ধারাবাহিক উপন্যাস
হে নেপথ্যচারিণী
(১৪)
সংশয়
ভাসানপরবর্তী নিস্তব্ধতা বড় ভয়ঙ্কর। সেই নিস্তব্ধতার গ্রাস সমস্ত প্রণোন্মাদ কোলাহলকেও যেন ছাপিয়ে যাওয়ার শক্তি রাখে। এই সমসময় বড় ভয়ানক। আধাখোলা টলিগঞ্জের স্টুডিওর গেট। চারিদিক নিঃশব্দ। শুধু খানিকদূরে ছোট্ট পুকুরঘাটে ফ্রেসনেলের স্নিগ্ধ কৃত্রিম আলোয় কয়েকটা ছায়াশরীর দেখা যাচ্ছে। পুকুরঘাটে ভূলুন্ঠিতা এক নারীশরীর। মধুরা চন্দ। নবীন সহ শিল্পপরিচালক। বয়স পঁচিশ ছাব্বিশ। তার তুলিতে টানা মুদিত ভুরু আর আলুলায়িত কেশের আড়ালেই শয়তানের গহ্বরের মতো জেগে রয়েছে এক গভীর ক্ষত। ত্রিনেত্র গহ্বর। সেই ক্ষতচিহ্ন থেকে সরু আল্পনার মতো রক্তের রেখা গালের কোল ঠোঁটের কোণ বেয়ে আক্রান্তর কাঁধ ছুঁয়ে সিঁড়ির ধাপ বেয়ে নেমে গেছে পুকুরের জলে। মৃতার হাত দুটি মুষ্ঠিবদ্ধ। চোখ দুটি অর্ধ্ববিস্ফারিত। যেন মৃত্যুর ঠিক আগের মুহূর্তে জীবনের প্রবল আকাঙ্ক্ষা তাকে স্তব্ধ করেছিল। সে বাঁচতে চেয়েছিল। মৃতদেহ ঘিরে তথাগত অধিকারী আর তার এক সহযোগী নোট নিচ্ছিল। একজন ফোটোগ্রাফার ছবি তুলে নিচ্ছিল নানান অ্যাঙ্গেল থেকে। ঘটনাস্থলে এই কজন ছাড়াও আরো একজন ব্যক্তি ছিল। সোহরাব চক্রবর্তী। প্রতিটি হত্যাস্থলে এভাবে অলৌকিকভাবে কীভাবে পৌছে যাচ্ছে সে! তার এক দৃশ্যকে দীর্ঘক্ষণ ধরে রাখবার স্নায়ুরোগ কি তবে এইবার আততায়ীকে চিনে নিতে সাহায্য করবে? কে জানে! তবে আমাদের আগমণ সোহরাব লক্ষ্য করল না। সে মৃতার হাত ধরে ফুঁপিয়ে ছোট বালকের মতোই কাঁদছে। তথাগত আশুদাকে ভিক্টিমের ডিটেইলস আগেই জানিয়েছিল। আশুদা ফ্রেসনেলের দিকে তাকিয়ে বলল, "এটা তোমরা লাগিয়েছ?" তথাগত অধিকারী মাথা নেড়ে বলল, না। ঘটনাস্থলে এই ফ্রেসনেল আগে থেকেই লাগানো ছিল। আশুদা গভীর মনোযোগ দিয়ে ক্রাইমসিন নিরীক্ষণ করছিল। আমি সোহরাবের পাশে গিয়ে তার কাঁধে হাত রাখলাম। রক্তিম সজল চোখে সে আমার দিকে তাকিয়ে বলল, "মধুরা নয়। আজ রাতে আমার আসার কথা ছিল এখানে। আশুদাকে বলেছিলাম আমাদের প্রোজেক্টের কথা। কাল শ্যুট। মাথা ধরেছিল। ও বলল ও একাই যাবে। বারণ করেছিলাম। শোনেনি। শুনল না।"
-স্টুডিও পাহারা দেবার
মতো কোনও গার্ড নেই কেন?
আশুদার প্রশ্নে তথাগত
ইতস্তত হেসে বলল, "ভাসানের রাত তো। বুঝতেই তো পারছেন। আশপাশে কোথাও নিশ্চয়ই পড়ে
আছে। আমরা খোঁজ চালাচ্ছি। পাবো তো নিশ্চয়ই। কোথায় পালাবে?"
আশুদা চিন্তিত হয়ে বলল,
"মনে খটকা লাগছে তথাগত। এমন হল কী করে?"
ঘটনাস্থল থেকে বেরিয়ে
এলাম আমরা। আমি নরক দর্শন পরবর্তী যুধিষ্ঠিরের মতো টলতে টলতে বেরিয়ে এলাম আশুদার সঙ্গে।
আমার মনের ভিতর ভর করে বসল বিভূতিভূষণ। চারপাশে ঘুরপাক খাচ্ছে নরকঙ্কাল। উদ্দাম নাচের
ভিতরেই তারা একে একে ভেঙে ভেঙে পড়ছে। তবু তাদের নৃত্য অব্যাহত। আকাশের প্রান্ত গুটিয়ে
যাচ্ছে কাগজের মতো আর সেই বন্য শ্বাপদ শৃগালের ভীড়ে এক বিকট নারীমূর্তির মতো রাত চেপে
বসছে আমাদের উপর। একি কোনও তন্ত্রসাধকের কাজ? না কি কোনও সিরিয়াল কিলার? মল্লার হোসেনের
মতো যে লগ্গি তারানার মূর্চ্ছনার সঙ্গে তাল মিলিয়ে মানুষ খুন করতে পারে!
বাকি রাত ঘুম এল না।
আশুদা সারারাত ঘরের ভিতর আলোর গোলকের সামনে বসে কী যেন ভেবে গেল। মধ্যে শুধু একবার
কথা হল। বলল, "সোহরাব বলেছিল মেয়েটির কথা। মধুরা। সামনের বৈশাখে ওদের বিয়ে হবার
কথা ছিল।"
-বুঝলে কিছু?
-আলোর হদিশ পেয়েছি।
কিন্তু বড় ডিফিউজ। ফ্রেসনেলের আলোর মতো। নির্দিষ্ট করে চিনতে পারছি না মুখগুলো। দেখি
সর্বানন্দকে কাল ফোন করব। আরও কিছু তথ্য দরকার।
পরদিন কলেজে বের হবার
সময় আশুদা বলল, "তোর ক্লাস শেষ হবে কখন?"
-পাঁচটা। সোয়া পাঁচটা।
-গুড। আমি তোর কলেজ
ক্যান্টিনে থাকব। ক্লাস শেষ হলে আমাকে নিয়ে বের হবি। কাজ আছে।
কোথায় বের হব? কী হল
সোহরাবের? আশুদা কাকে সন্দেহ করছে ভাবতে ভাবতেই ক্লাস শেষ হলো। গতকাল রাতে যে দৃশ্য
আমরা দেখেছি, তা এক অন্য ভাসান। মন বলছিল, ত্রিনেত্র রহস্যর কিনারা আশুদা দ্রুত করে
ফেলবে। বিকেল পাঁচটা পনেরোর সময় ক্যান্টিনে গিয়ে দেখলাম কোণের টেবিলে আশুদা এক কাপ
চা নিয়ে বসে আছে। আমি আসতেই উঠে পড়ল। আমরা বেরিয়ে পড়লাম বারাসাতের দিকে।
যেতে যেতে আশুদা একটা
তালিকা ধরিয়ে দিল আমার হাতে। তালিকাটি বারাসাত থেকে দত্তপুকুর, এই অঞ্চলের ওষুধের ডিলারের
তালিকা। আমি জিজ্ঞাসু চোখে তাকাতেই আশুদা বলল।
-আমার একজন রিপ্রেসেন্টেটিভ
বন্ধুকে খোঁজ নিতে বলেছিলাম। এই দোকানগুলো সবিতা আগরওয়ালের 'অস্মিতা' ওষুধটির স্টক
রাখে। তথাগতকে বলে রেখেছিলাম। শুভঙ্কর শাসমলের ফোনটা ট্র্যাক করা হচ্ছে। ওখানে এদের
কয়েকজনের নম্বর আছে।
-সবিতা ম্যাডামের 'অস্মিতা'র
ডিস্ট্রিবিউশন তো শুভঙ্করবাবুই করেন। তাই না?
-ঠিক ধরেছিস।
-তুমি কি তাহলে কিছু
সন্দেহ করছ?
-সন্দেহ নয়। খটকা। ব্যবচ্ছেদ
এখন উপরের চামড়া আর সাবকিউটেনিয়াস চর্বি অতিক্রম করেনি। তাই সেই গভীর ব্যবচ্ছেদের কাজটি
সেরে ফেলি চল।
বারাসাত চাঁপাডালির
মোড়ের কাছেই প্রথম ডিলার। কথায় বার্তায় একজন রেশন দোকানের ডিলার আর ঔষধের ডিলারের ভিতর
তেমন পার্থক্য পাওয়া গেল না। লোকটি মাঝবয়সী পোড় খাওয়া। আশুদা নিজেকে খুচরো ওষুধ ব্যবসায়ী
পরিচয় দিয়ে অস্মিতার কথা জানতে চাইতেই লোকটি তৎক্ষণাৎ আমাদের ফোন নম্বর লিখে নিল খাতায়।
তারপর বলল, "আমার কথা হয়েছে কোম্পানির সঙ্গে। এক সপ্তাহের ভিতরেই নতুন লট চলে
আসবে। আপনাদের জানিয়ে দেব।"
আশুদা গাড়ির কাছে ফিরে
আসতে আসতে বলল, "একেই বলে পাক্কা ব্যবসায়ী। একটিও খরিদ্দার হাতছাড়া করবে না।"
আরও কয়েকটি দোকান ঘুরেও
একই ফিডব্যাক পাওয়া গেল। এক সপ্তাহের ভিতর নতুন লট আসছে। দত্তপুকুর অবধি পৌঁছোতে পৌছোতে
রাত হয়ে গেল। ঘরে ফেরার পথে আশুদা বলল, "সব ডিলার বলছে এক সপ্তাহের ভিতর ওষুধ
আসবে। অথচ এটা তো ইয়ার এণ্ডিং নয়। বছরের মাঝামাঝি এতো চালু একটি ওষুধ কোম্পানি সরবরাহ
করতে পারছে না। ঘটনাটা বেশ অবাক করে দেবার মতো নয় বল তো?"
আমি ঘাড় নাড়ি। দত্তপুকুর
থেকে ফেরার পথে আশুদা হঠাৎ বলল।
-কাল কাজের চাপ কেমন
তোর?
--ওই যেমন থাকে। কেমন?
--তাহলে বাড়ি ফিরতে
রাত হলে সমস্যা নেই তো?
আমি ঘাড় নাড়ি। সমস্যা
কোথায়? বরং মন বলে ওঠে, আশুদা নিশ্চিত কোনও অভিযানের ফন্দি আঁটছে। আশুদা আমার অনুমান
সত্যি প্রমাণ করে গাড়ি ঘোরাতে বলল। দত্তপুকুর থেকে যশোর রোড ধরে আমরা বিড়ার দিকে চললাম।
খানিকটা যাবার পর আশুদা সোজ্ রাস্তা ছেড়ে ডানদিকের ইঁট সুড়কির রাস্তায় নেমে আসতে বলল।
-আমরা কোথায় যাচ্ছি
আশুদা?
--আশুদা গম্ভীর হয়ে
বলল। 'অস্মিতা' প্রস্তুতকারী ওষুধ কারখানায়। ঠিকানা দেখে যা বুঝেছি, এখানেই কোথাও ওদের
ল্যাবটা রয়েছে।
কাঁচা রাস্তা দিয়ে খানিকটা
যাবার পর আশুদা গাড়ি এক সাইডে রেখে আলো নিভিয়ে দিতে বলল। এতক্ষণ বুঝতে পারিনি। হেডলাইট
বন্ধ করতেই দেখলাম তিরিশ চল্লিশ হাত দূরে একটা উঁচু পাঁচিল ঘেরা বাড়ি। বাড়ির চারপাশের
দেয়ালে খানিক ব্যবধানে সাদা এলইডি জ্বলছে। সদরের বড় ধাতব দরজা বন্ধ। বুঝলাম আশুদা যে
গন্তব্যস্থলের কথা বলছিল, আমরা সেই গন্তব্যে অবশেষে পৌঁছেচি। গাড়ি বন্ধ করে পা টিপে
টিপে আমরা মেইন গেটের দিকে এগিয়ে গেলাম। গেটের খানিক দূরে একটি কালো বলেরো গাড়ি দাঁড়িয়ে
আছে। গাড়ির নম্বর দেখামাত্রই চমকে উঠলাম! এ নম্বর আমি আগে কোথায় যেন দেখেছি!
পাঁচিলের খানিক আগেই
একটি বড়ো শিশুগাছ। তার আড়ালে দাঁড়িয়ে দেখলাম রাত দশটার সময়েও কারখানায় ব্যস্ততা চুড়ান্ত
পরিমাণে। কর্মীরা গেটের ভেতর ছোট গেট দিয়ে যাতায়াত করছে। হঠাৎ ভিওর থেকে বেরিয়ে এল
চেনা মুখ। আশুদার দিকে বিস্ময়ে তাকালাম। পরিমল শাসমল। এতো রাতে! খানিক পর্যবেক্ষণের
পর আমরা ফিরে চললাম। গাড়িতে বসতেই মনের ভিতর দুইয়ে দুইয়ে চার হলো। ওই গাড়ি আমি সবিতা
ম্যাডামের বাড়ি যাবার দিন ট্রিভোলি কোর্টে নীচে পার্ক থাকতে দেখেছি গাড়িতে বসে ঘরে ফিরতে ফিরতে আশুদা বলল,"কারখানায়
তো বেশ ভালোই তোড়জোড় চলছে দেখছি। শুভঙ্কর লোকটি এতো কর্মঠ বাইরে থেকে বোঝা যায় না।"
-হয়তো সামনের সপ্তাহে
সকলকে 'অস্মিতা' সাপ্লাই দেবেন বলে কথা দিয়েছেন। তাই।
-হতে পারে। তবে একটা
কথা নির্দ্বিধায় বলতে পারি, জানিস অর্ক।
-কী আশুদা?
-মানুষের এখন খুব ঘুমের
প্রয়োজন। তথাগত জানালো। স্টুডিওপাড়ার দায়িত্বে থাকা গার্ডটা ধরা পড়েছে। পুলিশের জেরার
মুখে স্বীকার করেছে ও ঘুমিয়ে পড়েছিল। মদ বা মাদক টাদক কিছু নয়। লোকটি রোজ রাতে ঘুমির
ওষুধ খেয়ে ডিউটি করে। ওষুধ খেলেও ঘুম আসে না। বরং মন অপেক্ষাকৃত শান্ত থাকে। তাই নাইটডিউটিতে
সমস্যা হয় না। কিন্তু ওইদিন নতুন একটা ওষুধ একটু বেশি মাত্রায় নিয়ে ফেলায় ঘুম ভাঙেনি।
এসব দেখে যা বুঝলাম অর্ক, আধুনিক সভ্যতায় আমাদের ঘুমটি উড়েছে। তা না হলে 'অস্মিতা'র
এতো চাহিদা হতো বল?
আমি মাথা নাড়ি। আশুদার
কথায় সম্মত না হয়ে উপায় নেই।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন