আমাদের অযৌন ঘূর্ণন।

আমার এই অন্তরঙ্গ জীবনের কথা আমার স্বামীকে বলার সাহস কোনোদিন হয় নাই। সচেতনভাবেই আমি আর সজীব বেশিরভাগ সময় দেখা করি বন্ধুদের কমন আড্ডায়। বন্ধুদের নানাকথার ভিড়ে আমাদের দু’জনের চোখের দুঃসহ বিদ্যুৎ কেবল আমরাই টের পাই। চোখে চোখে একে অন্যের মাথায় পরিয়ে দেই নীহারকণার মুকুট।

বাইরের পৃথিবীর সাথে যোগাযোগ, কথা বলা কমিয়ে দেয়া শুরু সেই সময় থেকে।

শুধুমাত্র সজীবের সাথে কথা বলতে মন চায়, আর কারো সাথে না। আমার স্বামীর সাথেও কথা বলতাম, অপরাধবোধউদ্ভূত বাড়তি যতœ ও ভালোবাসাও দিয়েছি, মন না চাইলেও।

নতুন পড়া কবিতার লাইন, ঘাসফড়িঙের রঙ, পাতাবাহারের ঝোপে জোনাকি, রূপচাঁদা মাছ ভুনা করতে টমেটোর সস অপরিহার্য কি না... কত কী যে আমাদের আলোচ্য বিষয়! সজীবের সাথে প্রণয়ের সময়েই আমার মেয়ে অহনার জন্ম। অন্তঃসত্ত্বাকালে আমার স্বামী ইরফান আর আমার হবু বাচ্চার জন্য এত কেনাকাটা। এত উৎসব। এসব গল্প শুনে সজীব অদ্ভুত দৃষ্টিতে আমাকে দেখে। বাবা হয় নাই বলেই হয়ত এই আবেগ তার বোধগম্যতার বাইরে। আমার উচ্ছ্বাস বেশি দেখে বলত, ‘আমি প্রার্থনা করি তোমার সন্তান তোমার মতো মিষ্টি আর মজার হোক।’

আমার মেয়ে অহনার জন্মের পর বিস্ময়বিহ্বল আমি আবিষ্কার করি, তার কপালের ডান পাশে ভ্রƒর উপরে ঠিক সজীবের মতো জন্মদাগ। কিছুদিন পর দেখি আমার মেয়ে ঘন শ্যামলা, ঠিক সজীবের মতো। অথচ আমার আর ইরফানের পরিবারের প্রায় প্রতিটা মানুষ গৌরবর্ণ। সজীব তো কোনোভাবেই তার জৈবিক পিতা না। প্রতিদিন আমার মেয়ের চেহারায়, হাত-পায়ে সজীবের সাথে নতুন নতুন সাযুজ্য আবিষ্কার করি। আমার এই বিস্ময় সজীবকে বললে সে হেসে উড়িয়ে দেয়। অহনার দেড় বছর বয়সে অহনাকে নিয়ে সজীবকে দেখাই।

সজীব বলে, ‘অহনা আমার মতো দেখতে এটা তুমি ভাবতে ভালোবাসো বলেই তোমার এমন মনে হয়।’

সে অহনাকে কোলে নিয়ে কিছু সময় স্থিরদৃষ্টিতে তার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে, তার কপালের জন্মদাগে চুমু খেয়ে বুকে জড়িয়ে রাখে কিছুকাল। তারপর হেসে বলে, ‘তোমার মেয়ে পরির মতো সুন্দর। আমার মতো কুৎসিত হতে যাবে কোন দুঃখে?’ কেমন করে যে, ঘাসফড়িঙের ডানায় উড়ে উড়ে চার পাঁচটা বছর কেটে গেল।”

মারুয়ামা পার্কে বিকালের ঘোলাটে কুয়াশায় মাহবুব বলে, “আপনার জীবন তো ইউনিক। দারুণ ইন্টারেস্টিং।”

আমি বলি, “শেষ করি তো আগে। জানেন, আমার জীবনে প্রথম দুর্যোগ নেমে এল অহনার ছ’বছর বয়সে। চরম আনন্দ-আহ্লাদে সজীবকে দেখাতে অহনাকে নিয়ে যাই আলিয়াঁস ফ্রঁসেজে। মেয়েকে জড়িয়ে ধরল সে। হ্রেষার মতো বিশুদ্ধ উচ্ছ্বাসে আমি বলি, ‘আমার কথা যে সত্যি এতদিনে বুঝলা তো। ভালো করে দেখো আমার মেয়েকে। কী অদ্ভুত সুন্দর সে! আমি যে এতদিন একবিন্দু ভুল বলি নাই প্রমাণ পাইলা তো?’ মূর্তিবৎ নিষ্কম্প এক অচেনা সজীবকে দেখি। ‘বউকে নিয়ে দাওয়াতে যেতে হবে’ বলে সে তড়িঘড়ি উঠে যায়।

পরদিন ফোনে জানায়, ‘অহনাকে দেখার পর থেকে আমার মাথায় বাড়তি চাপ তৈরি হচ্ছে। তোমার কথা এতদিন আমি বিশ্বাস করি নাই। আমার সাথে মেয়েটার এত মিল কেমন করে হলো? বিষয়টা আমাকে চরম মানসিক চাপে রাখছে। মিতা, তুমি কষ্ট পেয়ো না। আমাদের সম্পর্কটা মনে হয় শেষ করা উচিত। বিয়ে-বহির্ভূত কোনো সম্পর্কই চিরস্থায়ী হয় না।’ সজীবের কথার জবাবে কোনো শব্দই আমি উচ্চারণ করি না। ফোন কেটে দেই।

আর কোনোদিন সজীবের সাথে কথা বলি নাই। অহনা ছাড়া দুনিয়ার বাকি সবার সাথেই বাক্যবিনিময় ক্রমে কমে আসতে থাকে। সজীবের সাথে সম্পর্ক শেষ হয়ে যাবার প্রায় এক বছর পর আমার স্বামী সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যায়। তারপর থেকে দাওয়াত, বন্ধুবান্ধব, আড্ডা, কোথাও গেলে নীরব মনোযোগী হাসিমুখ শ্রোতা হিসাবে উপস্থিত থাকি।

অহনাকে বড় করে তোলার আনন্দ, বোগেনভেলিয়া, রজনীগন্ধার সৌন্দর্য, ঘাসফুল, টগর, গোলাপের রঙ ছেনে, টবে পানি ঢেলে প্রাণের সন্ধান করি। সজীব চলে যাওয়ার পর পণ করেছিলাম মৃত্যুর আগে কোনোদিনও আর কারো প্রেমে পড়ব না। পড়িও নাই। অহনার স্কুল, মাস্টার, সকালের নাস্তা, বিকালে নাস্তা, টিফিন, এতসব তদারকিতে দিব্যি সময় কেটে যায়। অহনার দাদার রেখে যাওয়া বাড়িভাড়ায় আমাদের কষ্টে পড়তে হয় নাই কখনো।

অহনা বিশ্ববিদ্যালয়ে গেলে আমার জীবন দুর্বিষহ হয়ে ওঠে। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ফিরে অহনা সারাদিন মোবাইল ফোনে ঘরের দরজা বন্ধ করে কথা বলে। রাত করে বাড়ি ফেরে। আমি হৈচৈ করলে চিৎকার করে, হুমকি দেয় বাড়ি ছেড়ে চলে যাবে। সজীবের মতো উদ্ধত ক্রূর চোখ। সেই একই উদ্ধত ভঙ্গি। সপ্তাহখানেক পর, ব্যাগ গুছিয়ে সে রোকেয়া হলে উঠে যায়। অহনা প্রেমে পড়েছে আমি বুঝি। অহনা ছাড়া আমার তো আর কেউ নাই। আমার পক্ষে অহনার মুখ না দেখে একদিনও বাঁচা দুঃসহ। রোকেয়া হলের ওয়েটিং রুমে ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসে থাকি। আগে সপ্তাহান্তে বাসায় এসে থাকত। এখন তা-ও আসে না। মোবাইলে ফোন করলে দু’-তিনটা বাক্য বিনিময়ের পর ফোন রেখে দেয়।

কথা বলতে হবে বলে বাড়িতে কাজের মানুষ রাখি না। অহনা ছাড়া আর কারো সাথেই কথা বলি না। সামাজিকতা, আনুষ্ঠানিকতায় হাসিমুখে, মাথা নাড়িয়ে সব কথায় সমর্থনের ভঙ্গিতে উপস্থিত থাকি। বিশ্ববিদ্যালয়ে পুরানো এক-দু’জন বন্ধুর সাথে ক্যাফে, রেস্টুরেন্টে বসে কথা যদি বলেছি, তো তখন শুধু সজীবের গল্পই করেছি। আমার বন্ধু ফয়সালকে এ গল্প অন্তত তিরিশবার শুনিয়েছি। একই গল্প। একই ভঙ্গিতে। ধৈর্য ধরে সে শুনেছে। বলেছে, ‘তুই চাকরি কর, অথবা বিদেশে কোনো কোর্সে ভর্তি হয়ে যা।”

এক বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় অহনা বাড়ি ফেরে এক তরুণসহ। আমাকে পরিচয় করিয়ে দেয় তার বয়ফ্রেন্ড বলে। ছেলেটির বাবা-মা, চৌদ্দপুরুষের ঠিকুজি জানার চেষ্টা করি। বলি, ‘সারা সপ্তাহ অহনা ভার্সিটিতে থাকে। উইকএন্ডে বাসায় আসতে দাও না কেন?’ সে বলে, ‘আমাকে কেন, অহনাকে জিজ্ঞাসা করেন।’ অহনা বেডরুমে ঢুকতেই দরজা বাইরে থেকে বন্ধ করে দেই। তরুণটিকে বলি, ‘তুমি চলে যাও। অহনা আজ বাসায় থাকবে।’

অহনার ঘরের দরজা খুলে বলি, ‘তুই আর বাইরে যেতে পারবি না। আর হলে ফেরত যেতে পারবি না। আমি তোর পড়ালেখার খরচ আর দিব না।’ অহনা উন্মাদের মতো চিৎকার করে, ‘তুমি অসুস্থ মহিলা, আমারেও অসুস্থ বানাইতে চাও। কারো সাথে মিশো না, একা-থাকা ভূত, উন্মাদ কোথাকার।’ আমি তার চুল ধরে টেনে মাটিতে ফেলে ইচ্ছামতো চড়, লাথি মারতে থাকি, তার মুখ চেপে ধরি। সে আমার হাত কামড়ে দেয়। ‘অসুস্থ, শয়তান মহিলা’ বলে চিৎকার করে। আমার খুন চাপে। তার মুখে বালিশ ঠেসে ধরি। তারপর তার গলা চেপে ধরে বলি, ‘তোকে খুন করে আমি আত্মহত্যা করব।’ যখন দেখি অহনার চোখ, জিহ্বা বেরিয়ে যাচ্ছে তখন তাকে ছেড়ে দেই। অহনা রুম থেকে বেরিয়ে যায়। আমি সারা সন্ধ্যা ওই ঘরের মেঝেতেই কালো মেহগনির আলমারির মুখোমুখি স্থাণু হয়ে বসে থাকি। রাতে উঠে দেখি ঘরে অহনা নাই। পরদিন ভার্সিটির হলে গিয়ে খোঁজ নিয়ে জানতে পারি সে হলে ফিরে গিয়েছিল। এখন বাইরে। আমি ফোন করলে সে লাইন কেটে দেয়। দু’দিন পর তার এক বান্ধবী জানায়, সে তার প্রেমিককে বিয়ে করে মুগদাপাড়ায় তাদের বাড়িতে উঠেছে। পরদিন রোকেয়া হলে তার রুমমেটদের কাছে খোঁজ নিয়ে জানি, সে সত্যিই বিয়ে করেছে। ক্লাসমেটদের দু’জন বিয়ের সাক্ষী ছিল। অহনাকে এরপর আর কোনোদিন ফোন করি নাই। অহনাও আমাকে ফোন করে নাই। মাসকয়েক পর জাপানে রিসার্চে ভর্তি হই। ছ’মাস ধরে এখানে আছি।”

মাহবুব বলে, “আমার এখনো অবাক লাগছে, আপনি কেন প্রথম পরিচয়েই আমাকে আপনার জীবনের কথা বললেন?”

আমি বলি, “সপ্তাহতিনেক আগে মাতাল হয়ে একা ঘরে কথা বলেছি। তারপর এই প্রথম কথা বললাম। কথা বলতে চাচ্ছিলাম শুধু। সজীবকে বলা কথা, ইরফান আর অহনার স্মৃতি আমাকে ঘিরে শূন্য ঘরে উড়ে বেড়ায়। তাদেরকে বলা আমার আগের জীবনের কথামালার পুনরাবৃত্তি হয় আমার মাতাল দশায়। আমিই অভিনেতা, নির্দেশক, দর্শক।”

নিজামকে বলতে পারতেন। আমি কেন?”

নিজামের সাথে কথা বলতে মন চায় নাই। দু’ঘণ্টা ধরে আপনাকে দেখে মনে হলো আপনার সাথে কথা বলা যায়।”

এই যে আমার কার্ড রাখেন। কখনো কথা বলতে চাইলে ফোন করবেন। আপনার কার্ড আছে?”

না। আমার কোনো ফোন নাই। ল্যান্ডফোন, মোবাইল, কোনোটাই না। মন চাইলে আপনাকে পাবলিক ফোন বুথ থেকে ফোন করব।”

মাহবুব বলে, “চলেন একসাথে ডিনার করি।”

আমি বলি, “না। বাড়ি যাব।”

সন্ধ্যার আধো-আঁধিয়ারে মাহবুবের অপস্রিয়মাণ অবয়ব দেখতে দেখতে তার কার্ডটি পার্কের ঘাসে ছুড়ে ফেলি। তার সাথে কথা বলতে আর ভাল্লাগবে না। পার্কের বেঞ্চিতে শুয়ে পড়ি। বসন্তের বাতাসে ঘুম চলে আসছে। অহনার মুখটা মনে করতে চেষ্টা করি। ঝাপসা। কিছুই মনে পড়ছে না।


কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন