ধারাবাহিক উপন্যাস
(পঞ্চম পর্ব)
মানুষের জীবনে রোদ মেঘ বৃষ্টির খেলা অবিরত চলতেই থাকে। এই যেমন এখন সন্ধ্যা গড়িয়েছে। শহর জুড়ে এতো আলোর রোশনাই! তবুও আকাশে মেঘের ঘনান্ধকার। এই আঁধারের থেকে শহরের শরীরে জ্বলে ওঠা বিদ্যুতের আলোর জোর কি বেশি? এ প্রশ্ন আমার নিজের কাছে নিজেরই।
মিছিল বেরিয়েছে। বিষয়, ফুটপাতের হকার্সদের পুনর্বাসনের দাবী। বহুদূর থেকে মিছিলের শ্লোগানের ধ্বনি শোনা যাচ্ছে। জাস্টিস শব্দটা জনপ্রিয়ধারা। বিবর্তনের শুরুর থেকেই মানুষ যেমন নিজের প্রয়োজনে জাস্টিস চেয়েছে, তেমন দিয়েছেও। কালো মেঘ আর সমাজবহির্ভূত অন্যায়, দুই-ই সমার্থক আমার কাছে। মেঘের ঘনঘটার একটা পূর্বকাল ও একটা পরকাল থাকে। ধীরে ধীরে পরিবেশ গরম হতে হতে একসময় আবহাওয়াবিদেরা জানায় - বঙ্গোপসাগরে গভীর নিম্নচাপের প্রভাবে প্রবল বর্ষণে ভাসবে বাংলা। এরপর আবারও স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে যায় প্রকৃতি।
বৃষ্টিসিক্ত গাছেদের কচি সবুজ পাতায়
চিকচিকে ভাবের মধ্যে বিরাজ করে অপরূপ স্নিগ্ধতা। এই যে নিম্নচাপ ও পরবর্তীতে সবকিছু
আগের মতো হয়ে যাওয়া, এটা কি তুল্যমূল্য নয়?
অনেক প্রশ্ন আজকাল আমাকে খুব ভাবায়। এই যেমন প্রাণখোলা হাসির বিনিময়ে বাৎসরিক দশ লক্ষ অর্জিত টাকা দিয়ে আমি কী কী করবো! ভেবে নিয়েছি আগেই যে, মাকে নিয়ে একটু তীর্থ করতে যাবো। মা-এর বড় শখ ছিলো অযোধ্যায় রাম জন্মভূমি দেখবেন। আমার ছেলে অভিনব অনেকবার তার ঠাকুমাকে বুঝিয়েছে, ঠাকুমা রামের আঁতুড়ঘর বাল্মিকী রচিত রামায়নের পাতা। অযোধ্যায় কোনোদিনই রামচরিত্র জন্মায়নি। কিন্তু কে শোনে কার কথা! আমিও অভিকে বলেছি, মাকে না ঘাটাতে।
ফুটপাতের ভাঙা দোকানপাটের কিয়দংশে গতকাল একদল যুবকের গীটার বাজিয়ে সমবেত সঙ্গীত শুনছিলো অনেকেই। আমিও ছিলাম অনেকক্ষণ। জোটবদ্ধভাবে সম্মিলিত হতে নাটক ও সংগীতের প্রভাব চিরকালই ছিলো এবং এখনও আছে। আমাদের চিরাচরিত অভ্যাসে যা কিছুই বিঘ্ন ঘটায়, অর্থাৎ দেখা জিনিসকে হঠাৎ করে অদেখা বলে মনে হলে সভ্য সমাজ কালচারালি শকড্ হয়। আর তখনই আকাশে কড়কড় করে মেঘ ডেকে ওঠে।
বিজ্ঞাপন কোম্পানির লোকজন ইশারা করছে আমাকে। মানে এখন আমাকে দারুণ একটা হাসির পোজ দিতে হবে। আমি হাত নেড়ে ইশারায় পাঁচমিনিটের সময় চেয়ে নিয়ে আমার জীবনে ঘটে যাওয়া চমৎকার একটি হাসির দৃশ্যের পাতা উল্টাতে গিয়ে দুহাজার এক সালে আমার বাবা প্রয়াত হবার সময়টাতে চলে গেলাম। বাবা-র গোয়ালভরা গরু ছিলো। ছেলেপুলে খাঁটি দুধে ও ভাতে বড় হবে, এটাই ছিলো বাবার চাওয়া। উনি বেঁচে থাকার সময়ই গরুর সংখ্যা ধীরে ধীরে কমে আসছিলো। কারণ তাঁর শারীরিক শক্তি কমে যাওয়া। আমাদের গোয়ালঘরে ছিলো কেবল একটি গাই আর বাবার বড় প্রিয় একটি এঁড়ে বাছুর। জন্মের সময় এই বাছুরটার সাদা কপালে খয়েরী রং-এর রাজতিলক দেখে বাবার ধারণা ছিলো, এই এঁড়ে সংসারের সৌভাগ্যের প্রতীক। তাই কোনো অবস্থায়ই বাবা তাকে বিক্রি করে দিতে চাননি। আমাদের দুই ভাই-এর বিবাহিত সংসারের মাঝে বাবার মৃত্যুর পরে একদিন গোয়ালঘরের মাঝামাঝিতে গরুর দড়ি দিয়ে পার্টিশন তৈরি হলো। দুধেলা গাই এ-র দিকটা আমার ছোটো ভাই-এর। আর বলদের দিকটা আমি নামক আরও একটি বলদের।
আমি বাঁ হাত দিয়ে ইশারায় ক্যামেরাম্যানকে রেডি বলেই আকাশবাতাসজোড়া কোমল কঠিন আওয়াজ তুলে হাহাকার করা হাসির ঝড় তুললাম। চারিদিকে ক্যামেরার আলোর ঝলকানি, যেন বিদ্যুৎ-এর চমক!
(ক্রমশঃ)
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন